দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করেছিল সে দেশের নির্বাচিত সংসদ। তখন বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম বিজয়ী হয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সেই সংসদ গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতা তখন স্বয়ং নেলসন ম্যান্ডেলা।
অরুণ কর্মকার
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল কয়েক দিন আগে একটি সভায় বলেছেন, দেশে একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন (সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন) গঠন করা হবে। জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য এটি খুবই প্রয়োজন। ভালো হতো যদি বাহাত্তর সালেই এ রকম একটি কমিশন গঠন করা হতো। তিনি বলেছেন, তাঁরা (অন্তর্বর্তী সরকার) খুবই পেশাদারত্বের সঙ্গে সবকিছু নিষ্পত্তি করতে চান। যারা গণহত্যার মতো, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জঘন্য অপরাধ করেছেন, তাঁরা সংখ্যায় খুব বেশি না। তাঁদের উপযুক্ত, যথেষ্ট পরিমাণ শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই আমাদের করতে হবে। তাঁরা যে এই জাতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, সেটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হলেও এই কমিশন গঠন করতে হবে।
রিকনসিলিয়েশনের প্রয়োজনীয়তার কথা জুলাই অভ্যুত্থানসংক্রান্ত জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনেও রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সত্যিই এ রকম একটি
কমিশন গঠন করলে তা হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আর ওই কমিশন যদি সত্যিই কাজ করতে পারে, তাহলে তার ফলে আমাদের জাতীয় অর্জনও হতে পারে অমূল্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কমিশন গঠন করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার কথা স্মরণ করা হয়। কারণ, ১৯৯৫ সালে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুর নেতৃত্বে সেখানে যে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা হয়, তার অনুসৃত প্রক্রিয়া-পদ্ধতি, বিধিবিধান সবই আদর্শ ও অনুসরণযোগ্য বলে সারা পৃথিবীতে মান্যতা পেয়েছে। নিশ্চয়ই সেই কারণে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি এবং প্রধান বিচারপতিসহ একটি টিম দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করবে।
এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে এ ধরনের কমিশন-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় জানা-বোঝার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাই হচ্ছে উপযুক্ত দেশ। তারপরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। সব দেশকেই তা নিতে হয়। তার মধ্যে একটি হলো, কোন কালপর্বকে আমরা কমিশনের কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট করব। দক্ষিণ আফ্রিকার কমিশনের বিবেচ্য কালপর্ব ছিল ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল। আমরা এ ক্ষেত্রে কী করব? আমরা চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পর্বকে সুনির্দিষ্ট করতে পারি। ২০০৯ সাল থেকে করতে পারি। তার আগের কিংবা তারও পূর্ববর্তী কোনো সময়কে সুনির্দিষ্ট করারও সুযোগ আমাদের আছে। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচনার বিষয় যেটি করতে হবে সেটি হলো—ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় পুনর্মিলন বা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য। কাজেই কখন থেকে আমাদের জাতীয় অমিল বা অনৈক্য শুরু হলো, সেটাই হতে হবে সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য।
এ প্রসঙ্গও আইন উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ১৯৭২ সালে এই কমিশন করলে বা তখন থেকে থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা যখন হয়নি তখন ভাবনার বিষয় হলো এখন কী করা প্রয়োজন। ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের জন্য কালপর্ব নির্ধারণ করতে গিয়ে আমরা কি বাহাত্তর সালকে উপেক্ষা করতে পারব! যদি তা করি তাতে কি জাতীয় অনৈক্যের কারণ কিংবা সূচনা সম্পর্কে পূর্ণ সত্য উদ্ঘাটিত হবে! যদি না হয় তাহলে জাতীয় ঐক্য কিংবা পুনর্মিলন হবে কি? এগুলো হলো কমিশন গঠন এবং তা থেকে প্রকৃতই কিছু অর্জনের জন্য অপরিহার্য চিন্তার বিষয়।
আরেকটি বিষয় হলো, দক্ষিণ আফ্রিকায় এই কমিশন গঠন করেছিল সে দেশের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ। তখন বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম বিজয়ী হয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সেই সংসদ গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতা তখন স্বয়ং নেলসন ম্যান্ডেলা। সেই সংসদে গঠিত কমিশনকেও সংঘাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ গ্রহণ করেনি। কমিশনের কাছে অনেকে সাক্ষ্য কিংবা বিবৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন। বর্ণবাদবিরোধী হিসেবে খ্যাত এবং সম্মানিত পি ডব্লিউ বোথার মতো মান্যবর ব্যক্তিও কমিশনের সামনে উপস্থিত হওয়ার সমন অমান্য করেছিলেন। মুক্তি আন্দোলনের সদস্যরা সাধারণ ক্ষমার জন্য আবেদন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। যদিও কমিশনের কাছে তাঁদের বিরুদ্ধেও সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের। পরে অবশ্য তাঁরা রাজি হন। সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করেননি। তাঁরা এবং এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক সরকারের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকেরা কমিশনের কাছে সাধারণ ক্ষমার আবেদন করেননি। এসব কথা উল্লেখ করার কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত (যদি গঠন করা হয়) কমিশনের কাজের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো কী হতে পারে, তা আগে থেকেই বিবেচনা করে দেখা।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কমিশনের প্রধান হবেন কে, সদস্য হবেন কারা? এ জন্য সবার কাছে না হোক, দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কিছু লোক দরকার। এই লোকদের কি আমরা খুঁজে পাব? দেশে কি এখন বিতর্কের ঊর্ধ্বে কোনো না কোনো ট্যাগ লাগানো ছাড়া কোনো মানুষ অবশিষ্ট আছেন? যাঁকেই নির্ধারণ করা হবে তাঁকেই দেখা যাবে লেবেল লাগানো। হয় তিনি নিজের কাজের ফলে লেবেল আঁটা হয়েছেন অথবা কোনো না কোনো পক্ষ তাঁর পেছনে লেবেল এঁটে দিয়েছে। আমাদের সমাজে সবকিছু নিয়ে এমন পর্যায়ের অসুস্থ বিতর্ক, বিশৃঙ্খলা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে যে এ থেকে নিস্তার পাওয়া বড়ই কঠিন। এখানে কোনো কিছুই আর স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয় না। সবকিছুকে বিতর্কিত করে তোলার মধ্যেই যেন জাতির নির্বাণ লাভ হবে—এমনই একটা ভাব সর্বত্র। এই প্রবণতা দীর্ঘকাল ধরে ক্রমাগতভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ডেসমন্ড টুটুর মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আমাদের যাঁরা ছিলেন বা আছেন, তাঁদের সবাইকেই আমরা বিসর্জন দিয়েছি।
দক্ষিণ আফ্রিকার কমিশন ২৬ হাজার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সাক্ষ্য নিয়েছে, বিবৃতি সংগ্রহ করেছে। ভুক্তভোগীরা যেমন তা দিয়েছেন, তেমনি অভিযুক্ত এবং অপরাধীরাও দিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেককে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরনের অপরাধ ও মামলা থেকে সাধারণ ক্ষমা চেয়ে আবেদন করার অধিকার দেওয়া হয়। স্বল্পসংখ্যক ছাড়া সবাইকেই সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনাও হয়। নিষ্ঠুর বর্ণবাদী শাসক এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক কমিশনের সামনে হাজির হয়ে বর্ণবাদের কারণে সৃষ্ট গণদুর্ভোগের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কমিশন বর্ণবাদী সরকারের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিল। কারণ, তাদের অভীষ্ট ছিল জাতীয় পুনর্মিলন। সেই পুনর্মিলন এমন একটি প্রক্রিয়া, যা ভিন্নমত পোষণকারী মানুষকে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করে। পরস্পরকে বোঝার এবং শ্রদ্ধা করার বাতাবরণ সৃষ্টি করে। সেই কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকা এখন তার সব শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণের নাগরিকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দেশ। আমাদের মতো বহুধা বিভক্ত এবং কলুষিত একটি সমাজে এর কতটুকু গ্রহণীয়, তা ভেবে দেখার অবকাশ আছে।
এ প্রসঙ্গে আমরা একবার স্মরণ করতে পারি এক-এগারোর সরকারের সময়, ২০০৮ সালের ৩০ জুলাই গঠিত ‘সত্য ও জবাবদিহি কমিশন’-এর কথা। দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তির গতি বাড়ানোর জন্য এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি কমিশনে উপস্থিত হয়ে স্বীকারোক্তি দিলে জরিমানা আদায় করে তাঁকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিধান ছিল। সাড়ে তিন মাসের কম সময় স্থায়ী হয়েছিল সেই কমিশন। তার মধ্যে ৪৪৮ জন অভিযুক্ত স্বীকারোক্তি দিয়ে মোট ৩৪ কোটি টাকা (গড়ে একেকজন সাড়ে সাত লাখ টাকার মতো) জরিমানা দিয়েছিলেন। বিষয়টি তখন জনপরিসরে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিল।
ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন আরও অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয়। তেমন পরিসরে প্রকৃত সত্যের নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশ এবং তাকে জনসমক্ষে তুলে আনা বড়ই কঠিন। এ জন্য সমগ্র জাতির সামগ্রিক অস্তিত্বে কঠোর-কঠিনকে ধারণ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল কয়েক দিন আগে একটি সভায় বলেছেন, দেশে একটি ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন (সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন) গঠন করা হবে। জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য এটি খুবই প্রয়োজন। ভালো হতো যদি বাহাত্তর সালেই এ রকম একটি কমিশন গঠন করা হতো। তিনি বলেছেন, তাঁরা (অন্তর্বর্তী সরকার) খুবই পেশাদারত্বের সঙ্গে সবকিছু নিষ্পত্তি করতে চান। যারা গণহত্যার মতো, মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জঘন্য অপরাধ করেছেন, তাঁরা সংখ্যায় খুব বেশি না। তাঁদের উপযুক্ত, যথেষ্ট পরিমাণ শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই আমাদের করতে হবে। তাঁরা যে এই জাতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, সেটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য হলেও এই কমিশন গঠন করতে হবে।
রিকনসিলিয়েশনের প্রয়োজনীয়তার কথা জুলাই অভ্যুত্থানসংক্রান্ত জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনেও রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সত্যিই এ রকম একটি
কমিশন গঠন করলে তা হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আর ওই কমিশন যদি সত্যিই কাজ করতে পারে, তাহলে তার ফলে আমাদের জাতীয় অর্জনও হতে পারে অমূল্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কমিশন গঠন করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার কথা স্মরণ করা হয়। কারণ, ১৯৯৫ সালে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুর নেতৃত্বে সেখানে যে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা হয়, তার অনুসৃত প্রক্রিয়া-পদ্ধতি, বিধিবিধান সবই আদর্শ ও অনুসরণযোগ্য বলে সারা পৃথিবীতে মান্যতা পেয়েছে। নিশ্চয়ই সেই কারণে আইন উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি এবং প্রধান বিচারপতিসহ একটি টিম দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করবে।
এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে এ ধরনের কমিশন-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় জানা-বোঝার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকাই হচ্ছে উপযুক্ত দেশ। তারপরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। সব দেশকেই তা নিতে হয়। তার মধ্যে একটি হলো, কোন কালপর্বকে আমরা কমিশনের কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট করব। দক্ষিণ আফ্রিকার কমিশনের বিবেচ্য কালপর্ব ছিল ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল। আমরা এ ক্ষেত্রে কী করব? আমরা চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পর্বকে সুনির্দিষ্ট করতে পারি। ২০০৯ সাল থেকে করতে পারি। তার আগের কিংবা তারও পূর্ববর্তী কোনো সময়কে সুনির্দিষ্ট করারও সুযোগ আমাদের আছে। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচনার বিষয় যেটি করতে হবে সেটি হলো—ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় পুনর্মিলন বা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য। কাজেই কখন থেকে আমাদের জাতীয় অমিল বা অনৈক্য শুরু হলো, সেটাই হতে হবে সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য।
এ প্রসঙ্গও আইন উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ১৯৭২ সালে এই কমিশন করলে বা তখন থেকে থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সেটা যখন হয়নি তখন ভাবনার বিষয় হলো এখন কী করা প্রয়োজন। ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের জন্য কালপর্ব নির্ধারণ করতে গিয়ে আমরা কি বাহাত্তর সালকে উপেক্ষা করতে পারব! যদি তা করি তাতে কি জাতীয় অনৈক্যের কারণ কিংবা সূচনা সম্পর্কে পূর্ণ সত্য উদ্ঘাটিত হবে! যদি না হয় তাহলে জাতীয় ঐক্য কিংবা পুনর্মিলন হবে কি? এগুলো হলো কমিশন গঠন এবং তা থেকে প্রকৃতই কিছু অর্জনের জন্য অপরিহার্য চিন্তার বিষয়।
আরেকটি বিষয় হলো, দক্ষিণ আফ্রিকায় এই কমিশন গঠন করেছিল সে দেশের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ। তখন বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম বিজয়ী হয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সেই সংসদ গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতা তখন স্বয়ং নেলসন ম্যান্ডেলা। সেই সংসদে গঠিত কমিশনকেও সংঘাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ গ্রহণ করেনি। কমিশনের কাছে অনেকে সাক্ষ্য কিংবা বিবৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন। বর্ণবাদবিরোধী হিসেবে খ্যাত এবং সম্মানিত পি ডব্লিউ বোথার মতো মান্যবর ব্যক্তিও কমিশনের সামনে উপস্থিত হওয়ার সমন অমান্য করেছিলেন। মুক্তি আন্দোলনের সদস্যরা সাধারণ ক্ষমার জন্য আবেদন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। যদিও কমিশনের কাছে তাঁদের বিরুদ্ধেও সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের। পরে অবশ্য তাঁরা রাজি হন। সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করেননি। তাঁরা এবং এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক সরকারের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিকেরা কমিশনের কাছে সাধারণ ক্ষমার আবেদন করেননি। এসব কথা উল্লেখ করার কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত (যদি গঠন করা হয়) কমিশনের কাজের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো কী হতে পারে, তা আগে থেকেই বিবেচনা করে দেখা।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কমিশনের প্রধান হবেন কে, সদস্য হবেন কারা? এ জন্য সবার কাছে না হোক, দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কিছু লোক দরকার। এই লোকদের কি আমরা খুঁজে পাব? দেশে কি এখন বিতর্কের ঊর্ধ্বে কোনো না কোনো ট্যাগ লাগানো ছাড়া কোনো মানুষ অবশিষ্ট আছেন? যাঁকেই নির্ধারণ করা হবে তাঁকেই দেখা যাবে লেবেল লাগানো। হয় তিনি নিজের কাজের ফলে লেবেল আঁটা হয়েছেন অথবা কোনো না কোনো পক্ষ তাঁর পেছনে লেবেল এঁটে দিয়েছে। আমাদের সমাজে সবকিছু নিয়ে এমন পর্যায়ের অসুস্থ বিতর্ক, বিশৃঙ্খলা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে যে এ থেকে নিস্তার পাওয়া বড়ই কঠিন। এখানে কোনো কিছুই আর স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয় না। সবকিছুকে বিতর্কিত করে তোলার মধ্যেই যেন জাতির নির্বাণ লাভ হবে—এমনই একটা ভাব সর্বত্র। এই প্রবণতা দীর্ঘকাল ধরে ক্রমাগতভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ডেসমন্ড টুটুর মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আমাদের যাঁরা ছিলেন বা আছেন, তাঁদের সবাইকেই আমরা বিসর্জন দিয়েছি।
দক্ষিণ আফ্রিকার কমিশন ২৬ হাজার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সাক্ষ্য নিয়েছে, বিবৃতি সংগ্রহ করেছে। ভুক্তভোগীরা যেমন তা দিয়েছেন, তেমনি অভিযুক্ত এবং অপরাধীরাও দিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেককে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় ধরনের অপরাধ ও মামলা থেকে সাধারণ ক্ষমা চেয়ে আবেদন করার অধিকার দেওয়া হয়। স্বল্পসংখ্যক ছাড়া সবাইকেই সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনাও হয়। নিষ্ঠুর বর্ণবাদী শাসক এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক কমিশনের সামনে হাজির হয়ে বর্ণবাদের কারণে সৃষ্ট গণদুর্ভোগের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কমিশন বর্ণবাদী সরকারের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিল। কারণ, তাদের অভীষ্ট ছিল জাতীয় পুনর্মিলন। সেই পুনর্মিলন এমন একটি প্রক্রিয়া, যা ভিন্নমত পোষণকারী মানুষকে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করে। পরস্পরকে বোঝার এবং শ্রদ্ধা করার বাতাবরণ সৃষ্টি করে। সেই কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকা এখন তার সব শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণের নাগরিকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দেশ। আমাদের মতো বহুধা বিভক্ত এবং কলুষিত একটি সমাজে এর কতটুকু গ্রহণীয়, তা ভেবে দেখার অবকাশ আছে।
এ প্রসঙ্গে আমরা একবার স্মরণ করতে পারি এক-এগারোর সরকারের সময়, ২০০৮ সালের ৩০ জুলাই গঠিত ‘সত্য ও জবাবদিহি কমিশন’-এর কথা। দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তির গতি বাড়ানোর জন্য এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি কমিশনে উপস্থিত হয়ে স্বীকারোক্তি দিলে জরিমানা আদায় করে তাঁকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিধান ছিল। সাড়ে তিন মাসের কম সময় স্থায়ী হয়েছিল সেই কমিশন। তার মধ্যে ৪৪৮ জন অভিযুক্ত স্বীকারোক্তি দিয়ে মোট ৩৪ কোটি টাকা (গড়ে একেকজন সাড়ে সাত লাখ টাকার মতো) জরিমানা দিয়েছিলেন। বিষয়টি তখন জনপরিসরে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিল।
ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন আরও অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয়। তেমন পরিসরে প্রকৃত সত্যের নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশ এবং তাকে জনসমক্ষে তুলে আনা বড়ই কঠিন। এ জন্য সমগ্র জাতির সামগ্রিক অস্তিত্বে কঠোর-কঠিনকে ধারণ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
যে বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন হয়েছিল আমাদের সামনে, তার কতখানি পূরণের পথে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক হবে। ফরাসি বিপ্লব স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্বের দাবিতে সংঘটিত হয়েছিল। সেটা কেবল একজন রাজাকে অপসারণ করার উদ্দেশ্যে ছিল না; বরং সমাজকাঠামোকেই নতুন করে গড়ে তোলার ঘোষণা ছিল...
৩ ঘণ্টা আগেপারিবারিক যেকোনো দিবসে যখন আমরা পরিবারের বন্ধন, ভালোবাসা ও সমর্থনের কথা বলি, তখন একটি মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়—একজন পুলিশ অফিসারের আত্মহত্যা। এই ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং আমাদের সমাজে পারিবারিক কলহের ভয়াবহ পরিণতির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
৩ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে একটি নিরীহ পোষা বিড়ালের ওপর নির্মম নির্যাতনের অমানবিক একটি ঘটনা। অভিযোগের সূত্রপাত ‘ক্যাট সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ নামের একটি গ্রুপে, যেখানে ‘ইলমা ইলমা’ নামের এক তরুণী জানান, তাঁর পোষা পাঁচ মাস বয়সী সাদা মেয়েবিড়ালটিকে এক প্রতিবেশীর বাসায়...
৩ ঘণ্টা আগেমোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ সেলিম অর্থাৎ জাহাঙ্গীর বিদ্রোহ করে বাংলায় চলে আসেন। বর্তমান পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে তিনি ‘সেলিমাবাদ’ নামে একটি পরগনা সৃষ্টি করেন। পরে ওই এলাকার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন মদনমোহনকে।
৩ ঘণ্টা আগে