জাহীদ রেজা নূর
ঘটনাবলি এত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে যে কোন ঘটনার সঙ্গে কোন ঘটনাকে মিলিয়ে একটা যুক্তিসংগত সিদ্ধান্তে আসা যাবে, তা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। কে কার পক্ষ নিচ্ছে এবং কে কোন পক্ষ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। এ রকম একটি অবস্থায় মূল ঘটনাগুলো থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা করাই উত্তম। দূর থেকে বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখা যায়।
এই পর্যায়ে আমার মতো একজন রাজনীতি-অনভিজ্ঞ মানুষ রাজনীতির বাণী না শুনিয়ে বরং উচিত হবে অন্য বিষয়ে আলোকপাত করা।
খুলনা শহরে বেড়াতে এসে প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যেও ভোরবেলায় শহীদ হাদিস পার্কে স্বাস্থ্য উদ্ধারে আসা মানুষের সংখ্যা বুঝিয়ে দেয়, রাজনৈতিক ডামাডোল বা কোলাহলের বাইরেও একটা জগৎ আছে। তবে ব্যায়াম ও হাঁটাচলার মাঝেই টুকরো টুকরো যে কথাগুলো কানে আসে, তাতে রাজনীতি একেবারেই থাকে না, এমন নয়। এবং সেই রাজনীতি স্থানীয় পর্যায় থেকে বাড়তে বাড়তে জাতীয় পর্যায়ে উপনীত হয়। তবে তা কখনোই চিৎকার-চেঁচামেচিতে পরিণত হয় না। সবাই বুঝে গেছে, এই মুহূর্তে কোন কথা বললে কোন পরিণতি হবে, সেটা যেহেতু অজানা, তাই সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করার মধ্যেই বেঁচে থাকার সার্থকতা রয়েছে।
খুলনাবাসী কারও কারও সঙ্গে যেসব কথা হয়েছে, তাতে শহরের নানা ধরনের অসংগতি এবং নানা ধরনের প্রত্যাশার বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, সরকারি যে বাসভবনগুলো রয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে, সেগুলো ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে অনেক জায়গার সংস্থান হতে পারত। কেন একজন বড় সরকারি কর্মকর্তার বিশাল বড় এলাকাজুড়ে বাড়ি থাকবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। চলতি পথে একজন সতীর্থ আলী আজগর লবির বাড়িটি দেখিয়ে বললেন, এখন এই বাড়ি আবার সক্রিয় হচ্ছে।
একটি ছোট বাজারে অদ্ভুত এক দেয়াললিখন দেখা গেল। দেখে আনন্দ হলো, তেমনি বিষাদ এসেও ভর করল মনে।
দেয়াললিখনটা হলো, ‘২০ বছরে হয়নি যে সমস্যার সমাধান, তা আর হবে না এটা জেনে গেছে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের জনগণ’।
আমার কাছে ভাষ্যটি অভিনব লাগল। এভাবেও যে প্রতিবাদ করা যায়, সেটা আমার জানা ছিল না। আমার কাছে খুবই শৈল্পিক মনে হয়েছে প্রতিবাদের ধরনটি। চারদিকে যখন মার মার কাট কাট, একে ধর, ওকে জবাই কর ইত্যাদি স্লোগানের কারণে চিত্ত বিচলিত হচ্ছে, তখন এ রকম একটি শ্লেষ বা ব্যঙ্গ যে কত উচ্চাঙ্গের বার্তা দেয়, সেটা নতুন করে বলে দিতে হবে না।
খুলনার এই ২৩ নম্বর ওয়ার্ডটি কোথায়, কী সমস্যা আছে এখানে, তার কিছুই আমার জানা নেই। কিন্তু এই এলাকার মানুষ একটি নতুন ধরনের প্রতিবাদের ভাষা আবিষ্কার করেছে, এটা জেনে ভালো লাগল।
খুলনা শহরে এখন কটা সিনেমা হল রয়েছে, তা আমার জানা নেই। কিন্তু অন্তত দুটি সিনেমা হল দেখলাম, যেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিনোদনের জন্য মফস্বল শহরের সিনেমা হলগুলো অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেল কি না, সেই প্রশ্ন চাইলেও এড়ানো যাবে না। আমরা তো দেখেছি, আমাদের সাংস্কৃতিক অর্জনের অনেক কিছুই নানাভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এটাও তারই একটি লক্ষণ বলে মনে করলে ভুল হবে না। তবে এ কথাও ঠিক, সবার হাতে একটা করে স্মার্টফোন থাকায় সিনেমা দেখার চাহিদা সেখানেই মিটিয়ে ফেলা যায়। তাই দল বেঁধে সিনেমা হলে যাওয়ার উৎসবে ভাটা পড়েছে।
আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক চর্চা দিনে দিনে কমেছে, এটা সত্য। আগে যেরকম মুদিদোকানেও আধুনিক গান কিংবা সিনেমার গান বাজত, এখন কি আর সেরকম কিছু শোনা যায়? পরমতসহিষ্ণু হতে হলে সাংস্কৃতিক চর্চা মজ্জাগতভাবে রক্তের মধ্যে থাকতে হয় এবং তা গড়ে ওঠে পরিবার ও সমাজে প্রবাহিত আচার-আচরণ প্রভৃতির মাধ্যমে, সে কথা ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছে মানুষ। তাই শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের দিকেই নজর দিচ্ছেন অভিভাবকেরা, শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদের মনকর্ষণ না করে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার দিকেই নজর দিচ্ছেন এবং কখনো কখনো সেই পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য কোচিংয়ের মাধ্যমে কামিয়ে নিচ্ছেন টুপাইস।
খুলনার মানুষ কি এখনো সিনেমা দেখতে যায়? চোখের সামনেই তো অন্তত দুটি মৃত সিনেমা হল দেখতে হয়েছে। কটা টিকে আছে শহরে? পিকচার প্যালেস আর সোসাইটি নামের সিনেমা হলগুলোর জিন্দা লাশ দেখলাম রাস্তায়।
প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা রতন সেন যেখানে খুন হয়েছিলেন, সেখানে রয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে একটি ফলকে লেখা রয়েছে: ‘মানব রতন তুমি চির মানব সাথী!’
২.
শহীদ হাদিস পার্কে দ্বিতীয় দিন হাঁটতে গিয়ে ব্যায়াম করছিলেন যাঁরা, তাঁদের কথাবার্তায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়টি উঠে আসছিল। লেখার শুরুতেই বলেছি, এখন দেশে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা আসলে সময়ের ব্যবধান থেকে দেখতে হবে। নইলে মূল ঘটনা বোঝা যাবে না।
প্রধান উপদেষ্টার বাসায় যাওয়ার সামনের রাস্তাটায় কোনো ধরনের আন্দোলন করা যাবে না—এ রকম একটি নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কীভাবে সেখানে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হলো, তা নিয়ে নানা ধরনের মুখরোচক কথাবার্তা শোনা গেল। একজন বললেন, সরকার যে কাজটি করতে চায়, সেটা এই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে তাদের নির্দেশনা দিয়ে দেয়। এরপর এমন একটা ভাব করে যে চাপের মুখে পড়ে তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা পাতানো খেলা।
এ কথার প্রতিবাদও করছেন কেউ কেউ। কিন্তু এমন কাউকে কোথাও পাওয়া গেল না, যাঁরা বললেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কোনো একটা আশাবাদী ঘটনা ঘটতে দেখেছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আওয়ামী লীগ সরকারের যেসব কাজকে ফ্যাসিবাদী বলা হয়েছিল, এ সময়েও একই ধরনের কাজ হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন তুললেন কেউ কেউ।
আওয়ামী লীগ নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল বলে যাঁরা সমালোচনা করতেন, একই ঘটনা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘটায় তাঁরা কোন মনোভাব পোষণ করেন, সেটাও জানতে চাইলেন কেউ কেউ। এবং হাস্যচ্ছলে কেউ কেউ বললেন, ‘যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ।’
৩.
কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সেই দলকে কি কবর দেওয়া যায়? জামায়াতে ইসলামীকে কি আওয়ামী লীগ রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পেরেছে? বরং আওয়ামী লীগের রাজনীতি এই মুহূর্তে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে সেই রাজনীতি অন্য কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করবে। কোন ফর্মে সেটা আসবে, তা এখনই বলে দেওয়া যাবে না। সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় যেভাবে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে ছিল শিবিরের ছেলেরা, সেভাবেই ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগ কার ভেতরে ঢুকে যাবে, তা আগাম বলা যাবে না। জোর করে কারও মুখ বন্ধ রাখা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। প্রশ্ন হলো, এই দেশ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে কার্যক্রম চালালেও মূলত গণতান্ত্রিক অবয়বের মধ্যে নানা সময়ে স্বৈরাচার ভর করেছিল। এমন কোনো রাজনৈতিক সংগঠন দেখানো যাবে না, যাদের মধ্যে ক্ষমতার রেষারেষি নেই, অন্যকে গলা টিপে হত্যা করার প্রবণতা নেই। ক্ষমতায় থাকুক আর না থাকুক, ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ থাকলেই প্রয়োগ করা যে কত সহজ, সেই উদাহরণ দিতে খুব বেশি দূর যেতে হবে না।
৪.
আজই হোয়াটসঅ্যাপে এক মিনিট এক সেকেন্ডের একটি ভিডিও দেখে মন ভালো হয়ে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভিডিওটি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের যেসব গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য রয়েছে, সেই ভাস্কর্যের চরিত্রগুলো নেমে এসে মানুষের কাতারে দাঁড়াচ্ছে, মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময় করছে—এই হচ্ছে মূল থিম। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে না রাশিয়া, কিন্তু সম্মিলিত সেই বিজয়কে তারা হৃদয়ে ধারণ করে। এই বিজয়ে পুরো জাতি গর্বিত।
আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, বিজয় অর্জনের পরপরই বিজয়ের পরাজয় ঘটে গেছে। আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবতা ইত্যাদি থেকে আমরা ধীরে ধীরে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছি। পশুশক্তিকেই ভেবেছি আদ্যাশক্তি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রকেই সবচেয়ে কলুষিত করেছি। মুক্তিযুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছিল, তারা একবারের জন্য ভাবেনি যে জাতির কাছে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। অথচ তাদের একসময় রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সেই বোঝা বইতে বইতে জাতি এখন আর তা নিয়ে মোটেই বিচলিত নয়। ভুলে গেছে সেসব।
জনগণের বিজয়কে কুক্ষিগত করা কারও জন্যই শোভন নয়। অথচ আমাদের জাতি বারবার সেটাও দেখেছে। শতচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিজয়ীদের ঐক্য। এবং যেকোনো জায়গায় নিজেদের ক্ষমতার প্রকাশ দেখাতে গিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকেও খেলো করে ফেলা হয়েছে। ফলে যদি কেউ মনে করে যে তরুণেরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে, তারা যা ভাববে সেটাই ঠিক পথ, তাহলে সেই ভাবনার মধ্যে কতটা সত্য থাকবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। কারণ, অজস্র আবর্জনার মধ্য থেকে সত্য তুলে ধরার জন্য যে প্রয়াস প্রয়োজন, তা নিজের মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে অর্জন করার পথে কজন হাঁটবে? যদি নেতৃত্বের মধ্যেই গলদ থাকে, তাহলে এগিয়ে যাওয়া খুব কঠিন।
এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে, যে সংস্কারের কথা বলা হলো, তা আসলে করবে কে? প্রশ্ন করতে পারে, মেধা ও অভিজ্ঞতার মধ্যে মিলন না ঘটলে যে অরাজকতা সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার কে নেবে? প্রশ্ন করতে পারে, ১৯৭১ সালকে মূল্য দেওয়ার ধরন দেখেই দুষ্কৃতকারীদের মতলব বোঝা যায় এবং বোঝা যায় মূলত দেশপ্রেমী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটছে কি না। এই প্রশ্নগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গায়ের জোরে যা করা যায়, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে যা করা যায়, ইতিহাসের বিচারের জন্য একসময় তা কাঠগড়ায় দাঁড়াবেই।
কিন্তু সেই বিচারের জন্য ভাবনা ও চিন্তাশীলতার যে গভীরতা প্রয়োজন, সেটা না থাকলে কী হবে, তা কেউ বিবেচনা করে দেখছে না এখনো। মূল ভয়ের কারণ সেটাই।
ঘটনাবলি এত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে যে কোন ঘটনার সঙ্গে কোন ঘটনাকে মিলিয়ে একটা যুক্তিসংগত সিদ্ধান্তে আসা যাবে, তা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। কে কার পক্ষ নিচ্ছে এবং কে কোন পক্ষ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। এ রকম একটি অবস্থায় মূল ঘটনাগুলো থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা করাই উত্তম। দূর থেকে বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখা যায়।
এই পর্যায়ে আমার মতো একজন রাজনীতি-অনভিজ্ঞ মানুষ রাজনীতির বাণী না শুনিয়ে বরং উচিত হবে অন্য বিষয়ে আলোকপাত করা।
খুলনা শহরে বেড়াতে এসে প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যেও ভোরবেলায় শহীদ হাদিস পার্কে স্বাস্থ্য উদ্ধারে আসা মানুষের সংখ্যা বুঝিয়ে দেয়, রাজনৈতিক ডামাডোল বা কোলাহলের বাইরেও একটা জগৎ আছে। তবে ব্যায়াম ও হাঁটাচলার মাঝেই টুকরো টুকরো যে কথাগুলো কানে আসে, তাতে রাজনীতি একেবারেই থাকে না, এমন নয়। এবং সেই রাজনীতি স্থানীয় পর্যায় থেকে বাড়তে বাড়তে জাতীয় পর্যায়ে উপনীত হয়। তবে তা কখনোই চিৎকার-চেঁচামেচিতে পরিণত হয় না। সবাই বুঝে গেছে, এই মুহূর্তে কোন কথা বললে কোন পরিণতি হবে, সেটা যেহেতু অজানা, তাই সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করার মধ্যেই বেঁচে থাকার সার্থকতা রয়েছে।
খুলনাবাসী কারও কারও সঙ্গে যেসব কথা হয়েছে, তাতে শহরের নানা ধরনের অসংগতি এবং নানা ধরনের প্রত্যাশার বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, সরকারি যে বাসভবনগুলো রয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে, সেগুলো ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে অনেক জায়গার সংস্থান হতে পারত। কেন একজন বড় সরকারি কর্মকর্তার বিশাল বড় এলাকাজুড়ে বাড়ি থাকবে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। চলতি পথে একজন সতীর্থ আলী আজগর লবির বাড়িটি দেখিয়ে বললেন, এখন এই বাড়ি আবার সক্রিয় হচ্ছে।
একটি ছোট বাজারে অদ্ভুত এক দেয়াললিখন দেখা গেল। দেখে আনন্দ হলো, তেমনি বিষাদ এসেও ভর করল মনে।
দেয়াললিখনটা হলো, ‘২০ বছরে হয়নি যে সমস্যার সমাধান, তা আর হবে না এটা জেনে গেছে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের জনগণ’।
আমার কাছে ভাষ্যটি অভিনব লাগল। এভাবেও যে প্রতিবাদ করা যায়, সেটা আমার জানা ছিল না। আমার কাছে খুবই শৈল্পিক মনে হয়েছে প্রতিবাদের ধরনটি। চারদিকে যখন মার মার কাট কাট, একে ধর, ওকে জবাই কর ইত্যাদি স্লোগানের কারণে চিত্ত বিচলিত হচ্ছে, তখন এ রকম একটি শ্লেষ বা ব্যঙ্গ যে কত উচ্চাঙ্গের বার্তা দেয়, সেটা নতুন করে বলে দিতে হবে না।
খুলনার এই ২৩ নম্বর ওয়ার্ডটি কোথায়, কী সমস্যা আছে এখানে, তার কিছুই আমার জানা নেই। কিন্তু এই এলাকার মানুষ একটি নতুন ধরনের প্রতিবাদের ভাষা আবিষ্কার করেছে, এটা জেনে ভালো লাগল।
খুলনা শহরে এখন কটা সিনেমা হল রয়েছে, তা আমার জানা নেই। কিন্তু অন্তত দুটি সিনেমা হল দেখলাম, যেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিনোদনের জন্য মফস্বল শহরের সিনেমা হলগুলো অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেল কি না, সেই প্রশ্ন চাইলেও এড়ানো যাবে না। আমরা তো দেখেছি, আমাদের সাংস্কৃতিক অর্জনের অনেক কিছুই নানাভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এটাও তারই একটি লক্ষণ বলে মনে করলে ভুল হবে না। তবে এ কথাও ঠিক, সবার হাতে একটা করে স্মার্টফোন থাকায় সিনেমা দেখার চাহিদা সেখানেই মিটিয়ে ফেলা যায়। তাই দল বেঁধে সিনেমা হলে যাওয়ার উৎসবে ভাটা পড়েছে।
আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক চর্চা দিনে দিনে কমেছে, এটা সত্য। আগে যেরকম মুদিদোকানেও আধুনিক গান কিংবা সিনেমার গান বাজত, এখন কি আর সেরকম কিছু শোনা যায়? পরমতসহিষ্ণু হতে হলে সাংস্কৃতিক চর্চা মজ্জাগতভাবে রক্তের মধ্যে থাকতে হয় এবং তা গড়ে ওঠে পরিবার ও সমাজে প্রবাহিত আচার-আচরণ প্রভৃতির মাধ্যমে, সে কথা ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছে মানুষ। তাই শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের দিকেই নজর দিচ্ছেন অভিভাবকেরা, শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদের মনকর্ষণ না করে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার দিকেই নজর দিচ্ছেন এবং কখনো কখনো সেই পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য কোচিংয়ের মাধ্যমে কামিয়ে নিচ্ছেন টুপাইস।
খুলনার মানুষ কি এখনো সিনেমা দেখতে যায়? চোখের সামনেই তো অন্তত দুটি মৃত সিনেমা হল দেখতে হয়েছে। কটা টিকে আছে শহরে? পিকচার প্যালেস আর সোসাইটি নামের সিনেমা হলগুলোর জিন্দা লাশ দেখলাম রাস্তায়।
প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা রতন সেন যেখানে খুন হয়েছিলেন, সেখানে রয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে একটি ফলকে লেখা রয়েছে: ‘মানব রতন তুমি চির মানব সাথী!’
২.
শহীদ হাদিস পার্কে দ্বিতীয় দিন হাঁটতে গিয়ে ব্যায়াম করছিলেন যাঁরা, তাঁদের কথাবার্তায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়টি উঠে আসছিল। লেখার শুরুতেই বলেছি, এখন দেশে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা আসলে সময়ের ব্যবধান থেকে দেখতে হবে। নইলে মূল ঘটনা বোঝা যাবে না।
প্রধান উপদেষ্টার বাসায় যাওয়ার সামনের রাস্তাটায় কোনো ধরনের আন্দোলন করা যাবে না—এ রকম একটি নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কীভাবে সেখানে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হলো, তা নিয়ে নানা ধরনের মুখরোচক কথাবার্তা শোনা গেল। একজন বললেন, সরকার যে কাজটি করতে চায়, সেটা এই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে তাদের নির্দেশনা দিয়ে দেয়। এরপর এমন একটা ভাব করে যে চাপের মুখে পড়ে তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা পাতানো খেলা।
এ কথার প্রতিবাদও করছেন কেউ কেউ। কিন্তু এমন কাউকে কোথাও পাওয়া গেল না, যাঁরা বললেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কোনো একটা আশাবাদী ঘটনা ঘটতে দেখেছেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আওয়ামী লীগ সরকারের যেসব কাজকে ফ্যাসিবাদী বলা হয়েছিল, এ সময়েও একই ধরনের কাজ হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন তুললেন কেউ কেউ।
আওয়ামী লীগ নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল বলে যাঁরা সমালোচনা করতেন, একই ঘটনা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘটায় তাঁরা কোন মনোভাব পোষণ করেন, সেটাও জানতে চাইলেন কেউ কেউ। এবং হাস্যচ্ছলে কেউ কেউ বললেন, ‘যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ।’
৩.
কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে সেই দলকে কি কবর দেওয়া যায়? জামায়াতে ইসলামীকে কি আওয়ামী লীগ রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পেরেছে? বরং আওয়ামী লীগের রাজনীতি এই মুহূর্তে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে সেই রাজনীতি অন্য কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করবে। কোন ফর্মে সেটা আসবে, তা এখনই বলে দেওয়া যাবে না। সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় যেভাবে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে ছিল শিবিরের ছেলেরা, সেভাবেই ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগ কার ভেতরে ঢুকে যাবে, তা আগাম বলা যাবে না। জোর করে কারও মুখ বন্ধ রাখা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। প্রশ্ন হলো, এই দেশ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে কার্যক্রম চালালেও মূলত গণতান্ত্রিক অবয়বের মধ্যে নানা সময়ে স্বৈরাচার ভর করেছিল। এমন কোনো রাজনৈতিক সংগঠন দেখানো যাবে না, যাদের মধ্যে ক্ষমতার রেষারেষি নেই, অন্যকে গলা টিপে হত্যা করার প্রবণতা নেই। ক্ষমতায় থাকুক আর না থাকুক, ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ থাকলেই প্রয়োগ করা যে কত সহজ, সেই উদাহরণ দিতে খুব বেশি দূর যেতে হবে না।
৪.
আজই হোয়াটসঅ্যাপে এক মিনিট এক সেকেন্ডের একটি ভিডিও দেখে মন ভালো হয়ে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভিডিওটি। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের যেসব গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য রয়েছে, সেই ভাস্কর্যের চরিত্রগুলো নেমে এসে মানুষের কাতারে দাঁড়াচ্ছে, মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময় করছে—এই হচ্ছে মূল থিম। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে না রাশিয়া, কিন্তু সম্মিলিত সেই বিজয়কে তারা হৃদয়ে ধারণ করে। এই বিজয়ে পুরো জাতি গর্বিত।
আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, বিজয় অর্জনের পরপরই বিজয়ের পরাজয় ঘটে গেছে। আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবতা ইত্যাদি থেকে আমরা ধীরে ধীরে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছি। পশুশক্তিকেই ভেবেছি আদ্যাশক্তি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রকেই সবচেয়ে কলুষিত করেছি। মুক্তিযুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছিল, তারা একবারের জন্য ভাবেনি যে জাতির কাছে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। অথচ তাদের একসময় রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সেই বোঝা বইতে বইতে জাতি এখন আর তা নিয়ে মোটেই বিচলিত নয়। ভুলে গেছে সেসব।
জনগণের বিজয়কে কুক্ষিগত করা কারও জন্যই শোভন নয়। অথচ আমাদের জাতি বারবার সেটাও দেখেছে। শতচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিজয়ীদের ঐক্য। এবং যেকোনো জায়গায় নিজেদের ক্ষমতার প্রকাশ দেখাতে গিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকেও খেলো করে ফেলা হয়েছে। ফলে যদি কেউ মনে করে যে তরুণেরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে, তারা যা ভাববে সেটাই ঠিক পথ, তাহলে সেই ভাবনার মধ্যে কতটা সত্য থাকবে, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। কারণ, অজস্র আবর্জনার মধ্য থেকে সত্য তুলে ধরার জন্য যে প্রয়াস প্রয়োজন, তা নিজের মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে অর্জন করার পথে কজন হাঁটবে? যদি নেতৃত্বের মধ্যেই গলদ থাকে, তাহলে এগিয়ে যাওয়া খুব কঠিন।
এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে, যে সংস্কারের কথা বলা হলো, তা আসলে করবে কে? প্রশ্ন করতে পারে, মেধা ও অভিজ্ঞতার মধ্যে মিলন না ঘটলে যে অরাজকতা সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার কে নেবে? প্রশ্ন করতে পারে, ১৯৭১ সালকে মূল্য দেওয়ার ধরন দেখেই দুষ্কৃতকারীদের মতলব বোঝা যায় এবং বোঝা যায় মূলত দেশপ্রেমী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটছে কি না। এই প্রশ্নগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গায়ের জোরে যা করা যায়, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে যা করা যায়, ইতিহাসের বিচারের জন্য একসময় তা কাঠগড়ায় দাঁড়াবেই।
কিন্তু সেই বিচারের জন্য ভাবনা ও চিন্তাশীলতার যে গভীরতা প্রয়োজন, সেটা না থাকলে কী হবে, তা কেউ বিবেচনা করে দেখছে না এখনো। মূল ভয়ের কারণ সেটাই।
কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৬ জন নিহত। ভারত অভিযোগ করে পাকিস্তানের দিকে। পাকিস্তান অস্বীকার করে। পাল্টা হামলা, বিমান ধ্বংস, সীমান্তে উত্তেজনা, নিহতের সংখ্যা ৪৩। কাশ্মীরের আকাশে ধোঁয়ার রেখা যখন ক্রমে অন্ধকার করে তোলে, তখন একই সময়ে গাজার আকাশে ইসরায়েলের আগ্রাসনে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত।
৭ ঘণ্টা আগেরাজনীতি মানুষের অধিকার রক্ষার হাতিয়ার, আর আইন-আদালত মানুষের নিরাপত্তার শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু যখন এ দুই ব্যবস্থারই অপব্যবহার হয়—কখনো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, কখনো আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য—তখন তা শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকেই বিপন্ন করে তোলে।
৭ ঘণ্টা আগে৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে পালাবদলের হাওয়া বইছে। রাজপথের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবার রাজনৈতিক অঙ্গনেও এসেছে জোয়ার। একের পর এক নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ নিবন্ধনের জন্য ৬৫টি নতুন রাজনৈতিক দল আবেদন করেছে, যার অনেকগুলোই গত ৯ মাসের...
১ দিন আগেবর্তমানে বাংলাদেশে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি একটি সম্ভাবনাময় খাত। এই খাতে ‘পিকার্ড বাংলাদেশ’ তাদের দক্ষতা ও দায়বদ্ধতার মাধ্যমে বিদেশি বাজারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, বিশিষ্ট উদ্যোক্তা সাইফুল ইসলাম একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবসায়ী এবং মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী।
১ দিন আগে