বিধান রিবেরু
মানুষ যেদিন থেকে গল্পটা নিজের মতো করে বলতে শিখল, সেদিন থেকে সে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরল, আবার একে অপরের কাছেও এল। বাক্যটি স্ববিরোধী মনে হলেও এর ভেতর বিন্দু পরিমাণ বিরোধ নেই, বরং ঐকতান আছে। এই দূরত্ব ও নৈকট্যকে যে মানুষ পাখির নজরে পরখ করতে পারে, সেই মানুষ সেতারযন্ত্রে তোলা সুরের মতো ঐকতানের ধারায় ভাসতে পারে। সমাজে এই সুর ধরার ক্ষমতা অর্জন করতে পারাটাই আসল ব্যাপার।
কামার আহমাদ সাইমন পরিচালিত ‘অন্যদিন...’ চলচ্চিত্রটি দেখে আমার মানব ইতিহাসের দ্বন্দ্ব ও ঐক্য, ভ্রান্তি ও ক্রান্তির কথাই মনে হয়েছে। এক পুরোনো স্টিমারে করে যাত্রা শুরু করে কয়েক শ যাত্রী। তাদের ভেতর অবলা প্রাণী থেকে শুরু করে চপলা কিশোরী, টগবগে তরুণ, ভিনদেশি পর্যটক, বিত্তবান গৃহিণী, দরিদ্র বৃদ্ধ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, ঝানু রাজনীতিবিদ, আগামীদিনের সাংবাদিক, অন্ধ ভিখারি গায়ক... কে নেই? এ যেন গোটা রাষ্ট্র ও নাগরিকের রূপক, সময়ের স্রোতে ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান। দেশ অথবা জীবনের অভিযাত্রার গল্প নির্মাতা আমাদের শোনান। সেই গল্পের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আরও ছোট ছোট গল্প। মানুষের জীবনটাই তো তাই। গল্প বলার ইতিহাস। কারও গল্পে সৃষ্টিকর্তা প্রধান। কারও গল্পে সাইবার দুনিয়ায় থাকা লাখ লাখ ফ্যান-ফলোয়ারই সব। কেউ সেই গল্পে আস্থা রেখেছেন, যেখানে বলা হয়েছে মানবজাতির ইতিহাস, শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। তাই সে প্রশ্ন তোলে, একই ডেকে থেকে কেন তাকে নিচের তলায় প্রাকৃতিক কাজ সারতে হবে? যারা টাকা বেশি দিয়ে কেবিন নিয়েছে, তারা কি অধিক পুরীষ উৎপাদন করে?
শ্রেণির প্রশ্ন আরও উজ্জ্বল হয় খাবারের টেবিলে, যখন উচ্চবিত্ত ঘরের ভাবিরা ড্রাইভারদের মুরগির রান দেওয়া প্রসঙ্গে কথা বলে। কেউ নিজেকে দরদি প্রমাণ করার চেষ্টা করে, কেউ আবার বলে, সে স্বঘোষিত সংকীর্ণমনা। তাদের বক্তব্য পরিষ্কার, ছোটলোকের সঙ্গে এক টেবিলে কেউ খায় নাকি? বড়জোর তাদের করুণা করা যায়। আর যারা ছোটলোক? অর্থাৎ সমাজে যাদের কণ্ঠস্বর নেই, সাব-অলটার্ন, তারা কী বলে? তারা জীবনে ঘটে যাওয়া বীভৎস দুর্ঘটনার পর পায়ে রড ঢুকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। লোকটি হতবিহ্বল। তার স্ত্রী অকূলপাথারে ভাসছে, আসছে দিন চলবে কী করে, তার দিশা খোঁজে। তারই শ্রেণিভুক্ত আরেক নারী পরামর্শ দেয়, স্বামীর জন্য মানুষের কাছে হাত পাতা যায়, এতে লজ্জার কী আছে!
ধনী ব্যস্ত মুরগির পা কে খায় তা নিয়ে, আর গরিব অস্থির তার পঙ্গু পা নিয়ে সে চলবে কেমন করে সেটা নিয়ে। মাঝে মধ্যবিত্ত ব্যস্ত শিল্পের কলাকৈবল্যবাদ নিয়ে বাদানুবাদে। একদল ছেলেমেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া হবে, তাদের ভেতর একজন কবি, একজন গায়ক। খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের মনোমালিন্য হয়। আবার নদীর এক ঢেউ যেমন আরেক ঢেউয়ের ওপর পড়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তেমনই তাদের মেলামেশা। বোঝা মুশকিল, তারা কী নিয়ে তর্ক করে, কী নিয়ে সখ্য গড়ে, কী নিয়ে হয় উদ্বেলিত। তাই, তাদের মজমাতেই জমে ওঠে মহীনের ঘোড়াগুলির গান: ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি, খিদের থেকেও স্পষ্ট।
তবে আগেকার দিনে, যখন বাংলাদেশে ওয়াজ-মাহফিলের অতটা প্রসার ঘটেনি, গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালা হতো, তখন সেখানে থাকত বিবেক নামের এক চরিত্র। কামার আহমাদ সাইমনের এই ছবিতে বিবেক চরিত্রের মতোই নাজিল হয় এক অন্ধ ভিখারি, সোহেল তার নাম। সে অপূর্ব গলায় মারফতি ও মরমি গান গায়। গানে গানে বলে জীবন দর্শনের কথা: মানুষ আইবোরে, এক নজর দেখিতে মানুষ আইবোরে। এক ধার্মিক বৃদ্ধকেও বলতে শোনা যায় মানুষের জন্মের পর মৃত্যুর অনিবার্যতার কথা। ভিখারি ও ধার্মিকের বক্তব্য একই, এখানে ঐকতান, কিন্তু জীবনের গল্পে তারা আলাদা সত্তা, তারা যে গল্পে ইমান রেখেছে, সেটাও স্বতন্ত্র বটে।
শ্রেণি ও আধ্যাত্মিকতার বাইরে আমরা দেখি রাজনীতির গল্প। রাজনীতিতে উন্নয়নের নামে লুটপাট ও গুমের গল্প। নির্মম সত্য ও জলজ্যান্ত মিথ্যার গল্প। গল্প বলার ছলে এক রাজনীতিবিদ সঙ্গীকে বলেন, রাজনীতিও ফুটবলের মতো একটি খেলা। এই খেলায় মন খারাপ করে বসে পড়লে চলে না। আশা জিইয়ে রাখতে হয়। এরই ফাঁকে আমরা স্টিমারের লোকজনকে পানির গভীরতা মাপতে শুনি: দুই বাম মিলে না, দুই বাম মিলে না। তখন এক ঝটকায় মনে পড়ে দুটি বিষয়। মনে পড়ে, বাংলাদেশে এত অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভেতরেও দুই বামপন্থী নেতা কখনো এক হয় না। তারা শুধু ভেঙে টুকরা টুকরা হয়। আর ফায়দা লোটে অন্যরা। আর মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই ফটিকের মৃত্যুযন্ত্রণাকে। যে নদীপথে গ্রাম থেকে শহরে আসার সময় খালাসিদের মুখে শুনতে পেয়েছিল: এক বাঁও মেলে না, দুই বাঁও মেলে না। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় সে এই কথাগুলোই বকতে থাকে। অর্থাৎ গ্রামের মুক্ত পরিবেশ থেকে শহরের যান্ত্রিক ও ঘিঞ্জি পরিবেশে এসে ফটিক যেমন কোনো তল খুঁজে পাচ্ছিল না, তার প্রাণ মুক্তির জন্য আইঢাই করছিল, তেমনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতর থাকা মানুষও যেন পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাচ্ছে না। নাভিশ্বাস উঠছে তাদের। দেশ এখন ফ্যাসিবাদের কবল থেকে বেরিয়ে জনতার নৈরাজ্যবাদে এসে ঠেকেছে। মুক্তি কোথায়? আশা-দূরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে স্টিমারের মতোই আমরা কখনো হারিয়ে যাচ্ছি ঘন কুয়াশার ভেতর।
আবার কুয়াশা সরে যাওয়ার পর কোনো তীরে যদি নোঙর ফেলি, তো সেখানে বিপাকে পড়ছে স্টিমারের চাকা। নিদান হয়তো মেলে এসব বাধাবিপত্তি থেকে, কিন্তু চিন্তা-দুশ্চিন্তার খেলা থামে না।
বিদেশে যেতে চাওয়া এক লোক মরিয়া হয়ে সমাধান খোঁজে বিদেশি পর্যটকদের কাছে। যেন সে বলেই বসে: আমাকে এই দেশ থেকে নিয়ে চলো। বেকারত্বের অভিশাপ আর নিতে পারছি না। এ দেশের বেকার তরুণ জানে উন্নত জীবনের জন্য তাকে দেশ ছাড়তে হবে। মাদ্রাসায় পড়তে থাকা বালক জানে মানুষের করুণার ওপর তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। উঠতি বয়সের ইউটিউবার ছেলেটি জানে, যত সাবস্ক্রাইবার তত আয়-উপার্জন। আর স্টিমারের কাপ্তান জানে তরি তীরের দিকে নিয়ে যেতে কত ঢেউ ডিঙাতে হয়। নিয়তি সবারই অজানা। তাই তো হঠাৎ করে চরে আটকা পড়ে স্টিমার। সবাই হতবাক হয়, চরের এত মাঝখানে এল কী করে জলযানটি! তারা অপেক্ষা করে কখন জোয়ার আসবে। কখন তারা আবার ভাসবে। এখানেই সমাপ্তি টানা হয় অন্যদিনের।
এই চলচ্চিত্র কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আটকে পড়ার কথা বলছে? যে রাষ্ট্র বুঝতে পারছে না সে কোন দিকে যাবে? উদার গণতন্ত্রের দিকে, না মৌলবাদী চরমপন্থার দিকে? নাকি মধ্যপন্থায় নোঙর ফেলবে? কিংবা বামপন্থায়? আমরা যেন এক ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছি, অপেক্ষা করছি কোনো এক বিপ্লবের। যে বিপ্লবের জোয়ার আমাদের ভাসিয়ে তুলবে, টেনে নিয়ে যাবে সঠিক গন্তব্যের দিকে। আমরা যেন নির্বাণ লাভের আশায় সব কষ্ট স্বীকার করে অপেক্ষমাণ তথাগত।
মানবজন্মের গল্পটাই কষ্ট আর যন্ত্রণার গল্পে ঠাসা। সেখানে বিদ্যুৎ চমকের মতো আনন্দের কিছু মুহূর্ত আমাদের চমকিত করে। ছোট্ট মেয়েটির নাচ-গানের মতো সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় কী অনিশ্চয়তার ঠাসা আমাদের জীবন! আমরা বাসনা করি, ছোট্ট ছেলেটির হাতে থাকা সেই খেলনা পেগাসাস ঘোড়াটার মতো যদি আমাদেরও রঙিন দুনিয়া থাকত! বাস্তবতা হলো, কল্পরাজ্যের ভ্রম দিয়ে আমরা যতই নিজেদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি না কেন, আমরা শুকনা বালুচরে থমকে আছি। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, গণতন্ত্র...সব ক্ষেত্রেই।
আমরা যদি মানবিক হতে পারতাম, মানুষকে সবকিছুর ওপরে স্থান দিতে পারতাম—সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে—তাহলে বোধ হয় মানসিক শক্তি দিয়েই সব স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পারতাম। আমরা নিজেদের উত্তম রূপে প্রকাশ করতে পারতাম। শেষ পর্যন্ত সবাইকে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রার্থনাই জানায় ‘অন্যদিন...’। কামার আহমাদ সাইমন পরিচালিত ও সারা আফরীন প্রযোজিত ছবিটি দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। ছবিটি ২০২১ সালে নির্মিত হলেও তা বাংলাদেশে মুক্তি পেতে যাচ্ছে এই বছর। কেন এত দিন বাদে ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে, তা অনুমেয়। আমরা চাই, আমাদের রাষ্ট্র এই ছবির ভেতর আটকে পড়া স্টিমারের মতো না হোক, এর গতির সঞ্চার হোক এবং কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাক।
লেখক– প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক
মানুষ যেদিন থেকে গল্পটা নিজের মতো করে বলতে শিখল, সেদিন থেকে সে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরল, আবার একে অপরের কাছেও এল। বাক্যটি স্ববিরোধী মনে হলেও এর ভেতর বিন্দু পরিমাণ বিরোধ নেই, বরং ঐকতান আছে। এই দূরত্ব ও নৈকট্যকে যে মানুষ পাখির নজরে পরখ করতে পারে, সেই মানুষ সেতারযন্ত্রে তোলা সুরের মতো ঐকতানের ধারায় ভাসতে পারে। সমাজে এই সুর ধরার ক্ষমতা অর্জন করতে পারাটাই আসল ব্যাপার।
কামার আহমাদ সাইমন পরিচালিত ‘অন্যদিন...’ চলচ্চিত্রটি দেখে আমার মানব ইতিহাসের দ্বন্দ্ব ও ঐক্য, ভ্রান্তি ও ক্রান্তির কথাই মনে হয়েছে। এক পুরোনো স্টিমারে করে যাত্রা শুরু করে কয়েক শ যাত্রী। তাদের ভেতর অবলা প্রাণী থেকে শুরু করে চপলা কিশোরী, টগবগে তরুণ, ভিনদেশি পর্যটক, বিত্তবান গৃহিণী, দরিদ্র বৃদ্ধ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, ঝানু রাজনীতিবিদ, আগামীদিনের সাংবাদিক, অন্ধ ভিখারি গায়ক... কে নেই? এ যেন গোটা রাষ্ট্র ও নাগরিকের রূপক, সময়ের স্রোতে ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান। দেশ অথবা জীবনের অভিযাত্রার গল্প নির্মাতা আমাদের শোনান। সেই গল্পের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আরও ছোট ছোট গল্প। মানুষের জীবনটাই তো তাই। গল্প বলার ইতিহাস। কারও গল্পে সৃষ্টিকর্তা প্রধান। কারও গল্পে সাইবার দুনিয়ায় থাকা লাখ লাখ ফ্যান-ফলোয়ারই সব। কেউ সেই গল্পে আস্থা রেখেছেন, যেখানে বলা হয়েছে মানবজাতির ইতিহাস, শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। তাই সে প্রশ্ন তোলে, একই ডেকে থেকে কেন তাকে নিচের তলায় প্রাকৃতিক কাজ সারতে হবে? যারা টাকা বেশি দিয়ে কেবিন নিয়েছে, তারা কি অধিক পুরীষ উৎপাদন করে?
শ্রেণির প্রশ্ন আরও উজ্জ্বল হয় খাবারের টেবিলে, যখন উচ্চবিত্ত ঘরের ভাবিরা ড্রাইভারদের মুরগির রান দেওয়া প্রসঙ্গে কথা বলে। কেউ নিজেকে দরদি প্রমাণ করার চেষ্টা করে, কেউ আবার বলে, সে স্বঘোষিত সংকীর্ণমনা। তাদের বক্তব্য পরিষ্কার, ছোটলোকের সঙ্গে এক টেবিলে কেউ খায় নাকি? বড়জোর তাদের করুণা করা যায়। আর যারা ছোটলোক? অর্থাৎ সমাজে যাদের কণ্ঠস্বর নেই, সাব-অলটার্ন, তারা কী বলে? তারা জীবনে ঘটে যাওয়া বীভৎস দুর্ঘটনার পর পায়ে রড ঢুকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। লোকটি হতবিহ্বল। তার স্ত্রী অকূলপাথারে ভাসছে, আসছে দিন চলবে কী করে, তার দিশা খোঁজে। তারই শ্রেণিভুক্ত আরেক নারী পরামর্শ দেয়, স্বামীর জন্য মানুষের কাছে হাত পাতা যায়, এতে লজ্জার কী আছে!
ধনী ব্যস্ত মুরগির পা কে খায় তা নিয়ে, আর গরিব অস্থির তার পঙ্গু পা নিয়ে সে চলবে কেমন করে সেটা নিয়ে। মাঝে মধ্যবিত্ত ব্যস্ত শিল্পের কলাকৈবল্যবাদ নিয়ে বাদানুবাদে। একদল ছেলেমেয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া হবে, তাদের ভেতর একজন কবি, একজন গায়ক। খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের মনোমালিন্য হয়। আবার নদীর এক ঢেউ যেমন আরেক ঢেউয়ের ওপর পড়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তেমনই তাদের মেলামেশা। বোঝা মুশকিল, তারা কী নিয়ে তর্ক করে, কী নিয়ে সখ্য গড়ে, কী নিয়ে হয় উদ্বেলিত। তাই, তাদের মজমাতেই জমে ওঠে মহীনের ঘোড়াগুলির গান: ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি, খিদের থেকেও স্পষ্ট।
তবে আগেকার দিনে, যখন বাংলাদেশে ওয়াজ-মাহফিলের অতটা প্রসার ঘটেনি, গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালা হতো, তখন সেখানে থাকত বিবেক নামের এক চরিত্র। কামার আহমাদ সাইমনের এই ছবিতে বিবেক চরিত্রের মতোই নাজিল হয় এক অন্ধ ভিখারি, সোহেল তার নাম। সে অপূর্ব গলায় মারফতি ও মরমি গান গায়। গানে গানে বলে জীবন দর্শনের কথা: মানুষ আইবোরে, এক নজর দেখিতে মানুষ আইবোরে। এক ধার্মিক বৃদ্ধকেও বলতে শোনা যায় মানুষের জন্মের পর মৃত্যুর অনিবার্যতার কথা। ভিখারি ও ধার্মিকের বক্তব্য একই, এখানে ঐকতান, কিন্তু জীবনের গল্পে তারা আলাদা সত্তা, তারা যে গল্পে ইমান রেখেছে, সেটাও স্বতন্ত্র বটে।
শ্রেণি ও আধ্যাত্মিকতার বাইরে আমরা দেখি রাজনীতির গল্প। রাজনীতিতে উন্নয়নের নামে লুটপাট ও গুমের গল্প। নির্মম সত্য ও জলজ্যান্ত মিথ্যার গল্প। গল্প বলার ছলে এক রাজনীতিবিদ সঙ্গীকে বলেন, রাজনীতিও ফুটবলের মতো একটি খেলা। এই খেলায় মন খারাপ করে বসে পড়লে চলে না। আশা জিইয়ে রাখতে হয়। এরই ফাঁকে আমরা স্টিমারের লোকজনকে পানির গভীরতা মাপতে শুনি: দুই বাম মিলে না, দুই বাম মিলে না। তখন এক ঝটকায় মনে পড়ে দুটি বিষয়। মনে পড়ে, বাংলাদেশে এত অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভেতরেও দুই বামপন্থী নেতা কখনো এক হয় না। তারা শুধু ভেঙে টুকরা টুকরা হয়। আর ফায়দা লোটে অন্যরা। আর মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই ফটিকের মৃত্যুযন্ত্রণাকে। যে নদীপথে গ্রাম থেকে শহরে আসার সময় খালাসিদের মুখে শুনতে পেয়েছিল: এক বাঁও মেলে না, দুই বাঁও মেলে না। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় সে এই কথাগুলোই বকতে থাকে। অর্থাৎ গ্রামের মুক্ত পরিবেশ থেকে শহরের যান্ত্রিক ও ঘিঞ্জি পরিবেশে এসে ফটিক যেমন কোনো তল খুঁজে পাচ্ছিল না, তার প্রাণ মুক্তির জন্য আইঢাই করছিল, তেমনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতর থাকা মানুষও যেন পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাচ্ছে না। নাভিশ্বাস উঠছে তাদের। দেশ এখন ফ্যাসিবাদের কবল থেকে বেরিয়ে জনতার নৈরাজ্যবাদে এসে ঠেকেছে। মুক্তি কোথায়? আশা-দূরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে স্টিমারের মতোই আমরা কখনো হারিয়ে যাচ্ছি ঘন কুয়াশার ভেতর।
আবার কুয়াশা সরে যাওয়ার পর কোনো তীরে যদি নোঙর ফেলি, তো সেখানে বিপাকে পড়ছে স্টিমারের চাকা। নিদান হয়তো মেলে এসব বাধাবিপত্তি থেকে, কিন্তু চিন্তা-দুশ্চিন্তার খেলা থামে না।
বিদেশে যেতে চাওয়া এক লোক মরিয়া হয়ে সমাধান খোঁজে বিদেশি পর্যটকদের কাছে। যেন সে বলেই বসে: আমাকে এই দেশ থেকে নিয়ে চলো। বেকারত্বের অভিশাপ আর নিতে পারছি না। এ দেশের বেকার তরুণ জানে উন্নত জীবনের জন্য তাকে দেশ ছাড়তে হবে। মাদ্রাসায় পড়তে থাকা বালক জানে মানুষের করুণার ওপর তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। উঠতি বয়সের ইউটিউবার ছেলেটি জানে, যত সাবস্ক্রাইবার তত আয়-উপার্জন। আর স্টিমারের কাপ্তান জানে তরি তীরের দিকে নিয়ে যেতে কত ঢেউ ডিঙাতে হয়। নিয়তি সবারই অজানা। তাই তো হঠাৎ করে চরে আটকা পড়ে স্টিমার। সবাই হতবাক হয়, চরের এত মাঝখানে এল কী করে জলযানটি! তারা অপেক্ষা করে কখন জোয়ার আসবে। কখন তারা আবার ভাসবে। এখানেই সমাপ্তি টানা হয় অন্যদিনের।
এই চলচ্চিত্র কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আটকে পড়ার কথা বলছে? যে রাষ্ট্র বুঝতে পারছে না সে কোন দিকে যাবে? উদার গণতন্ত্রের দিকে, না মৌলবাদী চরমপন্থার দিকে? নাকি মধ্যপন্থায় নোঙর ফেলবে? কিংবা বামপন্থায়? আমরা যেন এক ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছি, অপেক্ষা করছি কোনো এক বিপ্লবের। যে বিপ্লবের জোয়ার আমাদের ভাসিয়ে তুলবে, টেনে নিয়ে যাবে সঠিক গন্তব্যের দিকে। আমরা যেন নির্বাণ লাভের আশায় সব কষ্ট স্বীকার করে অপেক্ষমাণ তথাগত।
মানবজন্মের গল্পটাই কষ্ট আর যন্ত্রণার গল্পে ঠাসা। সেখানে বিদ্যুৎ চমকের মতো আনন্দের কিছু মুহূর্ত আমাদের চমকিত করে। ছোট্ট মেয়েটির নাচ-গানের মতো সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় কী অনিশ্চয়তার ঠাসা আমাদের জীবন! আমরা বাসনা করি, ছোট্ট ছেলেটির হাতে থাকা সেই খেলনা পেগাসাস ঘোড়াটার মতো যদি আমাদেরও রঙিন দুনিয়া থাকত! বাস্তবতা হলো, কল্পরাজ্যের ভ্রম দিয়ে আমরা যতই নিজেদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি না কেন, আমরা শুকনা বালুচরে থমকে আছি। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, গণতন্ত্র...সব ক্ষেত্রেই।
আমরা যদি মানবিক হতে পারতাম, মানুষকে সবকিছুর ওপরে স্থান দিতে পারতাম—সহজ মানুষ ভজে দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে—তাহলে বোধ হয় মানসিক শক্তি দিয়েই সব স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পারতাম। আমরা নিজেদের উত্তম রূপে প্রকাশ করতে পারতাম। শেষ পর্যন্ত সবাইকে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রার্থনাই জানায় ‘অন্যদিন...’। কামার আহমাদ সাইমন পরিচালিত ও সারা আফরীন প্রযোজিত ছবিটি দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। ছবিটি ২০২১ সালে নির্মিত হলেও তা বাংলাদেশে মুক্তি পেতে যাচ্ছে এই বছর। কেন এত দিন বাদে ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে, তা অনুমেয়। আমরা চাই, আমাদের রাষ্ট্র এই ছবির ভেতর আটকে পড়া স্টিমারের মতো না হোক, এর গতির সঞ্চার হোক এবং কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাক।
লেখক– প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক
সেই কৌতুকটা তো নিশ্চয়ই শুনেছেন? একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে এক তরুণের দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করছ আজকাল?’ ‘জি, সৎ রাজনীতি করার চেষ্টা করছি।’ তরুণ জবাব দিলে বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, ‘ভালো। তুমি শাইন করবে।’
৬ ঘণ্টা আগেএকটি জাপানি লোককাহিনি দিয়ে শুরু করি। জাপানের এক পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করত এক বৃদ্ধ বাঁশকাটা শ্রমিক ও তার স্ত্রী। একদিন ওই বৃদ্ধ জঙ্গলে বাঁশ কাটতে গিয়ে হঠাৎ দেখে একটি কচি বাঁশ থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে—জ্বলজ্বলে সোনালি আলো। কৌতূহলবশত সে বাঁশটি কাটল।
৭ ঘণ্টা আগেসরকারি সহায়তা কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের পিছিয়ে পড়া ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা করা, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা। কিন্তু যখন এই সহায়তাপ্রাপ্তিই নতুন এক দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও ইউনিয়ন পরিষদে ভালনারেবল উইমেন বেনিফি
৮ ঘণ্টা আগেসোশ্যাল মিডিয়া খুললেই দেখা যায়—করোনা, লকডাউন বা কোয়ারেন্টিন নিয়ে নানা রকমের কৌতুক, মিম। কেউ বলে, ‘আবার যদি লকডাউন আসে, ঘরে বসে টিকটকে ক্যারিয়ার বানিয়ে ফেলব।’ কেউ আবার ব্যঙ্গ করে করোনাকে বলে, ‘পুরোনো প্রেমের মতো, নাম শুনলেই বিরক্ত লাগে!’ তাহলে আমরা ভুলে গেছি, এই করোনাই কেড়ে নিয়েছে লাখো মানুষকে।
১ দিন আগে