Ajker Patrika

ফেমিনিস্ট পুরুষ মানেই প্রকৃত প্রেমিক পুরুষ

নজরুল জাহিদ
আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৪, ১৮: ৪৭
Thumbnail image

পুরুষতন্ত্র সম্পর্কে প্রথম টের পাই অতি শৈশবে। মার সঙ্গে নানিবাড়ি গেছি। মা তার মেয়েবেলার সখীদের সঙ্গে মাতামাতি করছে, জোরে জোরে হাসছে, দু–একটা ‘বাজে কথাও’ বলছে এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার, মা তাদের সঙ্গে কথায় কথায় দ্বিমত করছে, নিজের মত দিচ্ছে। 

সেই প্রথম জানলাম, আমার মায়েরও নিজের কথা আছে! অথচ মা বাড়িতে আব্বার মুখের ওপর তেমন কিছুই বলে না। টের পেলাম, কিছু একটা সমস্যা আছে। 

যৌনশিক্ষা পাইনি শৈশবে। ফলে সবকিছু স্পষ্ট বুঝতাম না। ‘পেট বাধানো’, ‘পেট খালাস,, ‘নাং করা’, ‘ছিনালি করা’, ‘বের হয়ে যাওয়া’—এই সব শব্দ উচ্চারণ করে মেয়েদেরকেই অন্য মেয়েদের সম্পর্কে বেশি কানাঘুষা করতে শুনতাম। আঁতুড় ঘরটা দেখতাম বাড়ির সবচেয়ে খারাপ জায়গায়। যেন সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে সাজা পাচ্ছেন মা। মেয়েদের আরেকটা সাজা ছিল মাসিকের সময়। সবাইকে বলতে শুনতাম ‘শরীর খারাপ’। 

একটা দৃশ্যের কথা মনে আছে। প্রতিবেশীর বাড়ির উঠোনের এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাদের ১২ / ১৩ বছরের মেয়ে। মেয়েটির চাচা ভীষণ গালমন্দ করছে মেয়েটিকে। সঙ্গে সায় দিচ্ছে চাচি। ‘এত বড় ধাড়ি মেয়ে (মাসিকের) ত্যানা সামলাতে পারে না’, এ রকম কথা শুনছি। বুঝতে পারছি না আসলে কী হয়েছে। বকাঝকা চলছে। যা বুঝলাম, মেয়েটি তার ‘মাসিকের ত্যানা’ ঘরের পেছনের বেড়ায় গুঁজে রেখেছিল। কুকুর সেই কাপড় মুখে করে উঠোনে এনে ফেলেছে। এ নিয়েই হেনস্তা। 

 ‘শরীর খারাপ’র সময় মেয়েদের অপয়া বা অপবিত্র ভাবা হতো। পিঠা বানানোর সময় বা রান্না করার সময় সরিয়ে দেওয়া হতো। বিধবা বা বন্ধ্যা মেয়েদের বিয়ে বাড়িতে আসতে দিত না। ছোট ছোট মেয়েদেরও দেখতাম নিজেদের শরীর নিয়ে অতিসতর্ক আর আড়ষ্ট হয়ে চলাফেরা করত। আমরা ছেলেরা যখন সবাই খেলছি ফুটবল, ক্রিকেট, ভলি, মেয়েরা খেলছে কিতকিত, পাঁচ গুটি বা এক্কা দোক্কা। 

বুঝতাম আমি আর আমার বয়সী একটা মেয়ে এক নয়। বুঝতাম আমি ছেলে বলেই ওঁর চেয়ে ‘যোগ্য’। আর ও মেয়ে বলেই আমার চেয়ে ‘দুর্বল’। কিন্তু ‘এই মেয়ে বলেই’ ব্যাপারটা মনে প্রশ্ন তৈরি করত। মেয়ে হওয়াটা কি দোষের? 

এইভাবে যত বড় হয়েছি ততই, ঘরে এবং বাইরে, সবখানে, নারীর প্রতি অবহেলা আর অপমান দেখেছি। বয়স বেড়েছে, প্রেম করেছি, বিয়ে করেছি, কন্যার পিতা হয়েছি এবং কখন যেন নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরোধী হয়ে উঠেছি। নারী–পুরুষের সমতার সমর্থক হয়ে উঠেছি। পুরুষকার বা পুরুষ হিসেবে জন্মানোর অহমকে অযৌক্তিক মনে করতে শুরু করেছি। 

তার মানে এই নয় যে, পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে নারীতন্ত্র চেয়েছি বা পুরুষের অধিকারের বিনিময়ে নারীর অধিকার চেয়েছি বা পুরুষের চেয়ে নারীকে বড় করতে চেয়েছি। কেবল উভয়েই সমান সম্মান আর সম্ভাবনার মধ্যে থাকুক, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হোক উভয়ের জন্যেই, এমনটি চেয়েছি। এই চাওয়াটাকেই নারীবাদী হওয়া বলে কি না জানি না। তবে এর ফলে আমাকে বেশ কয়েক ধরনের সমালোচনারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। 

যেমন: অনেকেই বলেছেন, মেয়েদের পক্ষে লেখা–কথা–কাজ এসব আমার মেয়ে পটানোর চেষ্টা। মেয়েরা আশ্বস্ত হয়ে, ‘নিজ দলের মানুষ’ মনে করে কাছে আসবে, ফলে আমার উইম্যানাইজ করা সহজ হবে। আবার কেউ বলেছেন, মানুষকে শাস্ত্রীয় বিধানের বাইরে যেতে উৎসাহিত করছি। আমাদের মতো নারীবাদীর কারণে মেয়েরা বেঁধে দেওয়া সীমানাকে প্রশ্ন করতে শুরু করছে যাতে তাদের ক্ষতি হচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও আপত্তি উঠেছে। যেমন: এক মামাতো বোনের বাল্যবিয়ে বন্ধ করায় তাদের কাছে ভিলেন হয়ে দাঁড়াতে হয়েছে। অভিযোগ ছিল, ঘরোয়া শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। মেয়েরা বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে আমার লাই পেয়ে। তাদের বিপদ হলে তার দায় আমার। 

গত মা দিবসে নারী হয়ে জন্মাতে না পারার কারণে এই মানবজন্মে কিছু অনিবার্য অপ্রাপ্তির বিষয়ে লিখেছিলাম। তাতে ভীষণ রকম ট্রোলের শিকার হয়েছি। আমাকে ‘মাইগগ্যা পোলা’ বলা হয়েছে অর্থাৎ আমার সেক্সুয়ালিটি নিয়েও রসিকতা করা হয়েছে। 

তবু আমি পুরুষ বন্ধুদের বলি, নারীবাদী হয়েছি বলে আপনাদের অখুশি হওয়ার কিছু নেই। অস্বস্তিরও কিছু নেই। মেয়েরা সামনে এলে আখেরে আপনাদেরই লাভ। আবার নারীদেরও বলি, আপনাদেরও আলাদা করে খুশি হওয়ার কিছু নেই। আপনারা এগিয়ে এলে পুরুষ পিছিয়ে যাবে, তা নয়। 

আর উভয়কেই বলি, সভ্যতার এই পর্যায়ে এসে, যখন পৃথিবীতে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে পাঁচজনের বেশি নারী ও কন্যাশিশু তাদের পরিবারের কারও দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে, যখন প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবনে অন্তত একবার হলেও যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যখন শতকরা ৮৬ ভাগ নারী ও কন্যাশিশু জেন্ডার সহিংসতায় কোনো বিচারিক প্রতিকার পাচ্ছে না, তখন আমাদের সবারই, মানববাদী হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, নারীবাদী হয়ে ওঠা কর্তব্য। 

সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বের কথা বাদ দিলেও ব্যক্তিগত শান্তি ও তৃপ্তির জন্য সবার নারীবাদী হয়ে ওঠা দরকার। কেন দরকার সে এক দীর্ঘ আলাপের বিষয়। আপাতত এইটুকু বলি, গবেষণায় দেখা গেছে, এমনকি প্রেমে বা দাম্পত্যে, সঙ্গসুখের তুরীয়ানন্দের জন্যও, ফেমিনিস্ট হলেই পুরুষ প্রকৃত প্রেমিক হয়ে উঠতে পারছে!

লেখক: অধিকারকর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত