মৃত্যুঞ্জয় রায়
দেশে প্রতিবছর বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বাস্তবায়নের সময় মাঝে মাঝে সংবাদ চোখে পড়ে যে প্রকল্পের ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে গাছ কাটা পড়ছে, বনভূমি উজাড় হচ্ছে, খাল ও জলাভূমি ভরাট হচ্ছে, নির্মাণস্থলে নির্মাণকাজের ফলে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, এমনকি কোনো কোনো প্রকল্প গ্রহণের ফলে পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ছে। নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ফলে সেতুর উজান ও ভাটি এলাকায় যে কী পরিমাণ পলি জমে নদীর বাস্তুতন্ত্র ও নাব্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা কয়েকটি সেতুর ওপর দাঁড়িয়েই সহজে বোঝা যায়।
কোনো দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সরকার সব সময়ই বলে আসছে, পরিবেশ ও সমাজের ক্ষতি করে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ জন্য যেকোনো প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন ও গ্রহণের আগে সে প্রকল্পের উপযুক্ততা বা যথার্থতা সঠিকভাবে যাচাই করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি সেসব প্রকল্পের পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাবগত সমীক্ষাও বাধ্যতামূলক। বিশেষ করে প্রকল্পটি গ্রহণের আগে সে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সেখানকার এবং রাষ্ট্রের সমাজ ও পরিবেশের কী ক্ষতি হতে পারে, কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের ঝুঁকি রয়েছে, সেগুলো নিরূপণ করার বিধান রয়েছে। নেতিবাচক প্রভাবগুলো যদি লঘু ও প্রশমনযোগ্য হয়, তাহলে সেসব প্রভাব নিরসনের জন্য প্রকল্প কাঠামোর ভেতরে সেসব ঝুঁকি নিরসনের ব্যবস্থা রেখেই উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করার গাইডলাইনে নির্দেশনা রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে প্রকল্প গ্রহণে কখনো কখনো অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করে প্রকল্প অনুমোদন করাতে গিয়ে এবং রাজনৈতিক চাপ বা ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে সেসব প্রকল্পের দলিলে এ বিষয়গুলোকে শুধু নিয়ম রক্ষার বিষয়ে পরিণত করা হয়, প্রকৃতপক্ষে যথাযথ ফিজিবিলিটি স্টাডি ও পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই অনেক প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। অনেক সময় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে যথাযথভাবে পরিবেশগত ও অবস্থানগত ছাড়পত্রও গ্রহণ করা হয় না। এমনকি আর্থিক বিষয়ের খুঁটিনাটিতেও অনেক গলদ থেকে যায়। এতে পরবর্তী সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকালে বেশ কিছু সমস্যার উদ্ভব হয়। এ কারণে পরবর্তী সময়ে প্রায় সব প্রকল্পেরই ডিপিপি বা টিএপিপি সংশোধন করা আবশ্যিক হয়ে পড়ে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বর্তমানে এ দেশে পরিবেশগত ও সামাজিক বিষয়াবলির চর্চা এবং প্রত্যাশিত অবস্থার মধ্যে মোটাদাগে যেসব গ্যাপ বা ব্যবধানগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো হলো:
১. কৃষকেরা এখনো পরিবেশবান্ধব কৃষিকাজের ভালো চর্চাগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নন। তাঁদের কম সচেতনতার কারণে খামারের স্থানে পরিবেশদূষণ, বিশেষ করে বায়ু, ভূমি ও পানিদূষণ এখনো ঘটছে। কৃষি আবর্জনা এবং সার এখনো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে না। কৃষিকাজে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় কৃষকেরা এখনো দক্ষ নন। কৃষিজমিও অ-কৃষি উদ্দেশ্যে স্থানান্তরিত হচ্ছে। নির্মাণস্থলে নানাভাবে পরিবেশদূষণ ঘটছে, বিশেষ করে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ধূলিদূষণ, নির্মাণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দূষণ কমাতে বা প্রতিরোধ করতে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
২. প্রকল্পগুলোতে ও প্রতিষ্ঠানে অবস্থান-নির্দিষ্ট পরিবেশগত ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা না থাকায় বিষয়টি অগ্রাহ্য করা হয় বা এড়িয়ে যাওয়া হয়। এ কারণে অবকাঠামো নির্মাণস্থলে কিছু পরিবেশগত ও সামাজিক ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে ও পরবর্তী সময়ে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
৩. প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণ এখনো কম দেখা যাচ্ছে এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও তা ভোগের/অ্যাকসেসের ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে রয়েছে।
৪. নারী শ্রমিকদের জন্য কোনো ন্যূনতম মজুরি আইন নেই, যাতে একই কাজের জন্য সমান মজুরির ভিত্তিতে কৃষি বা অবকাঠামোগত কাজে নারী কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা যায়। এ দেশে শ্রম বিধিমালা থাকলেও শ্রমিকদের কল্যাণসাধন সেভাবে করা হচ্ছে না।
৫. এমনকি যৌন হয়রানির শিকার নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয়ে কোনো অভিযোগও করেন না। দেশে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হলেও ভুক্তভোগী অভিযোগকারীরা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন নন।
৬. সর্বোপরি প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পরিবেশগত ও সামাজিক বিষয়াবলি সম্পর্কে দক্ষ জনবলেরও অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প প্রোফর্মা বা ডিপিপি প্রণয়নের উদ্দেশে প্রণীত ডিপিপি ম্যানুয়ালের ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে ১০টি নির্দেশনা রয়েছে। এগুলো হলো: যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের সময় এ ধরনের অন্যান্য আর কী প্রকল্প এবং বিদ্যমান স্থাপনা রয়েছে তা দেখতে হবে, ডিপিপি বা টিএপিপিতে পরিবেশগত টেকসইয়ের ওপর এগুলোর প্রভাব বা ফলাফল এবং নির্দিষ্ট প্রশমনব্যবস্থা, যেমন ভূমি, পানি, বায়ু, জীববৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র পরিষেবা (যদি প্রকল্পটি লাল শ্রেণিভুক্ত হয়, তবে পরিবেশগত প্রভাব ও ঝুঁকি নিরূপণ ডকুমেন্ট অবশ্যই সংযুক্ত করতে হবে), জলবায়ু পরিবর্তন, অভিযোজন এবং প্রশমন কৌশল গ্রহণ; জেন্ডার, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা অনগ্রসর গোষ্ঠীর চাহিদা; কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যের অবস্থা, সাংগঠনিক বিন্যাস বা কাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক উৎপাদনশীলতা, আঞ্চলিক বৈষম্য, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩ অনুযায়ী পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ (গ্রহণ করা হলে তার প্রমাণ সংযুক্ত করতে হবে, না হলে তার কারণ উল্লেখ করতে হবে) ইত্যাদি। এ ছাড়া ম্যানুয়ালের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টিকেও বিবেচনার উল্লেখ রয়েছে এবং ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালনকালে যেসব পরিবেশগত বিপত্তি ও দুর্যোগের ঝুঁকি রয়েছে, সেসব ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে প্রশমনের ব্যবস্থা থাকার কথা বলা হয়েছে। অতএব, প্রকল্প প্রণয়নের সময় ডিপিপিতেই এ বিষয়গুলো সক্রিয়ভাবে বিবেচনা ও যুক্ত করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিষয়কে উহ্য রেখে বা অগ্রাহ্য করে প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করা হয়। কাজেই কোনো প্রকল্পের পরিবেশগত ও সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনে গোড়াতেই এসব নির্দেশনা প্রতিপালনের দিকে নজর দিতে হবে।
প্রকল্প করা হয় উন্নয়নের জন্য, যা হতে হবে টেকসই। একটি প্রকল্প তখনই টেকসই হয়, যখন সে প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়নে ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি হয় ও তার সুফল সমাজে বহমান থাকে। প্রকল্পের তিনটি মাত্রা রয়েছে: পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। প্রাকৃতিক সম্পদ অফুরন্ত না। তাই পরিবেশগত দিক থেকে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষা ও তার যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। পাশাপাশি সামাজিক দিক থেকে সে প্রকল্পের কাজগুলো যেন সেখানকার মানুষ, সম্প্রদায় ও ধর্ম-কৃষ্টি-সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করে। এ দুটি বিষয়ে সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য দরকার জনসচেতনতা, যেন সমাজের ও প্রকল্পের মানুষেরা বুঝতে পারেন যে প্রকল্পের মাধ্যমে এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে পরিবেশ-প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের তাই এ তিনটি মাত্রাকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রায়ই প্রকল্পকাঠামো, নীতিমালা ও বাস্তবায়নের মধ্যে ফারাক বা অসংগতি দেখা যায়। এসব অসংগতিতে পরিবেশ ও সমাজের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। প্রকল্প বাস্তবায়নস্থলে ভূমি, পানি, বায়ু, জীববৈচিত্র্য এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি নারী-শিশু, আঞ্চলিক বৈষম্য, অনগ্রসর গোষ্ঠী, দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান, উৎপাদনশীলতার ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ে। প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এসব বিষয়কে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক খায়েশ বা অভিলাষ পূরণ এবং প্রকল্প নেওয়ার জন্য প্রকল্প নেওয়ার রীতি-সংস্কৃতি থেকে সরে এসে বাস্তবতা ও প্রয়োজনের নিরিখে প্রকল্প তৈরি এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকল্প তৈরির সময়ই খেয়াল রাখতে হবে যেন সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশ, প্রকৃতি ও সমাজের কোনো ক্ষতি না হয়। কোনো কারণে বাস্তবায়নকালে ক্ষতিকর কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হলে সেসব প্রভাব কাটিয়ে ওঠার মতো যেন যথেষ্ট সুরক্ষাব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক
দেশে প্রতিবছর বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বাস্তবায়নের সময় মাঝে মাঝে সংবাদ চোখে পড়ে যে প্রকল্পের ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে গাছ কাটা পড়ছে, বনভূমি উজাড় হচ্ছে, খাল ও জলাভূমি ভরাট হচ্ছে, নির্মাণস্থলে নির্মাণকাজের ফলে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, এমনকি কোনো কোনো প্রকল্প গ্রহণের ফলে পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ছে। নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ফলে সেতুর উজান ও ভাটি এলাকায় যে কী পরিমাণ পলি জমে নদীর বাস্তুতন্ত্র ও নাব্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা কয়েকটি সেতুর ওপর দাঁড়িয়েই সহজে বোঝা যায়।
কোনো দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সরকার সব সময়ই বলে আসছে, পরিবেশ ও সমাজের ক্ষতি করে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ জন্য যেকোনো প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন ও গ্রহণের আগে সে প্রকল্পের উপযুক্ততা বা যথার্থতা সঠিকভাবে যাচাই করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি সেসব প্রকল্পের পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাবগত সমীক্ষাও বাধ্যতামূলক। বিশেষ করে প্রকল্পটি গ্রহণের আগে সে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সেখানকার এবং রাষ্ট্রের সমাজ ও পরিবেশের কী ক্ষতি হতে পারে, কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের ঝুঁকি রয়েছে, সেগুলো নিরূপণ করার বিধান রয়েছে। নেতিবাচক প্রভাবগুলো যদি লঘু ও প্রশমনযোগ্য হয়, তাহলে সেসব প্রভাব নিরসনের জন্য প্রকল্প কাঠামোর ভেতরে সেসব ঝুঁকি নিরসনের ব্যবস্থা রেখেই উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করার গাইডলাইনে নির্দেশনা রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে প্রকল্প গ্রহণে কখনো কখনো অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করে প্রকল্প অনুমোদন করাতে গিয়ে এবং রাজনৈতিক চাপ বা ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে সেসব প্রকল্পের দলিলে এ বিষয়গুলোকে শুধু নিয়ম রক্ষার বিষয়ে পরিণত করা হয়, প্রকৃতপক্ষে যথাযথ ফিজিবিলিটি স্টাডি ও পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়াই অনেক প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। অনেক সময় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে যথাযথভাবে পরিবেশগত ও অবস্থানগত ছাড়পত্রও গ্রহণ করা হয় না। এমনকি আর্থিক বিষয়ের খুঁটিনাটিতেও অনেক গলদ থেকে যায়। এতে পরবর্তী সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকালে বেশ কিছু সমস্যার উদ্ভব হয়। এ কারণে পরবর্তী সময়ে প্রায় সব প্রকল্পেরই ডিপিপি বা টিএপিপি সংশোধন করা আবশ্যিক হয়ে পড়ে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বর্তমানে এ দেশে পরিবেশগত ও সামাজিক বিষয়াবলির চর্চা এবং প্রত্যাশিত অবস্থার মধ্যে মোটাদাগে যেসব গ্যাপ বা ব্যবধানগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো হলো:
১. কৃষকেরা এখনো পরিবেশবান্ধব কৃষিকাজের ভালো চর্চাগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নন। তাঁদের কম সচেতনতার কারণে খামারের স্থানে পরিবেশদূষণ, বিশেষ করে বায়ু, ভূমি ও পানিদূষণ এখনো ঘটছে। কৃষি আবর্জনা এবং সার এখনো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে না। কৃষিকাজে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় কৃষকেরা এখনো দক্ষ নন। কৃষিজমিও অ-কৃষি উদ্দেশ্যে স্থানান্তরিত হচ্ছে। নির্মাণস্থলে নানাভাবে পরিবেশদূষণ ঘটছে, বিশেষ করে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ধূলিদূষণ, নির্মাণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দূষণ কমাতে বা প্রতিরোধ করতে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
২. প্রকল্পগুলোতে ও প্রতিষ্ঠানে অবস্থান-নির্দিষ্ট পরিবেশগত ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা না থাকায় বিষয়টি অগ্রাহ্য করা হয় বা এড়িয়ে যাওয়া হয়। এ কারণে অবকাঠামো নির্মাণস্থলে কিছু পরিবেশগত ও সামাজিক ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে ও পরবর্তী সময়ে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
৩. প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণ এখনো কম দেখা যাচ্ছে এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও তা ভোগের/অ্যাকসেসের ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে রয়েছে।
৪. নারী শ্রমিকদের জন্য কোনো ন্যূনতম মজুরি আইন নেই, যাতে একই কাজের জন্য সমান মজুরির ভিত্তিতে কৃষি বা অবকাঠামোগত কাজে নারী কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা যায়। এ দেশে শ্রম বিধিমালা থাকলেও শ্রমিকদের কল্যাণসাধন সেভাবে করা হচ্ছে না।
৫. এমনকি যৌন হয়রানির শিকার নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয়ে কোনো অভিযোগও করেন না। দেশে অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হলেও ভুক্তভোগী অভিযোগকারীরা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন নন।
৬. সর্বোপরি প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পরিবেশগত ও সামাজিক বিষয়াবলি সম্পর্কে দক্ষ জনবলেরও অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প প্রোফর্মা বা ডিপিপি প্রণয়নের উদ্দেশে প্রণীত ডিপিপি ম্যানুয়ালের ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে ১০টি নির্দেশনা রয়েছে। এগুলো হলো: যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের সময় এ ধরনের অন্যান্য আর কী প্রকল্প এবং বিদ্যমান স্থাপনা রয়েছে তা দেখতে হবে, ডিপিপি বা টিএপিপিতে পরিবেশগত টেকসইয়ের ওপর এগুলোর প্রভাব বা ফলাফল এবং নির্দিষ্ট প্রশমনব্যবস্থা, যেমন ভূমি, পানি, বায়ু, জীববৈচিত্র্য, বাস্তুতন্ত্র পরিষেবা (যদি প্রকল্পটি লাল শ্রেণিভুক্ত হয়, তবে পরিবেশগত প্রভাব ও ঝুঁকি নিরূপণ ডকুমেন্ট অবশ্যই সংযুক্ত করতে হবে), জলবায়ু পরিবর্তন, অভিযোজন এবং প্রশমন কৌশল গ্রহণ; জেন্ডার, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা অনগ্রসর গোষ্ঠীর চাহিদা; কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যের অবস্থা, সাংগঠনিক বিন্যাস বা কাঠামো, প্রাতিষ্ঠানিক উৎপাদনশীলতা, আঞ্চলিক বৈষম্য, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩ অনুযায়ী পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ (গ্রহণ করা হলে তার প্রমাণ সংযুক্ত করতে হবে, না হলে তার কারণ উল্লেখ করতে হবে) ইত্যাদি। এ ছাড়া ম্যানুয়ালের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টিকেও বিবেচনার উল্লেখ রয়েছে এবং ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালনকালে যেসব পরিবেশগত বিপত্তি ও দুর্যোগের ঝুঁকি রয়েছে, সেসব ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে প্রশমনের ব্যবস্থা থাকার কথা বলা হয়েছে। অতএব, প্রকল্প প্রণয়নের সময় ডিপিপিতেই এ বিষয়গুলো সক্রিয়ভাবে বিবেচনা ও যুক্ত করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিষয়কে উহ্য রেখে বা অগ্রাহ্য করে প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করা হয়। কাজেই কোনো প্রকল্পের পরিবেশগত ও সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনে গোড়াতেই এসব নির্দেশনা প্রতিপালনের দিকে নজর দিতে হবে।
প্রকল্প করা হয় উন্নয়নের জন্য, যা হতে হবে টেকসই। একটি প্রকল্প তখনই টেকসই হয়, যখন সে প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়নে ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি হয় ও তার সুফল সমাজে বহমান থাকে। প্রকল্পের তিনটি মাত্রা রয়েছে: পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। প্রাকৃতিক সম্পদ অফুরন্ত না। তাই পরিবেশগত দিক থেকে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষা ও তার যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। পাশাপাশি সামাজিক দিক থেকে সে প্রকল্পের কাজগুলো যেন সেখানকার মানুষ, সম্প্রদায় ও ধর্ম-কৃষ্টি-সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করে। এ দুটি বিষয়ে সুরক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য দরকার জনসচেতনতা, যেন সমাজের ও প্রকল্পের মানুষেরা বুঝতে পারেন যে প্রকল্পের মাধ্যমে এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে পরিবেশ-প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের তাই এ তিনটি মাত্রাকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রায়ই প্রকল্পকাঠামো, নীতিমালা ও বাস্তবায়নের মধ্যে ফারাক বা অসংগতি দেখা যায়। এসব অসংগতিতে পরিবেশ ও সমাজের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। প্রকল্প বাস্তবায়নস্থলে ভূমি, পানি, বায়ু, জীববৈচিত্র্য এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি নারী-শিশু, আঞ্চলিক বৈষম্য, অনগ্রসর গোষ্ঠী, দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান, উৎপাদনশীলতার ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ে। প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এসব বিষয়কে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক খায়েশ বা অভিলাষ পূরণ এবং প্রকল্প নেওয়ার জন্য প্রকল্প নেওয়ার রীতি-সংস্কৃতি থেকে সরে এসে বাস্তবতা ও প্রয়োজনের নিরিখে প্রকল্প তৈরি এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকল্প তৈরির সময়ই খেয়াল রাখতে হবে যেন সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশ, প্রকৃতি ও সমাজের কোনো ক্ষতি না হয়। কোনো কারণে বাস্তবায়নকালে ক্ষতিকর কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হলে সেসব প্রভাব কাটিয়ে ওঠার মতো যেন যথেষ্ট সুরক্ষাব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক
রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২ ঘণ্টা আগেপাহাড় রক্ষা করা যখন খুবই জরুরি, তখন সে পাহাড় কেটে গোটা অঞ্চলের জন্য বিপদ ডেকে আনছে একদল দুর্বৃত্ত। খাগড়াছড়ির পানছড়ি এলাকায় অবাধে পাহাড় কাটা হচ্ছে, অথচ সরকারি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে দায়সারা বক্তব্য দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করছেন।
৩ ঘণ্টা আগে১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখন শেখ মুজিবুর রহমান জেলে ছিলেন, তাঁকে করা হয়েছিল দলের যুগ্ম সম্পাদক। পরবর্তী সময়ে শামসুল হক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১ দিন আগেআমাদের দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো আইনকানুন কিংবা বিধিবিধান নেই। তাহলে এই সরকারের মেয়াদ কত দিন হবে? একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, সেই অভ্যুত্থানের চালিকাশক্তির আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এই সরকার গঠিত ও ক্ষমতায়িত হয়েছে।
১ দিন আগে