অনলাইন ডেস্ক
মাসিক বা পিরিয়ড নারীজীবনের খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। তবে আমাদের দেশে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেকে অস্বস্তিতে পড়েন। মাসিকের ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে মাতৃত্ব ঝুঁকিপূর্ণ হয়। প্রতিবছরের ২৮ মে বিশ্বব্যাপী মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে ২৫ মে আজকের পত্রিকা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘মাসিকবান্ধব বিশ্বের জন্য একতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। আয়োজনে সহযোগী ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি) এবং ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশন (আইপিপিএফ)। লিখেছেন আজকের পত্রিকার প্রতিবেদক অর্চি হক।
মানুষকে বোঝাতে হবে, এটা নিষিদ্ধ বিষয় নয়
এই ইস্যুকে আমরা অনেক শব্দের মাধ্যমে চিহ্নিত করি। মাসিক হলো সবচেয়ে প্রচলিত শব্দ। প্রতি মাসে এটা আসে, তাই এটাকে মাসিক বলা হয়। অনেক ছেলে মাসিক কী, এটা নিয়ে কৌতুক করে, হাসাহাসি করে। ইংরেজিতে পিরিয়ড শব্দটি প্রচলিত। ‘মেন্সট্রুয়েশন’—এই লম্বা শব্দটি না বলে অনেকে মিনস বলে। শব্দচয়ন বা শব্দের ব্যবহার—এগুলোও অনেক কিছু নির্দেশ করে।
এই সভার মূল উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, পুরুষ অথবা ছেলেদেরও মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কাজে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এটা নিয়ে ভাবা উচিত। তবে মাসিক বিষয়টা কি স্বাস্থ্যের নাকি জনস্বাস্থ্যের, এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
মাসিক নিয়ে আমরা যে কণ্ঠস্বর তৈরি করেছি, এটা ছড়িয়ে দিতে চাই। এটাই আমাদের এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য। পরিবারের প্রত্যেক মানুষকে বোঝাতে হবে যে এটা নিষিদ্ধ কোনো বিষয় নয়। শিক্ষকদের বলতে হবে। শিক্ষার্থীদের সামনেই আলোচনা করতে হবে।
যখন দুর্যোগ হয়, বন্যা হয়, তখন আমরা চিন্তা করি, চাল, ডাল, পানি, লবণ সাহায্যের জন্য নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কেউ চিন্তা করে না, ওখানে স্যানিটারি প্যাড নিতে হবে। কেউ চিন্তা করি না যে ওখানে একজন গর্ভবতী মা থাকতে পারেন, একজন কিশোরী বা তরুণী থাকতে পারে। তার নিরাপত্তা দিতে হবে। তার জন্য মাসিক ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই চিন্তাগুলো সবাইকে করতে হবে। অন্যথায় মাসিকবান্ধব বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
মেয়েদের স্কুলে অনুপস্থিতির বড় কারণ অপরিষ্কার টয়লেট
কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য নিয়ে স্কুল পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, স্কুলগুলো আমাদের শক্তির জায়গা। সেখানে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা রয়েছে। মেয়েরা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কিছু জানে না, এমন নয়। গবেষণার কাজে নীলফামারী ও ভোলার স্কুলে গিয়ে আমরা দেখেছি, স্কুলে মেয়েদের অনুপস্থিত থাকার অনেক কারণ রয়েছে। সবচেয়ে কমন (সাধারণ) কারণ হলো, তারা অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহার করতে চায় না। এই বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। মেয়েরা বলেছে, মাসিকের সময় পেটব্যথা হয়, ওষুধ খেলে ব্যথা কমেও যায়। তাই ব্যথার কারণে তারা স্কুলে অনুপস্থিত থাকে, তা নয়; বরং অপরিষ্কার জায়গাটাকে তারা এড়াতে চায় বলেই স্কুলে যায় না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্যানিটারি প্যাড ডিসপোজাল আরেকটি সমস্যা। মেয়েরা এমনটাও বলেছে, ‘স্কুলে আসতে চাই না, সেটার আরও একটা কারণ, ব্যবহৃত স্যানিটারি প্যাড অথবা কাপড়টা আমি কোথায় ফেলব?’ যেসব স্কুলে পাঁচ শ বা এক হাজার কিশোরী থাকে, সবার একসঙ্গে মাসিক হয় না, এটা ঠিক। কিন্তু প্রতি মাসেই কারও না কারও তো হচ্ছে। ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলো কীভাবে ডিসপোজাল হবে, সেটা কি আমরা ভাবছি? স্কুলের কোন জায়গাটাতে এগুলো ডিসপোজাল হবে? শহরের কথা যদি ধরি, সিটি করপোরেশন থেকে এগুলো কীভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে?
ছেলেদেরও মাসিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করা উচিত। তাদের বোঝানো উচিত, এটা একটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। তার মায়ের এবং বোনেরও এটা হয়। সে যদি এটা না বোঝে, তবে বিয়ের পর তার দাম্পত্যজীবনেও সমস্যা তৈরি হতে পারে।
মাসিকবান্ধব বিশ্ব গড়তে হলে পরিবেশকেন্দ্রিক হতে হবে
টয়লেট ফ্যাসিলিটি, ওয়াশ ফ্যাসিলিটি নিয়ে আমরা কথা বলছি। কিন্তু এরপর আর আমরা কথা বলছি না। সেকেন্ডারি ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে গিয়ে এই প্যাডগুলো, স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলো কীভাবে ডিসপোজ হচ্ছে, এটার মেকানিজম আমাদের দেশে কেমন আছে? এটা গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে মিলে আমাদের ভূমিতে কীভাবে চলে যাচ্ছে, তা নিয়ে নীতিগত জায়গায় আলোচনা আমি কখনোই শুনি না। এই আলোচনা হওয়া জরুরি। মাসিকবান্ধব বিশ্ব যদি আমাদের তৈরি করতে হয়, শুধু মানুষকেন্দ্রিক নয়, পরিবেশকেন্দ্রিকও তৈরি করতে হবে। এটার জন্য সচেতনতা ও গবেষণা জরুরি। আমাদের অনেক ধরনের মিথ (বদ্ধমূল ধারণা) আছে, ভালো লাগা, মন্দ লাগা আছে যে আমার ব্যবহৃত প্যাডটা আসলে কোথায় যাচ্ছে? কার হাতে এটা ম্যানেজ হচ্ছে? অনেক সামাজিক, ধর্মীয় সংস্কার আমাদের মনে কাজ করে। অনেক পরিবার এখন পর্যন্ত প্যাডে কনভার্ট করতে চায় না। এর অন্যতম কারণ হলো, তার প্যাড কোথায় ডিসপোজ হচ্ছে।
বন্যার সময় প্যাড ডিসপোজ করা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। একতলা, দোতলা বাড়িগুলো তখন পানির নিচে থাকে। প্যাড ফেললে সেটা ভেসে বেড়াচ্ছে। সেখান থেকে পানি নিয়ে আবার ফুটিয়ে খাওয়া হচ্ছে। এটা আসলে হাইজিনের (পরিচ্ছন্নতার) বিপরীতে যায়। আমরা শুধু স্যানিটারি প্যাডের কথা বলি। কিন্তু পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়ের কথা বলি না। আবার কাপড় ব্যবহার করতে হলে শুধু পুরোনো কাপড়ই দেওয়া হয়। মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন কাপড়ও তো দেওয়া যেতে পারে। এটা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সরঞ্জামগুলো সুলভে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
মাসিকের ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে মাতৃত্ব ঝুঁকিপূর্ণ হয় ২৮ মে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। নিরাপদ মাতৃত্ব বিষয়টাও মাসিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। মাসিকের ব্যবস্থাপনা যদি সঠিক না হয়, মাতৃত্ব ঝুঁকিপূর্ণ হয়। ২০২১ সালে জাতীয় মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্র করা হয়েছিল। খুব সুন্দর কৌশলপত্র এটা। সরকারিভাবে যে কাজগুলো হচ্ছে, তার পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও কাজ করছে। পিএসটিসি ১৯৭৮ সালে জন্মলগ্ন থেকে যৌন প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নারী স্বাস্থ্যবিষয়ক অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করছি। একটা প্রকল্পের অধীনে আমরা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, তারা যেন সিলেবাসে মাসিকসংক্রান্ত অধ্যায়টি স্বাচ্ছন্দ্যে পড়াতে পারেন। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর অধিকাংশ শিক্ষক ক্লাসরুমে এ বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এর সূত্র ধরে আমরা চেষ্টা করেছি, টিচার্স ট্রেনিং কলেজের কারিকুলামেও মাসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যগুলোকে যুক্ত করার জন্য। কারণ, শিক্ষকেরা যখন প্রশিক্ষণ পায়, তখন এই আলোচনাগুলো আসা উচিত। তাহলে পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সময় তাঁরা সেটা বোঝাতে পারবেন।
আমরা বর্তমানে আরেকটি প্রকল্প পরিচালনা করছি, যেখানে খেলাধুলার মাধ্যমে কীভাবে মেয়েদের ট্যাবুসংক্রান্ত বিষয় দূর করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের প্রকল্পের কাজ চলছে, যেটার মাধ্যমে মানুষকে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। পাশাপাশি নারীরা যেন সুলভে মাসিক ব্যবস্থাপনা উপকরণ পায়, সেটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে ছয় শতাধিক সামাজিক উদ্যোক্তা আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন।
বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ মাসিক অব্যবস্থাপনা
মাসিকের কারণে দাম্পত্যজীবনেও সমস্যা হয়। এই সমস্যা বন্ধ্যাত্বের দিকেও ঠেলে দিচ্ছে। নারীদের বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ হলো মাসিক অব্যবস্থাপনা। এই জিনিসগুলো জানাবার জন্য আমাদের কাজ করা উচিত। কমিউনিকেশন ম্যাটেরিয়ালে এই জিনিসগুলো আমাদের যুক্ত করা উচিত। বেদেসহ বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, তাদের কত অজ্ঞতা আছে, কত বদ্ধমূল ধারণা আছে। এই সভ্য যুগেও মাসিক হলে সেই মেয়েটাকে বা নারীটাকে আলাদা করে দিচ্ছে। খাবার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হচ্ছে না। এক কোণে করে রাখার ফলে তার মানসিক সমস্যা হচ্ছে। সামাজিক অন্তর্ভুক্তির জায়গা থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে। তার মানসিক আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে মাসিক অব্যবস্থাপনা।
আমাদের দেশের অনেক নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ব্যবহারযোগ্য বাথরুম নেই। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে অনেক মেয়েকে মাসিক নিয়ে অনেকটা সময় কাটাতে হয়, সেখানে বাথরুমগুলো কতটা মাসিকবান্ধব? সেই বাথরুমগুলো ছেলেমেয়ে-নির্বিশেষে সবাই ব্যবহার করছে। সেগুলো কতটুকু পরিষ্কার, ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সেখানে নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছি। এসব নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে কমিউনিকেশন ম্যাটেরিয়ালগুলো (যোগাযোগ উপকরণ) প্রান্তিক অঞ্চলের জন্য কেমন হবে, নৃগোষ্ঠীর জন্য কেমন হবে আর শহুরে এলাকার জন্য কেমন হবে, এটা নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে। আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করলে মাসিকবান্ধব বাংলাদেশ গড়তে পারব।
বন্যার সময় বেশি সমস্যায় পড়েন নারীরা
বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি নারী রয়েছেন, যাঁরা ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী। কিশোরী রয়েছেন ১৭ মিলিয়ন। প্রতি মাসেই তাঁরা এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যান। কিন্তু এ নিয়ে কথা বলতে কেউ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। তাই তাঁরা সঠিকভাবে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারেন না। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নারী, পথ বা বস্তির তরুণী এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা বেশি সমস্যার মধ্যে আছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগ্রস্ত এলাকায়, বিশেষ করে বন্যার সময়ে মাসিক নিয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন নারীরা।
এ সময়ে নারী কর্মীদের ডেস্কে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে
আমাদের সিস্টেম চেঞ্জ নিয়ে ভাবতে হবে। প্রতি মাসের এই দিনগুলো নারীদের জন্য কঠিন হয়। আমাদের যে মানবসম্পদ নীতি আছে, জেন্ডার নীতি আছে, সেখানে এই বিষয়ে ভাবা প্রয়োজন। যাঁরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, এই দিনগুলোতে তাঁদের অফিসের ডেস্কে কাজ দেওয়া যায় কি না, দেখতে হবে। আমরা যারা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, মাতৃস্বাস্থ্য অথবা জনস্বাস্থ্য খাতে কাজ করি, তারা বলতে পারি, আজ আমি এটা করতে পারছি না। কারণ, আমি ভালো বোধ করছি না। এই সুযোগ সব নারীর থাকা উচিত। আমি স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। একটা পরীক্ষা, একটা ইনকোর্স অথবা একটা অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করা; ওই দিনটা কঠিন হতে পারে। বিষয়টি সিস্টেমে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ নয়। কিন্তু আমরা যদি একটু মানবিক হয়ে বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেমে নিতে পারি, সেটাও খুব ইতিবাচক হবে বলে মনে করি।
পাইলট আকারে কিছু করা যায় কি না ভাবা দরকার
মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে এবং মাসিকবান্ধব বিশ্ব গড়তে এ ধরনের বৈঠক হওয়া জরুরি। তবে গবেষণা, সেমিনার ইত্যাদির তুলনায় প্রয়োগ কতটুকু হচ্ছে? স্বল্প মেয়াদে পাইলট আকারে কিছু করা যায় কি না, সেটা ভাবা দরকার। খুচরা প্যাড বিক্রি হওয়া প্রয়োজন। আমাদের লজ্জা-দ্বিধার ক্ষেত্রে কতটুকু উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি, সেটা ভাবতে হবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটা ছোট প্রকল্প ছিল, স্কুলে স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করা। স্কুলে শিক্ষার্থীরা নিজেরাও যেন প্যাড তৈরি করতে পারে, সে জন্য যন্ত্রপাতিও দেওয়া হয়েছিল। এই প্রকল্পকে আরও বৃহদাকারে করার জন্য আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম। কিন্তু সেটা কার্যকর হয়নি।
মাসিকের সঙ্গে বাল্যবিবাহ সম্পর্কিত
মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ডিজপোজালের বিষয়টি একটি বড় ইস্যু। বিশেষ করে, বন্যার সময়ে এটা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। স্কুল-কলেজে একদম গ্রামের দিকে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে স্কুলগুলো আছে, সেখানে আরও বেশি সমস্যা। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, নদী বা এ রকম জায়গাতে স্যানিটারি প্যাড ছুড়ে ফেলা হয়। মাসিক বিষয়টাকে সেন্টার অব ডিসকাশনে রাখতে হবে। কারণ, মাসিকের সঙ্গে বাল্যবিবাহ সম্পর্কিত। যখনই মাসিক শুরু হচ্ছে, তখনই বাবা-মা মনে করছেন যে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে। এটার সঙ্গে পুষ্টি জড়িত। কারণ, মাসিকের সময় অনেক জায়গায় অনেক খাবার খেতে দেওয়া হয় না। মাসিক স্বাস্থ্য আলাদা না করে মেইনস্ট্রিম হেলথের সঙ্গে এটাকে যুক্ত করা উচিত।
আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মাসিক সম্পর্কিত
একজন মানুষ পৃথিবীতে সেই নারীর মাধ্যমে আসে, যে মেয়ের বা যেই মায়ের মাসিক হয়েছে। সুতরাং এটা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং এই বিষয়কে আমাদের সম্মান করতেই হবে। আর এই কাজ আমাদের বাড়ি থেকে শুরু করতে হবে। মাসিক একটি স্বাভাবিক বিষয়। এ সম্পর্কে আমাদের লজ্জা, ভয় থাকার কথা নয়। আমার অনুরোধ থাকবে, সবাই স্যানিটারি ন্যাপকিন সঙ্গে রাখবেন। কারও প্রয়োজন হলে দেবেন এবং সবাইকে এই পরামর্শ দেবেন।
মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি। সরকারের অর্থনৈতিক সংকট, প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি নানা সমস্যা রয়েছে। তার মধ্যেও আমরা এক কোটি স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার অনুমোদন পেয়েছি। আমরা এগুলো বিতরণ করব। মেনস্ট্রুয়াল হেলথ ম্যানেজমেন্টকে (এমএইচএম) আমরা এখন মেনস্ট্রুয়াল হেলথ অ্যান্ড হাইজিন ম্যানেজমেন্ট বলি। আশির দশকে ১০ শতাংশ স্যানিটারি ন্যাপকিনও ব্যবহৃত হতো না। এখন আমাদের মেয়েরা ৫০ শতাংশ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করছে। আশা করি, একসময় আমাদের শতভাগ মেয়েই মানসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করবে।
মাসিকের সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে
নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক তার প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। এটাকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। একজন নারীকে তাঁর জীবনে গড়ে ৩ হাজার দিন মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করতে হয়। এটা তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা অবশ্যই স্বাস্থ্যের বিষয়। মাসিকের সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে। তাই একে স্বাস্থ্যের সঙ্গে চিন্তা করতে হবে। নারীস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব বিশাল। প্রত্যেক নারীকে কর্মক্ষম হিসেবে চিন্তা করলে ওই নারীর কর্মক্ষমতার সঙ্গে তাঁর মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার একটা সম্পর্ক আছে। এর সঙ্গে অনেক সামাজিক বিষয়ের যোগাযোগ রয়েছে। জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্সের সঙ্গে এটার সম্পর্ক আছে। আমাদের বড় বড় দুর্যোগের সময় ভাবি না যে মাসিক ব্যবস্থাপনার সরঞ্জামাদি জরুরি সাহায্যের (ইমিডিয়েট সাপোর্ট) একটা অংশ হওয়া উচিত।
সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই
বাংলাদেশ সচেতনতায় অনেক অনেক পিছিয়ে। আমরা চাইলেও অনেক কিছু বলতে পারি না। আমাদের দেশে মাসিক হওয়া মানে, বিয়ের জন্য আমরা প্রস্তুত। বাল্যবিবাহের বিষয়টা এখানে চলে আসে। অর্থাৎ মাসিকের সঙ্গে বাল্যবিবাহের সম্পর্ক রয়েছে। আবার মাসিকের সঙ্গে স্বাস্থ্যগত বিষয়ও জড়িত। আমরা যদি সঠিকভাবে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি মানতে না পারি, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দিতে পারে। জরায়ু সংক্রমণ হতে পারে, ছত্রাক সংক্রমণ ঘটতে পারে। কিশোরীরা যেন দ্বিধাহীনভাবে এটা নিয়ে কথা বলতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমার মেয়েকে বলেছি, তোমার মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাডের কথা বললে বাবা কিনে এনে দেবে। আমার মেয়ে তার বাবার কাছে প্যাড চাইতে শিখেছে। এটা একটা উত্তরণ।
অসচ্ছল নারীদের স্যানিটারি প্যাড কিনতে সমস্যা হয়
গ্রামে বা বস্তি এলাকাগুলোতে মেয়েদের জন্য স্যানিটারি প্যাড বেশ কাজের। কারণ, এই জায়গাগুলোতে ২০টি পর্যন্ত পরিবার একটি বাথরুম ব্যবহার করে। এসব জায়গায় কাপড় ব্যবহার করা সমস্যাজনক। কারণ, একটা কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করতে যে সময় প্রয়োজন, বাথরুমে সেই সময়টা পাওয়া যায় না। কেউ এসে তাড়া দেয়। যারা আর্থিকভাবে একটু সচ্ছল, তারা স্যানিটারি প্যাড কিনতে পারে। তারা আর কাপড়ে ফেরত যেতে চায় না। তবে যারা অসচ্ছল, তাদের এটা কিনতে সমস্যা হয়। আমরা প্রকল্পের আওতায় মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করেছি। ওরা এখন বলে, ‘আপা, প্রজেক্ট শেষ হয়ে গেলে আমরা কীভাবে কিনব?’
সহজলভ্য হতে হবে মাসিক ব্যবস্থাপনার পণ্য
মাসিককে এখনো কোনো কোনো জায়গায় শারীরিক অসুস্থতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু এটা আসলে সুস্থ স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। এটা নিয়ে বারবার কথা বলা উচিত। মেয়েরা যেন মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সঠিকভাবে জানতে পারে এবং বলতে পারে, এমন স্বাভাবিক পরিবেশ চাই। এ ছাড়া পিরিয়ডকালে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা এবং মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পণ্যগুলো সহজলভ্য করা দরকার।
স্যানিটারি প্যাডের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত
যাঁরা শহরে থাকেন, তাঁদের জন্য স্যানিটারি প্যাড কেনা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু যাঁরা গ্রামে থাকেন, তাঁদের স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। গ্রামে যে নারীরা থাকেন, তাঁরা মাসের হাতখরচ বাঁচিয়ে প্যাড কিনতে পারছেন কি না, এ বিষয়টা চিন্তা করা উচিত। স্যানিটারি প্যাডের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত।
দোকানে খুচরা প্যাডের ব্যবস্থা করতে হবে
আমি গ্রামে দেখেছি, সেখানে শুধু বাজারেই স্যানিটারি প্যাড রাখা হয়। কিন্তু বাড়ির আশপাশের দোকানগুলোতে প্যাড রাখা হয় না। বাড়ির মেয়েরা খুব একটা বাজারে যান না। ফলে প্যাড কিনতে তাঁরা সমস্যায় পড়েন। আরেকটি সমস্যা হলো, বাসার বাইরে থাকার সময় প্যাড লাগলে পুরো প্যাকেট কিনতে হয়। হয়তো বাসায় পর্যাপ্ত প্যাড আছে বা তখন হাতে ওই পরিমাণ টাকা নেই, তাই ওই সময় পুরো প্যাকেট কেনা কষ্টকর হয়ে পড়ে। দোকানে খুচরা প্যাড বিক্রয়ের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।
সামাজিক মাধ্যমে হতে হবে ইতিবাচক প্রচার
এখনকার তরুণেরা দীর্ঘ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটান। কিন্তু সেখানে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। সামাজিক মাধ্যমে চ্যানেল বা পেজ করে রিলস, ইনফোগ্রাফিকস, কনটেন্ট তুলে ধরে তরুণসমাজকে এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা যেতে পারে। একজন নারী গড়ে ৩ হাজার দিন মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কাটান। বছরের হিসাবে এটা ছয় থেকে আট বছর। তাই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে হবে
মাসিক বিষয়টি এখনো আমাদের সমাজে ট্যাবু। এই ট্যাবু ভাঙার জন্য আমাদের উদার হয়ে সচেতনভাবে নাগরিক দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন। শিশু-কিশোরদের বইপুস্তকে আমরা বিষয়টিকে প্রতিফলিত করতে পারিনি। এটা সহজভাবে পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরতে হবে। ভাষার ব্যবহার, শব্দের ব্যবহার, আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে এই প্রসঙ্গকে সহজভাবে উপস্থাপন করার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আমাদের এগোতে হবে।
যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন
সঞ্চালক
ড. নূর মোহাম্মদ
নির্বাহী পরিচালক, পিএসটিসি
আলোচক
ডা. ফারিহা হাসিন, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক বিএসএমএমইউ)
নন্দিনী লোপা
কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (জিএফএফ), বিশ্বব্যাংক
কানিজ গোফরানী কোরায়শী
প্রজেক্ট ম্যানেজার, পিএসটিসি
ডা. ফারহানা হক
ডিরেক্টর (হেলথ কমিউনিকেশন)
রেডঅরেঞ্জ কমিউনিকেশনস
সাঈদা বানী
প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, ফেমিনিস্ট অপরচুনিটিস নাউ, ক্রিয়া
রেজিনা আরজু
উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ), মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
মাহবুবা হক কুমকুম
জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষক ও পরামর্শক, এমডিএফ বাংলাদেশ
ডা. মো. মনজুর হোসাইন
প্রোগ্রাম ম্যানেজার (এ অ্যান্ড আরএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
অনিতা শরীফ চৌধুরী, টিম লিডার, পিএসটিসি
ডা. মো. মাহবুবুল আলম, হেড অব প্রোগ্রামস, পিএসটিসি
ডা. সুস্মিতা আহমেদ, জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, আইপাস বাংলাদেশ
মাহমুদা নাসরিন, প্রজেক্ট ম্যানেজার, পিএসটিসি
প্রিয়তা মণ্ডল
চেয়ারপারসন, ন্যাশনাল ইয়ুথ নেটওয়ার্ক (নয়ন)
তাহরিমা তাসলিম
সদস্য, ন্যাশনাল ইয়ুথ নেটওয়ার্ক (নয়ন)
সুমাইয়া আক্তার
ইন্টার্ন, পিএসটিসি (শিক্ষার্থী, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
শুভাশীষ কুমার রিমন, ইন্টার্ন, পিএসটিসি (শিক্ষার্থী, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
ড. মো. গোলাম রহমান
সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
মাসিক বা পিরিয়ড নারীজীবনের খুব স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। তবে আমাদের দেশে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেকে অস্বস্তিতে পড়েন। মাসিকের ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে মাতৃত্ব ঝুঁকিপূর্ণ হয়। প্রতিবছরের ২৮ মে বিশ্বব্যাপী মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে ২৫ মে আজকের পত্রিকা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘মাসিকবান্ধব বিশ্বের জন্য একতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। আয়োজনে সহযোগী ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি) এবং ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশন (আইপিপিএফ)। লিখেছেন আজকের পত্রিকার প্রতিবেদক অর্চি হক।
মানুষকে বোঝাতে হবে, এটা নিষিদ্ধ বিষয় নয়
এই ইস্যুকে আমরা অনেক শব্দের মাধ্যমে চিহ্নিত করি। মাসিক হলো সবচেয়ে প্রচলিত শব্দ। প্রতি মাসে এটা আসে, তাই এটাকে মাসিক বলা হয়। অনেক ছেলে মাসিক কী, এটা নিয়ে কৌতুক করে, হাসাহাসি করে। ইংরেজিতে পিরিয়ড শব্দটি প্রচলিত। ‘মেন্সট্রুয়েশন’—এই লম্বা শব্দটি না বলে অনেকে মিনস বলে। শব্দচয়ন বা শব্দের ব্যবহার—এগুলোও অনেক কিছু নির্দেশ করে।
এই সভার মূল উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, পুরুষ অথবা ছেলেদেরও মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কাজে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এটা নিয়ে ভাবা উচিত। তবে মাসিক বিষয়টা কি স্বাস্থ্যের নাকি জনস্বাস্থ্যের, এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
মাসিক নিয়ে আমরা যে কণ্ঠস্বর তৈরি করেছি, এটা ছড়িয়ে দিতে চাই। এটাই আমাদের এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য। পরিবারের প্রত্যেক মানুষকে বোঝাতে হবে যে এটা নিষিদ্ধ কোনো বিষয় নয়। শিক্ষকদের বলতে হবে। শিক্ষার্থীদের সামনেই আলোচনা করতে হবে।
যখন দুর্যোগ হয়, বন্যা হয়, তখন আমরা চিন্তা করি, চাল, ডাল, পানি, লবণ সাহায্যের জন্য নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কেউ চিন্তা করে না, ওখানে স্যানিটারি প্যাড নিতে হবে। কেউ চিন্তা করি না যে ওখানে একজন গর্ভবতী মা থাকতে পারেন, একজন কিশোরী বা তরুণী থাকতে পারে। তার নিরাপত্তা দিতে হবে। তার জন্য মাসিক ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই চিন্তাগুলো সবাইকে করতে হবে। অন্যথায় মাসিকবান্ধব বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
মেয়েদের স্কুলে অনুপস্থিতির বড় কারণ অপরিষ্কার টয়লেট
কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য নিয়ে স্কুল পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, স্কুলগুলো আমাদের শক্তির জায়গা। সেখানে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা রয়েছে। মেয়েরা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কিছু জানে না, এমন নয়। গবেষণার কাজে নীলফামারী ও ভোলার স্কুলে গিয়ে আমরা দেখেছি, স্কুলে মেয়েদের অনুপস্থিত থাকার অনেক কারণ রয়েছে। সবচেয়ে কমন (সাধারণ) কারণ হলো, তারা অপরিষ্কার টয়লেট ব্যবহার করতে চায় না। এই বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। মেয়েরা বলেছে, মাসিকের সময় পেটব্যথা হয়, ওষুধ খেলে ব্যথা কমেও যায়। তাই ব্যথার কারণে তারা স্কুলে অনুপস্থিত থাকে, তা নয়; বরং অপরিষ্কার জায়গাটাকে তারা এড়াতে চায় বলেই স্কুলে যায় না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্যানিটারি প্যাড ডিসপোজাল আরেকটি সমস্যা। মেয়েরা এমনটাও বলেছে, ‘স্কুলে আসতে চাই না, সেটার আরও একটা কারণ, ব্যবহৃত স্যানিটারি প্যাড অথবা কাপড়টা আমি কোথায় ফেলব?’ যেসব স্কুলে পাঁচ শ বা এক হাজার কিশোরী থাকে, সবার একসঙ্গে মাসিক হয় না, এটা ঠিক। কিন্তু প্রতি মাসেই কারও না কারও তো হচ্ছে। ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলো কীভাবে ডিসপোজাল হবে, সেটা কি আমরা ভাবছি? স্কুলের কোন জায়গাটাতে এগুলো ডিসপোজাল হবে? শহরের কথা যদি ধরি, সিটি করপোরেশন থেকে এগুলো কীভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে?
ছেলেদেরও মাসিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করা উচিত। তাদের বোঝানো উচিত, এটা একটা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। তার মায়ের এবং বোনেরও এটা হয়। সে যদি এটা না বোঝে, তবে বিয়ের পর তার দাম্পত্যজীবনেও সমস্যা তৈরি হতে পারে।
মাসিকবান্ধব বিশ্ব গড়তে হলে পরিবেশকেন্দ্রিক হতে হবে
টয়লেট ফ্যাসিলিটি, ওয়াশ ফ্যাসিলিটি নিয়ে আমরা কথা বলছি। কিন্তু এরপর আর আমরা কথা বলছি না। সেকেন্ডারি ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে গিয়ে এই প্যাডগুলো, স্যানিটারি ন্যাপকিনগুলো কীভাবে ডিসপোজ হচ্ছে, এটার মেকানিজম আমাদের দেশে কেমন আছে? এটা গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে মিলে আমাদের ভূমিতে কীভাবে চলে যাচ্ছে, তা নিয়ে নীতিগত জায়গায় আলোচনা আমি কখনোই শুনি না। এই আলোচনা হওয়া জরুরি। মাসিকবান্ধব বিশ্ব যদি আমাদের তৈরি করতে হয়, শুধু মানুষকেন্দ্রিক নয়, পরিবেশকেন্দ্রিকও তৈরি করতে হবে। এটার জন্য সচেতনতা ও গবেষণা জরুরি। আমাদের অনেক ধরনের মিথ (বদ্ধমূল ধারণা) আছে, ভালো লাগা, মন্দ লাগা আছে যে আমার ব্যবহৃত প্যাডটা আসলে কোথায় যাচ্ছে? কার হাতে এটা ম্যানেজ হচ্ছে? অনেক সামাজিক, ধর্মীয় সংস্কার আমাদের মনে কাজ করে। অনেক পরিবার এখন পর্যন্ত প্যাডে কনভার্ট করতে চায় না। এর অন্যতম কারণ হলো, তার প্যাড কোথায় ডিসপোজ হচ্ছে।
বন্যার সময় প্যাড ডিসপোজ করা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। একতলা, দোতলা বাড়িগুলো তখন পানির নিচে থাকে। প্যাড ফেললে সেটা ভেসে বেড়াচ্ছে। সেখান থেকে পানি নিয়ে আবার ফুটিয়ে খাওয়া হচ্ছে। এটা আসলে হাইজিনের (পরিচ্ছন্নতার) বিপরীতে যায়। আমরা শুধু স্যানিটারি প্যাডের কথা বলি। কিন্তু পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়ের কথা বলি না। আবার কাপড় ব্যবহার করতে হলে শুধু পুরোনো কাপড়ই দেওয়া হয়। মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন কাপড়ও তো দেওয়া যেতে পারে। এটা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সরঞ্জামগুলো সুলভে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
মাসিকের ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে মাতৃত্ব ঝুঁকিপূর্ণ হয় ২৮ মে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। নিরাপদ মাতৃত্ব বিষয়টাও মাসিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। মাসিকের ব্যবস্থাপনা যদি সঠিক না হয়, মাতৃত্ব ঝুঁকিপূর্ণ হয়। ২০২১ সালে জাতীয় মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্র করা হয়েছিল। খুব সুন্দর কৌশলপত্র এটা। সরকারিভাবে যে কাজগুলো হচ্ছে, তার পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও কাজ করছে। পিএসটিসি ১৯৭৮ সালে জন্মলগ্ন থেকে যৌন প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নারী স্বাস্থ্যবিষয়ক অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করছি। একটা প্রকল্পের অধীনে আমরা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, তারা যেন সিলেবাসে মাসিকসংক্রান্ত অধ্যায়টি স্বাচ্ছন্দ্যে পড়াতে পারেন। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর অধিকাংশ শিক্ষক ক্লাসরুমে এ বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এর সূত্র ধরে আমরা চেষ্টা করেছি, টিচার্স ট্রেনিং কলেজের কারিকুলামেও মাসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যগুলোকে যুক্ত করার জন্য। কারণ, শিক্ষকেরা যখন প্রশিক্ষণ পায়, তখন এই আলোচনাগুলো আসা উচিত। তাহলে পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সময় তাঁরা সেটা বোঝাতে পারবেন।
আমরা বর্তমানে আরেকটি প্রকল্প পরিচালনা করছি, যেখানে খেলাধুলার মাধ্যমে কীভাবে মেয়েদের ট্যাবুসংক্রান্ত বিষয় দূর করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের প্রকল্পের কাজ চলছে, যেটার মাধ্যমে মানুষকে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। পাশাপাশি নারীরা যেন সুলভে মাসিক ব্যবস্থাপনা উপকরণ পায়, সেটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে ছয় শতাধিক সামাজিক উদ্যোক্তা আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন।
বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ মাসিক অব্যবস্থাপনা
মাসিকের কারণে দাম্পত্যজীবনেও সমস্যা হয়। এই সমস্যা বন্ধ্যাত্বের দিকেও ঠেলে দিচ্ছে। নারীদের বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ হলো মাসিক অব্যবস্থাপনা। এই জিনিসগুলো জানাবার জন্য আমাদের কাজ করা উচিত। কমিউনিকেশন ম্যাটেরিয়ালে এই জিনিসগুলো আমাদের যুক্ত করা উচিত। বেদেসহ বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, তাদের কত অজ্ঞতা আছে, কত বদ্ধমূল ধারণা আছে। এই সভ্য যুগেও মাসিক হলে সেই মেয়েটাকে বা নারীটাকে আলাদা করে দিচ্ছে। খাবার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হচ্ছে না। এক কোণে করে রাখার ফলে তার মানসিক সমস্যা হচ্ছে। সামাজিক অন্তর্ভুক্তির জায়গা থেকে সে বঞ্চিত হচ্ছে। তার মানসিক আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে মাসিক অব্যবস্থাপনা।
আমাদের দেশের অনেক নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ব্যবহারযোগ্য বাথরুম নেই। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে অনেক মেয়েকে মাসিক নিয়ে অনেকটা সময় কাটাতে হয়, সেখানে বাথরুমগুলো কতটা মাসিকবান্ধব? সেই বাথরুমগুলো ছেলেমেয়ে-নির্বিশেষে সবাই ব্যবহার করছে। সেগুলো কতটুকু পরিষ্কার, ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সেখানে নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছি। এসব নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে কমিউনিকেশন ম্যাটেরিয়ালগুলো (যোগাযোগ উপকরণ) প্রান্তিক অঞ্চলের জন্য কেমন হবে, নৃগোষ্ঠীর জন্য কেমন হবে আর শহুরে এলাকার জন্য কেমন হবে, এটা নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে। আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করলে মাসিকবান্ধব বাংলাদেশ গড়তে পারব।
বন্যার সময় বেশি সমস্যায় পড়েন নারীরা
বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি নারী রয়েছেন, যাঁরা ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী। কিশোরী রয়েছেন ১৭ মিলিয়ন। প্রতি মাসেই তাঁরা এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যান। কিন্তু এ নিয়ে কথা বলতে কেউ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। তাই তাঁরা সঠিকভাবে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারেন না। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নারী, পথ বা বস্তির তরুণী এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা বেশি সমস্যার মধ্যে আছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগ্রস্ত এলাকায়, বিশেষ করে বন্যার সময়ে মাসিক নিয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন নারীরা।
এ সময়ে নারী কর্মীদের ডেস্কে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে
আমাদের সিস্টেম চেঞ্জ নিয়ে ভাবতে হবে। প্রতি মাসের এই দিনগুলো নারীদের জন্য কঠিন হয়। আমাদের যে মানবসম্পদ নীতি আছে, জেন্ডার নীতি আছে, সেখানে এই বিষয়ে ভাবা প্রয়োজন। যাঁরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, এই দিনগুলোতে তাঁদের অফিসের ডেস্কে কাজ দেওয়া যায় কি না, দেখতে হবে। আমরা যারা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, মাতৃস্বাস্থ্য অথবা জনস্বাস্থ্য খাতে কাজ করি, তারা বলতে পারি, আজ আমি এটা করতে পারছি না। কারণ, আমি ভালো বোধ করছি না। এই সুযোগ সব নারীর থাকা উচিত। আমি স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। একটা পরীক্ষা, একটা ইনকোর্স অথবা একটা অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করা; ওই দিনটা কঠিন হতে পারে। বিষয়টি সিস্টেমে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ নয়। কিন্তু আমরা যদি একটু মানবিক হয়ে বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেমে নিতে পারি, সেটাও খুব ইতিবাচক হবে বলে মনে করি।
পাইলট আকারে কিছু করা যায় কি না ভাবা দরকার
মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে এবং মাসিকবান্ধব বিশ্ব গড়তে এ ধরনের বৈঠক হওয়া জরুরি। তবে গবেষণা, সেমিনার ইত্যাদির তুলনায় প্রয়োগ কতটুকু হচ্ছে? স্বল্প মেয়াদে পাইলট আকারে কিছু করা যায় কি না, সেটা ভাবা দরকার। খুচরা প্যাড বিক্রি হওয়া প্রয়োজন। আমাদের লজ্জা-দ্বিধার ক্ষেত্রে কতটুকু উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি, সেটা ভাবতে হবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটা ছোট প্রকল্প ছিল, স্কুলে স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করা। স্কুলে শিক্ষার্থীরা নিজেরাও যেন প্যাড তৈরি করতে পারে, সে জন্য যন্ত্রপাতিও দেওয়া হয়েছিল। এই প্রকল্পকে আরও বৃহদাকারে করার জন্য আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম। কিন্তু সেটা কার্যকর হয়নি।
মাসিকের সঙ্গে বাল্যবিবাহ সম্পর্কিত
মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ডিজপোজালের বিষয়টি একটি বড় ইস্যু। বিশেষ করে, বন্যার সময়ে এটা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। স্কুল-কলেজে একদম গ্রামের দিকে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে স্কুলগুলো আছে, সেখানে আরও বেশি সমস্যা। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, নদী বা এ রকম জায়গাতে স্যানিটারি প্যাড ছুড়ে ফেলা হয়। মাসিক বিষয়টাকে সেন্টার অব ডিসকাশনে রাখতে হবে। কারণ, মাসিকের সঙ্গে বাল্যবিবাহ সম্পর্কিত। যখনই মাসিক শুরু হচ্ছে, তখনই বাবা-মা মনে করছেন যে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গেছে। এটার সঙ্গে পুষ্টি জড়িত। কারণ, মাসিকের সময় অনেক জায়গায় অনেক খাবার খেতে দেওয়া হয় না। মাসিক স্বাস্থ্য আলাদা না করে মেইনস্ট্রিম হেলথের সঙ্গে এটাকে যুক্ত করা উচিত।
আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মাসিক সম্পর্কিত
একজন মানুষ পৃথিবীতে সেই নারীর মাধ্যমে আসে, যে মেয়ের বা যেই মায়ের মাসিক হয়েছে। সুতরাং এটা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং এই বিষয়কে আমাদের সম্মান করতেই হবে। আর এই কাজ আমাদের বাড়ি থেকে শুরু করতে হবে। মাসিক একটি স্বাভাবিক বিষয়। এ সম্পর্কে আমাদের লজ্জা, ভয় থাকার কথা নয়। আমার অনুরোধ থাকবে, সবাই স্যানিটারি ন্যাপকিন সঙ্গে রাখবেন। কারও প্রয়োজন হলে দেবেন এবং সবাইকে এই পরামর্শ দেবেন।
মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি। সরকারের অর্থনৈতিক সংকট, প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি নানা সমস্যা রয়েছে। তার মধ্যেও আমরা এক কোটি স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার অনুমোদন পেয়েছি। আমরা এগুলো বিতরণ করব। মেনস্ট্রুয়াল হেলথ ম্যানেজমেন্টকে (এমএইচএম) আমরা এখন মেনস্ট্রুয়াল হেলথ অ্যান্ড হাইজিন ম্যানেজমেন্ট বলি। আশির দশকে ১০ শতাংশ স্যানিটারি ন্যাপকিনও ব্যবহৃত হতো না। এখন আমাদের মেয়েরা ৫০ শতাংশ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করছে। আশা করি, একসময় আমাদের শতভাগ মেয়েই মানসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করবে।
মাসিকের সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে
নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক তার প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। এটাকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। একজন নারীকে তাঁর জীবনে গড়ে ৩ হাজার দিন মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করতে হয়। এটা তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা অবশ্যই স্বাস্থ্যের বিষয়। মাসিকের সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে। তাই একে স্বাস্থ্যের সঙ্গে চিন্তা করতে হবে। নারীস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব বিশাল। প্রত্যেক নারীকে কর্মক্ষম হিসেবে চিন্তা করলে ওই নারীর কর্মক্ষমতার সঙ্গে তাঁর মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার একটা সম্পর্ক আছে। এর সঙ্গে অনেক সামাজিক বিষয়ের যোগাযোগ রয়েছে। জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্সের সঙ্গে এটার সম্পর্ক আছে। আমাদের বড় বড় দুর্যোগের সময় ভাবি না যে মাসিক ব্যবস্থাপনার সরঞ্জামাদি জরুরি সাহায্যের (ইমিডিয়েট সাপোর্ট) একটা অংশ হওয়া উচিত।
সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই
বাংলাদেশ সচেতনতায় অনেক অনেক পিছিয়ে। আমরা চাইলেও অনেক কিছু বলতে পারি না। আমাদের দেশে মাসিক হওয়া মানে, বিয়ের জন্য আমরা প্রস্তুত। বাল্যবিবাহের বিষয়টা এখানে চলে আসে। অর্থাৎ মাসিকের সঙ্গে বাল্যবিবাহের সম্পর্ক রয়েছে। আবার মাসিকের সঙ্গে স্বাস্থ্যগত বিষয়ও জড়িত। আমরা যদি সঠিকভাবে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি মানতে না পারি, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দিতে পারে। জরায়ু সংক্রমণ হতে পারে, ছত্রাক সংক্রমণ ঘটতে পারে। কিশোরীরা যেন দ্বিধাহীনভাবে এটা নিয়ে কথা বলতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমার মেয়েকে বলেছি, তোমার মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাডের কথা বললে বাবা কিনে এনে দেবে। আমার মেয়ে তার বাবার কাছে প্যাড চাইতে শিখেছে। এটা একটা উত্তরণ।
অসচ্ছল নারীদের স্যানিটারি প্যাড কিনতে সমস্যা হয়
গ্রামে বা বস্তি এলাকাগুলোতে মেয়েদের জন্য স্যানিটারি প্যাড বেশ কাজের। কারণ, এই জায়গাগুলোতে ২০টি পর্যন্ত পরিবার একটি বাথরুম ব্যবহার করে। এসব জায়গায় কাপড় ব্যবহার করা সমস্যাজনক। কারণ, একটা কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করতে যে সময় প্রয়োজন, বাথরুমে সেই সময়টা পাওয়া যায় না। কেউ এসে তাড়া দেয়। যারা আর্থিকভাবে একটু সচ্ছল, তারা স্যানিটারি প্যাড কিনতে পারে। তারা আর কাপড়ে ফেরত যেতে চায় না। তবে যারা অসচ্ছল, তাদের এটা কিনতে সমস্যা হয়। আমরা প্রকল্পের আওতায় মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করেছি। ওরা এখন বলে, ‘আপা, প্রজেক্ট শেষ হয়ে গেলে আমরা কীভাবে কিনব?’
সহজলভ্য হতে হবে মাসিক ব্যবস্থাপনার পণ্য
মাসিককে এখনো কোনো কোনো জায়গায় শারীরিক অসুস্থতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু এটা আসলে সুস্থ স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। এটা নিয়ে বারবার কথা বলা উচিত। মেয়েরা যেন মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সঠিকভাবে জানতে পারে এবং বলতে পারে, এমন স্বাভাবিক পরিবেশ চাই। এ ছাড়া পিরিয়ডকালে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা এবং মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পণ্যগুলো সহজলভ্য করা দরকার।
স্যানিটারি প্যাডের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত
যাঁরা শহরে থাকেন, তাঁদের জন্য স্যানিটারি প্যাড কেনা তুলনামূলক সহজ। কিন্তু যাঁরা গ্রামে থাকেন, তাঁদের স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। গ্রামে যে নারীরা থাকেন, তাঁরা মাসের হাতখরচ বাঁচিয়ে প্যাড কিনতে পারছেন কি না, এ বিষয়টা চিন্তা করা উচিত। স্যানিটারি প্যাডের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত।
দোকানে খুচরা প্যাডের ব্যবস্থা করতে হবে
আমি গ্রামে দেখেছি, সেখানে শুধু বাজারেই স্যানিটারি প্যাড রাখা হয়। কিন্তু বাড়ির আশপাশের দোকানগুলোতে প্যাড রাখা হয় না। বাড়ির মেয়েরা খুব একটা বাজারে যান না। ফলে প্যাড কিনতে তাঁরা সমস্যায় পড়েন। আরেকটি সমস্যা হলো, বাসার বাইরে থাকার সময় প্যাড লাগলে পুরো প্যাকেট কিনতে হয়। হয়তো বাসায় পর্যাপ্ত প্যাড আছে বা তখন হাতে ওই পরিমাণ টাকা নেই, তাই ওই সময় পুরো প্যাকেট কেনা কষ্টকর হয়ে পড়ে। দোকানে খুচরা প্যাড বিক্রয়ের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।
সামাজিক মাধ্যমে হতে হবে ইতিবাচক প্রচার
এখনকার তরুণেরা দীর্ঘ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটান। কিন্তু সেখানে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। সামাজিক মাধ্যমে চ্যানেল বা পেজ করে রিলস, ইনফোগ্রাফিকস, কনটেন্ট তুলে ধরে তরুণসমাজকে এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা যেতে পারে। একজন নারী গড়ে ৩ হাজার দিন মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কাটান। বছরের হিসাবে এটা ছয় থেকে আট বছর। তাই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে হবে
মাসিক বিষয়টি এখনো আমাদের সমাজে ট্যাবু। এই ট্যাবু ভাঙার জন্য আমাদের উদার হয়ে সচেতনভাবে নাগরিক দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন। শিশু-কিশোরদের বইপুস্তকে আমরা বিষয়টিকে প্রতিফলিত করতে পারিনি। এটা সহজভাবে পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরতে হবে। ভাষার ব্যবহার, শব্দের ব্যবহার, আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে এই প্রসঙ্গকে সহজভাবে উপস্থাপন করার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আমাদের এগোতে হবে।
যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন
সঞ্চালক
ড. নূর মোহাম্মদ
নির্বাহী পরিচালক, পিএসটিসি
আলোচক
ডা. ফারিহা হাসিন, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক বিএসএমএমইউ)
নন্দিনী লোপা
কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (জিএফএফ), বিশ্বব্যাংক
কানিজ গোফরানী কোরায়শী
প্রজেক্ট ম্যানেজার, পিএসটিসি
ডা. ফারহানা হক
ডিরেক্টর (হেলথ কমিউনিকেশন)
রেডঅরেঞ্জ কমিউনিকেশনস
সাঈদা বানী
প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর, ফেমিনিস্ট অপরচুনিটিস নাউ, ক্রিয়া
রেজিনা আরজু
উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ), মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর
মাহবুবা হক কুমকুম
জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষক ও পরামর্শক, এমডিএফ বাংলাদেশ
ডা. মো. মনজুর হোসাইন
প্রোগ্রাম ম্যানেজার (এ অ্যান্ড আরএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
অনিতা শরীফ চৌধুরী, টিম লিডার, পিএসটিসি
ডা. মো. মাহবুবুল আলম, হেড অব প্রোগ্রামস, পিএসটিসি
ডা. সুস্মিতা আহমেদ, জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, আইপাস বাংলাদেশ
মাহমুদা নাসরিন, প্রজেক্ট ম্যানেজার, পিএসটিসি
প্রিয়তা মণ্ডল
চেয়ারপারসন, ন্যাশনাল ইয়ুথ নেটওয়ার্ক (নয়ন)
তাহরিমা তাসলিম
সদস্য, ন্যাশনাল ইয়ুথ নেটওয়ার্ক (নয়ন)
সুমাইয়া আক্তার
ইন্টার্ন, পিএসটিসি (শিক্ষার্থী, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
শুভাশীষ কুমার রিমন, ইন্টার্ন, পিএসটিসি (শিক্ষার্থী, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
ড. মো. গোলাম রহমান
সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
সাহিদুল ইসলাম চৌধুরী, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
নারীর মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা নিয়ে জনসমক্ষে আলোচনা ও সচেতনতা জরুরি। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার ভেঙে বিষয়টিকে নারী ও পুরুষ সবার কাছে সহজ ও স্বাভাবিক করে তুলতে সবাইকে কাজ করতে হবে। স্যানিটারি প্যাডের সহজলভ্যতা, তা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা এবং ব্যবহারের পরে পরিবেশসম্মতভাবে ফেলে দেওয়ার দিক
৮ দিন আগেউচ্চশিক্ষার প্রসারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে দেশে ১০৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনশ্রীতে আজকের পত্রিকার
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। এই অগ্রযাত্রায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বড় অবদান রাখছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বাদ দিলে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছেন।
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫