Ajker Patrika

বাংলাদেশ সরকার যা করতে পারে

সেলিম জাহান
বাংলাদেশ সরকার যা করতে পারে

(গতকালের পর)
বৈষম্য বাড়বে সেবা-সুযোগেও। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। শিক্ষার সকল পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষাদান চলবে আগামী দিনগুলোতে। কিন্তু এ প্রযুক্তি ধনী গৃহস্থালিতে যতখানি লভ্য, দরিদ্র গৃহস্থালিতে ততখানি নয়। নগর অঞ্চলে এর প্রাপ্তি যতখানি সহজ, গ্রামাঞ্চলে ততখানি নয়। সুতরাং করোনার কারণে শিক্ষায় একটি অন্তর্নিহিত বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। পরবর্তী পর্যায়ে কর্মসংস্থান ও আয়ের ক্ষেত্রেও একটি অসমতার জন্ম হবে।

অসমতার প্রকোপ বেশি করে পড়বে কতগুলো বিশেষ জনগোষ্ঠীর ওপর। রাষ্ট্রের সম্পদ সংকোচনের ফলে বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের মতো নাজুক গোষ্ঠীগুলোকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দেওয়া যাবে না। ফলে তারা আরও বিপাকে পড়বে। নারীরাও অসমভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন করোনা দ্বারা। প্রথমত, ঘরের অভ্যন্তরে গৃহকর্ম ও সেবামূলক কাজের চাপ নারীদের ওপরে বেড়ে গেছে। অবরুদ্ধ অবস্থায় ঘরের মধ্যে মতানৈক্য, সংঘাত, খিটিমিটি স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে নারীদের বিরুদ্ধে গৃহাভ্যন্তরীণ সহিংসতাও বিস্তৃত হয়েছে। এ-জাতীয় কর্মকাণ্ড সহিংসতার সংস্কৃতি আরও জোরদার করতে পারে। দ্বিতীয়ত, নারীদের একটি বড় অংশ কাজ করে পোশাকশিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। সুতরাং করোনা সংকটের নেতিবাচক প্রভাব তাঁদের ওপরেই বেশি পড়বে। তৃতীয়ত, করোনার কারণে স্বাস্থ্য খাতের মূল লক্ষ্য যখন এই অতিমারি, স্বাভাবিকভাবেই নারীদের স্বাস্থ্যসেবার নানান দিক, যেমন নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার পাবে না।

করোনা সংকটকালে বাংলাদেশে দুটো বিষয় বড়ই মুখ্য। একটি হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখা এবং অন্যটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে চাঙা রাখা। প্রায়ই দুটো বিষয় একে অন্যের বিপরীতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সংকটের কারণে, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এবং সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে অনুমিত হচ্ছে যে, দুটোই একসঙ্গে অর্জিত হতে পারবে না। সেই সঙ্গে প্রচ্ছন্ন অনুমান হচ্ছে যে, বিষয় দুটো পারস্পরিক দ্বন্দ্বমূলক–এর একটিকে বেছে নিতে হবে অন্যটির বিপরীতে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, কোনটি আমরা করব–দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বাঁচাব, না অর্থনীতিকে বাঁচাব।

আমার মনে হয়, বিষয়টি একটি ভ্রান্তিমূলক প্রেক্ষিত থেকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বিষয়টি ‘কোনটিকে বাদ দিয়ে কোনটি করব’ নয়–দুটোই করতে হবে। প্রশ্নটি হচ্ছে অগ্রাধিকারের–কোনটি এ মুহূর্তে করতে হবে এবং কোনটি তার পরে করতে হবে। বিষয় দুটো পরস্পরবিরোধী নয়, বিষয় দুটো পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী পরিকল্পনা, চিন্তা-চেতনায়, বাজেটে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে–‘মানুষ বাঁচানোর’। এ সংকটকালে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। তাদের কোনো কাজ নেই, তাদের কোনো আয় নেই, ঘরে তাদের খাদ্য নিঃশেষিত। তারা ‘দিন আনে দিন খায়’–নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার মতো তাদের কোনো সঞ্চয় নেই। এ মুহূর্তে তাদের জন্য দুটো জিনিস করা অত্যাবশ্যকীয়–খাদ্যনিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং নগদ অর্থ প্রদান। যেমন প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ চাল ও ডাল দেওয়া যেতে পারে।

বর্তমানে স্থিত নানান কাঠামো সমন্বয় করে তা করা যেতে পারে। জানি, নানান দুর্নীতির কথা সেখানে উঠবে। সেনাবাহিনীকে কি এ ব্যাপারে ব্যবহার করা যায় না?

নগদ অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। এক. দেশে প্রচলিত বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও অন্যান্য ভাতার মাধ্যমে নগদ অর্থায়ন বাড়ানো যেতে পারে। এখন এসব ভাতার পরিমাণ জনপ্রতি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। এসবের পরিমাণ ৫০০০ টাকায় উন্নীত করা দরকার। এর বাইরেও অন্যান্য দুস্থ জনগোষ্ঠীকে অর্থায়নের জন্য নানান কাঠামো ব্যবহার করা যায়। এর জন্য একটি অগ্রাধিকার তহবিল এখনই বাস্তবায়ন করা দরকার। এর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ও প্রক্রিয়া গড়ে তোলা প্রয়োজন। সুতরাং পুরো নজর দিতে হবে ‘মানুষ বাঁচানোর’ জন্য। এর আর কোনো বিকল্প বর্তমান মুহূর্তে নেই। এটাই এ সময়ে আমাদের ধ্যানজ্ঞান হওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য, খাদ্যনিরাপত্তাহীন পরিবারগুলোর জন্য এক মাসের খাদ্য সুরক্ষার জন্য ছয় হাজার কোটি টাকা লাগবে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। আগামী ছয় মাসের জন্য লাগবে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক প্রণোদনার জন্য বরাদ্দ অর্থ থেকে এর অর্থায়ন করা যেতে পারে। আমি মনে করি, এই মুহূর্তে ওই অর্থের অংশ দিয়ে বর্তমানের খাদ্যনিরাপত্তাহীন পাঁচ কোটি মানুষের অন্তত আগামী ছয় মাসের খাদ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হোক।

‘মানুষ বাঁচানোর’ সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি দিতে হবে মধ্যমেয়াদে ‘অর্থনীতিকে বাঁচানোর’। এর মূল লক্ষ্য হবে অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন। এর নানান উপাংশ থাকতে পারে।

এক. অতি দ্রুত কৃষির নানান উপকরণ, যেমন: সার, বীজ, পানি কৃষকের কাছে পৌঁছানো। তাঁদের জন্য সহজ ঋণের জোগান। দুই. ক্ষুদ্র ও মধ্যম শিল্পের জন্য প্রণোদনা এবং তিন. বড় শিল্পকে সহায়তা প্রদান। এসব ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। এক. আমাদের রপ্তানিযোগ্য সামগ্রীর ওপরে, যেমন: পোশাকশিল্প বা জনশক্তির ওপরে বিশেষ নজর দিতে হবে। দুই. লক্ষ রাখতে হবে, যাতে কৃষি বা ক্ষুদ্রশিল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ কায়েমি স্বার্থবাদীদের দ্বারা কুক্ষিগত না হয় এবং তিন. দুর্নীতি রোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে এখনই মনোযোগ দিয়ে এসব প্রতিহত করার জন্য মোর্চা গঠন করতে হবে। তবে, ভবিষ্যৎ খাদ্যসংকট এড়ানোর চিন্তাভাবনা এখনই হওয়া দরকার। আমাদের কৃষিব্যবস্থা আমাদের খাদ্য চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা রাখে। যথাযোগ্য প্রণোদনার মাধ্যমে তার সর্বোচ্চকরণ করা দরকার।

অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনায় সবচেয়ে প্রয়োজন, প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী হবে সামাজিক সুরক্ষার ওপরে গুরুত্ব। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ সময়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে বিনা খরচে খাদ্য বিতরণ; দশ টাকায় চাল বিক্রি; নগদ অর্থ বিতরণ এবং বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও নির্যাতিত নারীদের ভাতা। বর্তমানে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও অন্যান্য ভাতার পরিমাণ জনপ্রতি ৫০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। এ অঙ্ক লজ্জাজনক। সব ভাতার পরিমাণ ন্যূনতম ১০০০ টাকা করা দরকার। এই প্রস্তাবটি এখনই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা দরকার। এর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ও প্রক্রিয়া গড়ে তোলা প্রয়োজন। নগদ অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে দরিদ্র কৃষক, গ্রামীণ শ্রমিক, বিধবা ও অন্যদের সাহায্য করতে হবে।

আগামী দিনগুলোতে কোনো এক সময়ে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু শেষে অর্থনীতির পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। অর্থনৈতিক প্রণোদনার ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে যে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অংশটুকু যেন বৃহৎ ব্যবসা গিলে না ফেলে। সেই সঙ্গে ব্যাংকসহ বৃহৎ শিল্পকে উদ্ধার করা ও বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এই প্রণোদনা যেন ব্যবহৃত না হয়। এ রকম বরাদ্দের ক্ষেত্রে দুর্নীতির সুযোগও বেশি। দৃশ্যমানতা ও দায়বদ্ধতা ভিন্ন এ তহবিল তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। সম্পদ নষ্টের বিরুদ্ধে কী ধরনের কাঠামো কার্যকর হবে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন আছে। এই তহবিল থেকে যাঁরা অর্থ নেবেন, তাঁদের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য ঋণবিমার কথা চিন্তা করা যেতে পারে।

বহু মৃত্যু, বহু ক্ষতি, বহু দুঃস্বপ্নের স্মৃতি পেরিয়ে কোনো একদিন এ সংকট কেটে যাবে। সুন্দর দিন আবার ফিরে আসবে। কিন্তু তখন আমরা যেন এই সময়টাকে ভুলে না যাই, বিস্মৃত না হই বর্তমান সংকটের শিক্ষা নেওয়ার কথা। কিন্তু এ মুহূর্তে শুধু বলি: মানুষ, নম্র হও, নত হও প্রকৃতির কাছে, নমিত হও মাতা ধরিত্রীর কাছে। (শেষ)

লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেঘালয়ে হানিমুনে গিয়ে বর খুন, নিখোঁজ নববধূকে উদ্ধারে নেমেছে ড্রোন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচার ও কিছু প্রশ্ন

‘তাণ্ডব’ সিনেমার শো চলার সময় ছায়াবাণী হলে দর্শকদের ভাঙচুর, টাকা লুট

‘৫ মিনিট রুলস’ যেভাবে ইলন মাস্কের জীবনে সাফল্য আনল

যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের বাজার দখলের চেষ্টা ভারতে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত