Ajker Patrika

আলোর পথে হাঁটতে গিয়ে...

মাসুদ উর রহমান
মাসুদ উর রহমান
মাসুদ উর রহমান

কয়েক দিন আগে দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আধা কিলোমিটার, এক কিলোমিটার পরপর রাস্তার পাশে ওয়াজ মাহফিলের ব্যানার-পোস্টার। কোথাও কোথাও প্যান্ডেলের কাজ চলছে, সমানতালে চলছে ছোট ছোট মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দিয়ে চাঁদা তোলা। বিশেষ করে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলা থেকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম পর্যন্ত একটু বেশিই মনে হলো।

শুধু উত্তরে কেন? পূর্ব-পশ্চিম কিংবা দক্ষিণেও কি কম? সারা দেশে কম করে হলেও লাখখানেক এমন ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন চলছে চলবে। উদ্দেশ্য তো অবশ্যই ভালো, ইসলামি বক্তাদের ওয়াজ নসিহত শুনে মানুষ নিজেদের ভুলত্রুটি শোধরাবে, বাড়াবে নিজেদের ধর্মীয় চর্চা। সেই তাদের আত্মশুদ্ধির প্রভাবে পরিবারে, সমাজে এর প্রভাব পড়বে। হয়তো তাদের এই বদলে যাওয়া অন্য আরও দশজনকে প্রভাবিত করবে। কিন্তু বাস্তবে মানুষ কতটুকু নিজেকে শোধরাতে পারছে কিংবা তার ধর্মীয় জ্ঞানকে কতটুকু সমৃদ্ধ করতে পারছে, সেটি আমি জানি না। যেমন জানি না, তেমন আলামতও তো চারপাশে দেখি না।

যেটুকু দেখি তাতে মন খারাপ হয়। ধর্মীয় লেবাস ধারণ করে ঠকিয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিবিশেষকে, সমাজকে এমনকি দেশকে। মনে হয় বেহেশতে যাওয়ার একটা জোর প্রতিযোগিতা চলছে—বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করে কিংবা রাজনৈতিক আশ্রয়ে আনুকূল্যে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়াদের অনেকে কিংবা অবৈধ উপার্জনে হঠাৎ বড়লোক বনে যাওয়াদের মধ্যে দান-খয়রাতের যে একটা নেশা জাগে, সেটি বোঝা যায় রোজার ঈদের সময় জাকাতের কাপড়ের পাশাপাশি ব্যাগভর্তি সেমাই-চিনি-তেল-ডাল বিতরণের এবং কোরবানি ঈদের সময় বড় বড় পশু কোরবানির ফেসবুকীয় প্রচারে। এই ধনিক শ্রেণির ধর্মের প্রতি আনুগত্যও চোখে পড়ার মতো। মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে, ঈদগাহ-কবরস্থানে দান-খয়রাত করে সমাজে একদিকে একটা ভালো অবস্থান তৈরি করে আমজনতার মারহাবা যেমন কুড়ানো যায়, অপরদিকে ধর্মীয় ব্যাখ্যায় বেহেশতে যাওয়ার পথও সুগম হয়।

অর্থেবিত্তে কিছুটা পিছিয়ে আছে এমন মানুষের একটা অংশ আবার বেহেশতে যাওয়ার সহজ রাস্তা হিসেবে নিজ সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়িয়ে আলেম-ওলামা বানানোর চেষ্টা করেন। গরিবদের সাহায্য করা, আল্লাহর রাস্তায় দান-খয়রাত করা নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমরা তাদের যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা থেকে যারা গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং ভালো কাজের দ্বারা মন্দ কাজকে প্রতিহত করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখিরাতের শুভ পরিণাম।’ সমস্যা হয়ে যায় তখনই, যখন তাঁরা বাস্তবে অধর্মের কাজ করে কিন্তু ধার্মিক সাজেন সমাজের চোখে।

দোষের নয় মাদ্রাসায় পড়াও। অনেক ভালো মানের মাদ্রাসা নিশ্চয়ই আছে, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি অর্থাৎ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার সব অনুষঙ্গ আছে। তা ছাড়া, আলিয়া মাদ্রাসায় পড়া কিংবা জীবনের শুরুতে মাদ্রাসায় পড়ে পরবর্তী সময়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন—এমন সফল ব্যক্তির সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। আবার এমনও আছে যাঁরা মাদ্রাসায় পড়েননি, দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা নিয়ে উচ্চ পদে কিংবা নিম্ন পদে চাকরি করছেন অত্যন্ত সততা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। তাঁদের ব্যক্তিত্ববোধ, আত্মমর্যাদাবোধ দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে। কাজেই ভালো মানুষ হওয়ার অপরিহার্য অনুষঙ্গ মাদ্রাসায় পড়া, এটি বোধ হয় ঠিক নয়।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ভালো মানুষ হওয়ার পথে সামাজিক শিক্ষা, পারিবারিক শিক্ষা একটা বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু গ্রামগঞ্জে কিংবা মফস্বল শহরের অলিতে-গলিতে গড়ে ওঠা হাজার হাজার মাদ্রাসায় যারা পড়ছে, তাদের সবাই কি ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারছে? ‘না’ উত্তর আমি অনেক ধার্মিকের কাছ থেকেই শুনেছি, দেখেছিও। গলি-ঘুপচির অধিকাংশ মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীরা পবিত্র কোরআন শরিফ মুখস্থ করছে অনেকটা বুঝে কিংবা না বুঝে।

না বুঝে কেন বললাম? বললাম এই জন্য যে বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের বাসা থেকে একজন হবু হাফেজ তার কোরআন মুখস্থ করার সর্বশেষ পরীক্ষাটি দিচ্ছিল। সে কী পড়া! কত পড়া! ক্লান্তিহীন পড়ে যাচ্ছে। কোনো সূত্র-তত্ত্ব-তথ্য ছাড়া এইভাবে মুখস্থ করাটা কত পরিশ্রমের সেটা আমি সে সময় বেশ বুঝতে পেরেছি। একসময় তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, এই যে লাইনগুলো তুমি পড়লে, এই লাইনগুলোর অর্থ কী বা এখান থেকে কী শিক্ষাটা তুমি পেলে? আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে?’ উত্তরে সে বলল, ‘এই লাইনগুলোর অর্থ আমি জানি না কিন্তু আমাদের আরও অনেক কিতাব আছে যেখানে দ্বীনের কথা আছে, সেগুলো আমি বলতে পারব।’

হাফেজ হওয়াটা যে অনেক কঠিন একটা কাজ, সেদিন আমি বেশ বুঝতে পারলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমার বাসায় থেকে পরীক্ষা দিয়ে পাগড়ি অর্জন করা ছেলেটি কিন্তু তার সেই অর্জন ধরে রাখতে পারেনি। কর্মজীবনে উপযুক্ত কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে একসময় বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। তার বন্ধুদের যারা দেশে আছে, তাদের সবাইও ভালো নেই। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছে। কারণ, একজন আলেম তাঁর পোশাকি বেশের জন্য সে নিজে যেমন যেকোনো কাজ করতে পারেন না, তেমনি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষও তাঁর শিক্ষাকে, তাঁর লেবাসকে মূল্যায়ন করে যেকোনো কাজে নিয়োগ দিতে চায় না। বলা যায়, মসজিদে ইমামতি করার বাইরে তাঁদের সুযোগ খুব সীমিত।

একজন অভিভাবক চাইলেই তাঁর শিশুসন্তানকে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সে রকম মানসম্মত দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কয়টা আছে? মানসম্মত প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকা সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানকে কারা নজরদারি করছে, সে খবর কি আমাদের দেশ পরিচালকেরা রাখেন? অবশ্য বিষয়টি শুধু মাদ্রাসার না। আমাদের স্কুল-কলেজগুলোর অধিকাংশও এমনই। সুবিধা এইটুকু যে শিক্ষানীতির দুর্বলতায় উচ্চশিক্ষিত হয়েও কেবল লেবাসধারী না হওয়ার সুযোগে যেকোনো পেশা বেছে নিতে পারছে কিংবা কাজের খোঁজে বিদেশে পাড়ি জমাতে পারছে। মাদ্রাসার মতো একেবারে অজপাড়াগাঁয়ের কলেজে অনার্স কোর্স চালু হওয়ার সুবাদে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে লেবার ভিসায় বিদেশে যাচ্ছে, এমন উদাহরণ অনেক আছে।

আওয়ামী লীগের বা তার সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের একটা পারসেপশন আছে বা ছিল যে তারা প্রগতিশীল। তারা ধর্মীয় চেতনা অতটা লালন করে না যতটা অন্যরা করে। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগের সময়ও এ রকম অলি-গলিতে হাজার হাজার মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। কোথায় যেন দেখেছি বা শুনেছি (সত্য কি না বলতে পারব না), প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর চেয়ে মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন বেশি। আবার এমনও আছে যারা সকালে কিন্ডারগার্টেনে, দুপুরে প্রাইমারি স্কুলে এবং বিকেল-সন্ধ্যায় পড়ে মাদ্রাসায়। চিন্তা করা যায়, কতটা চাপ সেইসব কোমল শিশুর ওপর দিয়ে যায়?

এমন একটা ধারণা সমাজে প্রচলিত যে পরিবারের অন্তত একজন যদি দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত অর্থাৎ আলেম হয়, তাহলে পুরো পরিবারের আখেরাতের হিসাব-নিকাশ বেশ সহজ হয়ে যায়! সম্ভবত এই ধারণা থেকে বর্তমান অভিভাবকেরা অন্তত একজন সন্তানকে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন। ধর্মীয় দিক থেকে দেখলে হয়তো মন্দ না, কিন্তু মন্দের জায়গাটা হচ্ছে, এই কোমল শিক্ষার্থীর অনেকে জীবনের শুরুতেই একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হচ্ছে। মসজিদ-মাদ্রাসা এবং ওয়াজ মাহফিলের নামে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে চাঁদা তুলে অনেকটা ভিক্ষাবৃত্তির মানসিকতা তারা অর্জন করছে। ভবিষ্যতে এই শিশুদের আত্মবিশ্বাস বা আত্মঅহংকার বলে কি কিছু থাকবে? বিষয়টি আমাকে শুধু বিচলিতই করছে না, ভীষণ ভাবাচ্ছেও।

বলা যায়, আলোর পথে হাঁটতে গিয়ে অন্ধকারে ঢুকে যাওয়া। কূটাভাসের অর্থ যে এমনই।

লেখক: কলেজশিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নয়াদিল্লিতে নতুন হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহ, ৩ মাস সময় নিল ভারত

খেজুরে অতি মুনাফা, হতাশ ক্রেতা

চাপে পড়ে ৫টি বাস রিকুইজিশন দিয়েছেন পিরোজপুরের ডিসি, সরকারের হস্তক্ষেপ নেই: প্রেস সচিব

কলাবাগানে সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের মরদেহ উদ্ধার

রাতে স্বামীর জন্মদিন উদ্‌যাপন, সকালে নদীতে মিলল নববধূর লাশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত