Ajker Patrika

চট্টগ্রাম বিএনপিতে আধিপত্যের দ্বন্দ্বে ঝরছে প্রাণ

  • তিন মাসে ১৬টি সংঘর্ষে জড়ান নেতা-কর্মীরা।
  • যুবদলের কর্মীসহ দুজন নিহত, আহত শিশুসহ অর্ধশতাধিক।
  • দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কার ১৫।
সোহেল মারমা, চট্টগ্রাম
আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১১: ৫১
চট্টগ্রাম বিএনপিতে আধিপত্যের দ্বন্দ্বে ঝরছে প্রাণ

চট্টগ্রাম নগরে আধিপত্য ও বিভিন্ন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে একের পর এক অন্তর্কোন্দলে জড়াচ্ছেন বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত তিন মাসে অন্তত ১৬টি সংঘর্ষের ঘটে। এতে দুজন প্রাণ হারান। আহত হয়েছেন নেতা-কর্মীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। স্থানীয় যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ, খুন, চাঁদাবাজি, দখলদারির এসব অভিযোগ উঠেছে।

বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ানোর কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছেন বিএনপির নেতারা। অভিযুক্ত অন্তত ১৫ জনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও দলের ভাবমূর্তি রক্ষা নিয়ে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহাবুবুর রহমান শামীম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তার পরও দু-একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। তবে এর সঙ্গে যারাই জড়িত, আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা নগরের নিজ নিজ এলাকার আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে নেওয়া শুরু করেন। দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রক হিসেবে থাকা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা গা ঢাকা দিয়েছেন। এই সুযোগে এলাকার ডিশ-কেব্‌ল, ইট-বালু সরবরাহ ব্যবসা এবং সরকারি দপ্তরের দরপত্র, মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। শুধু নগর নয়, জেলার বিভিন্ন উপজেলায়ও তাঁরা অন্তর্কোন্দলে জড়াচ্ছেন।

বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ সেপ্টেম্বর নগরের পুরাতন চান্দগাঁও এলাকায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ইজারা দেওয়া একটি খেলার মাঠ দখল নিয়ে যুবদলের দুটি পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এ সময় ছুরিকাঘাতে জুবায়ের উদ্দীন বাবু (২৫) নামের এক যুবদল কর্মী নিহত হন। ওই দিন রাতেই মহানগর যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। পাশাপাশি সংঘর্ষে জড়িত দুই নেতাকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি।

১১ অক্টোবর রাতে নগরের বায়েজিদে দুটি কলোনির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মোহাম্মদ ইমন (২৮) নামের আরেক যুবক খুন হন। মহানগর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ওরফে বার্মাইয়া সাইফুল, তাঁর ভাই থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সবুজের সঙ্গে কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আলমের অনুসারীদের মধ্যে মূলত এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর ১৩ অক্টোবর অভিযুক্ত এই তিন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

নগরের বাইরেও দখল, আধিপত্য নিয়ে বিরোধের জেরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। গত ১৮ আগস্ট জেলার রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নে জিয়া বাজার এলাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলা আকবর খোন্দকারের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একই উপজেলায় দুটি পক্ষ আরও একাধিকবার সংঘর্ষে জড়ায়। এর মধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর দুটি পক্ষের সংঘর্ষ চলাকালে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করলে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। ২৭ আগস্ট চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বারইয়ারহাট বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত আটজন আহত হয়েছেন।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগারহাটে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। বাজার দখলকে কেন্দ্র করে বারৈয়ারঢালা ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুন্নবী সালাম ও যুবদলের উত্তর জেলা কমিটির সহসভাপতি মোহাম্মদ ইসমাইলের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

২১ সেপ্টেম্বর থেকে সপ্তাহব্যাপী নগরের খুলশী থানাধীন আমবাগান এলাকার আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের দুটি পক্ষ একাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এর মধ্যে ২৬ সেপ্টেম্বরে দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় এলাকায় সাকিব নামের ১৪ বছর বয়সী স্থানীয় এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়।

সাকিবের বাবা কোরবান আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ছেলে আরেকটু হলে মারাই যেত। তার তলপেটে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আল্লাহ আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সে এখন কিছুটা সুস্থ আছে।’

নগরীর খুলশীর সেগুনবাগান এলাকায় ২৬ অক্টোবর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের মারামারিতে ছুরিকাঘাতে দুজন আহত হন। এ সময় প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনাও ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, এলাকায় একটি জুয়া নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা মো. ইদ্রিস আলী বলেন, দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর কেন্দ্র থেকে এ পর্যন্ত ১৫-১৬ জনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার কাজী তারেক মো. আজিজ বলেন, চাঁদাবাজি, মারামারি, হানাহানিসহ যেকোনো ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। কে কোন দলের তা দেখা হচ্ছে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত