Ajker Patrika

বাঁচাতে হবে সমুদ্রকে, যা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে

সেলিম জাহান 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সমুদ্র মানুষের কাছে এক বিরাট বিস্ময়। সেটা সমুদ্রের বিশালত্বের জন্য নয়, কিংবা এ কারণেও নয় যে পৃথিবীর ৭০ ভাগই সমুদ্র, কিংবা এ জন্যও নয় যে জীবমণ্ডলের ৯৫ ভাগেরও বেশি সমুদ্রে। সমুদ্রের প্রতি আমাদের বিস্ময়ের কারণ হচ্ছে যে এর নীলাভ জলের ভেতরে যে জগৎ তা মানুষের কল্পনারও বাইরে। এ জগতের অংশমাত্র আমরা জানি, কিন্তু এর বেশিটাই আমাদের অজানা, আমাদের ধারণার বাইরে। সমুদ্রের বিস্ময়কর জগৎটাই আমাদের আকর্ষণ করে এবং একে রক্ষা করার জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধও করে। সমুদ্র আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা বড় কোনো কিছুর একটা ক্ষুদ্রতম অংশমাত্র এবং এ পৃথিবীতে সবকিছুই একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছরই ৮ জুন বিশ্ব সমুদ্র দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এই পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমুদ্রের যত বিস্ময় আছে, তার মধ্যে অপরিহার্য বিস্ময়গুলোকে এবং যে বিস্ময়গুলো আমাদের উদ্দীপ্ত করে, সেগুলোকে বেছে নিয়ে তাদের উদ্‌যাপন করা, যাতে সমুদ্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সময়ে আমরা তার বিস্ময়গুলোকে বিস্মৃত না হই।

পরিবেশ এবং উন্নয়নের জন্য গঠিত ব্রান্ডটল্যান্ড কমিশনের ১৯৮৭ সালের ‘ব্রান্ডটল্যান্ড প্রতিবেদনে’ বলা হয় যে অন্যান্য খাতের তুলনায় সমুদ্র খাতের কণ্ঠস্বর বহুলাংশে দুর্বল এবং ম্রিয়মাণ। এর সূত্র ধরে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে একটি বিশ্ব সমুদ্র দিবসের ধারণা ও প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সাল থেকে এ দিবসটি পালন করা শুরু হয়। বিশ্বব্যাপী বজায়ক্ষম উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের বাস্তবায়নকে এ দিবসটি সমর্থন করে এবং সেই সঙ্গে সমুদ্র এবং তার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে জন-আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করে। এ দিনটি উদ্‌যাপনের জন্য গত ২৭ বছরে নানাবিধ বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় দিবসটির শিরোনাম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘আমাদের সমুদ্র: আমাদের দায়িত্ব’ (২০০৯); ‘আমাদের সমুদ্র, আমাদের ভবিষ্যৎ’ (২০১৭) এবং ‘সমুদ্র নামের গ্রহ: পরিবর্তনীয় তরঙ্গ’ (২০২৩)। এ বছরের ‘বিশ্ব সমুদ্র দিবসের’ শিরোনাম হচ্ছে, ‘বিস্ময়: যা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, তাকে বাঁচানো’।

মানবজীবনে সমুদ্রের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা যায় না। সমুদ্র আমাদের জীবনের উৎস, মানুষের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। এবং সত্যিকার অর্থে সব জীবন্ত প্রাণীর জন্যই সমুদ্র এই ভূমিকাটি পালন করে। পৃথিবীর ৫০ শতাংশ অক্সিজেন সমুদ্র থেকে আসে, সমুদ্র হচ্ছে জগতের বেশির ভাগ জীববৈচিত্র্যের আবাস এবং বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষের প্রোটিন জোগানোর আধার। বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যও সমুদ্র গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সমুদ্রভিত্তিক শিল্পগুলোতে চার কোটি মানুষ কর্মরত। বিশ্ববাণিজ্যের ৮০ ভাগ পরিবহনই সমুদ্র পথে হয়ে থাকে। মানবজাতির খাদ্য এবং পুষ্টি নিরাপত্তায় সুসংরক্ষিত সমুদ্র একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৯০০ কোটি মানুষের খাদ্য জোগাতে সমুদ্রের ওপরে উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভর করতে হবে। মানুষের জীবন-জীবিকা এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সমুদ্রের অবদান অনস্বীকার্য।

নীলাভ অর্থনীতি, যা কি না সমুদ্র এবং তার সম্পদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি হতে পারে। বিশ্ব আজকে বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত—খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ-সংঘাত, অর্থনৈতিক শ্লথতা, আর্থিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি। ২০১২ সালে বিশ্ব তার নীলাভ অর্থনীতি কৌশলের রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল, মানব সমৃদ্ধি ও মানব উন্নয়নের জন্য সমুদ্রের সম্পদ ও সম্ভাবনাকে মুক্ত করে দেওয়া। সত্যিকার অর্থে, মৎস্য উন্নয়ন, জলভিত্তিক কৃষি, পর্যটন, জলভিত্তিক ক্রীড়া, সমুদ্রের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ইত্যাদির উন্নয়নের মাধ্যমে নীলাভ অর্থনীতি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। সাত বছর আগে বিশ্বে সামুদ্রিক মাছের রপ্তানি ছিল দেড় হাজার কোটি ডলার, যার ৫৪ শতাংশই এসেছিল উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে তাদের সব সম্ভাব্য সুফল সত্ত্বেও আজকে বিশ্বের সমুদ্রসমূহ নানান রকমের সমস্যা ও অন্তরায়ের সম্মুখীন। প্রায় ৯০ শতাংশ সামুদ্রিক মৎস্য আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, ৫০ ভাগ প্রবালপ্রাচীর নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিবছর বিশ্বে ৪০ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয় এবং বিগত দুই দশকে বৈশ্বিক প্লাস্টিক উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতিবছর, মোটামুটিভাবে এক কোটি টন প্লাস্টিক সমুদ্রে স্থান পায়। অন্যভাবে দেখলে, প্রতিদিন দুই হাজার বর্জ্য ফেলার ট্রাকভর্তি প্লাস্টিক সমুদ্রে ফেলা দেওয়া হয়। মানুষের খাওয়ার জন্য প্রতি তিনটি মাছের একটির মধ্যে প্লাস্টিক পাওয়া যায়। ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর সমুদ্রগুলোতে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বেশি থাকবে। প্রতিবছর সমুদ্রে প্লাস্টিকের কারণে এক লাখ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী জীব এবং ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি মারা যায়। তেলের জাহাজ ডুবি বা ভাঙা কিংবা সমুদ্রে তৈলবর্জ্য ফেলে দেওয়ার কারণে সমুদ্রের প্রভূত ক্ষতি হয়।

বঙ্গোপসাগরে ওপরে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের নিচুস্থিত বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পৃক্ত নানান সমস্যা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সাল নাগাদ শূন্য দশমিক ৩০ মিটার বাড়তে পারে, যার ফলে ৯ লাখ মানুষ গৃহচ্যুত হবে। আরও ৫০ বছর পরে ২১০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা শূন্য দশমিক ৭৪ মিটার বাড়লে দেশের ২১ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমিক্ষয়, মিষ্টিজলে নোনাজলের অনুপ্রবেশ এবং নিচু অঞ্চলের ভাঙনকে ত্বরান্বিত করবে। এসব পরিবর্তন মানুষের জীবন ও জীবিকা, কৃষিকাজ ও মনুষ্যাবাসের জন্য শঙ্কার কারণ হয়ে আবির্ভূত হবে।

কিন্তু একই সময়ে একটি নীলাভ অর্থনীতি গড়ে তোলার যথেষ্ট সম্ভাবনা বাংলাদেশে রয়েছে। এ জাতীয় অর্থনীতি দেশের প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বজায়ক্ষম জীবিকা অর্জনে সহায়তা করবে। সামুদ্রিক বাণিজ্য, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল, পর্যটন, মৎস্য উৎপাদন ও বাণিজ্য, তেল ও গ্যাস, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সামুদ্রিক লবণ প্রস্তুত—এসব কর্মকাণ্ড এই নীলাভ অর্থনীতির অংশ হতে পারে। বাংলাদেশে এ রকমের একটি অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে সামুদ্রিক এবং উপকূলীয় বাস্তু কাঠামোর সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবহারের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে একটি নীলাভ অর্থনীতিতে উত্তরণকে বিভিন্ন সমুদ্র-সম্পৃক্ত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ চিহ্নিতকরণ, সেই সঙ্গে দেশের নীতিমালা, নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর ব্যবস্থাপনা, সুশাসন কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।

বর্তমান সময়ে, আমাদের নীলাভ গ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নানান হুমকির সম্মুখীন—জলবায়ু এবং জীববৈচিত্র্যের সংকট। আমাদের জন্য আমরা একটি সুরক্ষিত সমুদ্র চাই এবং এ লক্ষ্যে আমাদের নানান কার্যক্রমকে সমন্বিত করতে হবে। বিশ্বকে ৩০×৩০ আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে, যেখানে ২০৩০ নাগাদ নীলাভ গ্রহের অন্ততপক্ষে ৩০ ভাগকে সুরক্ষিত করতে হবে। ২০২৫ সালের জাতিসংঘ সমুদ্র সম্মেলন ফ্রান্সের নিসে আগামী ৯-১৩ জুনে অনুষ্ঠিত হবে। এ সম্মেলনে বিশ্বের নানান সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদের সুরক্ষণ ও বজায়ক্ষম ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হবে। জুনের ৮ তারিখের উদ্‌যাপিতব্য বিশ্ব সমু্দ্র দিবস সেই লক্ষ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।

সেলিম জাহান

ভূতপূর্ব পরিচালক

মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং

দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত