Ajker Patrika

শিরোনাম খুঁজে পেলাম না বলে দুঃখিত!

আব্দুর রাজ্জাক 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

যে বিষয়ে আজ লিখব বলে ভাবছি, সে সম্পর্কে আমার জ্ঞান অতি সামান্য, প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। তবু দুই দিন যাবৎ মনটা খুবই খারাপ হয়ে আছে পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে। বলে রাখা ভালো, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত আমি মাদ্রাসায় পড়েছি। আমার বড় চাচা ছিলেন একজন ইসলামিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। ইমামতি করতেন, বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজ-নসিহত করতেন। আমি বেশ কয়েক বছর তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছি।

যে শিক্ষা পেয়েছি সেই ছোটবেলায়, সেটা এখনো ধারণ করছি। শিক্ষাটা ছিল এই রকম, ‘তোমার কৃতকর্মের ফল তুমিই ভোগ করবে। তোমার হয়ে রোজ হাশরের ময়দানে অন্য কেউ তোমার সম্পর্কে কিছু বলবে না, এমনকি তোমার মাতা-পিতা, সন্তানেরাও না। কেউ কাউকে চিনবে না। তোমার জীবন তুমি সেইভাবে গড়বে, তুমি তোমার অভিভাবক, সৃষ্টিকর্তার কাছে সেই রকম গ্রহণযোগ্য করে তুলবে, সেইভাবে প্রস্তুতি নিয়ো।’

কথাগুলো এখনো মনে আছে। আমি নিজেকে সেইভাবে তৈরি করেছি—ধর্ম আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, ধর্ম নিয়ে আমি কাউকে আঘাত করতে চাই না। নিজে ভালো থাকতে চাই, সৎ থাকতে চাই, নিজের মতো করেই কোরআন-হাদিসের আলোকে ধর্ম পালন করতে চাই। পাশাপাশি অন্যের স্বাধীনতায় আমি বিশ্বাস করি, যদি তার স্বাধীনতা অন্য কারও স্বাধীনতাকে হরণ না করে, বা ব্যাঘাত না ঘটায়।

আমি সাধারণত ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে, তাদের থেকে দূরে থাকি। যারা পরকালের কথা ভেবে ধর্ম পালন করে, তাদের বেশি ভালোবাসি। ব্যবসা বলতে বোঝাচ্ছি, বিশেষ করে সেই ধরনের ব্যবসা—কোনো একটি জায়গায় একটি স্থাপনা তৈরি করে, বিশেষ ধরনের কাপড় দিয়ে ঘিরে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মানুষের সহজ-সরল মনকে দুর্বল করে, আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করে। এই পদ্ধতি থেকে আমি সব সময় দূরে থাকি। আমি যতটুকু শিখেছি বা বুঝেছি, মানুষ মরে যাওয়ার পরে তার পাপ-পুণ্যের বিচার করবেন আল্লাহপাক।

সমাজে ধর্মের ব্যবহার, ধর্মভীরুতা দরকার আছে। এই ধর্মভীরুতার কারণেই একে অন্যকে বধ করে না, একে অন্যের প্রতি অবিচার-অন্যায় করে না। সম্পদশালী লোক গরিবের ওপর দয়া করে, দান-খয়রাত করে। যার ফলে সাধারণ গরিব মানুষ অনেক সাহায্য-সহযোগিতা পায়, সমাজে শান্তি বিরাজ করে। তাই ধর্মভীরু থাকা বা ধর্মের ওপর আস্থা রাখা একান্ত জরুরি। তাই বলে কূপমণ্ডূকতা, একেবারেই অবাস্তব অলৌকিক গল্প বানিয়ে বলা, মানুষকে বিপথে নেওয়া, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইত্যাদির পক্ষে থাকা যায় না।

আমার জীবনে আমি বহুবার মৃত মানুষের জানাজা পড়ার পরে কবরস্থানে গিয়ে দাফনে শরিক হয়েছি। এটা আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছি। লাশ দাফনের সময় আরবিতে যে দোয়া পড়তে হয়, তার বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, ‘মাটি থেকে আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তাতেই আমি তোমাদের ফিরিয়ে নেব, আর তা থেকে তোমাদের আবার বের করব।’ এই কথাগুলো আছে সুরা ত্বহার ৫৫ নম্বর আয়াতে। আল্লাহ বান্দার কৃতকর্মের জন্য বিচার করবেন মাটি থেকে তুলে। এখন আমরা নিজেরা নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি, অন্যের পাপ-পুণ্যের ভাগীদার আমরা হব কেন? দিল্লি মসজিদের প্রধান খতিব বলেছিলেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহপাক তোমাকে তোমার কৃতকর্মের কথা জিজ্ঞেস করবেন, তোমার কৃতকর্মের বিচার করবেন। অন্যের কৃতকর্মের জন্য তোমার কাছে কোনো প্রশ্ন করবেন না।’

বর্তমানে আমরা আমাদের কৃতকর্মের পরিবর্তে অন্যের কৃতকর্মের ওপর বেশি জোর দিচ্ছি। অন্যে কী করল বা কী করল না, এটা নিয়ে নানান আলোচনা করছি, অনেক সময় অন্যের ওপর জোরজবরদস্তি করছি, ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মীয় কোনো অনুশাসন চাপিয়ে দিচ্ছি। অথচ আমরা জানি না কোনটা ঠিক। আমি যেটা ঠিক মনে করি, অন্যে সেটা ঠিক মনে না-ও করতে পারে। মূল যেটা দেখার ব্যাপার—একজনের বিশ্বাসের ফলে অপরের বিশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটে কি না। অপরের কোনো ক্ষতি হয় কি না।

৫ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে যে ঘটনাটি ঘটে গেল, তা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড়। এমনকি বিশ্ব মিডিয়ায় এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আমাদের দেশের ভাবমূর্তি এ ব্যাপারে খুব একটা যে ভালো হয়েছে, সেটা কেউ বলতে পারবে না। যে নুরাল পাগলা মারা গিয়েছেন, তিনি যে সঠিক পথে ছিলেন বা ছিলেন না, তা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। এ ব্যাপারে আমি ভালো জানি না। তবে সাধারণ জ্ঞানে এইটুকু বুঝি, তিনি যদি ভুল পথে পরিচালিত হয়ে শিষ্যদের তাঁর কবরের এমন ব্যবস্থা করতে বলেন, যেটা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাহলে অত্র অঞ্চলের মুরব্বিরা সঠিক ইসলামি বিধান মেনে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু তাই বলে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে, হাজার লোকের সামনে লাশ কবর থেকে তুলে এইভাবে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নয়কি? এখানে অনেক হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়েছে, মুসলমানদের মধ্যেই ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে, দুটি পক্ষ হয়ে গেছে। একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখুন, এর ফলাফলটা কি সুখকর হয়েছে? আসলেই যদি আমরা ঠান্ডা মাথায় সবাই বসে, হাদিস-কোরআনের আলোকে সিদ্ধান্ত নিতাম, তাহলে এই ভেদাভেদ সৃষ্টি হতো না।

এই ব্যাপারটা নিয়ে দুটি পক্ষ যে হয়েছে, সেটা দৃশ্যমান। দুই পক্ষই বলছে তারা সত্যের পথে। তবে আসল সত্যটা যে কী, তা নির্ধারণ কে করবে?

সত্য কী? এই ব্যাপারে একটা উপাখ্যান বলতে চাই। রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বয়স্ক গভর্নর পন্টিয়াস পিলেট সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কৃতকর্মের বেশ সমালোচক ছিলেন। তাঁকে পানিশমেন্ট পোস্টিং দেওয়া হয় ফিলিস্তিনে। যিশুখ্রিষ্ট যখন সেখানে ধর্ম প্রচার করছিলেন, তখন রোমান সম্রাটের কাছে নালিশ গেল—যিশুখ্রিষ্ট রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করছেন। রোমান সম্রাটের কাছ থেকে বার্তা এল—রাজদ্রোহী যিশুকে হত্যা করতে হবে। পন্টিয়াস পিলেট খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন, যিশুখ্রিষ্ট কোনো রাজদ্রোহী কাজ করছেন না, রাজনীতি তাঁর কোনো পেশা না বা রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ নেই, তিনি শুধু ঈশ্বরের বাণী প্রচার করেন। তারপরও রোমান সম্রাটের বার্তা—তাঁকে হত্যা করতেই হবে—ক্রুশবিদ্ধ করে। পন্টিয়াস পিলেটের বাহিনী যিশুখ্রিষ্টকে ধরে নিয়ে এল। তাঁকে হত্যার হুকুম দেওয়ার পরে নিজ কক্ষে যাওয়ার আগে আরেকটি কক্ষে বড় একটি পাত্রে রাখা স্বচ্ছ পানির দিকে একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন পিলেট। এরপর পানি দিয়ে ভালো করে নিজের মুখমণ্ডল ধুতে লাগলেন। তখন পিলেটের লেফটেন্যান্ট তাঁকে বললেন, ‘পিলেট, আপনি কাজটি কী করলেন? একজন নিরপরাধ মানুষকে আপনি হত্যার নির্দেশ দিলেন। তিনি তো কোনো রাজদ্রোহী কাজ করেননি, শুধু ঈশ্বরের বাণী প্রচার করেছেন। আপনি যে কাজটি করছেন এটা সত্য না।’ পিলেট সেটা জানতেন। তিনি মুখ ধুতে ধুতে বললেন, ‘হোয়াট ইজ দ্য ট্রুথ?’ এখানে রূপক অর্থে বলা যায়, তিনি যে পানি দিয়ে মুখ ধুয়েছিলেন, তা আসলে তাঁর পাপ।

পন্টিয়াস পিলেটের সেই কথাটি, ‘হোয়াট ইজ দ্য ট্রুথ’—বাক্যটি নিয়ে এখনো বহু জ্ঞানী, দার্শনিক গবেষণা করেন, চিন্তা করেন। আসল সত্য কোনটি? আসলেই আমরা কি সবাই সেই সত্যটা জানি?

লেখক: প্রকৌশলী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত