সাহিদা পারভীন শিখা
চার দশকের বেশি সময় ধরে শ্রমিকের পাশে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছি। প্রতিদিনই শ্রমিকের কণ্ঠ শুনি—কখনো রুটি-রুজির কথা, কখনো নিরাপত্তার অভাব, কখনো মজুরিবৈষম্য তথা নিপীড়নের গল্প। কিন্তু কোনো গল্পই যেন মৃত্যুর গল্পের চেয়ে বড় হয় না। প্রতি মাসে, প্রতি সপ্তাহে, এমনকি প্রায় প্রতিদিনই খবর পাই কেউ সড়কে প্রাণ হারাল, কেউ বিদ্যুতায়িত হলো, কেউ উঁচু ভবন থেকে পড়ে গেল—এভাবেই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু এসব মৃত্যু আমাদের সমাজ কেবল সংখ্যা হিসেবেই দেখে।
সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির জরিপ বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় ৪২২ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। আগের বছরের তুলনায় সংখ্যা কমলেও এই কমাটুকু আমাদের গর্বের নয়, বরং ভয় ও বেদনার। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু পরিবহন খাতে—২০৭ জন। তারপর আছে নির্মাণ, কৃষি, কলকারখানা, এমনকি সেবামূলক খাতও।
আমি একবার দুর্ঘটনার শিকার একজন শ্রমিকের বাড়িতে গিয়েছিলাম। দুটি ছোট বাচ্চা মুখ তুলে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল আর বলছিল, ‘বাবা কই? কখন ফিরবে?’ আমি চুপ করে ছিলাম। কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। কী বলব? কীভাবে বলব, ওর বাবার হেলমেট ছিল না, কারণ মালিক দিতে চায়নি। কীভাবে বলব, ওর বাবার কর্মস্থলে কোনো নিরাপত্তা প্রটোকল ছিল না। এই প্রশ্ন শুধু আমাকে নয়, আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকেও কাঁপিয়ে তোলার কথা।
এসআরএস বলেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ২৬৭ জন মারা গেছে, যা মোট মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। আমরা সবাই জানি, আমাদের পরিবহন খাত অগোছালো, চালকেরা অদক্ষ, গাড়ি চলাচলে কোনো শৃঙ্খলা নেই। অনেক গাড়ির ফিটনেস নেই। চালকেরা বেপরোয়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত দিন ধরে কেন এই খাত সংস্কার করা গেল না?
বজ্রপাতেও প্রাণ গেছে ৫৬ জনের—এটি প্রাকৃতিক, কিন্তু কৃষিশ্রমিকদের সুরক্ষায় কী ব্যবস্থা আছে? নির্মাণশ্রমিক যাঁরা দিনে ১২ ঘণ্টা খালি পায়ে রড-বালু বয়ে ভবনে তোলেন, তাঁরা ছাদ থেকে পড়ে মারা যান—তাঁদের জন্য কি কোনো নিরাপদ মই, হেলমেট, বেল্টব্যবস্থা থাকা উচিত নয়?
আমরা যাঁরা শ্রমিকসংগঠনের সঙ্গে আছি, আমরা জানি, শ্রমিক শুধু মৃত্যুর ঝুঁকিতেই কাজ করছেন না, বরং তাঁদের মৃত্যুও যেন আরেকটি উৎপাদন খরচ মাত্র। কোনো কোনো মালিক বলেন, ‘হয়েছে তো একটা দুর্ঘটনা, বেশি বলার কী আছে?’ কেউ কেউ এমনও বলেন, ‘এত হাহুতাশ করার কী আছে? নতুন লোক পাওয়া যাবে।’
শ্রমিক বা শ্রমজীবী মানুষের জীবন মূল্যহীন। আরও গভীর সমস্যা হলো—অধিকাংশ দুর্ঘটনার পর আইনিপ্রক্রিয়া হয় না, ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা। একটি শিশু তার বাবাকে হারিয়ে শুধু দুঃখই পায় না, পায় না স্কুলে যাওয়ার সুযোগ, খাবার, ওষুধ, কিংবা জীবনের স্বপ্ন। একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীর শবদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরেন, সঙ্গে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা।
এসআরএস বলেছে, দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি, মালিকদের উদাসীনতা, এমনকি জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থার অভাব অন্যতম। এসব কথা আমরা বারবার বলে এসেছি। কিন্তু শোনে কে?
আমরা যখন ‘শ্রমিক নিরাপত্তা’ বলি, তখন সেটি যেন একটি আনুষ্ঠানিক শব্দ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ এই নিরাপত্তাই একজন মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার। শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ আছে—কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে? কেবল কাগজে লিখলেই কি নিরাপত্তা আসবে?
এখন আর শুধু জরিপ দেখার সময় নয়, এখন সময় ব্যবস্থা বদলানোর।
আমরা, শ্রমিকেরা, নারী শ্রমিকেরা, প্রতিদিন কারখানায় বা অন্য কর্মস্থলে কাজ করি, কাজ শেষে প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরতে পারব কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকি। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা মেনে নেওয়ার নয়। মৃত্যুর সঙ্গে বসবাসের দিন কবে শেষ হবে জানি না কেউ। তাই এখন আমাদের চাওয়া—জীবন চাই, মৃত্যু নয়। নিরাপত্তা চাই, করুণা নয়।
শ্রমিকের মৃত্যু আর মেনে নেওয়া যায় না—এখন প্রতিরোধের সময়। নইলে আমাদের সন্তানেরাও একদিন বলবে, ‘মা, তুমি জীবিকার জন্য যে কর্মক্ষেত্র বেছে নিয়েছিলে, সেই কর্মস্থলই তোমার জীবন কেড়ে নিল কেন?’
আমার কোনো উত্তর থাকবে না। তবে এর উত্তর থাকা উচিত—রাষ্ট্রের, সমাজের, সবার কাছে।
লেখক:– সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
চার দশকের বেশি সময় ধরে শ্রমিকের পাশে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছি। প্রতিদিনই শ্রমিকের কণ্ঠ শুনি—কখনো রুটি-রুজির কথা, কখনো নিরাপত্তার অভাব, কখনো মজুরিবৈষম্য তথা নিপীড়নের গল্প। কিন্তু কোনো গল্পই যেন মৃত্যুর গল্পের চেয়ে বড় হয় না। প্রতি মাসে, প্রতি সপ্তাহে, এমনকি প্রায় প্রতিদিনই খবর পাই কেউ সড়কে প্রাণ হারাল, কেউ বিদ্যুতায়িত হলো, কেউ উঁচু ভবন থেকে পড়ে গেল—এভাবেই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু এসব মৃত্যু আমাদের সমাজ কেবল সংখ্যা হিসেবেই দেখে।
সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির জরিপ বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় ৪২২ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। আগের বছরের তুলনায় সংখ্যা কমলেও এই কমাটুকু আমাদের গর্বের নয়, বরং ভয় ও বেদনার। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু পরিবহন খাতে—২০৭ জন। তারপর আছে নির্মাণ, কৃষি, কলকারখানা, এমনকি সেবামূলক খাতও।
আমি একবার দুর্ঘটনার শিকার একজন শ্রমিকের বাড়িতে গিয়েছিলাম। দুটি ছোট বাচ্চা মুখ তুলে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল আর বলছিল, ‘বাবা কই? কখন ফিরবে?’ আমি চুপ করে ছিলাম। কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। কী বলব? কীভাবে বলব, ওর বাবার হেলমেট ছিল না, কারণ মালিক দিতে চায়নি। কীভাবে বলব, ওর বাবার কর্মস্থলে কোনো নিরাপত্তা প্রটোকল ছিল না। এই প্রশ্ন শুধু আমাকে নয়, আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকেও কাঁপিয়ে তোলার কথা।
এসআরএস বলেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ২৬৭ জন মারা গেছে, যা মোট মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। আমরা সবাই জানি, আমাদের পরিবহন খাত অগোছালো, চালকেরা অদক্ষ, গাড়ি চলাচলে কোনো শৃঙ্খলা নেই। অনেক গাড়ির ফিটনেস নেই। চালকেরা বেপরোয়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত দিন ধরে কেন এই খাত সংস্কার করা গেল না?
বজ্রপাতেও প্রাণ গেছে ৫৬ জনের—এটি প্রাকৃতিক, কিন্তু কৃষিশ্রমিকদের সুরক্ষায় কী ব্যবস্থা আছে? নির্মাণশ্রমিক যাঁরা দিনে ১২ ঘণ্টা খালি পায়ে রড-বালু বয়ে ভবনে তোলেন, তাঁরা ছাদ থেকে পড়ে মারা যান—তাঁদের জন্য কি কোনো নিরাপদ মই, হেলমেট, বেল্টব্যবস্থা থাকা উচিত নয়?
আমরা যাঁরা শ্রমিকসংগঠনের সঙ্গে আছি, আমরা জানি, শ্রমিক শুধু মৃত্যুর ঝুঁকিতেই কাজ করছেন না, বরং তাঁদের মৃত্যুও যেন আরেকটি উৎপাদন খরচ মাত্র। কোনো কোনো মালিক বলেন, ‘হয়েছে তো একটা দুর্ঘটনা, বেশি বলার কী আছে?’ কেউ কেউ এমনও বলেন, ‘এত হাহুতাশ করার কী আছে? নতুন লোক পাওয়া যাবে।’
শ্রমিক বা শ্রমজীবী মানুষের জীবন মূল্যহীন। আরও গভীর সমস্যা হলো—অধিকাংশ দুর্ঘটনার পর আইনিপ্রক্রিয়া হয় না, ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা। একটি শিশু তার বাবাকে হারিয়ে শুধু দুঃখই পায় না, পায় না স্কুলে যাওয়ার সুযোগ, খাবার, ওষুধ, কিংবা জীবনের স্বপ্ন। একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীর শবদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরেন, সঙ্গে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা।
এসআরএস বলেছে, দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি, মালিকদের উদাসীনতা, এমনকি জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থার অভাব অন্যতম। এসব কথা আমরা বারবার বলে এসেছি। কিন্তু শোনে কে?
আমরা যখন ‘শ্রমিক নিরাপত্তা’ বলি, তখন সেটি যেন একটি আনুষ্ঠানিক শব্দ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ এই নিরাপত্তাই একজন মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার। শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ আছে—কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে? কেবল কাগজে লিখলেই কি নিরাপত্তা আসবে?
এখন আর শুধু জরিপ দেখার সময় নয়, এখন সময় ব্যবস্থা বদলানোর।
আমরা, শ্রমিকেরা, নারী শ্রমিকেরা, প্রতিদিন কারখানায় বা অন্য কর্মস্থলে কাজ করি, কাজ শেষে প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরতে পারব কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকি। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা মেনে নেওয়ার নয়। মৃত্যুর সঙ্গে বসবাসের দিন কবে শেষ হবে জানি না কেউ। তাই এখন আমাদের চাওয়া—জীবন চাই, মৃত্যু নয়। নিরাপত্তা চাই, করুণা নয়।
শ্রমিকের মৃত্যু আর মেনে নেওয়া যায় না—এখন প্রতিরোধের সময়। নইলে আমাদের সন্তানেরাও একদিন বলবে, ‘মা, তুমি জীবিকার জন্য যে কর্মক্ষেত্র বেছে নিয়েছিলে, সেই কর্মস্থলই তোমার জীবন কেড়ে নিল কেন?’
আমার কোনো উত্তর থাকবে না। তবে এর উত্তর থাকা উচিত—রাষ্ট্রের, সমাজের, সবার কাছে।
লেখক:– সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র
আবারও বন্যা, আবারও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দেশের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষত ফেনী অঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে একাধিক নদীর প্লাবন এবং সেই সঙ্গে অবিরাম বর্ষণের ফলে উত্তরবঙ্গও বন্যা প্লাবিত হতে পারে।
১৮ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় একটা নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ ধরনের বর্বরোচিত লোমহর্ষ হত্যাকাণ্ড ইতিপূর্বে ঘটেছে কি না মনে পড়ে না। একজন ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগকে আদিম যুগের আদলে পাথর দিয়ে আঘাত করে, তাঁর নিথর দেহের ওপর লাফিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে।
১৮ ঘণ্টা আগেজীবনের যাত্রাপথে আমরা অনেক মানুষের সান্নিধ্যে আসি। কেউ কেউ কেবল সহযাত্রী, কেউ কেউ হয়ে ওঠেন বাতিঘর। অধ্যাপক বদিউর রহমান ছিলেন তেমন একজন—নিঃশব্দ আলোকবর্তিকা, যিনি নিজের আলোয় নিজেকে পোড়াতে জানতেন, কিন্তু কখনো আলো জ্বালাতে চেষ্টার ভান করতেন না।
১৮ ঘণ্টা আগেবুধবার গোপালগঞ্জে যে সংঘর্ষ হলো, তা কি এড়ানো যেত না? আবার ঝরে পড়ল চারটি তাজা প্রাণ। এনসিপির সমাবেশে হামলা হলো, সংঘর্ষ হলো, গুলি চলল, আহত হলো শতাধিক মানুষ।
১৮ ঘণ্টা আগে