Ajker Patrika

একটি বাড়ির কথা

একটি বাড়ির কথা

উত্তরের ছোট্ট জেলা পঞ্চগড়। আগে অবশ্য জেলা ছিল না। ছিল দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার একটি থানা। গত শতকের আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতায় এসে অনেকগুলো নতুন জেলা বানালে পঞ্চগড় জেলার মর্যাদা পায়। এই জেলার একটি উপজেলা বোদা। এই নামটি নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের কারও কারও আপত্তি আছে। এতে বোদাবাসী কোনো পরোয়া করে না। কারণ, এই নামের একটি ইতিহাস আছে। এক সময় ছিল নদী বন্দর। পাথরাজ ও ঝিনাইকুড়ি নদীর তীরে বোদা বন্দর। ছোটবেলায় আমরাও শুনেছি গ্রামের মানুষ বলতেন, ‘বন্দর যামো’। এই বোদার একটি বাড়ির কথা ঈদের অবসরে পাঠকদের জানানোর লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

আমাদের বালকবেলায় দূর অঞ্চলের কেউ এই এলাকায় বেড়াতে এসে যদি বোদার কোনো বিখ্যাত বাড়ির কথা জানতে চাইতেন, তাহলে তাঁকে নিশ্চিতভাবে বলা হতো ‘কারকুন বাড়ি’-এর কথা। এই বাড়ি নিয়ে কিছু কথা।

কারকুন বাড়ির কর্তা হিসেবে আমরা পেয়েছি যোগেন চন্দ্র কারকুনকে। যোগেন কারকুনের বাবার নাম ত্রৈলোক্যনাথ খাঁভাদুরী, ছোট ভাইয়ের নাম সুরেন্দ্রনাথ খাঁভাদুরী। এক পরিবারে দু-রকম পদবি হলো কী করে? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়ার লোক এখন আর পাওয়া যাবে কি-না, আমি জানি না। তবে আমার অনুসন্ধানে দুটি তথ্য বেরিয়েছে। ১. যোগেন বাবুও খাঁভাদুরী পদবি লিখতেন। কিন্তু কুচবিহার মহারাজা তাঁকে তাঁর জমিদারি তদারকির জন্য ‘কারকুন’ উপাধি দিয়েছিলেন বলে তিনি খাঁভাদুরী ত্যাগ করে কারকুন ব্যবহার শুরু করেন। ২. জনৈক কারকুন পদবিধারী জমিদার যোগেন বাবুকে তার বালকবেলায় দত্তক নিয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি কারকুন পদবি ব্যবহার করেন। ওই দত্তক গ্রহণকারীর জমিদারি যোগেন বাবু উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। তাঁর বাবার আসলে জমিদারি ছিল না।

এই দুই তথ্য নিয়ে এখন আর বিভ্রান্তি তৈরির কিছু নেই। আমরা যোগেন বাবুকে কারকুন হিসেবেই জানি এবং আমাদের কাছে তাঁর বাড়িটি কারকুন বাড়ি হিসেবেই পরিচিত।

ত্রৈলোক্যনাথ খাঁভাদুরীকে মানুষ ‘পাগলা মাস্টার’ বলে কেন ডাকত? সম্ভবত তিনি কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে কারও কারও নামের শেষে ‘পাগলা’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন ফইম পাগলা, সিরাজ পাগলা ইত্যাদি।

ত্রৈলোক্যনাথ বাবু ছিলেন পরোপকারী মানুষ। কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। অভাবী মানুষকে সহায়তা করতেন। কখনো কখনো নিজের সামর্থ্যের কথা খুব একটা চিন্তা না করেও। দুটো ঘটনার কথা বললে তাঁর পাগলামির কিছুটা নমুনা পাওয়া যাবে। বোদা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের কথা বলেছি। স্কুলের আর্থিক সংকট দেখা দিলে তিনি স্থির থাকতে পারতেন না। বলতেন, ‘বেচাও গাছ, বাঁচাও স্কুল’। তাঁদের শাল বাগান ছিল। ওই বাগান থেকে শাল গাছ বিক্রি করে স্কুল তহবিলে টাকা দিতেন। তাঁদের শাল বাগানের কিছু অংশ আমরাও দেখেছি। এখন সম্ভবত কারকুনদের শাল গাছ আর নেই।

একবার যোগেন বাবু বোদা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট পদে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। হয়তো সেটা দেশ ভাগের আগে। তখন পর্যন্ত সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা চালু হয়নি। মানুষ এক জায়গায় সমবেত হয়ে প্রার্থীর পক্ষের লাইনে দাঁড়ালে মাথা গুনে বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হতো। যোগেন বাবুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভাসাইনগরের মহিরউদ্দিন সরকার। ভোটের দিন দেখা গেল দুই প্রার্থীর লাইনে সমানসংখ্যক মানুষ দাঁড়িয়েছেন। যোগেন বাবুর বাবাকে এই খবর দেওয়া হলো। তিনি ভোট দিতে যাননি। তিনি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ছেলের লাইনে দাঁড়ালেই ছেলে প্রেসিডেন্ট; অর্থাৎ, চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন। ত্রৈলোক্যনাথ বাবু দৌড়াতে দৌড়াতে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সময় বলছিলেন, ‘এক দিকে পুত্র, আর একদিকে ছাত্র। এখন কী করি?’

সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে তিনি গিয়ে মহিরউদ্দিন সরকারের লাইনে দাঁড়ালেন। ফলে তিনি বিজয়ী হলেন। যোগেন কারকুন পরাজিত হলেন। ত্রৈলোক্য বাবুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘পুত্র তো প্রেসিডেন্ট হলেও আমার, না হলেও আমার। কিন্তু ছাত্রও যে আমার, সেটা প্রমাণের আর উপায় কী ছিল?’ এমন মানুষকে ‘পাগলা’ না বলে কী বলা হবে!

বাবার রক্তের ধারা বহন করছিলেন বলে যোগেন বাবুও কিছুটা কম বৈষয়িক ছিলেন বলেই মনে হয়। তিনি ছিলেন খুব শৌখিন ও রুচিবান মানুষ। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ ছিল। বাড়িতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। তিনি নিজেও একসময় মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তাঁর বই পড়ার বাতিক এবং বাড়িতে বইয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহশালার কথা আগেই বলেছি। আর একটি কাজ তিনি করতেন, সেটা হলো ভ্রমণ। জীবনের প্রথম ভাগে তিনি ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করেছেন।

আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, কারকুন বাড়ি ছিল যেন বোদার অনেকের ‘ফুসফুস’। কারকুন বাড়ি কারও কারও কাছে ছিল মন ভালো করার ‘যন্তরমন্তর’। ওই বাড়িতে যাওয়া এবং পাতপেড়ে খাওয়া ছিল একটি নিত্য ঘটনা। কারকুন বাড়িতে গেছেন, অথচ কিছু না খেয়ে এসেছেন—এটা অবিশ্বাস্য। আমারও ছিল অবাধ যাতায়াত। কারণ, কারকুন-গিন্নি, ঊষারানী কারকুন ছিলেন আমার পিসিমা। মার চেয়ে আপনার মাসিমা নয়, মার চেয়ে আপনার পিসিমা। কীভাবে তিনি আমার পিসি হলেন? আমাদের তো কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। তাহলে?

আমার বাবা-কাকারা ছিলেন তিন ভাই। তাঁদের আপন কোনো বোন ছিল না। সে হিসেবে আমার কোনো পিসি থাকার কথা নয়। তারপরও কারকুন বাড়ির ঊষারানী কারকুন, যোগেন চন্দ্র কারকুনের স্ত্রী, আমার পিসি হয়েছিলেন। আমার বাবা-কাকার কাকাতো বোন, আমার সুনীতি পিসির সঙ্গে ছিল তাঁর দারুণ হৃদ্যতা, বোনের মতো। পিসির বোন, তাই আমারও পিসি। আমার এই পিসি হলেন বোদার কার্তিক সরকার, জ্যোতিষ সরকারের মা। আমার পিসা মহাশয়ের নাম শরৎচন্দ্র সরকার। তিনি ছিলেন আবার যোগেন কারকুনের ভাইতুল্য। এই দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা, যোগাযোগের সূত্রেই আমাদের সঙ্গেও কারকুন পরিবারের পরিচয় ও প্রায়-আত্মীয়তার মতো সম্পর্ক।

কারকুনবাড়ির সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল না—এমন মানুষ অবশ্য সে সময় খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। ওই বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল বোদার গণ্যমান্য বলে পরিচিত সবারই। যোগেন বাবু মিশুকে স্বভাবের ছিলেন। তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। ব্রাহ্মণ হলেও তাঁর মধ্যে কোনো গোঁড়ামি ছিল না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার অবাধ যাতায়াত ছিল কারকুন বাড়িতে। ওই বাড়ির সবাই ছিলেন আধুনিক ও উদার মনের মানুষ। অথচ এই যোগেন বাবুকেও একবার (ষাটের দশকের মাঝামাঝি) বোদা হাইস্কুলের কিছু উগ্র ছাত্রের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল।

যোগেন কারকুন ছিলেন বোদা হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। কমিটির কোনো এক সভায় তিনি নাকি ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তার জের ধরে কয়েকজন শিক্ষক কিছু ছাত্রকে উসকে দিয়েছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে।

কারকুন পরিবারের একটি ট্র্যাজেডি হলো অতি রূপবতী-গুণবতী হওয়া সত্ত্বেও ওই বাড়ির মেয়েদের বিয়ে না হওয়া। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘অতি বড়ো ঘরনি না পায় ঘর, অতি বড়ো সুন্দরী না পায় বর’। কারকুন বাড়ির দিদিদের দেখেও আমার তাই মনে হতো। কিন্তু ব্যতিক্রম একটি ঘটেছিল, যেটা আবার পরিবারকে ফেলেছিল লজ্জায়। ষাটের দশকের শেষ দিকেই কারকুন বাড়ির দ্বিতীয় কন্যা, আমাদের ইরাদি (ইরা রাণী কারকুন) পালিয়ে বিয়ে করলেন বোদা থানা সার্কেল অফিসারকে (উন্নয়ন)। তখন মানুষ বলত সিও (ডেভ.)। আব্দুর রৌফ চৌধুরী ছিল সম্ভবত ভদ্রলোকের নাম। ইরাদির এই বিয়ে ছিল তখন এক ব্যাপক আলোচিত বিষয়। কারকুন পরিবার বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেনি।

মেয়ের এভাবে বিয়ে করা এবং ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার দুটি ঘটনা সম্ভবত যোগেন পিসা মহাশয়কে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। মানসিকভাবে দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন। এর পর তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বাজারে আসা-যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছিলেন। ঝড়ে বিশাল বৃক্ষ উপড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল তাঁর।

যোগেন কারকুন মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আগে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি এবং আমার প্রিয় বন্ধু বিজন দত্ত সকালেই ছুটে গিয়েছিলাম কারকুন বাড়িতে। তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল তুলসিতলায়। বিশাল দেহের সৌম্যকান্তি মানুষটির অমন শয্যা দেখে আমার ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠেছিল। তার আগে আমি কখনো কোনো মরদেহ দেখতে যাইনি। সে হিসেবে ওটাই আমার প্রথম কোনো মৃতদেহ দেখা। প্রাণহীন একজন মানুষকে ভূমিশয্যায় দেখে আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছিল এবং আরও যে বিচিত্র অনুভূতি হয়েছিল, তা এখন আর বর্ণনা করতে পারব না। জীবন-মৃত্যুর যিনি নিপুণ কারিগর সেই বিশ্বস্রষ্টার প্রতি আমার মধ্যে আগে থেকেই ছিল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। একজন প্রিয় ও পছন্দের মানুষের মৃত্যুর পর বিশ্বস্রষ্টার অপার ক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্বাস যেন কিছুটা হলেও বেড়েছিল। সংসারের কর্তা চলে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই সব দায়িত্ব পিসিমার কাঁধে বর্তায়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংসারের হাল ধরেছিলেন।

যোগেন কারকুনের মৃত্যুর অল্প পরেই শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দেশীয় সহযোগী-অনুচরদের হত্যা-নির্যাতনের মুখে অসংখ্য মানুষকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। বোদা থেকেও আমরা অনেকেই বাধ্য হয়েই ভারতে গিয়ে শরণার্থীর জীবন বেছে নিয়েছিলাম। পাকিস্তানিদের আক্রমণের প্রধান টার্গেট ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক জনগোষ্ঠী। কারকুন বাড়ি দুই কারণেই টার্গেট ছিল। তারা একদিকে হিন্দু এবং অন্যদিকে বাড়ির বড় ছেলে অনুপ কুমার কারকুন দুলাল ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী, স্বাধীনতার পক্ষের একজন সংগঠক।

যেদিন বোদা প্রথম পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে যায়, সেদিনই তিনজনকে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের একজন আমার দাদাশ্বশুর (পরবর্তী সময়ে) যতীন্দ্র মোহন সাহা। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বোদার প্রথম শহীদ। তার পর হত্যা করা হয়েছিল বোদার তখনকার পোস্টমাস্টার আব্দুল মান্নানকে। তৃতীয় যাঁকে হত্যা করা হয়, তিনি আব্দুল লতিফ। লতিফ মেম্বর বলেই তাঁকে সবাই চিনত। তিনি পাকিস্তানিদের সহযোগী হয় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িঘর, দোকানপাট চিনিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কেন পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা একটা রহস্য। কিছু দালাল হত্যা করে পাকিস্তানিরা বোধ হয় বুঝিয়েছিল যে, বিশ্বাসঘাতকদের বেঁচে থাকার অধিকার না থাকাই ভালো। পাকিস্তানিরা বোদা বাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল ব্যাপক লুটপাট। আমাদের একটি গালা মালের দোকান ছিল। দোকানের সব মালামাল লুট হয়েছিল মুহূর্তের মধ্যে। ওই লুটেরার দল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরেই লুটপাট অব্যাহত রেখেছিল। আমার পরিবারের সবাই বলতে গেলে এক বস্ত্রে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বের হয়ে আর ফিরে আসা হয়নি। আমাদের তখনকার বাড়িটি ছিল দিনাজপুর-পঞ্চগড় হাইওয়ের পাশে পাথরাজ ব্রিজের পশ্চিম প্রান্তে আখ ক্রয়কেন্দ্রের লাগোয়া। আমাদের বাড়িটি একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কারকুন বাড়ির ছেলেমেয়েরা দেশত্যাগ করলেও পিসিমা, ঊষারানী কারকুন জেদ ধরলেন তিনি কিছুতেই সদ্যপ্রয়াত স্বামীর ভিটা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র লুট হয়েছে। পাড়াপড়শিরাও লুটে অংশ নিয়েছে। রান্না-খাওয়ার বাসনকোসনও লুট হয়েছে। কিন্তু তাঁকে ভিটে ছাড়া করা যায়নি। তাঁর জেদ কিংবা মনোবলের কাছে ভয়ভীতি পরাজিত হয়েছিল।

তাঁকে হত্যার জন্য রাজাকার কমান্ডার চন্দনবাড়ির হবিবর রহমান একদিন কারকুন বাড়ি গিয়েও উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। পিসিমা আগেই টের পেয়ে ঘর ছেড়ে বাড়ির পেছন দিকের ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়েছিলেন। তাঁকে খুঁজতে ওই ঝোপের দিকেও গিয়েছিলেন হবিবর রহমান। তিনি পিসিমাকে দেখতেও পেয়েছিলেন। রাইফেল তাক করে গুলি ছোড়ার আগে একটি সাপ তার দিকে ছোবল হানতে গেলে প্রাণভয়ে তিনি দৌড়ে পালান। জীবন রক্ষা হয় পিসিমার।

হবিবর রহমান ছিলেন আনসার কমান্ডার। সে জন্য তাঁকে মানুষ হবিবর কমান্ডার বলেই জানত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তাঁকে কেউ ভয়াবহ চরিত্রের মানুষ বলে মনে করত না। ২৬ বা ২৭ মার্চ ঠাকুরগাঁও ইপিআর ছাউনি থেকে পালিয়ে আসা একজন পাকিস্তানি সৈনিককে পাকড়াও করে বোদা হাইস্কুল মাঠে বহু মানুষের উপস্থিতিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। যারা গুলি করেছিলেন, তাদের মধ্যে হবিবর কমান্ডারও ছিলেন। তিনি একসময় যাত্রা-নাটকে অভিনয় করতেন। বেশ হাসি-খুশি প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার বাবা-কাকাদের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। আমি তাঁকে চাচা বলতাম। তিনিও আমাকে নাম ধরে না ডেকে ‘বাবাজি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমরা বন্ধুরা স্কুলে পড়ার সময়ই কিছুদিন বেশ নাটক পাগল হয়ে উঠেছিলাম। এক বছর আমরা চারটি নাটক মঞ্চস্থ করেছি। হবিবর চাচা দু-একটি নাটক নির্দেশনা বা পরিচালনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। মনে আছে, রিহার্সালের জায়গা না পেয়ে আমরা রাতের বেলা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে পাথরাজ ব্রিজের ওপরও রিহার্সাল করেছি। তখন অবশ্য জায়গাটি এখনকার মতে ঘিঞ্জি ছিল না।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হবিবর রহমান হয়ে ওঠেন এক ভয়ংকর মানুষ। বোদায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের মধ্য তাঁর নাম ওপরের দিকেই রাখতে হবে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকার পর একসময় প্রকাশ্যে আসেন এবং বোদায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাড়ি ছিল বোদা বাজার থেকে কয়েক মাইল দূরের চন্দনবাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালন সত্ত্বেও স্বাধীন দেশে প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিনি বোদা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান বোদা গেলে তাঁর সভামঞ্চে হবিবর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন। আবার ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ ফরহাদের পক্ষাবলম্বন করে আমাদের লজ্জায় ফেলেছিলেন।

হবিবর কমান্ডার কারকুন-গিন্নিকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর ওপর উপদ্রব একটু কমে আসে। একজন পাকিস্তানি মেজরও তাঁর দেশ ছেড়ে না যাওয়ার কথা শুনে তাঁকে দেখতে আসেন। ওই মেজরও তাঁকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমি পরবর্তী সময়ে জেনেছি যে, পিসিমাকে গোপনে নানাভাবে সাহায্য করেছেন মাঝগ্রাম নিবাসী দবিরউদ্দিন হাজী সাহেব। চাল-ডাল, এমনকি হাড়িপাতিলও দবির চাচাই কারকুন বাড়িতে সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোতে পাঠাতেন। আজিজার রহমানও (যিনি পরে বোদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন) গোপনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, খোঁজ-খবর দিতেন। শত্রুকবলিত দেশে পিসিমা শত্রুর সঙ্গে মিত্রও পেয়েছিলেন। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। সবাই শত্রু ছিল না, আবার মিত্রও সবাই নয়। আমরা আজ শত্রু-মিত্র একাকার করে এক বিপন্ন অবস্থা তৈরি করেছি।

কারকুন বাড়ির সামনের পুকুর এবং মন্দির নিয়ে কিছু মিথ বা কাহিনি শোনা যায়। মন্দিরে শিবের মূর্তি ছিল। সে জন্য শিব মন্দির হিসেবেই ওটা পরিচিতি পেয়েছিল। বোদার হিন্দু নারীরা ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশীর রাতে সমবেতভাবে ওই মন্দিরে পূজা অর্চনা করতেন। শিব রাত্রিতে ভক্তরা যে বাসনা করেন, তা নাকি ভগবান শিব পূরণ করেন। এই মন্দিরে পূজা দিয়ে অনেকেরই নাকি মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। সে জন্য ওই মন্দিরকে একসময় জাগ্রত মন্দির বলা হতো। তবে এখন সে রামও নেই, নেই সে অযোধ্যাও। পাকিস্তান আমলেই একবার মন্দির থেকে শিবের বিগ্রহ চুরি যাওয়ায় ভক্তরা খুবই অসহায় বোধ করেছিলেন। অবিশ্বাসীরা তখন শিবের ‘ক্ষমতা’ নিয়ে বিদ্রূপ করতেও দ্বিধা করেননি! মন্দিরটি কিছুটা জীর্ণ দশা প্রাপ্ত হলেও এখনো শিবরাত্রি পালনের জন্য বিপুলসংখ্যক হিন্দু নারী ওই মন্দিরে সমবেত হন। ব্রত পালন করেন।

কারকুন বাড়ির সামনের পুকুর বা দিঘিটি কত বছর আগে খনন করা হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য জানা না গেলেও বোদার প্রবীণ লোকদের ধারণা, কমপক্ষে দুই শ বছর আগে পুকুরটি খনন করা হয়ে থাকতে পারে। প্রায় ১৮ বিঘা জমির ওপর ওই বিশাল পুকুরটি একসময় হয়তো শুধু কারকুন বাড়ি নয়, স্থানীয় বাসিন্দাদেরও দৈনন্দিন জলের সমস্যা মেটাত। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, পুকুরের পাড়জুড়ে কত গাছগাছালি। পুকুরে তখনো ছিল গভীর জল। পুকুরজুড়ে শাপলা ও পদ্ম যখন ফুটত, তখন চমৎকার লাগত দেখতে।

নানা গল্প চালু আছে এই পুকুর নিয়ে। একসময় নাকি মানুষের পূজা-পার্বণ কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানাদির জন্য থালা-বাসন দরকার হলে ওই পুকুরপাড়ে চাহিদাপত্র দিলে পুকুরই তা সরবরাহ করত। মানুষ প্রয়োজন শেষে সেগুলো আবার পুকুরে দিয়ে আসত। আমরা অবশ্য এমন মানুষের সন্ধান পাইনি, যে বা যারা পুকুর থেকে বাসনকোসন নিয়ে প্রয়োজন মিটিয়েছেন! মানুষ এসব ‘গল্প’ একটা সময় পর্যন্ত বিশ্বাস করত বলেই এগুলো চালু ছিল। এখন বিশ্বাস করে না বলেই শোনা যায় না। কথায় আছে: বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহু দূর।

আচ্ছা, শুধু বিশ্বাসের ওপর ভর করে কি সত্যি কিছু অর্জন করা যায়? আমরা কিছু হলেই ‘দোয়া’ ‘প্রার্থনা’ করি। দোয়া কি কাউকে রোগ বা বিপদমুক্ত করতে পারে? জানি না। তবে দোয়ার সঙ্গে ‘দাওয়া’ বলেও একটা কথা আছে। দোয়ার গুণের চেয়ে দাওয়ার গুণ টের পাওয়া যায় বেশি।

কারকুন বাড়িতে আম-কাঁঠালের অনেক গাছ ছিল। ঝড়ের দিনে শুধু মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ ছিল না, কারকুন বাড়িতেও সে সুখ ছিল। কারকুন বাড়ির ব্যাপার ছিল আরও আলাদা। গাছেরটা খাওয়া এবং তলারটা কুড়ানো—দুটোই চলত। অর্থাৎ, যেগুলো গাছ থেকে ঝরে পড়ত সেগুলো যেমন যে কেউ নিতে পারত, তেমনি গাছের পাকা ফলও চাইলেই পাওয়া যেত। কারকুন বাড়ি থেকে পাকা আম-কাঁঠালের বোঝা আমিও বহন করেছি।

আমাদের ছোটবেলার সময়টা ছিল অন্য রকম। বাড়ি, পরিবার, গ্রামগুলো কেমন সুন্দর মমতায় জড়ানো ছিল। মানুষের মনে এবং চোখে অন্ধকার ছিল। অর্থাৎ, শিক্ষিতের হার কম ছিল, আবার বিদ্যুৎও ছিল না। চোখের অন্ধকার দূর করত কেরোসিনের বাতি। কিন্তু মনের অন্ধকার? সেটা ছিল বলেই মানুষ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করত। জিন-ভূতের গল্প বেশি শোনা যেত। এই পথে সন্ধ্যায় যাওয়া যাবে না—ভূতের ভয় আছে, এই পুকুরের এই ক্ষমতা আছে—এসব মানুষ অবলীলায় বিশ্বাস করত।

এখন মানুষের মন এবং চোখ দুটোতেই আলো। কিন্তু কোনো কোনো মানুষকে পেয়ে বসছে এক নতুন ধরনের অন্ধত্ব, যার নাম ধর্মান্ধতা। আমাদের সেইকালে ধর্মবিশ্বাস ছিল, ধর্মান্ধতা ছিল কম। সে জন্য চমৎকার সম্প্রীতির পরিবেশ ছিল। কারকুন বাড়ি ছিল সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের এক মিলনক্ষেত্র।

কারকুনবাড়ির অনেক কিছুই আজ আর নেই। জীবন কারকুন এবং অচিন্ত্য কারকুন—দুই ভাই দিদি শর্বাণীকে নিয়ে আছেন। শর্বাণীদির বিয়ে হয়নি। কিন্তু জীবন-অচিন্ত্য বিয়ে করেছে। জীবনের এক পুত্র সন্তান, অচিন্ত্যর তিন মেয়ে। ওরা নিশ্চয়ই এখন এক হাঁড়িতে খায় না। কত দিন ওই বাড়িতে যাই না। বছর তিনেক আগে বোদা গিয়ে বন্ধু বিজন দত্তকে নিয়ে কারকুন বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে এসেছি। কিন্তু ভেতরে ঢুকিনি। একসময়ের প্রাণময় বাড়িটি কেমন নিষ্প্রাণ মনে হলো। জীবন সম্ভবত আগের ভিটায় আছে। অচিন্ত্য সামনের দিকে নতুন পাকা বাড়ি বানিয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অচিন্ত্য ছিল আমার প্রয়াত ছোট ভাই নিরঞ্জনের ক্লাসফ্রেন্ড। ওরা খুব ভালো বন্ধু ছিল।

আগে বাড়িতে গেলে শোনা যেতো প্রাণের স্পন্দন, এখন মনে হয় ঘুমঘোর।

ভেতরের লম্বা ঘরটি, যেটার বিভিন্ন কক্ষে মাসিমা এবং দিদিরা থাকতেন, সেটাও সেভাবেই আছে, নাকি সেখানেও নতুন ঘর উঠেছে, জানি না। বাইরের পরিবর্তন দেখে মনে হয়েছে, ভেতরেও নিশ্চয়ই অনেক অদলবদল হয়েছে।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো, সেই নানা গল্পগাথার পুকুরটি আর আগের মতো নেই। যে পুকুর খননের সময় পানি না ওঠায় নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নরবলি দিতে হয়েছিল, যে পুকুরের মাঝখানে নাকি ছিল একটি রহস্যময় বড় সিন্দুক জাতীয় কিছু, সেই পুকুরের ওপর দিয়ে এখন হয়েছে মহাসড়ক। পুকুরটি দুই ভাগ হয়েছে, ছোট হয়েছে। আগে পুকুরপাড়ে গেলে কখনো কখনো যেমন গা ছমছম করত, এখন আর তা করে না। অসংখ্য মানুষের যাতায়াত, যোগাযোগ সহজতর করার জন্য একটি পরিবারের ঐতিহ্য, স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করা হয়েছে। এটাই বোধ হয় আধুনিক সভ্যতার নিয়ম। পুরাতনকে আঁকড়ে থাকা নয়, নতুনকে আবাহন করাই যেন প্রগতি ও অগ্রগতির লক্ষণ।

কারকুন বাড়ির বড় ছেলে অনুপ কারকুন, আমাদের দুলালদা, যিনি ছোট-বড় সবার কাছেই একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন, সবাইকে ছেড়ে শেষ বিদায় নেন ১৯৮১ সালে। প্রায় দশ বছরের ব্যবধানে পিতা ও পুত্রের মৃত্যু কারকুন বাড়িতে ভাঙনের যে সুর বাজিয়েছিল, তা কিছুটা দূর হয়েছে ছোট দুই কারকুন বিয়ে করে সংসার শুরুর পর।

পিসিমা, ঊষারানী কারকুন বেঁচে থাকতে ওই বাড়িতে আগের ধারা, মানুষের যাতায়াত, আহার-বিহার অব্যাহত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর সে রকম আছে কি-না, জানি না। পিসির মৃত্যু হয়েছে ২০০৪ সালে। কী আশ্চর্যের ব্যাপার যে, তাঁর বিদায়ের দিনেও আমি বোদায় ছিলাম এবং বিজনকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম।

কারকুন বাড়ির দুই উত্তরাধিকার জীবন ও অচিন্ত্য ওদের ছেলেমেয়ে নিয়ে আর আগের অবস্থায় যেতে চায় কি-না, যেতে চাইলেও আর যেতে পারবে কি-না, জানি না। 

শর্বাণী কারকুন, আমাদের বাণীদি, কত দিন তাঁকে দেখি না। কত দিন তাঁর আপ্যায়নবঞ্চিত। কেমন আছেন বাণীদি? বয়স কি তাঁর সৌন্দর্য আড়াল করতে পেরেছে? এর পর বোদা গেলে বাণীদিকে অবশ্যই এক নজর দেখে আসব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মসজিদে আমির হামজাকে রাজনৈতিক আলোচনা করতে নিষেধ করায় লাঞ্ছিত বিএনপি নেতা

বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারীর মৃত্যু, মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ

বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে আগ্নেয়াস্ত্রভর্তি ট্রলি ব্যাগ উদ্ধার

তিন ঘণ্টা পর আংশিক চালু মেট্রোরেল

ঘুষ হিসেবে পাকা কলা নেওয়ার কথা স্বীকার, দুদকের গণশুনানিতে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সাক্ষাৎকার

এখন একটা আজব পরিস্থিতি বিরাজ করছে

ডা. মুশতাক হোসেন

ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ—এ চারটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার কারণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৭: ৫৩

আপনারা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নিলেন? আপনাদের মূল আপত্তিগুলো কী ছিল?

আমাদের প্রথম আপত্তি ছিল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত সংযুক্ত না করা। যেসব বিষয়ে সবাই মিলে একমত হয়েছি বা মোটামুটি একমত হয়েছি, সেসব যুক্ত করা ছাড়া আমরা স্বাক্ষর করব না। যেহেতু ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ কিছু বিষয়ে আপত্তি ছিল, সেটা স্বাক্ষর করলে তো মেনে নেওয়া হতো। সেটা জাতীয় সংসদে হলে অন্য কথা ছিল বা কোনো রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেটা হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সেটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন সে রকম কোনো ফোরাম না। এটা হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্যে আসার জন্য একটা চেষ্টা, একটা উদ্যোগ।

জুলাই সনদ তৈরি করার সময় এর পটভূমি ধরে আমরা ইতিহাসকে সঠিকভাবে লেখার জন্য বারবার ইনপুট দিয়েছি। আমাদের দলসহ অন্য দলের নেতারা সেটা বলেছেন। কিন্তু সনদে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকে পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ছোট ছোট অনেক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা কীভাবে এল, সেটা তো থাকা দরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তো থাকতে হবে। যদিও বিশাল আকারে ইতিহাস লেখার জায়গা এটা না। শেষে আসবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা। এর মধ্যে মাঝখানের ঘটনাগুলো শুধু উল্লেখ করলেই চলত। সেটা তো করা হয়নি। যাঁরা খসড়াটি করেছেন, তাঁদের আমি অবশ্যই অযোগ্য বলব না। একেকজনের কথায় একেকটা বিষয় ঢুকে গেছে। কারও সঙ্গে তাঁরা বিতর্ক করেননি। ফলে আমাদের বক্তব্যগুলোকে বেমালুম বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মনে করেছেন, আমাদের বক্তব্য বাদ দিলে বুঝি কোনো সমস্যা হবে না। আবার কোনো কোনো দল যা-ই বলেছে, সেটাই তাঁরা রেখেছেন; যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বক্তব্য একপেশে হয়েছে।

আবার অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের কথা হলো, এই সনদ পরিপূর্ণ হলে সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলো লিপিবদ্ধ থাকত। কিন্তু সেসব রাখা হয়নি। সনদের ভেতরে আবার তাঁরা লিখেছেন—যে দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়া কাজ করতে পারবে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, তারাও তো কাজ করবে। তারা প্রয়োজনবোধে একমত না হলে সংসদ ত্যাগ করবে। নতুবা সংসদের বাইরে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের কাছে মতামত তুলে ধরবে। এসব তো ম্যান্ডেট পাওয়া না-পাওয়ার ওপর নির্ভর করে না।

এটা তো বিএনপির ভাষা। বিএনপি মনে করে, তারা ম্যান্ডেট নিয়ে আগামী সংসদে যাবে। সেটা ভালো কথা। কিন্তু আমরা ম্যান্ডেট পাব কি পাব না সেটা ভিন্ন কথা। আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি চুপ না থাকার জন্য। আমরা যেমনভাবে সংসদের ভেতরে কথা বলব, তেমনি সংসদের বাইরেও কথা বলব। আমরা আবার রাজপথে আন্দোলনও করব। সবকিছু মিলিয়ে আমরা কয়েকটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করিনি।

তবে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি, যেসব বিষয়ে আমরা সহমত জ্ঞাপন করেছি (সেটার রেকর্ড আছে) সেটা খুব ভালো কাজ হয়েছে। আমরা ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই যে সাংবিধানিক প্রশ্ন, আইনের প্রশ্নসহ সংস্কার নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে তারা একটা ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করতে পেরেছে। এই দলিল থেকে বোঝা যাবে, কোন দলের কী দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু আমরা বলেছি, গায়ের জোরে সংবিধান বাতিল করার দাবি—এটা অসাংবিধানিক অপরাধ। আমরা মনে করি, সংবিধান বাতিল করার দাবি তোলা যাবে এবং নতুন সংবিধান করার দাবিও তোলা যাবে—সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ হবে না। কিন্তু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যদি বাতিল করতে চায়, সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ। তারা ৭ (ক) ধারার বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। এটা নিয়ে আমরা আপত্তি করেছি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষে আমরা পিআর পদ্ধতির পক্ষে, কিন্তু দুই বাসদ ও সিপিবি উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে না।

তবে আমরা যে কয়েকটি বাম দল এসব বিষয়ে একমত হয়েছি, আমরা আগামী দিনে সংসদের ভেতরে ও বাইরে এসব নিয়ে সংগ্রাম এবং রাজনৈতিকভাবে জনমত গঠনের কাজ করব। সেটা আমরা অঙ্গীকার করেছি।

এরপর আপনারা একটা স্মারকলিপি দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কারণ কী?

আমরা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলাম না, সেটা নিয়ে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করেছি। সেই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যটা আমাদের দুজন প্রতিনিধি হাতে হাতে ঐকমত্য কমিশনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

স্মারকলিপি দেওয়ার পর ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য কী?

তারা বলেছে, আপনারা অনেক কষ্ট করে, সময় নিয়ে বক্তব্য বা নোট দিয়েছেন, আপনারা এটার অংশীদার হন। আমরা বলেছি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে কেন আমরা আত্মসমর্পণ করব মৌলিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে? বিএনপি যেমন প্রত্যাশা করছে, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। তারাসহ তাদের মিত্ররা দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাবে। তারা যেসব নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলোতে তারা পক্ষে নিতে পারে। কিন্তু সংসদে যাওয়ার আগেই আমাদের মেনে নিতে হবে, সংবিধান বাতিলের ১৪ ধারা রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ না, নারী ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের দরকার নেই, সংবিধানের ১৫০ (২) ধারা মতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ না থাকা—এ বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে তো আমরা সনদে স্বাক্ষর করে দাসখত দিতে পারি না। এই ফাঁদেও পা দিতে পারি না। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এসব বিষয় যদি সংশোধন না করা হয়, তাহলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারি না।

এনসিপি সনদের বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্ন নিয়ে স্বাক্ষর করেনি। এটাকে আপনারা কীভাবে দেখেন?

তাদের তো সনদ নিয়ে কোনো দাবি নেই। তারা সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। আমাদের তো সনদের খসড়া নিয়েই আপত্তি। কিন্তু তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা শুধু বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিতর্ক তুলে স্বাক্ষর করেনি।

আপনি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন। সে সময়ে তিন জোটের রূপরেখাকে পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন কোনো দলই গুরুত্ব দেয়নি। এখন আপনি জুলাই সনদ নিয়ে কতটা আশাবাদী?

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখাকে নির্দিষ্ট করে সংবিধানের সঙ্গে আপগ্রেড করা হয়নি। সে সময় যে তিনটি জোট এই রূপরেখাতে স্বাক্ষর করেছিল, তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার অনেক কিছুই মানেনি। তারা সেখানকার রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। তা ছাড়া, এটার কোনো আইনি রূপও দেওয়া হয়নি। কথা ছিল তারা পরস্পরের প্রতি কোনো বৈরী আচরণ করবে না। সেই রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করার জন্য এক দল অন্য দলের প্রতি বিরূপ আচরণ করেছে। এগুলোকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক আচরণ বা সাংবিধানিক আইন মেনে চলা বলা যায় না।

কিন্তু এবারের জুলাই সনদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এর ধারা ও উপধারা ধরে বিতর্ক করে কে পক্ষে আছে আর কে বিপক্ষে আছে, তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। সে কারণে বলতে চাই, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখার সঙ্গে এবারের জুলাই সনদটা অনেক অগ্রসর দলিল বলতে হবে। কোনো দল যদি এর কোনো বক্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে পালন করতে না চায়, তাহলে সব রাজনৈতিক দল তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। জুলাই সনদ একেবারেই সুনির্দিষ্ট। কিন্তু নব্বইয়ের রূপরেখা এভাবে সুনির্দিষ্ট ছিল না। আবার সেই রূপরেখার মধ্যে কোনো গভীরতা ছিল না। তারপরেও যে কিছু হয়নি, সেটা বলা যাবে না। কারণ, নব্বইয়ের পরে সব দল কিন্তু সংসদীয় সরকার পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে সেই সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার পরেও নানা অঘটন ঘটেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতি আসলে কোন দিকে যাচ্ছে?

এখন দ্রুত দরকার একটা সংসদ নির্বাচন করা। যে নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। এখন কোনো জবাবদিহি করা যাচ্ছে না। আমরা যেভাবে গত স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পেরেছি, এখন কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তা করতে পারছি না। এখন কোনো বিষয়ে সরকারের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করলে তারা বলে, কোনো কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আবার পুলিশও একই কথা বলছে।

রাজনৈতিক দলগুলো দেশটাকে ভাগাভাগি করার মতো করে কথা বলছে। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, আবার সবাই মিলে ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এখানে এখন একটা আজব পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা এ সরকার দিতে পারছে না। এ জন্য নির্বাচন করা দরকার। যদিও সুষ্ঠু নির্বাচন করা নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তারপরও নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তখন আমরা একটা রাজনৈতিক ব্যাকরণের মধ্যে প্রবেশ করতে পারব।

নির্বাচিত সরকার ভালো কাজ করলে পক্ষে থাকব আর মন্দ কাজ করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। আগে থেকে বলা সম্ভব নয়, যারা দায়িত্বে থাকবে তারা কতটুকু পারছে বা পারছে না। তারা যদি জনগণের পক্ষে না থাকে, তাহলে প্রয়োজনে আগাম নির্বাচন দাবি করব।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মসজিদে আমির হামজাকে রাজনৈতিক আলোচনা করতে নিষেধ করায় লাঞ্ছিত বিএনপি নেতা

বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারীর মৃত্যু, মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ

বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে আগ্নেয়াস্ত্রভর্তি ট্রলি ব্যাগ উদ্ধার

তিন ঘণ্টা পর আংশিক চালু মেট্রোরেল

ঘুষ হিসেবে পাকা কলা নেওয়ার কথা স্বীকার, দুদকের গণশুনানিতে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ঢাকার অন্য খালগুলোও তো এমন সুন্দর হতে পারে

মৃত্যুঞ্জয় রায় 
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৮: ০৮
কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে সুশোভিত নিকুঞ্জ খাল। ছবি: লেখক
কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে সুশোভিত নিকুঞ্জ খাল। ছবি: লেখক

কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত। আহা, কী পরিষ্কার সেই খালের জল, কোথাও একটা শুকনো পাতা পড়ে নেই জলের ওপর। খালের পাড়ে স্বর্ণচাঁপা, বকুল, কাঠবাদাম, চালতা, ছাতিম গাছগুলোর ছত্রবৎ পত্রাচ্ছাদন, গোড়া বাঁধানো নারকেলগাছের সারি। খালের জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, লাফ দিচ্ছে মাছেরা। মাঝে মাঝে পাড়ে রয়েছে জলের ওপর বাড়ানো জেটির মতো রেলিংঘেরা পাকা চাতাল, যার ওপর দাঁড়িয়ে জলের কাছে যাওয়া যায়, খালের জলে বড়শি ফেলে মাছ ধরা যায়। ওপরে হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশ, রোদের ঝিলিক। খালের পশ্চিম পাড়ে একটি অভিজাত এলাকার মনোরম ভবন। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন ঢাকা শহর নয়—নেদারল্যান্ডসের কোনো এক জায়গা।

নেদারল্যান্ডসের গিথুর্ন গ্রামের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা হয়তো জানেন, সেই গ্রামে গাড়ি চালানোর মতো কোনো রাস্তা নেই, আছে গ্রামজুড়ে চলাচলের জন্য চমৎকার খাল আর হাঁটার পথ। একটা গ্রামে কোনো গাড়ির রাস্তা নেই, খাল ও খালের ওপর আছে ১৭০টির বেশি সেতু। বৈদ্যুতিক নৌকায় করে সেই গ্রামের অধিবাসীরা এখান থেকে সেখানে যায়। আহা, গাড়ি ও জ্বালানির দূষণমুক্ত কী শান্ত মনোরম সে গ্রাম! খালের পাড় বাঁধানো, দুই পাড়ে থাকা অনুচ্চ ঘরবাড়ি, আঙিনার কোথাও কোনো খোলা মাটি নেই, পুরোটাই সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসে ঢাকা, মাঝে মাঝে ফুলগাছের ঝোপ। যেন সে এক স্বপ্নের জায়গা, পৃথিবীর বুকেই স্বর্গের শোভা। ঢাকার এ জায়গাটি দেখেও সেই গিথুর্ন গ্রামের ছবিটা চোখে ভাসছিল। ধন্যবাদ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে—নিকুঞ্জ খালের এমন সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য।

আহা রে, ঢাকা শহরের সব খাল যদি এরূপ সুন্দর হতো! এ কথা ভাবতেই মনের মধ্যে ভেসে উঠল এর বিপরীত দৃশ্য। খাল দখল করতে করতে সেগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যতটুকু অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও হয়ে পড়েছে ময়লার ভাগাড়, কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ে ভরা মশককুলের অভয়ারণ্য। বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নির্গমনের নিকাশনালার মতো ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো কোনো খাল। পচা দুর্গন্ধযুক্ত অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশেই কেটে যাচ্ছে পথচারী ও এলাকাবাসীর দিনকাল। খালগুলো যেভাবে মরতে বসেছে, তাতে আগামী ১০ বছরও লাগবে না ঢাকা শহর খালশূন্য হতে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরে খালের সংখ্যা ৪৭টি। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী ৫৬টি। ড্যাপেও খালের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৪৩টি।

ধরা হয়, অতীতে ঢাকা শহরে ৪৭টি খাল সচল ছিল। শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেসব খাল। নৌকা ও নৌযান চলত সেসব খালে। পণ্য পরিবহন ও লোক চলাচলে সে সময় খালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। একসময় শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত একটি খাল ছিল—পরীবাগ খাল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে তার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সেই খাল আর এখন নেই। এভাবে ধোলাই খাল, রায়েরবাজার, গোপীবাগ, নারিন্দা, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি ইত্যাদি খালগুলোরও এখন আর অস্তিত্ব নেই। ধানমন্ডি লেকটাই একসময় ছিল খাল, হাতিরঝিলের খালে পিলখানা থেকে হাতির পালকে নিয়ে যাওয়া হতো গোসল করাতে। মোগল শাসকেরা ঢাকা শহরে বহুসংখ্যক খাল থাকায় ঢাকাকে রাজধানী করার চিন্তা করেছিল, খালগুলো তাদের চলাচল ও প্রতিরক্ষার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শহরের জলাবদ্ধতা দূর ও পানি নিষ্কাশনের জন্যও ছিল সেগুলো সহায়ক। সেসব এখন ইতিহাস। এখন এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়।

ঢাকা শহরের সব খাল উদ্ধার করা প্রথম কাজ। উদ্ধারের পর সেসব খালের দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে বা হাঁটার পথ তৈরি ও বাহারি গাছপালা লাগিয়ে সুশোভন করা দ্বিতীয় কাজ। তৃতীয় কাজ হলো খালগুলোতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যাটারি, বিদ্যুৎ ও হস্তচালিত নৌযান চালনার উদ্যোগ নেওয়া। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কোনো নৌযান সেসব খালে চলাচলের অনুমতি না দেওয়া হবে খালের জলজ জীবগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা এবং দূষণ কমানোর গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ওয়াকওয়ে যেন শুধু ওয়াক তথা হাঁটার জন্যই ব্যবহৃত হয়, সে রাস্তায় যেন কোনো গাড়ি বা মোটরসাইকেল না চলে। সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো খাল এবং তার চারপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখতে উত্তম ব্যবস্থাপনার চর্চা অব্যাহত রাখা। খাল ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে সেখানকার সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণই এসব ব্যবস্থাপনাকে সুচারুরূপে বাস্তবায়নের মূল সূত্র, এর সঙ্গে থাকবে সঠিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনা, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনার প্রচারণা। এ কাজে দরকার রাষ্ট্রীয় বা সরকারের সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং জনগণের অংশগ্রহণ। অনেক তরুণ এখন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এরূপ কাজে অংশ নিতে আগ্রহী। তাদের উৎসাহিত করে নিরাপদভাবে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত মালি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ করবেন জবাবদিহির মধ্যে, স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মিলেমিশে। শোভাবর্ধনের চারাগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে সিটি করপোরেশনগুলোকেই। তবে এককভাবে শুধু দুই সিটি করপোরেশনের ওপর সম্পূর্ণ বিষয়টি চাপিয়ে দিলে হবে না। খালগুলোর দখলদারেরা অনেক শক্তিশালী, নিশ্চিত যে তাঁরা কেউই সেসব খালের দখল স্বেচ্ছায় ছাড়বেন না। দখলমুক্ত করার জন্য জোর প্রশাসনিক প্রচেষ্টা ও আইন প্রয়োগ করা দরকার।

প্রকৃতিতে প্রবহমান নদী আর খালগুলো হলো আমাদের দেহের শিরা-উপশিরার মতো। একটি ভূখণ্ডের জীবনরেখা বলা হয় এসব জলস্রোতকে। প্রবহমান এসব জলাশয় যেমন জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মাটিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও সহায়ক। ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও খালগুলোকে সচল করা দরকার। বর্তমানে ঢাকা শহরে ২৬টি খালের অস্তিত্ব চোখে দেখা গেলেও বাকি ২১টি খাল নেই। কোথায় কোথায় সেসব খাল ছিল, তা নিশ্চয় অতীতের মানচিত্রগুলোতে পাওয়া যাবে। সেগুলো আদৌ উদ্ধার বা দখলমুক্ত করা যাবে, তা দুরাশা। উদ্ধার করা গেলে সেগুলো খনন করে সচল ও শোভাময় করা উচিত। জার্মানির বার্লিন শহরে খালে করে ক্যানালক্রুজ করার সময় খালপাড়ের দুই পাশের বিভিন্ন স্থাপনা ও নাগরিক সৌন্দর্য, সেতু, রেস্তোরাঁ দেখতে দেখতে অভিভূত হতাম। ভাবতাম, জলের দেশ, নদীর দেশ, খালের দেশ বাংলাদেশ; অথচ সে দেশের শহরগুলোর খালে কেন এ রকম নৌ-পর্যটন করা যাবে না?

খালপাড় ভেঙে যাতে কোনো নগরবাসীর এক ফুট জমিও নষ্ট না হয়, সে জন্য ভেনিস, কোপেনহেগেন, প্যারিস ইত্যাদি শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল ও নদীর দুই পাড় যেভাবে পাকা করে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে, সেভাবে আমাদের প্রবহমান খালগুলোর পাড়ও বেঁধে দেওয়া যায়। নগরীর খালগুলো নিয়ে একটি চমৎকার পরিকল্পনার সুযোগ রয়েছে ড্যাপ বাস্তবায়নের কারণে। চলাচল, পরিবহন, জলাবদ্ধতা নিরসন, দূষণ হ্রাস, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পর্যটন, সৌন্দর্যবর্ধন, স্থানীয় মানুষের আয়বর্ধন, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা ও জরিপকাজ নিশ্চয় সহায়ক হবে। সবার মনে রাখা উচিত, প্রাকৃতিক প্রবাহকে রুদ্ধ করার অধিকার কারও নেই, তার ফল কখনো ভালো হয় না। এ নিয়ে কোনো খণ্ডিত পরিকল্পনা নয়, নিতে হবে সমন্বিত সামগ্রিক পরিকল্পনা। তাহলে আমরাও দেখতে পাব একটি মনোরম মহানগর, সুশোভিত খালসমৃদ্ধ একটি সুশোভন পরিবেশ। কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে নিকুঞ্জ খালটি যদি এত সুন্দর করা যায়, সুন্দর রাখা যায়, তাহলে অন্যগুলো কেন এরূপ সুন্দর হবে না?

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মসজিদে আমির হামজাকে রাজনৈতিক আলোচনা করতে নিষেধ করায় লাঞ্ছিত বিএনপি নেতা

বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারীর মৃত্যু, মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ

বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে আগ্নেয়াস্ত্রভর্তি ট্রলি ব্যাগ উদ্ধার

তিন ঘণ্টা পর আংশিক চালু মেট্রোরেল

ঘুষ হিসেবে পাকা কলা নেওয়ার কথা স্বীকার, দুদকের গণশুনানিতে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইউএনও এবং বাল্যবিবাহ

সম্পাদকীয়
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৮: ০১
ইউএনও এবং বাল্যবিবাহ

পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।

বহু প্রচার করার পরও কোথাও কোথাও অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিবারের পক্ষ থেকে। কোথাও কোথাও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, কোথাও কোথাও তৈরি হচ্ছে না। অনেকে ভুলে যাচ্ছেন, কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের বিয়ের পিঁড়িতে না বসানোই মঙ্গল।

বাল্যবিবাহের শিকার অল্প বয়সী মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে না। এতে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, পুষ্টিহীনতা এবং প্রসবজনিত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সে সন্তানের মা হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনেক সময় তারা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ে। সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ নষ্ট হয়। আত্মনির্ভরশীল হতে না পারার কারণে সংসারে নানা ধরনের সংকটে তাদের পড়তে হয়। শিক্ষাবঞ্চিত ও অল্প বয়সে সংসার শুরু করা মেয়েরা সাধারণত আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকে। এতে পরিবারে দারিদ্র্য দূর হয় না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা চলতে থাকে।

এতে যে নারীর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেটাও বিবেচনায় আনা দরকার। বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে নিজস্ব মতামত-সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বাধীন জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সামাজিকভাবে সে হেয় হতে থাকে। সংসারে তার মতামতের কোনো মূল্য থাকে না। পুরুষশাসিত সমাজে এমনিতেই মেয়েরা থাকে কোণঠাসা হয়ে, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটি সে ক্ষেত্রে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। এ যেন তার ব্যাপারে সামাজিক নিপীড়নের জন্য একটি মুক্ত জায়গা হয়ে দেখা দেয়।

একজন মানুষ যেন মুক্ত, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সমাজে অর্থনৈতিক অবদান রাখার মতো করে নিজেকে তৈরি করে নিতে পারে, সেসব দিক বিবেচনা করা না হলে সংকটে পড়ে রাষ্ট্র।

পিরোজপুরের নেছারাবাদের ঘটনাটি আশার আলো জাগায়। যদিও ইউএনও বিয়ের অনুষ্ঠানে বাধা দেননি, তবু তিনি সেখানে অংশ না নিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ চলে যাওয়ায় বিয়েটা হয়নি বলে একটি ভালো কাজ হয়েছে। যখন সমাজের একটি বড় অংশ অল্প বয়সে বিবাহ ও মাতৃত্বে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে না। ফলে জাতির অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক যে মেয়েটি অভিভাবকদের কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছিল, এখন হয়তোবা সে তা থেকে মুক্ত হবে। অভিভাবকেরাও সচেতন হয়ে এই শিশুকে শারীরিক, মানসিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারেন। তাতে একটি সমৃদ্ধ ও সমানাধিকারের সমাজ গঠিত হওয়ার পথে তাঁরা অবদান রাখতে পারেন।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মসজিদে আমির হামজাকে রাজনৈতিক আলোচনা করতে নিষেধ করায় লাঞ্ছিত বিএনপি নেতা

বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারীর মৃত্যু, মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ

বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে আগ্নেয়াস্ত্রভর্তি ট্রলি ব্যাগ উদ্ধার

তিন ঘণ্টা পর আংশিক চালু মেট্রোরেল

ঘুষ হিসেবে পাকা কলা নেওয়ার কথা স্বীকার, দুদকের গণশুনানিতে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিষাক্ত গ্যাস

সম্পাদকীয়
বিষাক্ত গ্যাস

মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার—তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ভাববেন। এ রকম একটা অবস্থায় দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়টিতে স্থানীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে মোটেও অনুকূল থাকে না, সেটা বোঝা দরকার।

সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেদক শিয়ালবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক গুদামে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে এখনো অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। রাসায়নিকের ড্রাম থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। প্রায়ই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-এক দিন সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়, তারপর একসময় সেটা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু যে মানুষেরা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতিটি দিনই যে কাটছে ভয়ংকর রাসায়নিকের সঙ্গে লড়াই করে, সে খবর কয়জন রাখে?

চিকিৎসকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পরও বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার ঘনত্ব বেশি থাকে। পরে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ ভুক্তভোগীর শরীরে ঢোকে। ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যতেও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।

বিষাক্ত কণিকা বা গ্যাস মানবদেহে ঢোকে শ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের মাধ্যমে এবং খাদ্যের মাধ্যমে। এই গ্যাস অ্যাজমা, কাশি, গলাজ্বলা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চোখ আর ত্বকও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তৈরি হতে পারে মাথাব্যথা, বমি ও ক্লান্তির মতো ঘটনা। ভারী ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।

শিয়ালবাড়ীর দুর্ঘটনাস্থলের অন্তত এক হাজার গজ পর্যন্ত এলাকায় বাতাসে এখনো পোড়া জিনিস ও গ্যাসের মতো কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখনো রয়েছে সংকটের মুখে।

আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু দেশের মানুষ এ কথাও জানে, সেই মৌলিক অধিকার সব সময় সমুন্নত রাখা হয় না। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি কয়টি গুদামে আছে? এসব জায়গায় কি নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়? শুধু গুদাম কেন, কারখানাগুলোয় কি সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে? শ্রমিকেরা কি নিরাপদে তাঁদের কাজ করে যেতে পারেন?

এসব দুর্ঘটনায় মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা বিপদে পড়েন। তাঁদের পাশে যদি দাঁড়ানো না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, শিল্প-ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে, তা নিরসনের কোনো চিন্তা কারও নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মসজিদে আমির হামজাকে রাজনৈতিক আলোচনা করতে নিষেধ করায় লাঞ্ছিত বিএনপি নেতা

বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারীর মৃত্যু, মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ

বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে আগ্নেয়াস্ত্রভর্তি ট্রলি ব্যাগ উদ্ধার

তিন ঘণ্টা পর আংশিক চালু মেট্রোরেল

ঘুষ হিসেবে পাকা কলা নেওয়ার কথা স্বীকার, দুদকের গণশুনানিতে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত