মামুনুর রশীদ
সম্প্রতি বিমানবন্দরে অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। মামলার নথিপত্র প্রকাশ হওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। হত্যাচেষ্টাটি হয়েছে ১৯ জুলাই, ২০২৪ আর মামলাটি হয়েছে ২০২৫ সালের ৩ মে। একটি হত্যাচেষ্টা মামলা এত বিলম্বে করা যায় কি না, তা অবশ্য আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়। এর আগে অবশ্য আইন উপদেষ্টা এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছিলেন, এভাবে মামলা করলেই হবে না, তদন্ত সাপেক্ষে মামলা গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্রের এই দুজন বড় কর্তাও জানেন এসব মামলা হয়রানিমূলক।
নুসরাত ফারিয়া বিদেশে যাচ্ছিলেন, বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাঁর বিদেশযাত্রা বন্ধ করে এবং গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান দিয়ে দেয়। হত্যাচেষ্টার ওই সময়ে যে তিনি বিদেশে ছিলেন, এটা পাসপোর্ট এবং ভিসার প্রমাণসহ আদালতে জমা দেন। এবার বাদীপক্ষের উকিল হত্যাচেষ্টার বাইরেও কিছু কথা বলেন। তা হলো, নুসরাত ফারিয়া শেখ হাসিনার কিছু গুণকীর্তন করেছেন এবং একটা পর্যায়ে অভিনেত্রীকে ওই উকিল ‘নর্তকী’ বলে আখ্যা দেন। প্রশ্ন ওঠে, শেখ হাসিনার গুণকীর্তন নাকি হত্যাচেষ্টা—কোনটা মুখ্য? নুসরাত কী কারণে হত্যাচেষ্টা করতে যাবেন? এত সব প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও আইন উপদেষ্টা একজন শিক্ষক হয়েও এই কথাটা এত দিন ধরে খোলা রেখেছেন কেন? এটি শুধু প্রশ্ন নয়, তার চেয়েও বড় কিছু।
এবার আমার প্রসঙ্গে আসি। নুসরাতের সঙ্গে আমার বিষয়টিও আলোচনার অপেক্ষা রাখে। আমিও ৩০ এপ্রিল, ২০২৫ রাতে ঢাকা বিমানবন্দর হয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য উপস্থিত হই। আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কিছুক্ষণ বিলম্ব করেন। আমি অবাক বিস্ময়ে অপেক্ষা করি। কারণ ৫ আগস্টের পর আমি দুইবার মুম্বাই ও একবার নেপালে যাই; মুম্বাই শুটিংয়ের কাজে আর নেপালে একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশ নিতে। কোথাও কোনো হয়রানির শিকার হতে হয়নি। যাহোক, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কিছুক্ষণ পর সসম্মানে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে দেন এবং যথাসময়েই আমি বিমানে আরোহণ করি।
আমি কিছুদিন যাবৎই অসুস্থ। বিশেষ করে, নেপালে গিয়ে ঠান্ডা লাগায় খুবই কাশি হচ্ছিল। চিকিৎসাও করাচ্ছিলাম। ৩০ তারিখের যাত্রায় দোহায় বিমান পরিবর্তন করে ওঠার পর থেকে শরীরটা আরও খারাপ অনুভূত হচ্ছিল। তখনো গন্তব্যে পৌঁছাতে ১৬ ঘণ্টা বাকি। যতই সময় পার হচ্ছিল, ততই শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলাম। খেতেও পারছিলাম না, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছিল। কাতার এয়ারলাইনসের ক্রুরা নানাভাবে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বহু কষ্টে ডালাস বিমানবন্দরে পৌঁছার পর দেখলাম এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ আমার জন্য অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করে রেখেছে। সরাসরি চলে গেলাম হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল আমার ডবল নিউমোনিয়া হয়েছে। সঙ্গে সেপসিস হয়েছে (রক্তের ভেতর সংক্রমণ ঢুকে যায়)। সেই থেকে সাত দিন আমাকে আইসিইউতে রেখে নিবিড় পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হয়।
হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ই সম্ভবত তৃতীয় দিন জানতে পারি, আমার নামেও একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে, একই সময়ের ঘটনা, গত জুলাইয়ের। সম্ভবত আমার মামলাটিও নুসরাত ফারিয়ার মামলার কাছাকাছি সময়ে করা। আমিও নুসরাতের মতো জুলাইতে দেশের বাইরে ছিলাম। পাসপোর্টের অ্যারাইভাল ও ডিপারচার সিল তার সাক্ষ্য দেবে। এই মামলায় আমার সঙ্গে আবার চঞ্চল চৌধুরী ও রিয়াজকে আসামি করা হয়েছে। যদি মামলাটি ৩০ তারিখেই হতো এবং বিমানবন্দরে কাগজ চলে আসত, তাহলে নুসরাতের মতো আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়ে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রেখে দিত। এবং যেখানে আইসিইউ প্রয়োজন সেখানে হাজতনিবাসেই আমার হয়তো বিচারটি হয়ে যেত। যারা আমাদের পথের কাঁটা মনে করে, তাদের জন্য একটা স্বস্তির নিশ্বাস দেখতে পাওয়া যেত। নুসরাতসহ অনেকেরই রাত-দিন হয়তো আমার মতো একই রকম হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিল্পীদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? শিল্পীরা কি জাতির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে নাকি আলোকিত করেছে? ৫৩ বছর যাবৎ একেবারে শূন্য থেকে থিয়েটার আন্দোলনকে কোথায় এনেছি আমরা! দেশ-বিদেশ থেকে কত সম্মান আমরা নিয়ে এসেছি। আমাদের কর্তব্যনিষ্ঠার ফলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ স্থাপিত হয়েছে। সারা দেশে নাট্যমঞ্চ স্থাপিত হয়েছে। এ সবকিছুই আমরা করেছি কোনো অর্থ ছাড়া, বিনা পারিশ্রমিকে। ওই আগস্টের পর সবাই আমরা ভেবেছিলাম একটা সাময়িক সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন।
সেই সমঝোতার সরকার এসেছে, যাদের দায়িত্ব হচ্ছে আজীবন শৃঙ্খলা, মানুষের মাঝে জানমালের নিরাপত্তা এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অর্পণ করা। জনজীবনে শৃঙ্খলা আসেনি, জানমালের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়নি কিন্তু প্রতিদিনই রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে যা দেখা যায় তা হলো—সংস্কার কার্যক্রম। সবচেয়ে হাস্যকর প্রচেষ্টা—ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা। এইভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে টাই পরা কজন ভদ্রলোক যাঁরা বাংলাদেশের ঋতুপরিক্রমা জানেন না, জোয়ার-ভাটার খবর জানেন না, তাঁরা কত লোককে চা-বিস্কুট খাইয়ে একটা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করবেন? গত ৫৪ বছরে নানা ধরনের রাজনৈতিক উত্থান-পতন, বিভক্তি, শিক্ষাব্যবস্থার বিবিধ শাখা-প্রশাখা, ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন, দুর্নীতিসহ হাজারো সমস্যায় আক্রান্ত দেশটায় কয়েক মাসের মধ্যে কয়েকজন জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তি বিষয়টি করে ফেলবেন? কী হাস্যকর চেষ্টা!
প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এখন বড় দাবি এবং একটাই দাবি—নির্বাচন চাই। সেখানে কোন কারণে বিলম্ব? ‘শুভস্য শীঘ্রম অশুভস্য কাল হরনং’। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে একটা অশুভের দিকে যাত্রা করছে এই অনির্বাচিত ও অন্তর্বর্তী সরকার। সবার সব দাবিদাওয়ায় প্রতিদিন রাজপথ, অফিস-আদালত তছনছ হচ্ছে। কেই-বা এই সরকারকে অধিকার দিল দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার? নির্বাচিত সরকার এসব না-ও মানতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ারই-বা কে এই সরকার? এটা নিশ্চিত যে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাই এই সিদ্ধান্ত মানবেন না। যেখানে ব্যাপক উন্নতি হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থান দখল করে আছে মব—মবতন্ত্র। দেশের একজন প্রখ্যাত ভাস্কর রাশাকে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে লাঞ্ছিত করা হয়। দৌড়ে তাঁকে আত্মরক্ষা করতে হয়েছে। জনপ্রিয় অভিনেতা সিদ্দিককে যাঁরা আক্রমণ করল, তাঁদের সবার ছবি আছে। কিন্তু জানি না এখন পর্যন্ত পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না। এর আগে যখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে, তখনই মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। কারণ, এই সময়টা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকে, কয়েকটা মাস শান্তিতে থাকা যায় এবং ভোটটা ঠিকমতো দেওয়া যায়।
এবার নানা ধরনের নিপীড়নমূলক ডালপালা বেরোচ্ছে। অসংখ্য রাজনৈতিক দল গড়ে উঠছে। তাদের টাকাপয়সা জোগান দেওয়ার ব্যাপারও আছে। যারা টাকা দেবে তারা বিনিময়ও চাইবে। নতুন অনেক দাতাই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাবে।
শিল্পীদের ওপর ক্ষোভ থাকার কারণ আছে জামায়াতে ইসলামীর। যখনই সুযোগ পায় তখনই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণটা খুবই স্পর্শকাতর। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। বহু শতাব্দী ধরে বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে মধ্যযুগ থেকেই লড়াইটা চলছে। ভাষা আন্দোলন থেকে সূচনা হলো একটা যুদ্ধই। সেই যুদ্ধ একাত্তরে একটা রূপ পেল। চিত্রকলা, সংগীত, নাটক, নৃত্যকলা—সবকিছুর সঙ্গে বাঙালিত্বের বহুদিনের একটা গাঁটছড়া বাঁধা। দু-একজন অভিনেত্রী, গায়িকা, অভিনেতাকে অপমান করে কোনো লাভ হবে?
সাম্প্রতিককালের একটি উদাহরণ দিই। হয়তো ভালোই উদাহরণ হবে। ৫ আগস্টের পর পূর্ব গগন থেকে অনেক অশ্বারোহী এসেছেন। দু-একজন যে হেঁটে আসেননি, তা নয়। অশ্বারোহীদের একজন শিল্প-সাহিত্যের লোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নাট্য পরিচালক, গবেষক। আমরাও তাঁকে গ্রহণ করলাম। কিন্তু তিনি অশ্ব থেকে নামছেনই না। দাবড়ে চলেছেন। নাটক বন্ধ করছেন, অভিনয় বন্ধ করছেন। নতুন নানা নিউ ন্যারেটিভ তৈরি করছেন। শিল্পকলা একাডেমির পবিত্র প্রাঙ্গণে সম্মানিত ব্যক্তিরা লাঞ্ছিত হলেন, বড় বড় স্বজনপ্রীতিতে মাতলেন। তারপর তাঁর বস স্মরণকালের সবচেয়ে সমালোচিত উপদেষ্টার সঙ্গে লেগে গেলেন। অশ্বারোহী ড. জামিল আহমেদ অশ্ব থেকে আর নামলেন না, চলে গেলেন। প্রতিষ্ঠানটি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে রইল।
এমনই অনেক অশ্বারোহী জুটে গেছে, যারা মানুষের সম্মান নষ্ট করবে, কোনোকিছুই প্রমাণ দেবে না। অযথা হয়রানি করা হবে। উদ্দেশ্য—মুক্তিযুদ্ধ ও শিল্প-সাহিত্যকে অবমাননা করে জাতীয় সংস্কৃতিকে একহাত দেখাবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস অনেক ধরনের বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, প্রত্যাশা ছিল নাগরিক সমাজকে সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেবেন না। কিন্তু এই বিলম্ব প্রক্রিয়া প্রতিটি নাগরিককে কোনো না কোনোভাবে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার মামলা আক্রান্ত আইন ব্যবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে পারবেন না। তাই প্রয়োজন দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। জাতি তার প্রিয় রাজনীতিকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করুক। তবে আমাদের প্রতি যে অসম্মান-অবিচার হলো, তার জন্য আইনবিষয়ক উপদেষ্টা কীভাবে দায়িত্ব এড়াবেন, তিনিই জানেন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
সম্প্রতি বিমানবন্দরে অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়েছে। মামলার নথিপত্র প্রকাশ হওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। হত্যাচেষ্টাটি হয়েছে ১৯ জুলাই, ২০২৪ আর মামলাটি হয়েছে ২০২৫ সালের ৩ মে। একটি হত্যাচেষ্টা মামলা এত বিলম্বে করা যায় কি না, তা অবশ্য আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়। এর আগে অবশ্য আইন উপদেষ্টা এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছিলেন, এভাবে মামলা করলেই হবে না, তদন্ত সাপেক্ষে মামলা গ্রহণ করা হবে। রাষ্ট্রের এই দুজন বড় কর্তাও জানেন এসব মামলা হয়রানিমূলক।
নুসরাত ফারিয়া বিদেশে যাচ্ছিলেন, বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাঁর বিদেশযাত্রা বন্ধ করে এবং গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান দিয়ে দেয়। হত্যাচেষ্টার ওই সময়ে যে তিনি বিদেশে ছিলেন, এটা পাসপোর্ট এবং ভিসার প্রমাণসহ আদালতে জমা দেন। এবার বাদীপক্ষের উকিল হত্যাচেষ্টার বাইরেও কিছু কথা বলেন। তা হলো, নুসরাত ফারিয়া শেখ হাসিনার কিছু গুণকীর্তন করেছেন এবং একটা পর্যায়ে অভিনেত্রীকে ওই উকিল ‘নর্তকী’ বলে আখ্যা দেন। প্রশ্ন ওঠে, শেখ হাসিনার গুণকীর্তন নাকি হত্যাচেষ্টা—কোনটা মুখ্য? নুসরাত কী কারণে হত্যাচেষ্টা করতে যাবেন? এত সব প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও আইন উপদেষ্টা একজন শিক্ষক হয়েও এই কথাটা এত দিন ধরে খোলা রেখেছেন কেন? এটি শুধু প্রশ্ন নয়, তার চেয়েও বড় কিছু।
এবার আমার প্রসঙ্গে আসি। নুসরাতের সঙ্গে আমার বিষয়টিও আলোচনার অপেক্ষা রাখে। আমিও ৩০ এপ্রিল, ২০২৫ রাতে ঢাকা বিমানবন্দর হয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য উপস্থিত হই। আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কিছুক্ষণ বিলম্ব করেন। আমি অবাক বিস্ময়ে অপেক্ষা করি। কারণ ৫ আগস্টের পর আমি দুইবার মুম্বাই ও একবার নেপালে যাই; মুম্বাই শুটিংয়ের কাজে আর নেপালে একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশ নিতে। কোথাও কোনো হয়রানির শিকার হতে হয়নি। যাহোক, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা কিছুক্ষণ পর সসম্মানে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে দেন এবং যথাসময়েই আমি বিমানে আরোহণ করি।
আমি কিছুদিন যাবৎই অসুস্থ। বিশেষ করে, নেপালে গিয়ে ঠান্ডা লাগায় খুবই কাশি হচ্ছিল। চিকিৎসাও করাচ্ছিলাম। ৩০ তারিখের যাত্রায় দোহায় বিমান পরিবর্তন করে ওঠার পর থেকে শরীরটা আরও খারাপ অনুভূত হচ্ছিল। তখনো গন্তব্যে পৌঁছাতে ১৬ ঘণ্টা বাকি। যতই সময় পার হচ্ছিল, ততই শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলাম। খেতেও পারছিলাম না, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছিল। কাতার এয়ারলাইনসের ক্রুরা নানাভাবে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বহু কষ্টে ডালাস বিমানবন্দরে পৌঁছার পর দেখলাম এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ আমার জন্য অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করে রেখেছে। সরাসরি চলে গেলাম হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল আমার ডবল নিউমোনিয়া হয়েছে। সঙ্গে সেপসিস হয়েছে (রক্তের ভেতর সংক্রমণ ঢুকে যায়)। সেই থেকে সাত দিন আমাকে আইসিইউতে রেখে নিবিড় পরিচর্যার ব্যবস্থা করা হয়।
হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ই সম্ভবত তৃতীয় দিন জানতে পারি, আমার নামেও একটি হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে, একই সময়ের ঘটনা, গত জুলাইয়ের। সম্ভবত আমার মামলাটিও নুসরাত ফারিয়ার মামলার কাছাকাছি সময়ে করা। আমিও নুসরাতের মতো জুলাইতে দেশের বাইরে ছিলাম। পাসপোর্টের অ্যারাইভাল ও ডিপারচার সিল তার সাক্ষ্য দেবে। এই মামলায় আমার সঙ্গে আবার চঞ্চল চৌধুরী ও রিয়াজকে আসামি করা হয়েছে। যদি মামলাটি ৩০ তারিখেই হতো এবং বিমানবন্দরে কাগজ চলে আসত, তাহলে নুসরাতের মতো আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়ে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রেখে দিত। এবং যেখানে আইসিইউ প্রয়োজন সেখানে হাজতনিবাসেই আমার হয়তো বিচারটি হয়ে যেত। যারা আমাদের পথের কাঁটা মনে করে, তাদের জন্য একটা স্বস্তির নিশ্বাস দেখতে পাওয়া যেত। নুসরাতসহ অনেকেরই রাত-দিন হয়তো আমার মতো একই রকম হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিল্পীদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? শিল্পীরা কি জাতির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে নাকি আলোকিত করেছে? ৫৩ বছর যাবৎ একেবারে শূন্য থেকে থিয়েটার আন্দোলনকে কোথায় এনেছি আমরা! দেশ-বিদেশ থেকে কত সম্মান আমরা নিয়ে এসেছি। আমাদের কর্তব্যনিষ্ঠার ফলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ স্থাপিত হয়েছে। সারা দেশে নাট্যমঞ্চ স্থাপিত হয়েছে। এ সবকিছুই আমরা করেছি কোনো অর্থ ছাড়া, বিনা পারিশ্রমিকে। ওই আগস্টের পর সবাই আমরা ভেবেছিলাম একটা সাময়িক সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন।
সেই সমঝোতার সরকার এসেছে, যাদের দায়িত্ব হচ্ছে আজীবন শৃঙ্খলা, মানুষের মাঝে জানমালের নিরাপত্তা এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা অর্পণ করা। জনজীবনে শৃঙ্খলা আসেনি, জানমালের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়নি কিন্তু প্রতিদিনই রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে যা দেখা যায় তা হলো—সংস্কার কার্যক্রম। সবচেয়ে হাস্যকর প্রচেষ্টা—ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা। এইভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে টাই পরা কজন ভদ্রলোক যাঁরা বাংলাদেশের ঋতুপরিক্রমা জানেন না, জোয়ার-ভাটার খবর জানেন না, তাঁরা কত লোককে চা-বিস্কুট খাইয়ে একটা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করবেন? গত ৫৪ বছরে নানা ধরনের রাজনৈতিক উত্থান-পতন, বিভক্তি, শিক্ষাব্যবস্থার বিবিধ শাখা-প্রশাখা, ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন, দুর্নীতিসহ হাজারো সমস্যায় আক্রান্ত দেশটায় কয়েক মাসের মধ্যে কয়েকজন জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তি বিষয়টি করে ফেলবেন? কী হাস্যকর চেষ্টা!
প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এখন বড় দাবি এবং একটাই দাবি—নির্বাচন চাই। সেখানে কোন কারণে বিলম্ব? ‘শুভস্য শীঘ্রম অশুভস্য কাল হরনং’। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে একটা অশুভের দিকে যাত্রা করছে এই অনির্বাচিত ও অন্তর্বর্তী সরকার। সবার সব দাবিদাওয়ায় প্রতিদিন রাজপথ, অফিস-আদালত তছনছ হচ্ছে। কেই-বা এই সরকারকে অধিকার দিল দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার? নির্বাচিত সরকার এসব না-ও মানতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ারই-বা কে এই সরকার? এটা নিশ্চিত যে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাই এই সিদ্ধান্ত মানবেন না। যেখানে ব্যাপক উন্নতি হওয়ার কথা ছিল, সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্থান দখল করে আছে মব—মবতন্ত্র। দেশের একজন প্রখ্যাত ভাস্কর রাশাকে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে লাঞ্ছিত করা হয়। দৌড়ে তাঁকে আত্মরক্ষা করতে হয়েছে। জনপ্রিয় অভিনেতা সিদ্দিককে যাঁরা আক্রমণ করল, তাঁদের সবার ছবি আছে। কিন্তু জানি না এখন পর্যন্ত পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না। এর আগে যখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে, তখনই মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। কারণ, এই সময়টা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকে, কয়েকটা মাস শান্তিতে থাকা যায় এবং ভোটটা ঠিকমতো দেওয়া যায়।
এবার নানা ধরনের নিপীড়নমূলক ডালপালা বেরোচ্ছে। অসংখ্য রাজনৈতিক দল গড়ে উঠছে। তাদের টাকাপয়সা জোগান দেওয়ার ব্যাপারও আছে। যারা টাকা দেবে তারা বিনিময়ও চাইবে। নতুন অনেক দাতাই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাবে।
শিল্পীদের ওপর ক্ষোভ থাকার কারণ আছে জামায়াতে ইসলামীর। যখনই সুযোগ পায় তখনই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণটা খুবই স্পর্শকাতর। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। বহু শতাব্দী ধরে বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে মধ্যযুগ থেকেই লড়াইটা চলছে। ভাষা আন্দোলন থেকে সূচনা হলো একটা যুদ্ধই। সেই যুদ্ধ একাত্তরে একটা রূপ পেল। চিত্রকলা, সংগীত, নাটক, নৃত্যকলা—সবকিছুর সঙ্গে বাঙালিত্বের বহুদিনের একটা গাঁটছড়া বাঁধা। দু-একজন অভিনেত্রী, গায়িকা, অভিনেতাকে অপমান করে কোনো লাভ হবে?
সাম্প্রতিককালের একটি উদাহরণ দিই। হয়তো ভালোই উদাহরণ হবে। ৫ আগস্টের পর পূর্ব গগন থেকে অনেক অশ্বারোহী এসেছেন। দু-একজন যে হেঁটে আসেননি, তা নয়। অশ্বারোহীদের একজন শিল্প-সাহিত্যের লোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নাট্য পরিচালক, গবেষক। আমরাও তাঁকে গ্রহণ করলাম। কিন্তু তিনি অশ্ব থেকে নামছেনই না। দাবড়ে চলেছেন। নাটক বন্ধ করছেন, অভিনয় বন্ধ করছেন। নতুন নানা নিউ ন্যারেটিভ তৈরি করছেন। শিল্পকলা একাডেমির পবিত্র প্রাঙ্গণে সম্মানিত ব্যক্তিরা লাঞ্ছিত হলেন, বড় বড় স্বজনপ্রীতিতে মাতলেন। তারপর তাঁর বস স্মরণকালের সবচেয়ে সমালোচিত উপদেষ্টার সঙ্গে লেগে গেলেন। অশ্বারোহী ড. জামিল আহমেদ অশ্ব থেকে আর নামলেন না, চলে গেলেন। প্রতিষ্ঠানটি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে রইল।
এমনই অনেক অশ্বারোহী জুটে গেছে, যারা মানুষের সম্মান নষ্ট করবে, কোনোকিছুই প্রমাণ দেবে না। অযথা হয়রানি করা হবে। উদ্দেশ্য—মুক্তিযুদ্ধ ও শিল্প-সাহিত্যকে অবমাননা করে জাতীয় সংস্কৃতিকে একহাত দেখাবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস অনেক ধরনের বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, প্রত্যাশা ছিল নাগরিক সমাজকে সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেবেন না। কিন্তু এই বিলম্ব প্রক্রিয়া প্রতিটি নাগরিককে কোনো না কোনোভাবে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার মামলা আক্রান্ত আইন ব্যবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে পারবেন না। তাই প্রয়োজন দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। জাতি তার প্রিয় রাজনীতিকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করুক। তবে আমাদের প্রতি যে অসম্মান-অবিচার হলো, তার জন্য আইনবিষয়ক উপদেষ্টা কীভাবে দায়িত্ব এড়াবেন, তিনিই জানেন।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
ডিসেম্বর আর জুন নিয়ে যে বচসা (বচসা বলাই শ্রেয়, এটাকে সুস্থ মস্তিষ্কের আলোচনা বলার কোনো সুযোগ নেই) শুরু হয়েছে, তার অন্তর্নিহিত কারণ বোঝা দায়। অনেক ইউটিউবারই এই প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন এবং তাঁদের মতো করে আলোচনা করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন...
১৭ ঘণ্টা আগেজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক আধার। ৭০০ একর বেষ্টিত এই প্রতিষ্ঠানে প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যে প্রগাঢ় বন্ধন, তা উচ্চশিক্ষার প্রকৃত পরিবেশ নিশ্চিত করে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি লেকের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সুইজারল্যান্ড নামে পরিচিত...
১৭ ঘণ্টা আগেএকসময় যাকে কেবল বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ভাবা হতো, সেই ফেসবুক এখন আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হয়ে উঠেছে। বিশেষত, সংবাদ ও তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে ফেসবুকের ভূমিকা দিন দিন শুধু শক্তিশালীই হচ্ছে না, বরং প্রশ্ন উঠছে, মূলধারার গণমাধ্যম কি ক্রমেই...
১৮ ঘণ্টা আগেরাজনীতি যদি জনগণের জন্য হয়, তাহলে সেই সাধারণ জনগণকে প্রতিদিন ভোগান্তির ভেতর যারা ফেলে, তারা কি আদৌ রাজনৈতিক দল? নাকি মুখে মুখে জনগণের কথা বলা সুবিধাবাদী দল? এই প্রশ্নটি রইল অতি ডান, মধ্যপন্থী ও বাম—সব দলের প্রতি। অন্য দেশেও মানুষ আন্দোলন করে, বিশেষ করে যদি ইউরোপের কথা বলি, সেখানে রাজপথের মাঝে খোলা
২ দিন আগে