বিভুরঞ্জন সরকার
মানুষ সততই অতীতপ্রবণ। অতীতকাতরতা মানুষ সহজে কাটাতে পারে না। তাই অতীত বন্দনা করে কবিতা-গান-প্রবাদ প্রবচন রচিত হয়েছে। অতীত মানুষের সঙ্গে কথা কয়, অতীত কখনো কখনো মানুষকে এতটাই আপ্লুত করে যে, অতীতচারিতা একবার শুরু হলে সহজে থামতে চায় না। কিন্তু বহু নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার হলেও অতীতে ফিরে যাওয়ার কোনো যন্ত্র আবিষ্কার এখনো হয়নি। সম্ভবত হবেও না। কারণ, মানুষের চোখ তো সামনে। পেছনে ফিরতে তাই কেউ চায় না।
হে অতীত তুমি কথা কয়ে যাও গোপনে গোপনে,/যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ,/আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম—এসব কিছুই আমাদের অতীত-মুগ্ধতার পরিচয়বাহী।
আসলে অতীতের সবকিছু যেমন ভালো না, তেমনি বর্তমানেরও সবকিছু খারাপ নয়। ভালো-মন্দ মিলিয়েই আমাদের এই জগৎ-সংসার। মানবিকতা ও পশুত্ব দুটো নিয়েই মানুষ। তবে যে মানুষের মধ্যে মানবিকতার চেয়ে পশুত্ব বেশি, তার থেকে সাবধান থাকাই ভালো।
অতীতে শায়েস্তা খাঁর আমলে এক টাকায় কয়েক মন চাল পাওয়া যেত—এই গল্প শুনে আমাদের হা-হুতাশ করার কিছু নেই। অত অল্প দাম হলেও তখনো মানুষের অভাব ছিল। তখনো কোনো কোনো মানুষ না খেয়ে থাকত। মানুষের কাজের সুযোগ ছিল কম। ক্রয়ক্ষমতা কম থাকায় কম দামের জিনিসও মানুষ প্রয়োজন বা চাহিদা অনুযায়ী কিনতে পারত না। তা ছাড়া শায়েস্তা খাঁর আমলে কি মানুষ চন্দ্রাভিযানে গিয়েছিল? সে সময় কি রঙিন টেলিভিশন ছিল? কম্পিউটার ছিল কি? অথবা হাতে হাতে স্মার্ট ফোন? এই পৃথিবী আজ একটি বড় গ্রাম বা লোকালয়ে পরিণত হয়েছে; হাতের মুঠোয় আজ বিশ্ব। এসব কিছুই বর্তমানের বিষয়, অতীতের নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীটা ক্রমাগত বদলাচ্ছে এবং বদলাচ্ছে ভালোর দিকে।
তার মানে এটা মনে করার কারণ নেই যে, আমি অতীতকে ভুলে যেতে বলছি। অতীতকে আমরা অবশ্যই মনে রাখব। অতীত হলো বর্তমানের ভিত্তি। আমাকে দিয়েই তো মানব সভ্যতা বা পৃথিবীর শুরু নয়। আমার বাবা ছিলেন, তাঁর বাবা ছিলেন, তাঁরও বাবা ছিলেন, আবার তাঁরও—আসলে এভাবেই আমরা এগিয়ে চলছি। চলার পথ আবার এক রকম নয়। নদী যেমন একূল ভাঙে ওকূল গড়ে মানুষের জীবনচক্রও ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়। কিন্তু আমি আমার অতীত কয় পুরুষের তথ্য জানি? বড়জোর বাবা এবং তাঁর বাবা। কিন্তু ইতিহাস আমাদের অনেক পেছনে নিয়ে যায়। কেবল নিকট অতীত নয়, ইতিহাসের কারবার সুদূর অতীত নিয়েও।
বিশেষ কোনো জ্ঞান দেওয়ার জন্য আমি এসব লিখছি কি না, কারও মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে। সুদূর অতীত নয়, নিকট অতীতের দু-একটা বিষয় মনে পড়ছে বলেই এই লেখা। যা লিখব, তার সবই আমি চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি, তা কিন্তু নয়। কিছু আমি লোক মুখেও শুনেছি। অক্ষর আবিষ্কারের আগে এবং মানুষের লেখা শেখার আগে মুখে মুখেই তো কথাকাহিনি প্রচার হয়েছে। কালক্রমে সেটাই হয়েছে ইতিহাসের অংশ।
আমাদের স্কুলজীবন কেটেছে ষাটের দশকে। গত শতকের ষাটের দশক ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণের কাল। পাকিস্তানের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী সামরিক ডিক্টেটর আইয়ুব খান একদিকে নিজের শাসনের ভিত্তি পোক্ত করার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে উঠছে এক নতুন ধারা, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক নতুন জনজাগরণ। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক নৈকট্য তরুণদের মধ্যে ঝড় তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিল। আমি বড় হয়েছি বৃহত্তর দিনাজপুরের পঞ্চগড় এলাকায়। একেবারেই পশ্চাৎপদ একটি অঞ্চল। একদিকে ভূস্বামী, অন্যদিকে ভূমিহীন। আমার স্কুল বন্ধুদের মধ্যেও দুই শ্রেণি থেকে আসা সদস্য ছিল। কিন্তু কে ভূস্বামী, আর কে ভূমিহীন পরিবার থেকে আসা, তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। যেসব বন্ধুর পরিবার বেশি অবস্থাপন্ন ছিল, তারা কেউ সেটা কোনোভাবেই প্রকাশ করত না। কারও মধ্যে হামবড়া ভাব ছিল না। আমাদের শিক্ষকদের অনেকেরই আবাদি জমি ছিল। কেউ কেউ নিজে চাষাবাদও করতেন।
আমাদের সময় আমাদের স্কুলে কোনো স্কুল ড্রেস বা ইউনিফরম ছিল না। হাইস্কুলে ক্লাস নাইনেও আমরা কেউ কেউ লুঙ্গি পরে ক্লাস করতে গিয়েছি। একদিন হেড স্যার আমাদের কয়জনকে লুঙ্গি পরে স্কুলে যাওয়ায় বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখায় আমি লুঙ্গি ছেড়ে পায়জামা ধরলাম। আমি তো প্যান্ট বানিয়েছি উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর।
আমাদের সময় দামি পোশাক পরে স্কুলে এসে কেউ সহপাঠীদের চমকে দেওয়ার প্রতিযোগিতা করত না। এখন বিত্তবানদের মধ্যে যে উৎকট প্রদর্শনবাদিতা, ব্র্যান্ডের পোশাক ছাড়া চলে না, আমাদের সময় তেমন ছিল না। শুধু ঈদ এবং পূজায় নতুন পোশাক নিয়ে একটু প্রতিযোগিতা বন্ধুদের মধ্যে হতো। তবে সেটা নীরবে। কে কত বেশি দামের কাপড় কিনেছে, তা নিয়ে কাউকে বড়াই করতে দেখিনি।
একবার আমি পূজায় কেরোলিন কাপড়ের জামা বানানোর বায়না ধরলাম। কেরোলিন বেশ মসৃণ সিল্কের মতো এবং দামি কাপড় ছিল। আমি কখনো কিছুর জন্য আবদার করতাম না বলে আমাকে কেরোলিন কাপড় কিনে দেওয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে বাবার সাবধানবাণী, ‘তোমার বন্ধুদের কেউ হয়তো এই কাপড়ের জামা পরবে না। তাদের সামনে তুমি এমন আচরণ করো না, যাতে ওরা কষ্ট পায়।’
ওই জামাটি আমি পূজার কয়দিন ছাড়া আর পরিনি। আসলেই তখন আমরা বন্ধুদের থেকে কোনো কারণে বিচ্ছিন্ন হতে চাইতাম না। এককাট্টা হয়ে থাকতে চাইতাম। আমাদের সময় পড়াশোনা নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল, খেলাধুলা নিয়েও ছিল, কিন্তু বড়োলোকি চাল দেখানো নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না।
আমাদের এলাকায় কয়েকজন ভূস্বামীর সঙ্গেই আমার নানা কারণে পরিচয় ছিল। এঁদের সবাই আমার চেয়ে বয়সে প্রবীণ ছিলেন, ছিলেন আমার বাবার চেয়েও বয়সে বড়। কিন্তু তাঁদের কেউ সম্পদের গরিমা দেখাতেন না। সাধারণ পোশাকে সাইকেল চালিয়ে তাঁরা হাটবাজারে আসতেন। মোটরসাইকেল বা হোন্ডা জিনিসটি তো ষাট দশকের শেষে আমরা দেখেছি।
শত শত বিঘা জমির মালিক দুজন–ওয়ালিউল ইসলাম মন্টু এবং সফিকুল আলম চৌধুরীকে আমরা ছাত্র হিসেবেই পেয়েছি। মন্টু ভাইয়ের চেয়ে আলম ভাই হয়তো একটু সিনিয়র ছিলেন। পোশাক-আশাকে এই দুজনের একটু বনেদিআনা ছিল। আলম ভাই ছিলেন একটু শৌখিন প্রকৃতিরও। দুজনই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ডাকসাইটে নেতা। আমার সঙ্গে এই দুজনের সম্পর্ক ছিল এককথায় চমৎকার। তাঁরা আমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখতেন।
আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ এবং টেলিফোন এসেছিল কাছাকাছি সময়ে। ১৯৬৮ / ১৯৬৯ সালে। তারের মাধ্যমে আলো এবং শব্দের (কথা) প্রবাহ বা সঞ্চালন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাট আগ্রহ ও কৌতূহল তৈরি করেছিল।
টেলিফোনে দূরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারলে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করত মানুষ। আমাদের এলাকায় প্রথম একটি টেলিফোন সেট লাগে পোস্ট অফিসে। পোস্ট অফিস থেকে কেউ ইচ্ছা করলে পয়সা দিয়ে ফোন করতে পারত। তবে এতে একটু সময় লাগত। তখন টেলিফোন সেট ছিল অন্য রকম। একটি কালো যন্ত্র, হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে তারপর সংযোগ স্থাপন করতে হতো। তখন ফোনে বেশ জোরে কথা বলতে শুনতাম। একজন কথা বললে আশপাশে অনেকে জড়ো হতো। বেশ মজার ছিল বিষয়টি। এখন ছোটবড়, ধনী-গরিব প্রায় সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন।
জীবন যেমন আগের মতো নেই, তেমনি জীবনের প্রয়োজন মেটানোর নতুন নতুন উপকরণও এখন দুষ্প্রাপ্য নয়। টাকা থাকলে সুখের সামগ্রীর অভাব নেই। আগে ভোগ-বিলাসের উপকরণ কম ছিল, মানুষের মধ্যে সুখ-শান্তি বেশি ছিল। এখন টাকা দিয়ে সব কিনতে হয় বলেই কি মানুষ উন্মাদের মতো টাকার পেছনে ছুটছে?
আমার জীবন যেভাবে চলেছে, আমার সন্তানের জীবনও একই ধারায় চলবে, সে আশা করা ঠিক নয়। পরিবর্তন এবং পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলাও বুঝি জীবনেই ধর্ম। কিন্তু ‘মানুষ’ বলতে যে বৈশিষ্ট্য চোখের সামনে আসে, তার চরম ব্যত্যয় ঘটতে দেখলে স্বাভাবিকভাবেই মনের চাকা পেছনে ঘুরতে চায়।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
মানুষ সততই অতীতপ্রবণ। অতীতকাতরতা মানুষ সহজে কাটাতে পারে না। তাই অতীত বন্দনা করে কবিতা-গান-প্রবাদ প্রবচন রচিত হয়েছে। অতীত মানুষের সঙ্গে কথা কয়, অতীত কখনো কখনো মানুষকে এতটাই আপ্লুত করে যে, অতীতচারিতা একবার শুরু হলে সহজে থামতে চায় না। কিন্তু বহু নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার হলেও অতীতে ফিরে যাওয়ার কোনো যন্ত্র আবিষ্কার এখনো হয়নি। সম্ভবত হবেও না। কারণ, মানুষের চোখ তো সামনে। পেছনে ফিরতে তাই কেউ চায় না।
হে অতীত তুমি কথা কয়ে যাও গোপনে গোপনে,/যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ,/আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম—এসব কিছুই আমাদের অতীত-মুগ্ধতার পরিচয়বাহী।
আসলে অতীতের সবকিছু যেমন ভালো না, তেমনি বর্তমানেরও সবকিছু খারাপ নয়। ভালো-মন্দ মিলিয়েই আমাদের এই জগৎ-সংসার। মানবিকতা ও পশুত্ব দুটো নিয়েই মানুষ। তবে যে মানুষের মধ্যে মানবিকতার চেয়ে পশুত্ব বেশি, তার থেকে সাবধান থাকাই ভালো।
অতীতে শায়েস্তা খাঁর আমলে এক টাকায় কয়েক মন চাল পাওয়া যেত—এই গল্প শুনে আমাদের হা-হুতাশ করার কিছু নেই। অত অল্প দাম হলেও তখনো মানুষের অভাব ছিল। তখনো কোনো কোনো মানুষ না খেয়ে থাকত। মানুষের কাজের সুযোগ ছিল কম। ক্রয়ক্ষমতা কম থাকায় কম দামের জিনিসও মানুষ প্রয়োজন বা চাহিদা অনুযায়ী কিনতে পারত না। তা ছাড়া শায়েস্তা খাঁর আমলে কি মানুষ চন্দ্রাভিযানে গিয়েছিল? সে সময় কি রঙিন টেলিভিশন ছিল? কম্পিউটার ছিল কি? অথবা হাতে হাতে স্মার্ট ফোন? এই পৃথিবী আজ একটি বড় গ্রাম বা লোকালয়ে পরিণত হয়েছে; হাতের মুঠোয় আজ বিশ্ব। এসব কিছুই বর্তমানের বিষয়, অতীতের নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীটা ক্রমাগত বদলাচ্ছে এবং বদলাচ্ছে ভালোর দিকে।
তার মানে এটা মনে করার কারণ নেই যে, আমি অতীতকে ভুলে যেতে বলছি। অতীতকে আমরা অবশ্যই মনে রাখব। অতীত হলো বর্তমানের ভিত্তি। আমাকে দিয়েই তো মানব সভ্যতা বা পৃথিবীর শুরু নয়। আমার বাবা ছিলেন, তাঁর বাবা ছিলেন, তাঁরও বাবা ছিলেন, আবার তাঁরও—আসলে এভাবেই আমরা এগিয়ে চলছি। চলার পথ আবার এক রকম নয়। নদী যেমন একূল ভাঙে ওকূল গড়ে মানুষের জীবনচক্রও ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়। কিন্তু আমি আমার অতীত কয় পুরুষের তথ্য জানি? বড়জোর বাবা এবং তাঁর বাবা। কিন্তু ইতিহাস আমাদের অনেক পেছনে নিয়ে যায়। কেবল নিকট অতীত নয়, ইতিহাসের কারবার সুদূর অতীত নিয়েও।
বিশেষ কোনো জ্ঞান দেওয়ার জন্য আমি এসব লিখছি কি না, কারও মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে। সুদূর অতীত নয়, নিকট অতীতের দু-একটা বিষয় মনে পড়ছে বলেই এই লেখা। যা লিখব, তার সবই আমি চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি, তা কিন্তু নয়। কিছু আমি লোক মুখেও শুনেছি। অক্ষর আবিষ্কারের আগে এবং মানুষের লেখা শেখার আগে মুখে মুখেই তো কথাকাহিনি প্রচার হয়েছে। কালক্রমে সেটাই হয়েছে ইতিহাসের অংশ।
আমাদের স্কুলজীবন কেটেছে ষাটের দশকে। গত শতকের ষাটের দশক ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণের কাল। পাকিস্তানের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী সামরিক ডিক্টেটর আইয়ুব খান একদিকে নিজের শাসনের ভিত্তি পোক্ত করার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে উঠছে এক নতুন ধারা, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক নতুন জনজাগরণ। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক নৈকট্য তরুণদের মধ্যে ঝড় তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিল। আমি বড় হয়েছি বৃহত্তর দিনাজপুরের পঞ্চগড় এলাকায়। একেবারেই পশ্চাৎপদ একটি অঞ্চল। একদিকে ভূস্বামী, অন্যদিকে ভূমিহীন। আমার স্কুল বন্ধুদের মধ্যেও দুই শ্রেণি থেকে আসা সদস্য ছিল। কিন্তু কে ভূস্বামী, আর কে ভূমিহীন পরিবার থেকে আসা, তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। যেসব বন্ধুর পরিবার বেশি অবস্থাপন্ন ছিল, তারা কেউ সেটা কোনোভাবেই প্রকাশ করত না। কারও মধ্যে হামবড়া ভাব ছিল না। আমাদের শিক্ষকদের অনেকেরই আবাদি জমি ছিল। কেউ কেউ নিজে চাষাবাদও করতেন।
আমাদের সময় আমাদের স্কুলে কোনো স্কুল ড্রেস বা ইউনিফরম ছিল না। হাইস্কুলে ক্লাস নাইনেও আমরা কেউ কেউ লুঙ্গি পরে ক্লাস করতে গিয়েছি। একদিন হেড স্যার আমাদের কয়জনকে লুঙ্গি পরে স্কুলে যাওয়ায় বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখায় আমি লুঙ্গি ছেড়ে পায়জামা ধরলাম। আমি তো প্যান্ট বানিয়েছি উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর।
আমাদের সময় দামি পোশাক পরে স্কুলে এসে কেউ সহপাঠীদের চমকে দেওয়ার প্রতিযোগিতা করত না। এখন বিত্তবানদের মধ্যে যে উৎকট প্রদর্শনবাদিতা, ব্র্যান্ডের পোশাক ছাড়া চলে না, আমাদের সময় তেমন ছিল না। শুধু ঈদ এবং পূজায় নতুন পোশাক নিয়ে একটু প্রতিযোগিতা বন্ধুদের মধ্যে হতো। তবে সেটা নীরবে। কে কত বেশি দামের কাপড় কিনেছে, তা নিয়ে কাউকে বড়াই করতে দেখিনি।
একবার আমি পূজায় কেরোলিন কাপড়ের জামা বানানোর বায়না ধরলাম। কেরোলিন বেশ মসৃণ সিল্কের মতো এবং দামি কাপড় ছিল। আমি কখনো কিছুর জন্য আবদার করতাম না বলে আমাকে কেরোলিন কাপড় কিনে দেওয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে বাবার সাবধানবাণী, ‘তোমার বন্ধুদের কেউ হয়তো এই কাপড়ের জামা পরবে না। তাদের সামনে তুমি এমন আচরণ করো না, যাতে ওরা কষ্ট পায়।’
ওই জামাটি আমি পূজার কয়দিন ছাড়া আর পরিনি। আসলেই তখন আমরা বন্ধুদের থেকে কোনো কারণে বিচ্ছিন্ন হতে চাইতাম না। এককাট্টা হয়ে থাকতে চাইতাম। আমাদের সময় পড়াশোনা নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল, খেলাধুলা নিয়েও ছিল, কিন্তু বড়োলোকি চাল দেখানো নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না।
আমাদের এলাকায় কয়েকজন ভূস্বামীর সঙ্গেই আমার নানা কারণে পরিচয় ছিল। এঁদের সবাই আমার চেয়ে বয়সে প্রবীণ ছিলেন, ছিলেন আমার বাবার চেয়েও বয়সে বড়। কিন্তু তাঁদের কেউ সম্পদের গরিমা দেখাতেন না। সাধারণ পোশাকে সাইকেল চালিয়ে তাঁরা হাটবাজারে আসতেন। মোটরসাইকেল বা হোন্ডা জিনিসটি তো ষাট দশকের শেষে আমরা দেখেছি।
শত শত বিঘা জমির মালিক দুজন–ওয়ালিউল ইসলাম মন্টু এবং সফিকুল আলম চৌধুরীকে আমরা ছাত্র হিসেবেই পেয়েছি। মন্টু ভাইয়ের চেয়ে আলম ভাই হয়তো একটু সিনিয়র ছিলেন। পোশাক-আশাকে এই দুজনের একটু বনেদিআনা ছিল। আলম ভাই ছিলেন একটু শৌখিন প্রকৃতিরও। দুজনই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ডাকসাইটে নেতা। আমার সঙ্গে এই দুজনের সম্পর্ক ছিল এককথায় চমৎকার। তাঁরা আমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখতেন।
আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ এবং টেলিফোন এসেছিল কাছাকাছি সময়ে। ১৯৬৮ / ১৯৬৯ সালে। তারের মাধ্যমে আলো এবং শব্দের (কথা) প্রবাহ বা সঞ্চালন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাট আগ্রহ ও কৌতূহল তৈরি করেছিল।
টেলিফোনে দূরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারলে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করত মানুষ। আমাদের এলাকায় প্রথম একটি টেলিফোন সেট লাগে পোস্ট অফিসে। পোস্ট অফিস থেকে কেউ ইচ্ছা করলে পয়সা দিয়ে ফোন করতে পারত। তবে এতে একটু সময় লাগত। তখন টেলিফোন সেট ছিল অন্য রকম। একটি কালো যন্ত্র, হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে তারপর সংযোগ স্থাপন করতে হতো। তখন ফোনে বেশ জোরে কথা বলতে শুনতাম। একজন কথা বললে আশপাশে অনেকে জড়ো হতো। বেশ মজার ছিল বিষয়টি। এখন ছোটবড়, ধনী-গরিব প্রায় সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন।
জীবন যেমন আগের মতো নেই, তেমনি জীবনের প্রয়োজন মেটানোর নতুন নতুন উপকরণও এখন দুষ্প্রাপ্য নয়। টাকা থাকলে সুখের সামগ্রীর অভাব নেই। আগে ভোগ-বিলাসের উপকরণ কম ছিল, মানুষের মধ্যে সুখ-শান্তি বেশি ছিল। এখন টাকা দিয়ে সব কিনতে হয় বলেই কি মানুষ উন্মাদের মতো টাকার পেছনে ছুটছে?
আমার জীবন যেভাবে চলেছে, আমার সন্তানের জীবনও একই ধারায় চলবে, সে আশা করা ঠিক নয়। পরিবর্তন এবং পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলাও বুঝি জীবনেই ধর্ম। কিন্তু ‘মানুষ’ বলতে যে বৈশিষ্ট্য চোখের সামনে আসে, তার চরম ব্যত্যয় ঘটতে দেখলে স্বাভাবিকভাবেই মনের চাকা পেছনে ঘুরতে চায়।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) যে তদন্ত করেছে, ২৭ জানুয়ারি সে তদন্তের ৫৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এইচআরডব্লিউর একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে...
১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি একটি অনন্য মাস। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য যে পথ রচনা করে দিয়েছে, সেই পথই দেশকে পৌঁছে দিয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। প্রকৃতপক্ষে এ দেশের আপামর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে সেই পথকে করেছে মসৃণ...
১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি একধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নানা বাধা দেখা যাচ্ছে। এসব ঘটনা শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবন্ধকতা নয়; বরং বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন।
১ ঘণ্টা আগেআজ থেকে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা শুরু হচ্ছে। মাসব্যাপী এই আয়োজন প্রাণের মেলায় পরিণত হোক, সেই কামনা করি। তবে আজ বইমেলা নিয়ে নয়, বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে যে নাটক অভিনীত হলো, তা নিয়েই কিছু কথা বলা সংগত হবে।
১ ঘণ্টা আগে