Ajker Patrika

দখল ও চাঁদাবাজির মচ্ছব

চিররঞ্জন সরকার
আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৮: ২৭
দখল ও চাঁদাবাজির মচ্ছব

দেশের অর্থনীতির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদদের নিয়ে গড়া সংগঠনের নাম হচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। এই সংগঠনটির অনেক সুনাম আছে। শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদেরা এই সংগঠনটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই সংগঠনটিও দখল হয়ে গেছে। ‘বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি’র ব্যানারে একদল সদস্য সমিতির প্রধান কার্যালয় দখল করে রেখেছেন। শুধু অর্থনীতি সমিতির অফিস নয়, এক সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত খবর মতে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাবলিক টয়লেটও দখল করা হয়েছে। আগে যাঁরা এই পাবলিক টয়লেটগুলো পরিচালনা করতেন, তাঁদের বাদ দিয়ে এখন নতুন গ্রুপ এগুলোর দখল নিয়েছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্ট বিকেল থেকেই শুরু হয়ে যায় লুটপাট, হামলা আর দখলের অভিযান। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত ছিলেন, তাঁরা এখন সরকারি, বেসরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন। কেউ চাইছেন ঠিকাদারি, কেউ দাবি করছেন চাঁদা, আবার কেউ ব্যস্ত চেয়ার দখল নিয়ে। ক্ষমতার পালাবদলে যেন দখলের মচ্ছব লেগেছে সর্বত্র।

এই নব্য দখলদারেরা রাতারাতি তাঁদের অবস্থান জানান দিতে শুরু করেছেন। বিভিন্ন সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন ও খাসজমি দখল করে দলীয় ব্যানার ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চাপ প্রয়োগ করে, হুমকি দিয়ে ঠিকাদারি কাজের দখলও নেওয়া হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দলবল নিয়ে ঠিকাদারি কাজের জন্য চাপ দিচ্ছে একটি মহল। তারা উন্নয়নকাজগুলো দখলে নিতে মরিয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় পুরোনো ঠিকাদারদের কাজ বন্ধ করে দিয়ে টাকার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতাও চলছে। নিজেদের বঞ্চিত দাবি করা একটি গ্রুপ বিভিন্ন চেয়ারে বসার জন্য দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় চাপ প্রয়োগ করে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে পছন্দের লোকদের পোস্টিং বাগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পদোন্নতিও আদায় করিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশেই চাঁদাবাজি, দখলদারত্ব ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেলেও সেখানে চাঁদাবাজির নতুন সিন্ডিকেটের উদ্ভব হয়েছে। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছে ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরেও

লিখিত অভিযোগ জমা পড়ছে। দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগে বেশ কিছু বিএনপি নেতাকে দল থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে।

এমনিতেই বাংলাদেশ হলো সংঘ, সংগঠন, সমিতি ও জোটের দেশ। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, আমলা, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, আলেম-ওলামা—প্রত্যেকের পৃথক সংগঠন আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় রাতারাতি এই সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব পরিবর্তন ও কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে।

দলবাজি ছাড়া এ দেশে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর অন্য কোনো ভূমিকা নেই। ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনগুলো স্রেফ চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে। পছন্দের লোকদের ভালো পদায়ন ও অপছন্দের লোকদের কোণঠাসা করে রাখাও শ্রমিক সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ায়, আর নানা কৌশলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, সেই টাকা মেরে দিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে। প্রকৌশলীরা ঠিকাদারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করার নেশায় মত্ত। চিকিৎসকেরা পছন্দের জায়গায় পোস্টিং নিয়ে হাসপাতাল ফাঁকি দিয়ে ওষুধ কোম্পানি আর বেসরকারি ক্লিনিকের কমিশন-বাণিজ্য করেন। শিক্ষকেরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোচিং-বাণিজ্য করে, প্রাইভেট পড়িয়ে এবং বিভিন্ন প্রকল্পের পরামর্শক হয়ে টু-পাইস কামানোর ধান্দা করেন। আমলা, পুলিশ, আইনজীবীদের সংগঠনও নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধা আদায়ের ধান্দায় মশগুল থাকে।

দলীয় আনুগত্যই শেষ বিচারে ঠিক করবে তার পদ, অবস্থা—সরকার পরিবর্তনের পর তাই ‘বঞ্চিত’ অংশ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নিজেদের ‘হিস্যা’ বুঝে নেওয়ার অভিযানে। পুরোনো সাইনবোর্ড ফেলে দিয়ে নতুন সাইনবোর্ড তোলা হয়েছে। আমাদের দেশে আমলা, ডাক্তার, পুলিশ, শিক্ষক, প্রকৌশলী প্রভৃতি পেশাজীবীর আয়-উন্নতির নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে দলীয় আনুগত্য। বিদেশে পড়ার বৃত্তি, অর্থ-বিত্ত, প্রভাব, সস্ত্রীক বা সপরিবারে বিদেশ সফরের কাঙ্ক্ষিত সুযোগ; জীবনের রোশনাই আর ভাগ্যের খোলতাই নির্ভর করছে দলীয় রাজনীতির জটিল সমীকরণে তার খেলবার শক্তির ওপর। চাল আর কূটচালে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে দলীয় নেতাদের কতটা নৈকট্যে কারা পৌঁছাতে পারলেন তার ওপরে নির্ভর করছে শান-শওকত, ক্যারিয়ার।

দলের কাজল না মেখে এখন কেউ চোখে দেখে না। গণসংগঠনগুলোও না। আর আমাদের দেশে দল মানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এতে কোনো রাখঢাকের বালাই থাকে না। পিয়ন থেকে সচিব—বলতে গেলে সবাই এই দুই শিবিরে ভাগ হয়ে পড়েছেন। আরও ভয়ংকর যে মহামান্য আদালতের মান্যবর বিচারকদের ক্ষেত্রেও এই রকম সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতিতে ঢুকে পড়ার অভিযোগ উচ্চারিত হচ্ছে।

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, বাসমালিক, আইনজীবী, ট্রাকচালক, ব্যাংক, বিমা, সচিবালয়, ওলামা-মাশায়েখ, ভ্যানচালক সমিতি সবাই দলীয় রাজনীতির ভিত্তিতে তাদের তথাকথিত নেতা নির্বাচিত করছে। কোনোটা হচ্ছে একেবারে নগ্নভাবে, প্রকাশ্যে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে, কোনোটায় আবার কিছুটা আড়াল রাখা হচ্ছে। এই নেতারাই সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিয়োগ-বাণিজ্য, ভর্তি-বাণিজ্য, পদোন্নতি, টেন্ডারসহ তাবৎ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছেন। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দাপট থাকে বেশি, কারণ সুযোগ আর সম্পদের ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ থাকে প্রবল আর বিরোধীপক্ষ অপেক্ষায় থাকে কবে তারা ক্ষমতায় যাবে।

সব শ্রেণির পেশাজীবীদের মধ্যে যেমন দলের খাদেমের অভাব নেই, তেমনি আবার একদল খাদেম আছে, যাদের কোনো দল নেই। তারা সব সময়ই সরকারি দল। খেদমতের নামে নিজেদের আখের গোছাতে সব সময় তারা চেষ্টা করে সরকারি দলে ভিড়তে। তাদের আরেক নাম পারমানেন্ট গভর্নমেন্ট পার্টি। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর এখন বিএনপির খাদেমদের সমারোহ লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মুখ একই, কেবল সাইনবোর্ডটা বদলেছে।

ক্ষমতা বদলের মাস তিনেক হয়েছে। এর মধ্যেই সিবিএগুলোতে কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, মোটরশ্রমিক—সব সংগঠন এখন বিএনপির দখলে। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও ভোল পাল্টে ফেলেছেন। অনেকেই এখন জয় বাংলাপন্থী থেকে জিন্দাবাদপন্থী হয়ে গেছেন। ক্রীড়াঙ্গনেও একই চিত্র।

এতকাল আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা হাজার হাজার শাখা সংগঠনে দেশ ভরে ফেলেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা, শিশু, যুব, স্বেচ্ছাসেবক, কৃষক, হকার, বাস্তুহারা, তাঁতি, মজুর, মুটে, রিকশা-ভ্যানচালক, সিবিএ, ব্যবসায়ী, তথ্যপ্রযুক্তি, সংস্কৃতি, চিকিৎসক, আর্থিক, মৎস্যজীবী, বিনিয়োগকারী, খেলাধুলা,

নারী, শিল্প-বাণিজ্য, ব্যবসায়ী, প্রবীণ নাগরিক, ম্যানেজমেন্ট, মানবাধিকারসহ অসংখ্য সেল তৈরি করেছিল। সেসব সেলে সদস্যেরও কোনো অভাব হয়নি। ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর সব সেল শ্মশানের ছাইয়ের মতো মিলিয়ে গেছে। সেই ভস্মে এখন জন্ম নিয়েছে বিএনপির সব সেল। জন্ম নিয়েছে বললে ভুল হবে, তাদের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে।

দেশজুড়েই আগের রূপে ফিরে এসেছে দখলদারত্ব ও চাঁদাবাজি। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়, কিন্তু এর মধ্যেও রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে চাঁদাবাজের পরিবর্তন হয় কিন্তু চাঁদাবাজি বন্ধ হয় না।

অথচ ৫ আগস্টের পর দেশবাসী এক ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন দেখেছিল। বাংলাদেশ হবে সুশাসিত, গণতান্ত্রিক, জবরদখলবিহীন ও সব প্রকার ক্ষমতার অপব্যবহারের ঊর্ধ্বে—এমনটাই ছিল জনপ্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আড়ালে চলে যাওয়ায় শূন্যস্থান পূরণে ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের একশ্রেণির নেতা-কর্মী ‘এখন আমাদের সময়’ মনে করে আত্মঘাতী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান যে নিপীড়নহীন ও দখলদারমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছে, তাকে প্রহসনে পরিণত করতে যেন উঠেপড়ে লেগেছেন।

এই পরিস্থিতি থেকে যদি উদ্ধার পাওয়া না যায় তাহলে ‘নতুন বাংলাদেশে’র অভীষ্ট ব্যর্থ হয়ে পড়বে।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিষাক্ত গ্যাস

সম্পাদকীয়
বিষাক্ত গ্যাস

মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার—তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ভাববেন। এ রকম একটা অবস্থায় দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়টিতে স্থানীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে মোটেও অনুকূল থাকে না, সেটা বোঝা দরকার।

সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেদক শিয়ালবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক গুদামে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে এখনো অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। রাসায়নিকের ড্রাম থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। প্রায়ই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-এক দিন সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়, তারপর একসময় সেটা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু যে মানুষেরা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতিটি দিনই যে কাটছে ভয়ংকর রাসায়নিকের সঙ্গে লড়াই করে, সে খবর কয়জন রাখে?

চিকিৎসকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পরও বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার ঘনত্ব বেশি থাকে। পরে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ ভুক্তভোগীর শরীরে ঢোকে। ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যতেও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।

বিষাক্ত কণিকা বা গ্যাস মানবদেহে ঢোকে শ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের মাধ্যমে এবং খাদ্যের মাধ্যমে। এই গ্যাস অ্যাজমা, কাশি, গলাজ্বলা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চোখ আর ত্বকও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তৈরি হতে পারে মাথাব্যথা, বমি ও ক্লান্তির মতো ঘটনা। ভারী ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।

শিয়ালবাড়ীর দুর্ঘটনাস্থলের অন্তত এক হাজার গজ পর্যন্ত এলাকায় বাতাসে এখনো পোড়া জিনিস ও গ্যাসের মতো কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখনো রয়েছে সংকটের মুখে।

আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু দেশের মানুষ এ কথাও জানে, সেই মৌলিক অধিকার সব সময় সমুন্নত রাখা হয় না। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি কয়টি গুদামে আছে? এসব জায়গায় কি নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়? শুধু গুদাম কেন, কারখানাগুলোয় কি সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে? শ্রমিকেরা কি নিরাপদে তাঁদের কাজ করে যেতে পারেন?

এসব দুর্ঘটনায় মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা বিপদে পড়েন। তাঁদের পাশে যদি দাঁড়ানো না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, শিল্প-ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে, তা নিরসনের কোনো চিন্তা কারও নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

প্রশ্নবিদ্ধ উপদেষ্টারা ও সরকারের নিরপেক্ষতা

অরুণ কর্মকার
প্রশ্নবিদ্ধ উপদেষ্টারা ও সরকারের নিরপেক্ষতা

না, সব উপদেষ্টা প্রশ্নবিদ্ধ নন। তবে সংখ্যাটা যে নেহাত কম হবে না, তা অনুমান করা যায় যখন প্রধান তিনটি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলই আলাদা আলাদাভাবে উপদেষ্টাদের দলঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তোলে। অবশ্য এবারই প্রথম নয়, এর আগেও একই অভিযোগ তোলা হয়েছে, যখন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম কোনো কোনো উপদেষ্টার সেফ এক্সিটের প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। আর এবার তো জানা গেল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত বুধবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দৃষ্টিতে দলঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের নামধামের তালিকাই নিয়ে গিয়েছিল। তবে ওই দিন সেই তালিকা তারা প্রধান উপদেষ্টাকে দেয়নি। প্রয়োজন হলে পরে দেবে। এবার শুধু বিষয়টি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং কয়েকজন উপদেষ্টা বিএনপির পক্ষে কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেছে।

শুধু উপদেষ্টা নয়, জামায়াত সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা নিয়ে গিয়েছিল প্রায় ৪০ জন আমলারও, যাঁরা তাদের দৃষ্টিতে কোনো না কোনো দলের হয়ে, বিশেষত বিএনপির হয়ে কাজ করছেন। আর বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ ব্রিফিংয়ে জামায়াতের নেতারা উল্লেখ করেছেন যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন ও পুলিশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ লোকই বিএনপির। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে জামায়াত বলেছে, নির্বাচনের আগে সরকারকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। এ জন্য সচিবালয়, পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ে রদবদল আনতে হবে। বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতের আরও অভিযোগ, বিএনপি রাজনৈতিক চাপে পড়ে গণভোটে রাজি হলেও এখন জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

ওই দিনই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি প্রতিনিধিদলও পৃথকভাবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, তাঁরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন, নির্বাচনের আগে বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রশাসন ও পুলিশে নিজেদের মতো ভাগ-বাঁটোয়ারা শুরু করেছে। ডিসি-এসপিদের তালিকা করে সরকারকে দিচ্ছে এবং সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের মধ্য থেকেও এ ব্যাপারে তারা সহযোগিতা পাচ্ছে।

এনসিপির আরও বড় অভিযোগ নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে। প্রধান উপদেষ্টাকে তারা বলেছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। কোনো কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। শাপলা প্রতীক পাওয়া প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলামের স্পষ্ট বক্তব্য হলো, যে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন এবং প্রতীকের বিষয়ে এনসিপির সঙ্গে ন্যায়বিচার করে না, তার অধীনে নির্বাচনে গিয়ে ন্যায়বিচার এবং নিরপেক্ষতা বা সঠিক ফলাফল পাওয়ার ব্যাপারে ভরসা করা যায় না। তাই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের যুক্তি হলো, নির্বাচন কমিশনের কারণে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন না হয়, সেই দায়ও সরকারের ওপরই পড়বে।

উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রশ্ন আছে বিএনপিরও। জামায়াত ও এনসিপির এক দিন আগে, গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। সেই বৈঠকে তারাও কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি তুলেছে। কারও নাম উল্লেখ না করেই বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে আহ্বান জানিয়েছে দলটি। এর আগেও বিএনপির পক্ষ থেকে এমন আহ্বান জানানো হয়েছিল। তখন দুই ছাত্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছিল বলেও খবর বেরিয়েছে। তবে তাঁরা তখনই তাতে রাজি হননি। উপদেষ্টাদের ছাড়াও প্রশাসন নিয়েও অন্য দুই দলের মতোই উদ্বেগ আছে বিএনপিরও। মঙ্গলবারের বৈঠকে তারা এই বলে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে প্রশাসন, পুলিশ এবং বিচার বিভাগের প্রায় ৫০ ভাগ ফ্যাসিস্টের দোসর।

তিনটি দলের সঙ্গে বৈঠকেই প্রধান উপদেষ্টা সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে আমরা ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি; সামনে আরও অনেক উদ্যোগ আপনারা দেখতে পাবেন।’

তা প্রধান উপদেষ্টা যতই নিশ্চয়তা দিন না কেন, যেখানে সব দলের কাছেই উপদেষ্টাদের (সবার নয়) এবং প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্টতা স্পষ্ট, যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে উল্লেখ করে যখন প্রকাশ্যে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে নিশ্চিন্তে নিশ্চিত থাকতে পারে! তা ছাড়া, মাঝেমধ্যেই তো দলগুলোর পরস্পরের প্রতি বৈরী বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যেমন কিছুদিন আগে এনসিপির আহ্বায়ক তাঁর ফেসবুক পোস্টে বললেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন (পিআর) নিয়ে জামায়াতের আন্দোলন রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। কিংবা জামায়াত জুলাই অভ্যুত্থানের আগে-পরে কখনোই সংস্কার আলোচনায় যুক্ত হয়নি। তারা কোনো কার্যকর প্রস্তাব দেয়নি। কোনো সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেনি এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকারও দেখায়নি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বললেন আরও একটু শক্ত কথা—‘জন্মের পরই বাপের সাথে পাল্লা দিতে যেও না।’ সরকার ভাবতে পারে যে এগুলো তো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার বাহাস। এটা নিয়ে তাদের অতটা না ভাবলেও চলবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই বাহাসগুলো তো রাজনৈতিক বাস্তবতা। এগুলো তো রাজনৈতিক অঙ্গনকে অস্থিতিশীল করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশেও প্রভাব ফেলতে পারে।

তারপর উল্লেখ করা যায় মঙ্গলবারের বৈঠকে বিএনপি যে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, সে সম্পর্কে এনসিপির প্রতিক্রিয়ার কথা। এনসিপি বলল হঠাৎ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরামর্শটি দুরভিসন্ধিমূলক। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকার গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি তাদের ম্যান্ডেট। অথচ বিএনপির বক্তব্যটি ছিল—নিরপেক্ষতার নিরিখে এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নিতে হবে।

এইসব রাজনৈতিক টানাপোড়েন ছাড়াও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। যেমন জামায়াতের কাছে অমীমাংসিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি, ওই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী নভেম্বরে গণভোট। এই দাবিতে জামায়াতসহ আটটি দল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এনসিপির কাছে অমীমাংসিত বিষয় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং তাদের দাবিকৃত নির্বাচনী প্রতীক শাপলা বরাদ্দ দেওয়া। বিএনপির কাছে সবচেয়ে বড় ইস্যু সময়মতো সুষ্ঠু নির্বাচন। এ ছাড়া এই তিনটি দলের কাছেই (হয়তো আরও অনেক দলের কাছে) সাধারণ ইস্যু হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য দলঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়া। এর মধ্যে বেশ কিছু বিষয় প্রতিটি দল চায় না। এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সেই ভূমিকা নিরপেক্ষ হিসেবেই প্রতীয়মান হওয়া এক বড় চ্যালেঞ্জই বটে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পাঠকের লেখা /স্বার্থের সমাজে বন্ধুত্ব

হেনা শিকদার
আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ১১
স্বার্থের সমাজে বন্ধুত্ব

সমাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে, পৃথিবী প্রবেশ করেছে এক নতুন যুগে। এই গতিময় সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরা হয়তো অনেক কিছু পাচ্ছি, কিন্তু হারিয়ে ফেলছি আরও বেশি কিছু। আজ আমরা এক অদ্ভুত স্বার্থপর সময়ে বাস করছি, যেখানে প্রতিটি সম্পর্কের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি। এমন এক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে যে সম্পর্কটি, মানুষের আত্মার সঙ্গে মিশে থাকে—বন্ধুত্ব।

একসময় বন্ধুত্ব ছিল নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক দারুণ উদাহরণ। সেখানে লেনদেনের কোনো হিসাব ছিল না, ছিল শুধু একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, আস্থা এবং নির্ভরতা। শৈশবের সেই দিনগুলোর কথা মনে করলে আজও অনেকের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। টিফিনের খাবার ভাগ করে খাওয়া, বন্ধুর দুঃখে নির্দ্বিধায় পাশে দাঁড়ানো, কিংবা সামান্য কারণে অহেতুক ঝগড়া করে আবার মুহূর্তেই সব ভুলে গিয়ে একে অপরের হাত ধরার মধ্যে যে পবিত্রতা ছিল, আজকের যান্ত্রিক সভ্যতায় তা যেন এক দুর্লভ বস্তু।

বর্তমান সমাজব্যবস্থা আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে সবকিছুকে ব্যক্তিগত লাভের নিরিখে বিচার করতে হয়। আমরা এখন বন্ধু বানানোর আগেও অবচেতন মনে বিচার করে নিই—এই সম্পর্কটি আমার জীবনে কতটা মূল্য যোগ করবে? তার সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, কিংবা তার মাধ্যমে আমার কোনো উপকার হবে কি না—এইসব প্রশ্নই এখন বন্ধুত্বের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, একধরনের ‘শর্তাধীন’ বন্ধুত্বের জন্ম হচ্ছে, যেখানে স্বার্থের লেনদেন শেষ হলেই সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যায়। এই ধরনের বন্ধুত্ব অনেকটা ব্যবসায়িক চুক্তির মতো, যেখানে একে অপরকে ব্যবহার করে নিজের আখের গোছানোই মূল উদ্দেশ্য।

এই স্বার্থপরতার পেছনে অবশ্য বেশ কিছু সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। প্রথমত, আধুনিক জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান চাপ এবং প্রতিযোগিতা মানুষকে এতটাই আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে যে, সে নিজের জগৎ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তার এক মায়াবী জগতের সৃষ্টি করেছে। এখানে মানুষের বন্ধুর সংখ্যা হাজার হাজার, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ভরসা করার মতো বন্ধুর সংখ্যা প্রায় শূন্য। লাইক, কমেন্ট এবং শেয়ারের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব আসলে একধরনের লোকদেখানো সম্পর্ক, যার গভীরে কোনো প্রাণের ছোঁয়া নেই। এখানে সবাই যেন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে—কার কত বন্ধু, কে কতটা জনপ্রিয়। এই জাঁকজমকপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের সত্যিকারের আবেগ এবং অনুভূতি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

তবে এই হতাশাজনক চিত্রের মধ্যেও আশার আলো রয়েছে। স্বার্থের এই ঝোড়ো হাওয়ার বিপরীতে দাঁড়িয়েও কিছু মানুষ এখনো সত্যিকারের বন্ধুত্বের পতাকা উড়িয়ে চলেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, বন্ধুত্ব মানে শুধু দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক নয়, বরং এটি একটি আত্মিক টান, যা কোনো স্বার্থের বিনিময়ে বিক্রি হয় না। একজন সত্যিকারের বন্ধু আয়নার মতো, যে কেবল আমাদের ভালো দিকগুলোই তুলে ধরে না, বরং আমাদের ভুলগুলোও দেখিয়ে দেয়। সে আমাদের বিপদের দিনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় এবং আনন্দের দিনে মন খুলে হাসে।

এই স্বার্থপর সময়ে সত্যিকারের বন্ধু খুঁজে পাওয়া হয়তো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বন্ধুত্বের সম্পর্ককে যদি আমরা লাভ-ক্ষতির হিসাব থেকে মুক্ত করতে পারি, তবেই এর আসল সৌন্দর্য উপলব্ধি করা সম্ভব। বন্ধুত্ব কোনো পণ্য নয় যে তাকে ব্যবহার করে ফেলে দিতে হবে। এটি একটি চারা গাছের মতো, যাকে যত্ন, বিশ্বাস এবং সময় দিয়ে বড় করে তুলতে হয়। যখন একজন মানুষ সব ধরনের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আরেকজন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তখনই জন্ম নেয় এক নির্মল বন্ধুত্ব।

স্বার্থের এই সমাজে বন্ধুত্বের মানে হলো এক নিঃস্বার্থ আশ্রয়। এমন এক সম্পর্ক, যেখানে আপনি কোনো মুখোশ ছাড়াই নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন, যেখানে আপনার দুর্বলতাগুলো নিয়ে কেউ উপহাস করবে না, বরং আপনাকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। এই বন্ধুত্ব আপনাকে শেখাবে যে পৃথিবীতে এখনো এমন কিছু সম্পর্ক আছে, যা অর্থ বা ক্ষমতার বিনিময়ে কেনা যায় না, যা কেবল হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। তাই এই যান্ত্রিক সভ্যতায় হারিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের উচিত জীবনের সেই নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলোকে খুঁজে বের করা এবং পরম মমতায় সেগুলো আগলে রাখা। কারণ, দিন শেষে এই সম্পর্কগুলোই আমাদের বেঁচে থাকার আসল প্রেরণা জোগায়।

শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পাঠকের লেখা /বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব

রিয়াদ হোসেন
আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১১: ৪৩
বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিক্ষয় রোধসহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করে আসছে। এই সুন্দরবনের এক অনন্য প্রজাতির প্রাণী হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

সাধারণ মানুষের মতো বাঘেরও প্রধান দুটি মৌলিক চাহিদা হলো খাদ্য ও বাসস্থান। বিশেষ করে খাদ্যের জোগান এবং আবাসস্থল নিরাপদ করতে পারলে বাঘ বাঁচিয়ে রাখা কিংবা তাদের প্রজনন বৃদ্ধিতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। এ জন্য সুন্দরবনকে বন্য প্রাণীর অবাধ বিচরণের জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে বাঘসহ অন্য প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে এখন বাঘের অস্তিত্ব আছে। বাঘ বাঁচাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সেসব দেশের সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান রক্ষায় অন্য প্রজাতির প্রাণী থেকে বাঘ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সুন্দরবনে চোরা শিকারি বাঘের প্রধান হুমকি। কিছু অতিলোভী চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের জন্য দিন দিন বাঘের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সবশেষ তথ্যমতে, সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ১১৪টি। কয়েক বছর আগে বড় বড় বনদস্যু দলের আত্মসমর্পণের ফলে বাঘনিধন কিছুটা কমে এসেছে। দুই বছর আগেও খাদ্যসংকটে বাঘ লোকালয়ে এলে হত্যা করা হতো। এখন সেটিও অনেকটা বন্ধ হয়েছে। বন সংরক্ষণে বন মন্ত্রণালয়ের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে সুন্দরবনসংলগ্ন স্থানীয় মানুষ আগের থেকে অনেক সচেতন হয়ে উঠেছে। এ জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর জীবিকায় সরকারকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের জীবন-জীবিকার জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের বিষয়ে আরও বেশি কাজ করতে হবে।

সুন্দরবনকে বাঁচাতে এবং বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে বাঘ সংরক্ষণের বিকল্প নেই। আর এ জন্য বন বিভাগ কিংবা সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে সুন্দরবন বা বাঘ কোনোটাই রক্ষা করা সম্ভব হবে না; যদি আমরা আমাদের নিজেদের জায়গা থেকে সচেতন না হই। পাশাপাশি বাঘনিধন ও হরিণ শিকার বন্ধের জন্য ২০১২ সালে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যে আইনের ৩৬ ধারায় বাঘশিকারি বা হত্যাকারী জামিন-অযোগ্য হবেন এবং সর্বোচ্চ সাত বছর সর্বনিম্ন দুই বছর কারাদণ্ড ও ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ আইনটিও অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে সুন্দরবন বাঁচানোর পাশাপাশি বাঘ, হরিণসহ নানা প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত