আব্দুর রহমান
‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিমে আশমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!’
কাজী নজরুল ইসলামের এই লাইন দুটি খুব বেশি পরিচিত না হলেও, অনেকেই হয়তো তাঁর ‘বকরীদ’—শীর্ষক কবিতাটি পড়ে থাকবেন। এখানে নজরুলের আহ্বানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, ঈদের চাঁদ যখন উঠেছে, তখন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকা কী কারণে?
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যখন ঈদের উৎসবের কথা বলি, তখন আমরা কী উদ্যাপন করব আর কী উদ্যাপন করব না তা নিয়ে নানা মত আছে গুণীজন মহলে। বিশেষ করে, আমরা ঈদের উৎসবে বাঙালির মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ বা সাংস্কৃতিক উপাদান হাজির করব কি না বা বাঙালির জীবনে মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান গ্রহণ করব কি না—তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় থাকি। লজ্জা বোধ করি, নিজের ধর্মীয় ও জাতিগত সাংস্কৃতিক উপাদানকে গ্রহণ করা নিয়ে।
ধর্মের দোহাই বনাম সংস্কৃতির উপাদান—এই দুইয়ে আমাদের ঈদের আনন্দ উদ্যাপন বিভক্ত। কিন্তু, ধর্ম আর জাতিগত সংস্কৃতিকে আলাদা করে দেখাটা আমার কাছে সমস্যাজনক মনে হয়। হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে যখন বাংলা ভূখণ্ডে ইসলাম আসে, তখন প্রথম দিকে হয়তো বাঙালি মুসলমানের দ্বৈত আত্মপরিচয় ছিল। কিন্তু তারপর ইসলাম আস্তে আস্তে বাঙালিত্বে আত্তীকৃত হয়ে গেছে এবং এই দুটোর মিশেলে তৈরি হয়েছে বাঙালি মুসলমান। ১২শ–১৩ শ বছর কম সময় নয়। এই সময়ে আত্তীকৃত হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা না।
বাঙালি মুসলমান ইসলাম আসার পর তার পুরোনো পরিচয় ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই। আবার ইসলাম গ্রহণ করে বাঙালিয়ানা ফেলে দিয়েছে—এমনটাও ভাবার সুযোগ নাই। বাঙালি মুসলমান দুইটাকেই নিজের মতো করে একীভূত করেছে এবং বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে একটা একক ও অনন্য আত্মপরিচয়ে পরিণত করেছে, দ্বৈত পরিচয়ে নয়। তাই, এইখানে বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার কোনো দরকার নেই।
যদি বাঙালি মুসলমানকে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার প্রয়োজন না পড়ে, তবে কেন বাঙালি মুসলমানের ঈদ উদ্যাপনে বাংলাদেশের মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ মিলতে পারবে না? আমরা মনে করি, এই প্রশ্নটা জরুরি। কারণ, আমরা জাতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে যে বিভাজনের আলোচনা দেখতে পাই—যেখানে বাঙালি ও বাংলাদেশি মুসলমানকে আলাদা করে ফেলা হয়—সেটি আদতে আমাদের অস্তিত্বকেই সংকটে ফেলে এবং বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে কেবলই সংঘাতের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়।
যাই হোক, ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গেয়ে ফেলা হলো! কিন্তু, অবতরণিকায় এটুকু না বললেও চলছিল না। কারণ, চলতি বছর ঈদুল ফিতরে রাজধানী ঢাকায় ঈদ উদ্যাপনের সঙ্গে ঢাক-ঢোল, বাদ্য, আনন্দ মিছিল যুক্ত করা হয়েছে। অনেক বছর পরই এমনটা করা হয়েছে। ঢাকায় অন্তত গত এক দশকে এমন ঈদ আয়োজন কখনো হয়েছে কি না, তা খুঁজে পেতে বোধ হয় বেশ বেগই পেতে হবে।
ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান। মুঘল আমলে ঢাকার ঈদ ছিল আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠান। বাদশাহদের ঈদ উদ্যাপনের চিত্র ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশাল আকারের হাতি আনা হতো এবং বাদশাহরা হাওদার ওপর রাখা রত্নখচিত শৈল্পিক কেদারায় আসীন হতেন।
হাতিযোগে বাদশাহ এবং পদব্রজে রাজকর্মচারীরা দিল্লির ঈদগাহের দিকে যাত্রা করতেন, যা ছিল এক রাজকীয় শোভাযাত্রা। এই জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য মুঘলদের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল। তবে এই জাঁকজমকপূর্ণ উদ্যাপন মূলত মুঘল বাদশাহ, সুবেদার ও বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সাধারণ মানুষ এতে তেমনভাবে অংশ নিতে পারত না।
কিন্তু ১৬০০ সালের পর সুবা বাংলার সুবাদার, নায়েবে নাজিম এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি আজকের ধানমন্ডি ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে আসতেন। ঢাকায় ঈদের মিছিল ছিল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। মিছিলে সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি এবং হাতে অস্ত্র নিয়ে সৈন্যরা অংশ নিত। এই মিছিল ঢাকার মানুষের জন্য বিশেষ আকর্ষণ ছিল, যা দেখার জন্য তারা রাস্তার দুপাশে ভিড় করত।
আজ অবশ্য দেশে হাতিশালা নেই। রাজরাজড়াদের দরবার, সেপাই–বরকন্দাজ নেই। নেই সেই আমলের ঐতিহ্যও। কিন্তু আমাদের জনমানুষের আনন্দের, উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল মেলা। আনন্দ মিছিল। দীর্ঘদিন পর আমরা যেন ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে আনন্দ মিছিল দেখলাম। মেলাও আয়োজিত হতে দেখলাম। এটি আমাদের অতীত ইতিহাসকে জীবিত রাখার একটা দারুণ প্রচেষ্টা। সময়ের প্রয়োজনে আমাদের মেলা, মিছিল উদ্যাপনের উপকরণে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মূল যে ধারণা সেটিতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। গ্রামাঞ্চলে এখনো সীমিত পরিসরে মেলা দেখা যায়।
তবে ঢাকার ঈদ উৎসবের ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ হলেও কালের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। এবার দীর্ঘদিন পর ঈদ আনন্দ শোভাযাত্রা হয়েছে ঢাকায়। ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি ছিল এই শোভাযাত্রায়। এতে মুঘল আমলের আদলে বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঈদ শোভাযাত্রায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজসহ সর্বস্তরের মানুষ। এটি আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠের সামনে থেকে এই আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রাটি আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়ক দিয়ে খামারবাড়ি মোড় হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে গিয়ে শেষ হয়।
কেবল মিছিল নয়, আগারগাঁওয়ের বাণিজ্যমেলায় স্থাপিত মাঠে ঈদের জামায়াতের আগে ও পরে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! যা আমি বিগত চার বছরের কোনো ঈদে দেখিনি। আগের ঈদগুলোতে মানুষের মধ্যে কেমন চাপা আবেগ, বেদনার উপস্থিতি ছিল। কী যেন নেই, কী যেন নেই। নিরাপত্তা, বিধিনিষেধের বাড়াবাড়িতে আগের ঈদগুলো যেন পরিণত হয়েছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতায়। কিন্তু আজ দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে আয়োজিত ঈদের জামাতে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত থাকার পরও নেই নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে রাখা পুলিশের এপিসিতে উঠে সাধারণ মানুষকে সেলফি তুলতে দেখা গেল। এমনকি উপদেষ্টা আসিফের নিরাপত্তার জন্য আসা সোয়াত টিমের সদস্যরাও হাসিমুখে ছবি তুললেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বিপুল পুলিশ বা সেনা সদস্যের উপস্থিতি দেখা গেল না। বরং লাখো মানুষের ঈদের জামাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হয়তো কয়েক শ পুলিশ ও সেনা সদস্য ছিলেন। এরপরও, পুলিশ সদস্যদের নির্ভার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেল। এ যেন এক নতুন ঈদ। নতুন সূর্যোদয়।
সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে দারুণ উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। হাজারো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদ আনন্দযাত্রায় অংশ নিয়েছেন। নেই কোনো মাইকিং, নেই কোনো নির্দেশনা। তবুও সু-শৃঙ্খলভাবে মিছিল হলো। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শেষও হলো।
মানুষের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়বোধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার পার্থক্যের দেয়াল পাতলা হয়ে যাওয়া—এটাকে এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করি। দুর্নীতি, অপশাসন ও অন্যান্য কারণে যখন আমাদের ‘সোশ্যাল ফ্যাব্রিক’ বা ‘সামাজিক বন্ধন’ ছিঁড়ে গেছে বা এখনো যাচ্ছে, তখন এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কারণ, এগুলো নতুন কোনো আবিষ্কার নয়, বরং আমাদের সমাজের ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ সময়ের’ আচরণের প্রতিচ্ছবি। আমাদের সমাজ বদলাবে—এটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখাটাও জরুরি। কারণ, তাতে শেকড় অক্ষুণ্ন রেখে নতুনত্বে উত্তরণ সহজ ও সমৃদ্ধ হয়, নবযুগ আরও প্রাণবন্ত হয়।
লেখক আজকের পত্রিকার সহ–সম্পাদক
‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিমে আশমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!’
কাজী নজরুল ইসলামের এই লাইন দুটি খুব বেশি পরিচিত না হলেও, অনেকেই হয়তো তাঁর ‘বকরীদ’—শীর্ষক কবিতাটি পড়ে থাকবেন। এখানে নজরুলের আহ্বানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, ঈদের চাঁদ যখন উঠেছে, তখন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকা কী কারণে?
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যখন ঈদের উৎসবের কথা বলি, তখন আমরা কী উদ্যাপন করব আর কী উদ্যাপন করব না তা নিয়ে নানা মত আছে গুণীজন মহলে। বিশেষ করে, আমরা ঈদের উৎসবে বাঙালির মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ বা সাংস্কৃতিক উপাদান হাজির করব কি না বা বাঙালির জীবনে মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান গ্রহণ করব কি না—তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় থাকি। লজ্জা বোধ করি, নিজের ধর্মীয় ও জাতিগত সাংস্কৃতিক উপাদানকে গ্রহণ করা নিয়ে।
ধর্মের দোহাই বনাম সংস্কৃতির উপাদান—এই দুইয়ে আমাদের ঈদের আনন্দ উদ্যাপন বিভক্ত। কিন্তু, ধর্ম আর জাতিগত সংস্কৃতিকে আলাদা করে দেখাটা আমার কাছে সমস্যাজনক মনে হয়। হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে যখন বাংলা ভূখণ্ডে ইসলাম আসে, তখন প্রথম দিকে হয়তো বাঙালি মুসলমানের দ্বৈত আত্মপরিচয় ছিল। কিন্তু তারপর ইসলাম আস্তে আস্তে বাঙালিত্বে আত্তীকৃত হয়ে গেছে এবং এই দুটোর মিশেলে তৈরি হয়েছে বাঙালি মুসলমান। ১২শ–১৩ শ বছর কম সময় নয়। এই সময়ে আত্তীকৃত হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা না।
বাঙালি মুসলমান ইসলাম আসার পর তার পুরোনো পরিচয় ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই। আবার ইসলাম গ্রহণ করে বাঙালিয়ানা ফেলে দিয়েছে—এমনটাও ভাবার সুযোগ নাই। বাঙালি মুসলমান দুইটাকেই নিজের মতো করে একীভূত করেছে এবং বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে একটা একক ও অনন্য আত্মপরিচয়ে পরিণত করেছে, দ্বৈত পরিচয়ে নয়। তাই, এইখানে বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার কোনো দরকার নেই।
যদি বাঙালি মুসলমানকে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার প্রয়োজন না পড়ে, তবে কেন বাঙালি মুসলমানের ঈদ উদ্যাপনে বাংলাদেশের মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ মিলতে পারবে না? আমরা মনে করি, এই প্রশ্নটা জরুরি। কারণ, আমরা জাতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে যে বিভাজনের আলোচনা দেখতে পাই—যেখানে বাঙালি ও বাংলাদেশি মুসলমানকে আলাদা করে ফেলা হয়—সেটি আদতে আমাদের অস্তিত্বকেই সংকটে ফেলে এবং বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে কেবলই সংঘাতের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়।
যাই হোক, ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গেয়ে ফেলা হলো! কিন্তু, অবতরণিকায় এটুকু না বললেও চলছিল না। কারণ, চলতি বছর ঈদুল ফিতরে রাজধানী ঢাকায় ঈদ উদ্যাপনের সঙ্গে ঢাক-ঢোল, বাদ্য, আনন্দ মিছিল যুক্ত করা হয়েছে। অনেক বছর পরই এমনটা করা হয়েছে। ঢাকায় অন্তত গত এক দশকে এমন ঈদ আয়োজন কখনো হয়েছে কি না, তা খুঁজে পেতে বোধ হয় বেশ বেগই পেতে হবে।
ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান। মুঘল আমলে ঢাকার ঈদ ছিল আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠান। বাদশাহদের ঈদ উদ্যাপনের চিত্র ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশাল আকারের হাতি আনা হতো এবং বাদশাহরা হাওদার ওপর রাখা রত্নখচিত শৈল্পিক কেদারায় আসীন হতেন।
হাতিযোগে বাদশাহ এবং পদব্রজে রাজকর্মচারীরা দিল্লির ঈদগাহের দিকে যাত্রা করতেন, যা ছিল এক রাজকীয় শোভাযাত্রা। এই জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য মুঘলদের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল। তবে এই জাঁকজমকপূর্ণ উদ্যাপন মূলত মুঘল বাদশাহ, সুবেদার ও বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সাধারণ মানুষ এতে তেমনভাবে অংশ নিতে পারত না।
কিন্তু ১৬০০ সালের পর সুবা বাংলার সুবাদার, নায়েবে নাজিম এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি আজকের ধানমন্ডি ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে আসতেন। ঢাকায় ঈদের মিছিল ছিল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। মিছিলে সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি এবং হাতে অস্ত্র নিয়ে সৈন্যরা অংশ নিত। এই মিছিল ঢাকার মানুষের জন্য বিশেষ আকর্ষণ ছিল, যা দেখার জন্য তারা রাস্তার দুপাশে ভিড় করত।
আজ অবশ্য দেশে হাতিশালা নেই। রাজরাজড়াদের দরবার, সেপাই–বরকন্দাজ নেই। নেই সেই আমলের ঐতিহ্যও। কিন্তু আমাদের জনমানুষের আনন্দের, উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল মেলা। আনন্দ মিছিল। দীর্ঘদিন পর আমরা যেন ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে আনন্দ মিছিল দেখলাম। মেলাও আয়োজিত হতে দেখলাম। এটি আমাদের অতীত ইতিহাসকে জীবিত রাখার একটা দারুণ প্রচেষ্টা। সময়ের প্রয়োজনে আমাদের মেলা, মিছিল উদ্যাপনের উপকরণে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মূল যে ধারণা সেটিতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। গ্রামাঞ্চলে এখনো সীমিত পরিসরে মেলা দেখা যায়।
তবে ঢাকার ঈদ উৎসবের ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ হলেও কালের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। এবার দীর্ঘদিন পর ঈদ আনন্দ শোভাযাত্রা হয়েছে ঢাকায়। ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি ছিল এই শোভাযাত্রায়। এতে মুঘল আমলের আদলে বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঈদ শোভাযাত্রায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজসহ সর্বস্তরের মানুষ। এটি আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠের সামনে থেকে এই আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রাটি আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়ক দিয়ে খামারবাড়ি মোড় হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে গিয়ে শেষ হয়।
কেবল মিছিল নয়, আগারগাঁওয়ের বাণিজ্যমেলায় স্থাপিত মাঠে ঈদের জামায়াতের আগে ও পরে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! যা আমি বিগত চার বছরের কোনো ঈদে দেখিনি। আগের ঈদগুলোতে মানুষের মধ্যে কেমন চাপা আবেগ, বেদনার উপস্থিতি ছিল। কী যেন নেই, কী যেন নেই। নিরাপত্তা, বিধিনিষেধের বাড়াবাড়িতে আগের ঈদগুলো যেন পরিণত হয়েছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতায়। কিন্তু আজ দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে আয়োজিত ঈদের জামাতে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত থাকার পরও নেই নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে রাখা পুলিশের এপিসিতে উঠে সাধারণ মানুষকে সেলফি তুলতে দেখা গেল। এমনকি উপদেষ্টা আসিফের নিরাপত্তার জন্য আসা সোয়াত টিমের সদস্যরাও হাসিমুখে ছবি তুললেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বিপুল পুলিশ বা সেনা সদস্যের উপস্থিতি দেখা গেল না। বরং লাখো মানুষের ঈদের জামাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হয়তো কয়েক শ পুলিশ ও সেনা সদস্য ছিলেন। এরপরও, পুলিশ সদস্যদের নির্ভার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেল। এ যেন এক নতুন ঈদ। নতুন সূর্যোদয়।
সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে দারুণ উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। হাজারো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদ আনন্দযাত্রায় অংশ নিয়েছেন। নেই কোনো মাইকিং, নেই কোনো নির্দেশনা। তবুও সু-শৃঙ্খলভাবে মিছিল হলো। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শেষও হলো।
মানুষের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়বোধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার পার্থক্যের দেয়াল পাতলা হয়ে যাওয়া—এটাকে এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করি। দুর্নীতি, অপশাসন ও অন্যান্য কারণে যখন আমাদের ‘সোশ্যাল ফ্যাব্রিক’ বা ‘সামাজিক বন্ধন’ ছিঁড়ে গেছে বা এখনো যাচ্ছে, তখন এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কারণ, এগুলো নতুন কোনো আবিষ্কার নয়, বরং আমাদের সমাজের ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ সময়ের’ আচরণের প্রতিচ্ছবি। আমাদের সমাজ বদলাবে—এটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখাটাও জরুরি। কারণ, তাতে শেকড় অক্ষুণ্ন রেখে নতুনত্বে উত্তরণ সহজ ও সমৃদ্ধ হয়, নবযুগ আরও প্রাণবন্ত হয়।
লেখক আজকের পত্রিকার সহ–সম্পাদক
চীনের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেলে তিস্তা নদীর ড্রেজিং, নদী ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। চীনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের কৃষি, জ্বালানি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।
১৭ ঘণ্টা আগেই-মেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের যুগেও পাঠক সংবাদপত্রে চিঠি লেখেন—এটাই প্রমাণ করে, মুদ্রিত শব্দের আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। দ্রুত বদলে যাওয়া যোগাযোগের মাধ্যমের ভিড়েও কিছু কথা থাকে, যা কাগজে ছাপা হয়ে আলো ছড়ায়।
৩ দিন আগেঅপারেশন সার্চলাইটের নৃশংসতায় তখন আকাশে উড়ছে শকুন। রাজপথে চিৎকার করছে কুকুর। আকাশে ‘কা কা’ করে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে কাকেরা বুঝিয়ে দিচ্ছে, সোনার বাংলাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে পাকিস্তানি হানাদারেরা।
৩ দিন আগেসংগীত যাঁর ধ্যান, সাহিত্য যাঁর প্রাণ, আর দেশপ্রেম যাঁর জীবনদর্শন—তিনি সন্জীদা খাতুন। তাঁর নাম উচ্চারণ করলেই একধরনের আলো ছড়িয়ে পড়ে, যেটি জাতিসত্তা, চেতনাবোধ আর মননের প্রসারের আলো। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত সুর, তাঁর জীবনচর্চা, তাঁর মনন ও প্রজ্ঞা—সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক চরিত্র।
৩ দিন আগে