বিভুরঞ্জন সরকার
বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন আজ, ২৫ মে। বাংলা ১৩০৬ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের চুরুলিয়ায় তাঁর জন্ম। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যখন প্রবল হয়ে উঠছিল, তখন বাংলা সাহিত্যে সাহসের ঝড় তুলে উন্নত শির এই কবির আবির্ভাব মানুষকে প্রতিবাদী হতে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। স্বাধীনতা, সাম্য চিন্তা এবং সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে জাগরণের এক নতুন হাওয়া তৈরি করতে কাজী নজরুল ইসলামের রচনাসমূহ বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।
কবির মৃত্যু হয়েছে ঢাকায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ছয় বছরের মাথায়, বাংলা ১৩৮৩ সনের ১২ ভাদ্র। মসজিদের পাশে তাঁকে কবর দেওয়ার কথা তাঁর একটি কবিতায় আছে। তাই তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়েছে। এ থেকে কারও মনে হতে পারে যে, নজরুল বুঝি খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন অথবা তাঁর সাহিত্যের মূল উপজীব্য বুঝি ছিল ইসলাম ধর্ম।
না, নজরুল মোটেও ধর্মীয় কবি ছিলেন না। এটা সত্য যে, তিনি হামদ, নাত, গজলসহ অনেক ইসলামি সংগীত রচনা করেছেন, তাঁর লেখায় আরবি-ফারসি শব্দও প্রচুর ব্যবহার করেছেন। আবার তিনি শ্যামাসংগীত, ভজন, কীর্তনও লিখেছেন। হিন্দুদের দেবদেবী তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার একজন মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চায় তাঁর আগ্রহ দেখা যায়নি। তিনি বিয়ে করেছিলেন হিন্দু নারী প্রমিলা দেবীকে। সন্তানদের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী অনিরুদ্ধ ইসলাম এবং কাজী সব্যসাচী ইসলাম।
ধর্মবিশ্বাস দিয়ে নয়, তিনি মানুষকে দেখতেন মানুষ হিসেবে। তিনি লিখেছেন: ‘নদীর পাশ দিয়ে চলতে যখন দেখি একটি লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ প্রশ্ন ভাবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান, একজন মানুষ ডুবছে এইটেই… সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে… মন বলে আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি।’
তিনি লিখেছেন: ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
যারা হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়িতে জাতের মান নির্ধারণ করেন, তাঁদের তিনি ‘বেকুব’ বলে তিরস্কার করেছেন। ধর্মাচরণ নিয়ে তাঁকে বিদ্রুপ-গঞ্জনা কম সহ্য করতে হয়নি। আক্ষেপ করে তিনি বলেছেন: ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে, আমার গাঁটছাড়ার বাঁধন কাটতে বেগ পেতে হবে না। কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে ছুরি। বর্তমানে সাহিত্য নিয়ে ধূলোবালি, এত ধোঁয়া, এত কোলাহল উঠছে যে ওর মাঝে সামান্য দীপবর্তিকা নিয়ে পথ খুঁজতে গেলে আমার বাতিও নিভবে, আমিও মরব।’
নজরুল বেঁচেছিলেন ৭৭ বছর। কিন্তু এর মধ্যে ৩৫ বছর ছিলেন জীবন্মৃত। তিনি তাঁর কবিতায় বলেছিলেন: ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না, কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না। — নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ!’
১৯৪২ সাল থেকে ১৯৭৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সে রকমই ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল, লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন মাত্র ২২ বছর। এই অল্প সময়ে তিনি কবিতা, গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ কত কিছুই না লিখেছেন। অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা নজরুলের জীবন ছিল একদিকে ছন্নছাড়া, অন্যদিকে ধূমকেতুর মতো। বেঁচে থাকার জন্য জীবনে তাঁকে কত কিই-না করতে হয়েছে।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে তিনি প্রথম সাড়া ফেলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। এ বছর ‘বিদ্রোহী’র শতবর্ষ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি যেমন ভৃগু ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে চেয়েছেন, তেমনি খোদার আসন আরশ ছেদিয়া ওঠার কথাও বলেছেন। তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে যেমন খ্যাতি পেয়েছেন, তেমনি প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি হিসেবেও তাঁকেই গণ্য করা হয়। দ্রোহ আর প্রেম তাঁর কাছে অভিন্ন ছিল। তিনি বলেছেন: ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য’। তাঁকে সাম্য ও মানবতার কবি বলা হয়। কারণ, তাঁর কলম থেকেই বেরিয়েছে: ‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।’
অন্যায়, অসাম্যের বিরুদ্ধে, অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিল ক্ষুরধার। তিনি লিখেছেন: ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি/ সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
তাঁর কলম থেকেই বেরিয়েছে: ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/ এক সে আকাশ মায়ের কোলে/ যেন রবি শশী দোলে/ এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।’ আবার সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সমান সোচ্চার। লিখেছেন: ‘দেখিনু সেদিন রেলে/ কুলি বলে এক বাবুসাব তারে টেনে দিল নিচে ফেলে/ চোখ ফেটে এলো জল/ এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
নজরুলের সময়ে তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপও কিছু কম হয়নি। তাঁকে তুচ্ছ করার জন্য ‘বালক প্রতিভা’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর ‘পরিণত’ বোধ আসেনি। কিন্তু যাঁরা এসব করেছেন, তাঁরা সমাজে প্রভাবকের স্থান পাননি, কেউ বা হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু নজরুল আছেন উজ্জ্বল দেদীপ্যমান।
নজরুল বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমর্থন ও অকাতর স্নেহ পেয়েছেন। নজরুলের পত্রিকা ‘ধুমকেতু’র জন্য আশীর্বাণীতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন:
‘আয় চলে আয় রে ধুমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দেবে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধ চেতন।’
ধুমকেতুতে প্রকাশিত কবিতার জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারে রাজবন্দীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল টানা ৪০ দিন অনশন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের দৃঢ়তাকে সমর্থন জানিয়ে লেখেন: ‘আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা তাকে হত্যা করারই সামিল। অনশনে যদি কাজীর মৃত্যু ঘটে তা হলেও তার অন্তরে সত্য আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে’।
শেষপর্যন্ত স্নেহভাজন নজরুলের অনশনে বিচলিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টেলিগ্রাম করেন: ‘Give up hunger strike. Our literature claims you.।’ কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ নজরুলকে এই টেলিগ্রাম না দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিল।
১৯৪১ সালে এক সাহিত্য সভায় নজরুল বলেছিলেন: ‘যদি আর বাঁশী না বাজে—আমি কবি বলে বলছিনে, আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি—আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চির দিনের জন্য বিদায় নিলাম।’
তিনি লিখেছেন:
‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব,
তবু আমারে দেব না ভুলিতে…’
হ্যাঁ, বাঙালির পক্ষে তাঁকে ভোলা সম্ভব হবে না। সত্যদ্রষ্টা কবিকে ভোলা যায় না।
জন্মদিনে কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন আজ, ২৫ মে। বাংলা ১৩০৬ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের চুরুলিয়ায় তাঁর জন্ম। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যখন প্রবল হয়ে উঠছিল, তখন বাংলা সাহিত্যে সাহসের ঝড় তুলে উন্নত শির এই কবির আবির্ভাব মানুষকে প্রতিবাদী হতে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। স্বাধীনতা, সাম্য চিন্তা এবং সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে জাগরণের এক নতুন হাওয়া তৈরি করতে কাজী নজরুল ইসলামের রচনাসমূহ বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।
কবির মৃত্যু হয়েছে ঢাকায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ছয় বছরের মাথায়, বাংলা ১৩৮৩ সনের ১২ ভাদ্র। মসজিদের পাশে তাঁকে কবর দেওয়ার কথা তাঁর একটি কবিতায় আছে। তাই তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়েছে। এ থেকে কারও মনে হতে পারে যে, নজরুল বুঝি খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন অথবা তাঁর সাহিত্যের মূল উপজীব্য বুঝি ছিল ইসলাম ধর্ম।
না, নজরুল মোটেও ধর্মীয় কবি ছিলেন না। এটা সত্য যে, তিনি হামদ, নাত, গজলসহ অনেক ইসলামি সংগীত রচনা করেছেন, তাঁর লেখায় আরবি-ফারসি শব্দও প্রচুর ব্যবহার করেছেন। আবার তিনি শ্যামাসংগীত, ভজন, কীর্তনও লিখেছেন। হিন্দুদের দেবদেবী তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার একজন মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চায় তাঁর আগ্রহ দেখা যায়নি। তিনি বিয়ে করেছিলেন হিন্দু নারী প্রমিলা দেবীকে। সন্তানদের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী অনিরুদ্ধ ইসলাম এবং কাজী সব্যসাচী ইসলাম।
ধর্মবিশ্বাস দিয়ে নয়, তিনি মানুষকে দেখতেন মানুষ হিসেবে। তিনি লিখেছেন: ‘নদীর পাশ দিয়ে চলতে যখন দেখি একটি লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ প্রশ্ন ভাবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান, একজন মানুষ ডুবছে এইটেই… সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে… মন বলে আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি।’
তিনি লিখেছেন: ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
যারা হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়িতে জাতের মান নির্ধারণ করেন, তাঁদের তিনি ‘বেকুব’ বলে তিরস্কার করেছেন। ধর্মাচরণ নিয়ে তাঁকে বিদ্রুপ-গঞ্জনা কম সহ্য করতে হয়নি। আক্ষেপ করে তিনি বলেছেন: ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে, আমার গাঁটছাড়ার বাঁধন কাটতে বেগ পেতে হবে না। কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে ছুরি। বর্তমানে সাহিত্য নিয়ে ধূলোবালি, এত ধোঁয়া, এত কোলাহল উঠছে যে ওর মাঝে সামান্য দীপবর্তিকা নিয়ে পথ খুঁজতে গেলে আমার বাতিও নিভবে, আমিও মরব।’
নজরুল বেঁচেছিলেন ৭৭ বছর। কিন্তু এর মধ্যে ৩৫ বছর ছিলেন জীবন্মৃত। তিনি তাঁর কবিতায় বলেছিলেন: ‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না, কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না। — নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ!’
১৯৪২ সাল থেকে ১৯৭৭ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সে রকমই ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল, লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন মাত্র ২২ বছর। এই অল্প সময়ে তিনি কবিতা, গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ কত কিছুই না লিখেছেন। অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা নজরুলের জীবন ছিল একদিকে ছন্নছাড়া, অন্যদিকে ধূমকেতুর মতো। বেঁচে থাকার জন্য জীবনে তাঁকে কত কিই-না করতে হয়েছে।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে তিনি প্রথম সাড়া ফেলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। এ বছর ‘বিদ্রোহী’র শতবর্ষ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি যেমন ভৃগু ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে চেয়েছেন, তেমনি খোদার আসন আরশ ছেদিয়া ওঠার কথাও বলেছেন। তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে যেমন খ্যাতি পেয়েছেন, তেমনি প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি হিসেবেও তাঁকেই গণ্য করা হয়। দ্রোহ আর প্রেম তাঁর কাছে অভিন্ন ছিল। তিনি বলেছেন: ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য’। তাঁকে সাম্য ও মানবতার কবি বলা হয়। কারণ, তাঁর কলম থেকেই বেরিয়েছে: ‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।’
অন্যায়, অসাম্যের বিরুদ্ধে, অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিল ক্ষুরধার। তিনি লিখেছেন: ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি/ সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’
তাঁর কলম থেকেই বেরিয়েছে: ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/ এক সে আকাশ মায়ের কোলে/ যেন রবি শশী দোলে/ এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।’ আবার সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সমান সোচ্চার। লিখেছেন: ‘দেখিনু সেদিন রেলে/ কুলি বলে এক বাবুসাব তারে টেনে দিল নিচে ফেলে/ চোখ ফেটে এলো জল/ এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
নজরুলের সময়ে তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপও কিছু কম হয়নি। তাঁকে তুচ্ছ করার জন্য ‘বালক প্রতিভা’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর ‘পরিণত’ বোধ আসেনি। কিন্তু যাঁরা এসব করেছেন, তাঁরা সমাজে প্রভাবকের স্থান পাননি, কেউ বা হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু নজরুল আছেন উজ্জ্বল দেদীপ্যমান।
নজরুল বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমর্থন ও অকাতর স্নেহ পেয়েছেন। নজরুলের পত্রিকা ‘ধুমকেতু’র জন্য আশীর্বাণীতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন:
‘আয় চলে আয় রে ধুমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দেবে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধ চেতন।’
ধুমকেতুতে প্রকাশিত কবিতার জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারে রাজবন্দীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অত্যাচারের প্রতিবাদে নজরুল টানা ৪০ দিন অনশন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের দৃঢ়তাকে সমর্থন জানিয়ে লেখেন: ‘আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা তাকে হত্যা করারই সামিল। অনশনে যদি কাজীর মৃত্যু ঘটে তা হলেও তার অন্তরে সত্য আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে’।
শেষপর্যন্ত স্নেহভাজন নজরুলের অনশনে বিচলিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে টেলিগ্রাম করেন: ‘Give up hunger strike. Our literature claims you.।’ কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ নজরুলকে এই টেলিগ্রাম না দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিল।
১৯৪১ সালে এক সাহিত্য সভায় নজরুল বলেছিলেন: ‘যদি আর বাঁশী না বাজে—আমি কবি বলে বলছিনে, আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি—আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চির দিনের জন্য বিদায় নিলাম।’
তিনি লিখেছেন:
‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব,
তবু আমারে দেব না ভুলিতে…’
হ্যাঁ, বাঙালির পক্ষে তাঁকে ভোলা সম্ভব হবে না। সত্যদ্রষ্টা কবিকে ভোলা যায় না।
জন্মদিনে কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের বাইরে খুব কাছের একটা দেশে এসেছি। পৃথিবীর কত দূরদূরান্তের দেশে গিয়েছি, কিন্তু কখনো নেপালে আসিনি। যদিও অনেকবার সুযোগ হয়েছে, তবু আসা হয়নি। যেখানেই গিয়েছি, শুধু বেড়াবার জন্য যাইনি। গিয়েছি কাজে এবং নাটকের কাজে। হয় কোথাও অভিনয় করতে গিয়েছি, আবার কোথাও নাটকের কর্মশালার কাজে অথবা সেমিন
১ ঘণ্টা আগেমস্তিষ্ক বিকাশের কারণে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে বুদ্ধিমত্তা মানে চারপাশ থেকে সরাসরি শুধু তথ্য ধারণ করা নয়, সেই সঙ্গে বিচারবুদ্ধিও। যার মাধ্যমে তথ্যগুলোকে সমন্বয় সাধন ও ব্যবহার করা যায়, ভবিষ্যতের কোনো বিপদ সম্পর্কে আগে আভাস পাওয়া সম্ভব হয়, যা জিনের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো প্রয়ো
২ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দ হলো জটিল। আমাদের যাপিত জীবনের অনেক কিছুতেই আমরা জটিলতার তারতম্য অনুভব করি। অঙ্ক জটিল, সমস্যা জটিল, সমাধান জটিল, মানবজীবন জটিল, জগৎসংসার জটিল—এমন বহুসংখ্যক জটিলতার মধ্যে আমাদের নিত্যবসবাস। এতসব জটিলতার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় কীভাবে এল জটিল শব্দটি আমরা কি তা জানি? আবার স
২ ঘণ্টা আগেরাজধানীর গুলশানে মঙ্গলবার মধ্যরাতে আবার মব ভায়োলেন্স ঘটতে দেখা গেল। কোত্থেকে অভিযোগ এসেছে সেটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা না ভেবেই একদল মানুষ আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে সাবেক এমপি তানভীর ইমামের বাড়ি ভেবে একটি বাড়িতে ভাঙচুর
২ ঘণ্টা আগে