ড. মঞ্জুরে খোদা
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রধান প্রক্রিয়া হচ্ছে নির্বাচন। কিন্তু সেই নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ—অন্তত বাংলাদেশের মতো সংঘাতময়, অসহিষ্ণু, অবিশ্বাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দেশে। প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভারসাম্যমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল করতে হলে প্রচলিত এফপিটিপি (ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট) পদ্ধতির সঙ্গে পিআর (প্রপোরশোনাল রিপ্রেজেন্টেটিভ) পদ্ধতি যুক্ত করা হলে ভোটারদের মতামতের ভারসাম্যমূলক অবস্থার প্রতিফলন দেখা যাবে।
বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফল কতটা ভারসাম্যহীন, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছে মাত্র ৬২টি, অর্থাৎ ২১ শতাংশ আসন। আর বিএনপি-জামায়াত জোট ৪৫.১৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে ২০৮টি, অর্থাৎ ৬৯ শতাংশ আসন। এখানে বিএনপি মাত্র ৪.৯৪ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগের চেয়ে ১৪৬টি বেশি, অর্থাৎ ২৩৫ শতাংশ বেশি আসন। এই হিসাবই বলে দেয় যে এফপিটিপি ব্যবস্থায় জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে না। এই ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকার আসনের ক্ষেত্রেও প্রকৃত জনমতের একই ধরনের অন্যায্য প্রতিফলন ঘটতে পারে। যেমন ধরা যাক, একটি আসনে পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে যদি তাঁরা যথাক্রমে ২৭, ২৬, ২১, ১৭ ও ৯ শতাংশ করে ভোট পান, তাহলে যিনি ২৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন তিনিই নির্বাচিত হবেন এবং ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি’ হিসেবে গণ্য হবেন। যদিও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট মোটেও পাননি। মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের হিসাবে তিনি অন্তত প্রদত্ত ভোটের ৫১ শতাংশ পাননি। এই ব্যবস্থায় একটি দল ৩০০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে প্রতিটিতে ২০ শতাংশ করে ভোট পেয়েও একটি আসনও না পেতে পারে। সংগতই এই ব্যবস্থা মোটেও জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত করে না।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা সংখ্যানুপাতিক পিআর না এফপিটিপি সিস্টেমে হবে, সেটা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। লক্ষ করেছি, এই বিতর্ক নিয়ে বিরোধ যে পর্যায়ে গেছে, তাতে শিগগির সমঝোতার কোনো সুযোগ দেখছি না। নির্বাচনের কোনো পদ্ধতিই ত্রুটিমুক্ত নয়, তারপরও যে পদ্ধতিতে মানুষের ন্যূনতম অংশগ্রহণ থাকে, সেটাকেই গ্রহণ করা সমীচীন। পিআর পদ্ধতি ভোটের ভিত্তিতে সংসদে সব দলের অংশগ্রহণই নিশ্চিত শুধু করবে না, সরকারকে স্বৈরাচার ও কর্তৃত্বপরায়ণও হতে বাধা দেবে। তবে নির্বাচনকে সম্পূর্ণ পিআর বা সম্পূর্ণ এফপিটিপি না করে এই দুইয়ের মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করাটাকে যৌক্তিক মনে করি। জাপান এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। আমি মনে করি, জাপানের এই পদ্ধতি আমাদের জন্য উপযোগী।
বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর তালিকায় জাপান শীর্ষস্থান দখল করে আছে অনেক বছর ধরে। কিন্তু একটি দেশের উন্নয়নের পেছনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কতটা ভূমিকা রাখে, তা জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থার দিকে তাকালে অনুধাবন করা যায়। জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থা শুধু একটি ভোটপ্রক্রিয়া নয়, বরং তা এক দীর্ঘ রাজনৈতিক সংস্কার, অভিজ্ঞতা এবং গণতান্ত্রিক চর্চার ফল। এটি এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো, যেখানে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি উভয়ের সঠিক প্রতিফলন ঘটে।
জাপান বিশ্বের অন্যতম উন্নত এবং রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল একটি দেশ। এই স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা, যা সময়ের বিবর্তনে একদিকে যেমন আধুনিক হয়েছে, তেমনি গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব এবং স্বচ্ছতা বজায় রেখে নাগরিকদের মতামতের সঠিক প্রতিফলন নিশ্চিত করেছে। জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিছক একটি ভোটপ্রক্রিয়া নয়, বরং এটি এক সুসংগঠিত কাঠামো, যা দেশটির রাজনীতির মৌলিক ভিত্তি।
জাপানের আধুনিক নির্বাচনী ব্যবস্থার সূচনা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, যখন মার্কিন দখলদারত্বে দেশটির সংবিধান সংস্কার হয় (১৯৪৭ সালের নতুন সংবিধান)। এটি একটি পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে সাধারণ জনগণ ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। এর আগে জাপানে সামন্ততান্ত্রিক ও সামরিক রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে চলেছে, যেখানে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার ছিল সীমিত। যুদ্ধ-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সংস্কার এই ইতিহাসকে একেবারে পাল্টে দেয়।
জাপানের সংসদকে বলা হয় ‘দ্য ন্যাশনাল ডায়েট’, যা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট; প্রথমটি হচ্ছে নিম্নকক্ষ (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস), যার আসনসংখ্যা ৪৬৫টি, মেয়াদ: ৪ বছর, সরকার গঠনের ক্ষমতা এই কক্ষের হাতে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে উচ্চকক্ষ (হাউস অব কাউন্সিলরস) আসন: ২৪৮টি, এর মেয়াদ ৬ বছর (প্রতি ৩ বছরে অর্ধেক আসনের নির্বাচন হয়)। এই কাঠামো আইন পাসে সহায়তা এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি সংসদীয় কাঠামো যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স ও লর্ডসের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ।
জাপানের নির্বাচনী পদ্ধতি মিশ্র এফপিটিপি ও পিআরের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর মিশ্র পদ্ধতি, যা দুটি আলাদা পদ্ধতির সমন্বয়ে গঠিত: প্রথম ব্যবস্থা হচ্ছে (এফপিটিপি), যেখানে কোনো একক আসন থেকে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী নির্বাচিত হন। সেখানে প্রার্থী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এটি স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধি নির্বাচনে কার্যকর।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) রাজনৈতিক দলসমূহ একটি নির্ধারিত তালিকা দেয়। ভোটাররা দলকে ভোট দেন এবং সেই ভোটের অনুপাতে দলগুলো আসন পায়। এটি জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে এবং ছোট দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।
এই মিশ্র ব্যবস্থায় নিম্নকক্ষে ২৮৯টি আসন এফপিটিপি আর ১৭৬টি পিআর পদ্ধতিতে বণ্টিত হয়। উচ্চকক্ষে প্রায় অর্ধেক আসন এফপিটিপি, অর্ধেক পিআর পদ্ধতিতে নির্ধারিত হয়।
জাপানের নাগরিকেরা অত্যন্ত সচেতন ও দায়িত্বশীল ভোটার হিসেবে পরিচিত। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, যার ফলে নির্বাচনসংক্রান্ত বিতর্ক খুবই কম। ভোটাররা দুটি ব্যালট ব্যবহার করেন। একজন প্রার্থীর নাম (এফপিটিপি), একটি রাজনৈতিক দলের নাম (পিআর) এই দুটি ভোট একই সঙ্গে ব্যক্তি এবং দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে, যা গণতন্ত্রের একটি ভারসাম্যপূর্ণ রূপ।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় রাজনৈতিক মেরুকরণ, সহিংসতা ও ভোট কারচুপি নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। এর বিপরীতে জাপানে: নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, দ্বৈত ভোটব্যবস্থা (ব্যক্তি ও দল), স্বচ্ছতা ও নিয়মিত ভোটার তালিকা হালনাগাদ, প্রার্থীদের খরচ ও প্রচারণার বিধিনিষেধ—এসবই একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ গঠনে সহায়তা করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।
বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেখানে জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থা হতে পারে এক অনুকরণীয় উদাহরণ। স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং ভোটারের স্বাধীনতা রক্ষা করা যে একটি টেকসই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত—জাপান তার বাস্তব প্রমাণ।
জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রমাণ করে যে, গণতন্ত্র কেবল ভোটদানের সুযোগ নয়—এটি হলো এক শৃঙ্খলিত, সংবেদনশীল ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক অনুশীলন। ভোটারদের মতামত যেন শুধু সংখ্যায় নয়, প্রতিনিধিত্বেও প্রতিফলিত হয়—জাপান তার নিখুঁত প্রয়োগ।
এটি এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তি ও দলের ভূমিকা সমান গুরুত্ব পায়, ছোট দলগুলোর জন্য সুযোগ উন্মুক্ত থাকে এবং ভোটারদের বিশ্বাস অক্ষুণ্ন থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল গণতন্ত্রগুলোর জন্য জাপান নিঃসন্দেহে এক দিকনির্দেশক।
জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থা কেবল একটি ভোটদানের প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক দর্শনের বাস্তবায়ন। এ ব্যবস্থা যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য শিক্ষণীয়। যেখানে ব্যক্তির কণ্ঠস্বর, দলের নীতিমালা এবং দেশের ভবিষ্যৎ একই সরলরেখায় এসে মিলিত হয়—সেখানেই জন্ম নেয় এক শক্তিশালী গণতন্ত্র। জাপান সেই শক্তির প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশ তাকে অনুসরণ করতে পারে।
লেখক: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রধান প্রক্রিয়া হচ্ছে নির্বাচন। কিন্তু সেই নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ—অন্তত বাংলাদেশের মতো সংঘাতময়, অসহিষ্ণু, অবিশ্বাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দেশে। প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভারসাম্যমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল করতে হলে প্রচলিত এফপিটিপি (ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট) পদ্ধতির সঙ্গে পিআর (প্রপোরশোনাল রিপ্রেজেন্টেটিভ) পদ্ধতি যুক্ত করা হলে ভোটারদের মতামতের ভারসাম্যমূলক অবস্থার প্রতিফলন দেখা যাবে।
বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফল কতটা ভারসাম্যহীন, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছে মাত্র ৬২টি, অর্থাৎ ২১ শতাংশ আসন। আর বিএনপি-জামায়াত জোট ৪৫.১৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে ২০৮টি, অর্থাৎ ৬৯ শতাংশ আসন। এখানে বিএনপি মাত্র ৪.৯৪ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগের চেয়ে ১৪৬টি বেশি, অর্থাৎ ২৩৫ শতাংশ বেশি আসন। এই হিসাবই বলে দেয় যে এফপিটিপি ব্যবস্থায় জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে না। এই ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকার আসনের ক্ষেত্রেও প্রকৃত জনমতের একই ধরনের অন্যায্য প্রতিফলন ঘটতে পারে। যেমন ধরা যাক, একটি আসনে পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে যদি তাঁরা যথাক্রমে ২৭, ২৬, ২১, ১৭ ও ৯ শতাংশ করে ভোট পান, তাহলে যিনি ২৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন তিনিই নির্বাচিত হবেন এবং ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি’ হিসেবে গণ্য হবেন। যদিও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট মোটেও পাননি। মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের হিসাবে তিনি অন্তত প্রদত্ত ভোটের ৫১ শতাংশ পাননি। এই ব্যবস্থায় একটি দল ৩০০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে প্রতিটিতে ২০ শতাংশ করে ভোট পেয়েও একটি আসনও না পেতে পারে। সংগতই এই ব্যবস্থা মোটেও জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত করে না।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা সংখ্যানুপাতিক পিআর না এফপিটিপি সিস্টেমে হবে, সেটা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। লক্ষ করেছি, এই বিতর্ক নিয়ে বিরোধ যে পর্যায়ে গেছে, তাতে শিগগির সমঝোতার কোনো সুযোগ দেখছি না। নির্বাচনের কোনো পদ্ধতিই ত্রুটিমুক্ত নয়, তারপরও যে পদ্ধতিতে মানুষের ন্যূনতম অংশগ্রহণ থাকে, সেটাকেই গ্রহণ করা সমীচীন। পিআর পদ্ধতি ভোটের ভিত্তিতে সংসদে সব দলের অংশগ্রহণই নিশ্চিত শুধু করবে না, সরকারকে স্বৈরাচার ও কর্তৃত্বপরায়ণও হতে বাধা দেবে। তবে নির্বাচনকে সম্পূর্ণ পিআর বা সম্পূর্ণ এফপিটিপি না করে এই দুইয়ের মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করাটাকে যৌক্তিক মনে করি। জাপান এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। আমি মনে করি, জাপানের এই পদ্ধতি আমাদের জন্য উপযোগী।
বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর তালিকায় জাপান শীর্ষস্থান দখল করে আছে অনেক বছর ধরে। কিন্তু একটি দেশের উন্নয়নের পেছনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কতটা ভূমিকা রাখে, তা জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থার দিকে তাকালে অনুধাবন করা যায়। জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থা শুধু একটি ভোটপ্রক্রিয়া নয়, বরং তা এক দীর্ঘ রাজনৈতিক সংস্কার, অভিজ্ঞতা এবং গণতান্ত্রিক চর্চার ফল। এটি এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো, যেখানে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি উভয়ের সঠিক প্রতিফলন ঘটে।
জাপান বিশ্বের অন্যতম উন্নত এবং রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল একটি দেশ। এই স্থিতিশীলতার অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা, যা সময়ের বিবর্তনে একদিকে যেমন আধুনিক হয়েছে, তেমনি গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব এবং স্বচ্ছতা বজায় রেখে নাগরিকদের মতামতের সঠিক প্রতিফলন নিশ্চিত করেছে। জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিছক একটি ভোটপ্রক্রিয়া নয়, বরং এটি এক সুসংগঠিত কাঠামো, যা দেশটির রাজনীতির মৌলিক ভিত্তি।
জাপানের আধুনিক নির্বাচনী ব্যবস্থার সূচনা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, যখন মার্কিন দখলদারত্বে দেশটির সংবিধান সংস্কার হয় (১৯৪৭ সালের নতুন সংবিধান)। এটি একটি পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে সাধারণ জনগণ ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। এর আগে জাপানে সামন্ততান্ত্রিক ও সামরিক রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে চলেছে, যেখানে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার ছিল সীমিত। যুদ্ধ-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সংস্কার এই ইতিহাসকে একেবারে পাল্টে দেয়।
জাপানের সংসদকে বলা হয় ‘দ্য ন্যাশনাল ডায়েট’, যা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট; প্রথমটি হচ্ছে নিম্নকক্ষ (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস), যার আসনসংখ্যা ৪৬৫টি, মেয়াদ: ৪ বছর, সরকার গঠনের ক্ষমতা এই কক্ষের হাতে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে উচ্চকক্ষ (হাউস অব কাউন্সিলরস) আসন: ২৪৮টি, এর মেয়াদ ৬ বছর (প্রতি ৩ বছরে অর্ধেক আসনের নির্বাচন হয়)। এই কাঠামো আইন পাসে সহায়তা এবং রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি সংসদীয় কাঠামো যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স ও লর্ডসের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ।
জাপানের নির্বাচনী পদ্ধতি মিশ্র এফপিটিপি ও পিআরের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর মিশ্র পদ্ধতি, যা দুটি আলাদা পদ্ধতির সমন্বয়ে গঠিত: প্রথম ব্যবস্থা হচ্ছে (এফপিটিপি), যেখানে কোনো একক আসন থেকে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী নির্বাচিত হন। সেখানে প্রার্থী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এটি স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধি নির্বাচনে কার্যকর।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) রাজনৈতিক দলসমূহ একটি নির্ধারিত তালিকা দেয়। ভোটাররা দলকে ভোট দেন এবং সেই ভোটের অনুপাতে দলগুলো আসন পায়। এটি জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে এবং ছোট দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।
এই মিশ্র ব্যবস্থায় নিম্নকক্ষে ২৮৯টি আসন এফপিটিপি আর ১৭৬টি পিআর পদ্ধতিতে বণ্টিত হয়। উচ্চকক্ষে প্রায় অর্ধেক আসন এফপিটিপি, অর্ধেক পিআর পদ্ধতিতে নির্ধারিত হয়।
জাপানের নাগরিকেরা অত্যন্ত সচেতন ও দায়িত্বশীল ভোটার হিসেবে পরিচিত। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, যার ফলে নির্বাচনসংক্রান্ত বিতর্ক খুবই কম। ভোটাররা দুটি ব্যালট ব্যবহার করেন। একজন প্রার্থীর নাম (এফপিটিপি), একটি রাজনৈতিক দলের নাম (পিআর) এই দুটি ভোট একই সঙ্গে ব্যক্তি এবং দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে, যা গণতন্ত্রের একটি ভারসাম্যপূর্ণ রূপ।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় রাজনৈতিক মেরুকরণ, সহিংসতা ও ভোট কারচুপি নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। এর বিপরীতে জাপানে: নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, দ্বৈত ভোটব্যবস্থা (ব্যক্তি ও দল), স্বচ্ছতা ও নিয়মিত ভোটার তালিকা হালনাগাদ, প্রার্থীদের খরচ ও প্রচারণার বিধিনিষেধ—এসবই একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ গঠনে সহায়তা করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।
বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেখানে জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থা হতে পারে এক অনুকরণীয় উদাহরণ। স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং ভোটারের স্বাধীনতা রক্ষা করা যে একটি টেকসই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত—জাপান তার বাস্তব প্রমাণ।
জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রমাণ করে যে, গণতন্ত্র কেবল ভোটদানের সুযোগ নয়—এটি হলো এক শৃঙ্খলিত, সংবেদনশীল ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক অনুশীলন। ভোটারদের মতামত যেন শুধু সংখ্যায় নয়, প্রতিনিধিত্বেও প্রতিফলিত হয়—জাপান তার নিখুঁত প্রয়োগ।
এটি এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যক্তি ও দলের ভূমিকা সমান গুরুত্ব পায়, ছোট দলগুলোর জন্য সুযোগ উন্মুক্ত থাকে এবং ভোটারদের বিশ্বাস অক্ষুণ্ন থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল গণতন্ত্রগুলোর জন্য জাপান নিঃসন্দেহে এক দিকনির্দেশক।
জাপানের নির্বাচনী ব্যবস্থা কেবল একটি ভোটদানের প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক দর্শনের বাস্তবায়ন। এ ব্যবস্থা যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য শিক্ষণীয়। যেখানে ব্যক্তির কণ্ঠস্বর, দলের নীতিমালা এবং দেশের ভবিষ্যৎ একই সরলরেখায় এসে মিলিত হয়—সেখানেই জন্ম নেয় এক শক্তিশালী গণতন্ত্র। জাপান সেই শক্তির প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশ তাকে অনুসরণ করতে পারে।
লেখক: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
জোসেফ গোয়েবলস ছিলেন হিটলারের নাৎসি জার্মানির তথ্য ও প্রচারবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি ছিলেন মিথ্যাকে ‘সত্য’ বানানোর এক ভয়ংকর কৌশলের রূপকার। গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন, ‘একটি বড় মিথ্যাকে বারবার বললে মানুষ একসময় সেটিকে সত্য বলে মেনে নেয়।’ তাঁর এই নীতি দিয়েই নাৎসি জার্মানি কোটি মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করেছিল...
১১ ঘণ্টা আগেগত বছর জুলাইয়ের আন্দোলনে একটি স্লোগান শুনে আমি পুলকিত বোধ করেছিলাম। স্লোগানটা ছিল—‘কোটা না মেধা মেধা, মেধা মেধা’। এই স্লোগানের আরেকটি সমার্থক প্রবাদ বাক্য আছে আমাদের সমাজে—‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো’। আপনি কার ছেলে বা মেয়ে, কার নাতি বা নাতনি অর্থাৎ পিতা-মাতা বা দাদা-দাদির পরিচয় সূত্রে আপনি...
১১ ঘণ্টা আগেসেই উনিশ শ সাতাশি সালের এক শীতের সকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রাসনাদার শহরে ক্যাম্পাসের সামনে জড়ো হয়েছিল একদল বিদেশি শিক্ষার্থী। কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল এরা। ছুটির দিনে ভ্রমণে যাচ্ছিল। দুটো বাস প্রস্তুত। কয়েকজন শিক্ষক আর অনেকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে বাস ছুটল তাগানরোগের দিকে...
১১ ঘণ্টা আগেরাজধানী ঢাকায় সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধপ্রবণতার উদ্বেগজনক বৃদ্ধি জনমনে গভীর দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে খুন, অপহরণ, ছিনতাই ও ডাকাতি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৮২.৫ শতাংশ বেশি। এ নিয়ে ১৩ জুলাই আজকের পত্রিকায় একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
১১ ঘণ্টা আগে