Ajker Patrika

তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল

আজাদুর রহমান চন্দন
মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবস্থা নিতে দেরি করা এসব ঘটনার প্রতি সহানুভূতির বার্তা দেয়
মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবস্থা নিতে দেরি করা এসব ঘটনার প্রতি সহানুভূতির বার্তা দেয়

মব ভায়োলেন্স তথা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ সহিংসতাই যেন কথিত নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের পথ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে উল্টো এর সাফাই গাওয়ায় এমন ধারণার উদ্রেক হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক? মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মব সহিংসতায় অন্তত ১৭৪ জন নিহত হয়েছে। হত্যার ঘটনা ছাড়াও এই ১০ মাসে ‘মব জাস্টিসের’ নামে ব্যক্তির ওপর হামলা, অফিস ও ঘরবাড়ি লুটপাট, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা-মাজার-আখড়া ভাঙা, এমনকি নারীদের ফুটবল ম্যাচ পর্যন্ত বন্ধ করার ঘটনা ঘটেছে। আসকের তথ্যমতে, কোথাও চোর-ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজ এবং কোথাও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সহযোগী বা দোসর অপবাদ দিয়ে মব সৃষ্টি করে এসব মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও ছিল না। সরকার এসব ঘটনায় দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় জনতা মব সন্ত্রাসে উৎসাহিত হচ্ছে। এতে স্বেচ্ছাচারী ‘বিচার’ নিয়মিত মামুলি ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের কারও কারও মন্তব্য মব সন্ত্রাসীদের রীতিমতো উসকানি দিচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ের সামনে যে মব তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলোকে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে দেখছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তাঁর মতে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে যাঁরা গণমাধ্যম দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরাই এই প্রেশার গ্রুপ তৈরি করছেন।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মতে, মব সন্ত্রাসের ঘটনায় পুলিশের ব্যবস্থা নিতে দেরি করা বা হস্তক্ষেপে নীরব মানসিকতার কারণে এসব ঘটনার প্রতি সহানুভূতির বার্তাই দিচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, সহিংসতার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরে পুলিশ সক্রিয় হয়েছে। এমনকি, জনতা তাণ্ডব চালালেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার ওপর হামলা।

যদিও সেনাপ্রধানের হুঁশিয়ারি এবং রংপুরে জি এম কাদেরের বাসভবনে হামলার ঘটনায় সেনাবাহিনীর তৎপরতার পর জনমনে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এসেছিল। বলা চলে, মব সন্ত্রাস খানিকটা থমকেও ছিল। কিন্তু এখন আবার শুরু হয়েছে এই বর্বরতা। রাজধানীতে সাবেক সিইসি নূরুল হুদাকে তাঁর বাসা থেকে বের করে এনে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছনা, খিলক্ষেত এলাকায় মব তৈরির হুমকির মুখে রেলওয়ের জমিতে থাকা একটি অস্থায়ী মণ্ডপ উচ্ছেদ এবং লালমনিরহাটে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সনাতন ধর্মাবলম্বী পিতা-পুত্রকে হেনস্তার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কেউ কেউ দেশকে ‘মবের মুল্লুক’ বলতেও পিছপা হচ্ছেন না।

২২ জুন রাজধানীর উত্তরায় একদল লোক সাবেক সিইসি নূরুল হুদার বাসায় ঢুকে তাঁকে বের করে আনে। পরে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করে তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ঘটনার সময় সেখানে পুলিশ উপস্থিত ছিল। পুলিশ বলছে, ‘মব’ তৈরি করে নূরুল হুদাকে হেনস্তার ঘটনায় ফরিদ হোসেন নেতৃত্ব দিয়েছেন। ভিডিও ফুটেজ ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ফরিদসহ ছয়জনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাঁরা সবাই ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, কে এম নূরুল হুদার ওপর হামলার ঘটনাটি পৃথিবীর মানুষ দেখলে বাংলাদেশের মানুষকে অসভ্য ও বর্বর সম্বোধন করবে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে এক বিবৃতিতে অন্তর্বর্তী সরকার জানায়, মব সৃষ্টির মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। পরে উত্তরা পশ্চিম থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব মো. হানিফ মিয়াকে আটক করে সেনাবাহিনী। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা মব সহিংসতার সমালোচনা করলেও নূরুল হুদাকে হেনস্তার ঘটনায় জড়িত দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এখনো সাংগঠনিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

খিলক্ষেত এলাকায় দুর্গাপূজা আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের অনুমতি নিয়েই গত বছরের সেপ্টেম্বরে তৈরি করা হয়েছিল অস্থায়ী মণ্ডপটি। এরপর থেকে একটি ‘অস্থায়ী মন্দির’ হিসেবে সেখানে ধর্মীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন পূজা আয়োজকেরা। কয়েক দিন আগে ‘স্থানীয় মুসল্লি’ পরিচয়ে কিছু মানুষ ওই অস্থায়ী মন্দিরটি ভাঙার আলটিমেটাম দেয়। মন্দির কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক সজীব সরকার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘মন্দিরে ঠাকুরের প্রতিমা ছিল, সেগুলোসহ ভাঙা হয়েছে, আগে থেকে জানালে প্রতিমাগুলো সরাতে পারতাম আমরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক সরকারি জমিতে তো মসজিদ-মাদ্রাসা আছে, সেখানে তো কিছু হয় না!’ অনেককে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ ধরনের মন্তব্য করতে দেখা গেছে।

লালমনিরহাটের সদর উপজেলার গোশালা বাজার এলাকায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ‘মব’ তৈরি করে নরসুন্দর বাবা ও ছেলেকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে একদল উত্তেজিত লোক। পুলিশ ওই দুজনকে আটক করেছে। আটক ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, চুল কাটানোর পর টাকা কম দেওয়া নিয়ে তর্কের জের ধরে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তুলে ওই দুজনকে পরিকল্পিতভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। ওই হেনস্তার ঘটনায় যত না সমালোচনা হচ্ছে, তার চেয়ে ঢের বেশি সমালোচনা তৈরি হয়েছে ঘটনার পর মবের সামনে লালমনিরহাট সদর থানার ওসি মোহাম্মদ নুরনবীর দেওয়া একটি বক্তব্য নিয়ে। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে ওসিকে বলতে শোনা যায়, ‘ওসি হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আমার। কিন্তু যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা আমারও কলিজায় আগুন লেগেছে। আপনাদের মতো চোখে পানি আমারও এসেছে। কীভাবে এত বড় ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এ দেশে করে! আমি আপনাদের ওয়াদা দিলাম। তাদের যখন অ্যারেস্ট করেছি; বাংলাদেশে এমন মামলা তাদের দেব, নিশ্চিত তাদের যেন যাবজ্জীবন বা ফাঁসি হয়...।’

মব সহিংসতা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেও কিছু মানুষ বিগত সরকারের সময়ের দু-একটি ঘটনার নজির দেখিয়ে এখনকার সহিংসতার সাফাই গাইছেন। তখন বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও সেগুলো কি সরকারের প্রশ্রয় পেয়েছিল? বিচারের আওতায় আসেনি? কেউ কেউ আবার কয়েক ধাপ এগিয়ে ‘মব সংস্কৃতির’ দায় দেওয়ার চেষ্টা করছেন নব্বইয়ের দশকের গণ-আদালত কিংবা ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের কাঁধে। তাদের কে বোঝাবে যে ওই দুটি ঘটনার কোনোটিতেই সামান্যতম সহিংসতা ছিল না। উভয় ঘটনায় দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের মনের কথাই কেবল উচ্চারিত হয়েছিল। শাহবাগে যখন গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশ চলছিল, তখন ঢিল ছোড়ার দূরত্বে হাসপাতালে অবস্থান (বন্দী হিসেবে) করছিলেন জামায়াত নেতা গোলাম আযম। কেউ কি বলতে পারবে, ওই সমাবেশ থেকে গোলাম আযমকে লক্ষ্য করে একটি ঢিল ছোড়ারও চেষ্টা করা হয়েছিল? দেশে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে গণপিটুনিতে হত্যা আগেও ছিল। তবে আগে পিটুনির শিকার হয়েছে মূলত চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী ও শিশু অপহরণকারী সন্দেহে জনতার হাতে ধরা পড়া ব্যক্তি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা নতুন রূপ নিয়েছে। মব জাস্টিসের নামে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যেকোনো ক্ষেত্রে। পুলিশ সদস্যও রেহাই পাচ্ছেন না এই সহিংসতা থেকে।

আওয়ামী লীগের শাসনকালে অবশ্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ বা ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে হামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগ পরে আর প্রমাণ করা যায়নি। বরং বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অভিযোগ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। সে সময় ধর্ম অবমাননার অজুহাত সাজানো এবং সহিংসতা সহজ হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাও কম দায়ী ছিল না। এসব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের ভূমিকা দেখে মনে হতো, তারা যেন একবার ব্যাঙের গালে আর একবার সাপের গালে চুমু খায়।

মনে রাখা দরকার, একটা অন্যায় দিয়ে আরেকটা অন্যায়কে কখনোই জায়েজ করা যায় না। এমন চেষ্টা করলে বরং হিতে বিপরীত হয়ে থাকে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে যেকোনো অপরাধ বহুমাত্রিক রূপ নেয় এবং জ্যামিতিক হারে বাড়ে। বিশেষ করে ক্ষমতার পালাবদল হলে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রূপ-মাত্রা কতটা বাড়ে, সেটা বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে কে আর বেশি জানে!

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত