এ কে এম শামসুদ্দিন
৭ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়ালের একটি বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দুমুখো নীতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংকালে ভারতীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, ‘এখন বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সব বিষয়ে নিষ্পত্তি চায় ভারত।’ ভারতের এ বক্তব্য শুনে পুরোনো এক বাংলা প্রবাদের কথা মনে পড়ে গেল। প্রবাদটি হলো ‘ভূতের মুখে রাম নাম’।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ১৩ মার্চ এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘এগুলো একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ধরনের মন্তব্য অযাচিত এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। এ ধরনের মন্তব্য বিভ্রান্তিকর এবং বাস্তবতার ভুল প্রতিফলন।’
‘ভারত বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চায়’—এ কথা শুনে ব্যক্তিগতভাবে আমিও অনেকটাই অবাক হয়েছি। কারণ, ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত অনুরূপ এক ব্রিফিংকালে শেখ হাসিনার পরিকল্পিত ‘ডামি নির্বাচন’-এ বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ না নেওয়ায় ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভারতের মতামত কী জানতে চাওয়া হলে, এই রণধীর জয়সোয়ালই ভারত সরকারের পক্ষে সেদিন বলেছিলেন, ‘নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আমরা এই অবস্থানেই আছি।’
প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও ভোটারবিহীন নির্বাচন হলেও ভারত তখন বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বলেনি। সাংবিধানিক বৈধতার কথা বলে ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, ২০১৮ সালের রাতের ভোট ও ২০২৪ সালে ‘ডামি প্রার্থী’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল ভারত। এই নির্বাচনগুলোর পর ক্ষমতায় যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিই সমর্থন ছিল ভারতের।
২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে যখন সংঘাত, সহিংসতা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ বেড়েছে, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে, তখনো আওয়ামী লীগ সংবিধানের দোহাই দিয়ে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর ছিল। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে চারদিকে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপতৎপরতায় হতাহতের ঘটনায় তখন উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক মিশনের কর্তাব্যক্তিরা। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধীপক্ষের সঙ্গে সংলাপে বসে সরকারকে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ বের করার জন্য আহ্বান জানালেও শেখ হাসিনা তাতে সাড়া দেননি। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের আগ্রহ থাকে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সেই সহিংস পরিস্থিতিতে ভারত কিন্তু সেদিন শেখ হাসিনার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যখন শেখ হাসিনা সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে চলছিল, ভারত তখন শেখ হাসিনার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে সামাল দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। এ উপলক্ষে ২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের ‘টু-প্লাস-টু’ বৈঠকে বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে?—‘সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এভাবেই সেদিন ভারত নিজেদের অবস্থান ‘স্পষ্ট’ করেছিল। বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হতে পারে, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি “যথেষ্ট” চাপও সৃষ্টি করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক হোক। নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতিও ঘোষণা করেছে। তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সক্রিয়ও। যুক্তরাষ্ট্রের ওই সক্রিয়তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে—এমন শঙ্কা আছে ভারতের। বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে এই ব্যাখ্যা ভারত আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে। ১০ নভেম্বরের বৈঠকেও সেটা নতুনভাবে তাদের জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি। বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে সে দেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, ভারত কঠোরভাবে তাই সমর্থন করবে।’
ভারত আসলে বাংলাদেশ নিয়ে মুখে যা বলে কার্যক্ষেত্রে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। নির্বাচনে শেখ হাসিনা যেখানে বাংলাদেশের মানুষের ভোট প্রয়োগের সুযোগই রাখেননি, ভারত সেখানে জেনেশুনেই দিল্লির বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে শেখ হাসিনার প্রহসনের ডামি নির্বাচনে বাধা না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষার বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কারণ নেই, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এই মন্তব্য প্রসঙ্গে ৭ মার্চের ব্রিফিংকালে জানতে চাওয়া হলে জয়সোয়াল সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি খতিয়ান তুলে ধরে বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষার দায়িত্ব সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের। সেই দায়িত্ব তারা পালন করুক।’ ভারত বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে এত যে মাথা ঘামাচ্ছে তার কিয়দংশও যদি নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি নজর দিত, তাহলে হয়তো প্রতিবছর সে দেশে সংখ্যালঘু হত্যার সংখ্যা আরও কম হতে পারত। নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া নিয়ে যেখানে অনেক অভিযোগ, সেখানে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কতটুকু যুক্তিসংগত, সে প্রশ্ন আসতেই পারে।
গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সে দেশে সংখ্যালঘু; বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে সে দেশে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে কিংবা ইলেকট্রিক খুঁটিতে বেঁধে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
ভারতে প্রতিনিয়ত মুসলিমদের টার্গেট করে নির্যাতন চালানো হয়। মুসলিমদের প্রতি শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডই নয়, খুব সূক্ষ্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে মসজিদ ধ্বংসেরও প্রচেষ্টা জারি রয়েছে। অতীতের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কথা বাদ দিলেও সম্প্রতি ক্রিকেটে ভারতের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়লাভ উপলক্ষে আনন্দ-ফুর্তির নামে মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটে মসজিদে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ৯ মার্চ সন্ধ্যায় যখন রমজান উপলক্ষে তারাবির নামাজ চলছিল, তখন প্রায় ৪০টি মোটরবাইকে শতাধিক হিন্দু যুবক মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের মহুতের জামা মসজিদের সামনে এসে বাইকের হর্ন বাজিয়ে, বাজি ফাটিয়ে, শ্রীরাম, ভারত মাতার জয় স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি মুসলিমদের গালিগালাজ করা হয়।
মুসলিমদের গালমন্দ করতে সে দেশের হিন্দুত্ববাদী নেতারাও পিছিয়ে নেই। মুসলিমদের প্রতি তাঁদের অবজ্ঞা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশও ঘটে কারও কারও আচরণে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে আসা যাক। ভারত যে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, তা থেকে সহজেই এই উপসংহারে আসা যায় যে, মুখে যা-ই বলুক বাংলাদেশে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা কিংবা গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করুক—ভারত কোনো দিনই তা চায়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতি সাবালক হোক, তা ভারতের কাম্য নয়। এ উদ্দেশ্যেই ভারত বরাবরই এ দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত ও চারিত্রিকভাবে দুর্বলদের বেছে নিয়েছে।
জেনারেল এরশাদ এবং শেখ হাসিনা এ কারণে ভারতের এত প্রিয় ছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত বাংলাদেশকে নয়, বরং শেখ হাসিনা ও তাঁর দলকে নগ্নভাবেই সমর্থন জুগিয়ে গেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী প্রকাশ্যেই যখন বলেন, ‘শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যা যা দরকার, তা করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছি’ অথবা নির্বাচনের ১২ দিন আগে মেহেরপুর-১ আসনের আওয়ামী লীগের এক স্থানীয় নেতা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নান যখন বলেন, ‘আমি শেখ হাসিনার প্রার্থী, আমি ভারতের প্রার্থী। আমি এখানে হারার জন্য আসিনি (সমকাল, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩)’, তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব কতখানি, তা টের পাওয়া যায়।
গত ৫ আগস্ট গদিচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ও সহস্রাধিক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ভারতের মাটিতে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গণহত্যার মামলার আসামি। ভারত যদি সত্যিকার অর্থেই চায়, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসুক, তাহলে সে দেশে পলাতক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনাসহ সব আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে তার প্রমাণ রাখতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কি তা করবে? উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে ভালো। আর যদি না হয়, তাহলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এত সুন্দর বক্তব্য ও বিবৃতি, বাংলাদেশের মানুষের কাছে বরাবরের মতো অন্তঃসারশূন্যই রয়ে যাবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
৭ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়ালের একটি বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দুমুখো নীতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংকালে ভারতীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, ‘এখন বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সব বিষয়ে নিষ্পত্তি চায় ভারত।’ ভারতের এ বক্তব্য শুনে পুরোনো এক বাংলা প্রবাদের কথা মনে পড়ে গেল। প্রবাদটি হলো ‘ভূতের মুখে রাম নাম’।
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ১৩ মার্চ এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘এগুলো একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ধরনের মন্তব্য অযাচিত এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। এ ধরনের মন্তব্য বিভ্রান্তিকর এবং বাস্তবতার ভুল প্রতিফলন।’
‘ভারত বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চায়’—এ কথা শুনে ব্যক্তিগতভাবে আমিও অনেকটাই অবাক হয়েছি। কারণ, ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত অনুরূপ এক ব্রিফিংকালে শেখ হাসিনার পরিকল্পিত ‘ডামি নির্বাচন’-এ বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ না নেওয়ায় ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভারতের মতামত কী জানতে চাওয়া হলে, এই রণধীর জয়সোয়ালই ভারত সরকারের পক্ষে সেদিন বলেছিলেন, ‘নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আমরা এই অবস্থানেই আছি।’
প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল ও ভোটারবিহীন নির্বাচন হলেও ভারত তখন বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বলেনি। সাংবিধানিক বৈধতার কথা বলে ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, ২০১৮ সালের রাতের ভোট ও ২০২৪ সালে ‘ডামি প্রার্থী’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল ভারত। এই নির্বাচনগুলোর পর ক্ষমতায় যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিই সমর্থন ছিল ভারতের।
২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে যখন সংঘাত, সহিংসতা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ বেড়েছে, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে, তখনো আওয়ামী লীগ সংবিধানের দোহাই দিয়ে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর ছিল। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে চারদিকে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপতৎপরতায় হতাহতের ঘটনায় তখন উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক মিশনের কর্তাব্যক্তিরা। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধীপক্ষের সঙ্গে সংলাপে বসে সরকারকে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ বের করার জন্য আহ্বান জানালেও শেখ হাসিনা তাতে সাড়া দেননি। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের আগ্রহ থাকে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সেই সহিংস পরিস্থিতিতে ভারত কিন্তু সেদিন শেখ হাসিনার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যখন শেখ হাসিনা সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে চলছিল, ভারত তখন শেখ হাসিনার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে সামাল দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। এ উপলক্ষে ২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের ‘টু-প্লাস-টু’ বৈঠকে বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে?—‘সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এভাবেই সেদিন ভারত নিজেদের অবস্থান ‘স্পষ্ট’ করেছিল। বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা এক বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হতে পারে, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি “যথেষ্ট” চাপও সৃষ্টি করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক হোক। নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতিও ঘোষণা করেছে। তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সক্রিয়ও। যুক্তরাষ্ট্রের ওই সক্রিয়তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে—এমন শঙ্কা আছে ভারতের। বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে এই ব্যাখ্যা ভারত আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে। ১০ নভেম্বরের বৈঠকেও সেটা নতুনভাবে তাদের জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি। বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে সে দেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, ভারত কঠোরভাবে তাই সমর্থন করবে।’
ভারত আসলে বাংলাদেশ নিয়ে মুখে যা বলে কার্যক্ষেত্রে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। নির্বাচনে শেখ হাসিনা যেখানে বাংলাদেশের মানুষের ভোট প্রয়োগের সুযোগই রাখেননি, ভারত সেখানে জেনেশুনেই দিল্লির বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে শেখ হাসিনার প্রহসনের ডামি নির্বাচনে বাধা না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষার বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কারণ নেই, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এই মন্তব্য প্রসঙ্গে ৭ মার্চের ব্রিফিংকালে জানতে চাওয়া হলে জয়সোয়াল সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি খতিয়ান তুলে ধরে বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষার দায়িত্ব সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের। সেই দায়িত্ব তারা পালন করুক।’ ভারত বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে এত যে মাথা ঘামাচ্ছে তার কিয়দংশও যদি নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি নজর দিত, তাহলে হয়তো প্রতিবছর সে দেশে সংখ্যালঘু হত্যার সংখ্যা আরও কম হতে পারত। নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া নিয়ে যেখানে অনেক অভিযোগ, সেখানে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কতটুকু যুক্তিসংগত, সে প্রশ্ন আসতেই পারে।
গত তিনটি লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সে দেশে সংখ্যালঘু; বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে সে দেশে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে কিংবা ইলেকট্রিক খুঁটিতে বেঁধে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
ভারতে প্রতিনিয়ত মুসলিমদের টার্গেট করে নির্যাতন চালানো হয়। মুসলিমদের প্রতি শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, নির্যাতন এবং হত্যাকাণ্ডই নয়, খুব সূক্ষ্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে মসজিদ ধ্বংসেরও প্রচেষ্টা জারি রয়েছে। অতীতের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কথা বাদ দিলেও সম্প্রতি ক্রিকেটে ভারতের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়লাভ উপলক্ষে আনন্দ-ফুর্তির নামে মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটে মসজিদে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ৯ মার্চ সন্ধ্যায় যখন রমজান উপলক্ষে তারাবির নামাজ চলছিল, তখন প্রায় ৪০টি মোটরবাইকে শতাধিক হিন্দু যুবক মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের মহুতের জামা মসজিদের সামনে এসে বাইকের হর্ন বাজিয়ে, বাজি ফাটিয়ে, শ্রীরাম, ভারত মাতার জয় স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি মুসলিমদের গালিগালাজ করা হয়।
মুসলিমদের গালমন্দ করতে সে দেশের হিন্দুত্ববাদী নেতারাও পিছিয়ে নেই। মুসলিমদের প্রতি তাঁদের অবজ্ঞা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশও ঘটে কারও কারও আচরণে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে আসা যাক। ভারত যে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, তা থেকে সহজেই এই উপসংহারে আসা যায় যে, মুখে যা-ই বলুক বাংলাদেশে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা কিংবা গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করুক—ভারত কোনো দিনই তা চায়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতি সাবালক হোক, তা ভারতের কাম্য নয়। এ উদ্দেশ্যেই ভারত বরাবরই এ দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত ও চারিত্রিকভাবে দুর্বলদের বেছে নিয়েছে।
জেনারেল এরশাদ এবং শেখ হাসিনা এ কারণে ভারতের এত প্রিয় ছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত বাংলাদেশকে নয়, বরং শেখ হাসিনা ও তাঁর দলকে নগ্নভাবেই সমর্থন জুগিয়ে গেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী প্রকাশ্যেই যখন বলেন, ‘শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যা যা দরকার, তা করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছি’ অথবা নির্বাচনের ১২ দিন আগে মেহেরপুর-১ আসনের আওয়ামী লীগের এক স্থানীয় নেতা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নান যখন বলেন, ‘আমি শেখ হাসিনার প্রার্থী, আমি ভারতের প্রার্থী। আমি এখানে হারার জন্য আসিনি (সমকাল, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩)’, তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব কতখানি, তা টের পাওয়া যায়।
গত ৫ আগস্ট গদিচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ও সহস্রাধিক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ভারতের মাটিতে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গণহত্যার মামলার আসামি। ভারত যদি সত্যিকার অর্থেই চায়, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসুক, তাহলে সে দেশে পলাতক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনাসহ সব আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে তার প্রমাণ রাখতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কি তা করবে? উত্তর যদি হ্যাঁ হয় তাহলে ভালো। আর যদি না হয়, তাহলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এত সুন্দর বক্তব্য ও বিবৃতি, বাংলাদেশের মানুষের কাছে বরাবরের মতো অন্তঃসারশূন্যই রয়ে যাবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশে-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
২ ঘণ্টা আগেজাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতিমধ্যে ৩৭টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঁচটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছে এবং দলগুলোকে মতামত জমা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। মতপার্থক্য দূর করার লক্ষ্যে সংলাপ শুরু হবে এবং বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত তা চলবে।
২ ঘণ্টা আগেরাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালটি যেন দখলবাজদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য! চিকিৎসাসেবার চেয়ে এখানে দখলদারিতেই বেশি গতি। সাততলা বস্তি, দোকানপাট, কাঁচাবাজার, এমনকি মাদক ও জুয়ার আড্ডার জন্য হাসপাতালের চেয়ে ভালো জায়গা আর কী-ইবা হতে পারে...
২ ঘণ্টা আগেআগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সংশয় যেন কাটছেই না। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল বিএনপি বড় ধরনের সংশয়ের মধ্যে আছে। বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে যে আভাস পাওয়া যায়, তাকে অবিশ্বাসও বলা যেতে পারে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ...
১ দিন আগে