ফারুক মেহেদী
এই লেখা যখন লিখছি, তখন আমাদের এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সহকর্মী রোজিনা ইসলাম নথি চুরির দায়ে মামলার শিকার। সর্বত্র তাঁকে নিয়ে আলোচনা। এ ঘটনার পর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ বলে কথা উঠেছে। আমি নিজেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে দেশসেরা সাংবাদিকের একাধিক পুরস্কারও পাওয়া হয়েছে। এ পরিচয়টা আমার গর্বের এবং আনন্দের। আমি আমার সংবাদের সত্যতা, বস্তুনিষ্ঠতার জন্য দালিলিক তথ্যপ্রমাণের খোঁজে থাকি সবসময়। এ বিষয়ে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেই আজকের লেখা শুরু করব। আমি তখন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের বিজনেস এডিটর। অর্থনীতি ও বাণিজ্য সংবাদ বিভাগের প্রধান হলেও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা আমার নেশার অংশ। আমি অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যসংক্রান্ত অনিয়ম–দুর্নীতি ও রাজস্ব ফাঁকিসহ নানান বিষয়ে নিয়মিত দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন করে থাকি।
২০১৭ সালের অক্টোবরের কোনো একদিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের চেয়ারম্যানের দপ্তরে একজন কাস্টমস কর্মকর্তার সঙ্গে নানান বিষয়ে আলাপ হচ্ছিল। তিনি কাজ করেন চট্টগ্রাম কাস্টমসে। সেখানে মেগা পোর্ট ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় তিনি বন্দরে পণ্যের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে যাতে কোনো ক্ষতিকর পণ্য আসা-যাওয়া না করতে পারে তার সঙ্গে জড়িত। খুবই দক্ষ কর্মকর্তা। কথার ফাঁকে জানালেন, চট্টগ্রাম বন্দরে সম্প্রতি তাঁরা চীনগামী একটি কনটেইনার জব্দ করেছেন, যেটাতে ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। তাঁরা গবেষণা করে দেখেছেন, এতে যেসব পদার্থ রয়েছে, তা মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। তিনি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করার জন্য উৎসাহিত করলেন।
বললাম, আমার গবেষণা প্রতিবেদনটি লাগবে। তিনি প্রথমে আপত্তি করলেও, দেশের প্রয়োজনে সংবাদ প্রতিবেদন করা উচিত মনে করে, তা দিতে রাজি হলেন। অফিসে এসে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে পরের দিনই সকালের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম চলে যাই। সেখানে নেমে স্থানীয় কার্যালয়ের একজন ক্যামেরাম্যানকে সঙ্গে নিয়ে বন্দরে গিয়ে হাজির হই। বন্দর কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিলেও নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আপত্তি তুলে অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান। পরের দিন তিনি কী মনে করে আমাকে ফোন করে অনুমোদন দেওয়ার আশ্বাস দেন। তাঁর অনুমোদন নিয়ে বন্দরে ঢুকে একজন কাস্টমস কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই কনটেইনারটি যেখানে রয়েছে, সেখানে যাই। ক্যামেরাম্যান ছবি তুলতে থাকেন। নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিজের অফিস কক্ষের সিসি ক্যামেরায় সম্ভবত বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং আমাকে অবিলম্বে ছবি তোলা বন্ধ করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমি কাজ অসমাপ্ত রেখেই তাঁর অফিসে ফিরে আসি। তিনি ব্যাপক হম্বিতম্বি করেন। পারলে আমাকে মারেন এমন অবস্থা। শুধু তা–ই নয়, ক্যামেরাম্যানের কাছ থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে তাতে কী কী ছবি তোলা হয়েছে, তা মুছে ফেলার চেষ্টা করেন। তিনি ছবি খুঁজে পাননি বলে তা মুছতে পারেননি। হুমকি দিয়ে বলেন, যদি এ বিষয়ে আমি কোনো প্রতিবেদন করি, তাহলে আমাকে তিনি জেলে পাঠাবেন। আমি সেখান থেকে বের হয়ে আমার সিইও সাহেবকে জানালাম। তিনি বললেন, ‘তুমি টেনশন কোরো না। আমরা প্রতিবেদন করব।’
ঢাকায় ফিরে আমরা প্রতিবেদনটি ব্রেকিং নিউজ আকারে ব্রডকাস্ট করি। সঙ্গে সঙ্গে তোলপাড়। শীর্ষ দৈনিকসহ প্রায় সব পত্রপত্রিকা তাদের অনলাইনে এ নিউজটি প্রকাশ করে। পরে তদন্ত কমিটি হয়, কনটেইনারটি কীভাবে সংরক্ষণ এবং ধ্বংস করা হবে, তা নিয়ে ধারাবাহিক কার্যক্রম চলতে থাকে। এরপর ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থ ধরায় আরও কঠোর হওয়া এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্ক্যানার বসানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ রকম আরও অনেক প্রতিবেদন করা হয়েছে, যেগুলোর প্রতিটি নথিপত্র পাওয়াসাপেক্ষে করা এবং এসবের পেছনে হুমকি, মৃত্যুঝুঁকিসহ নানান গল্প রয়েছে, যা হয়তো এখানে স্বল্প পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না।
বলার বিষয় হলো, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ও বড় সংবাদ করতে হলে দালিলিক তথ্যপ্রমাণ থাকতে হয়। না হলে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, যেকোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে– বিষয়টি এমন নয়। বরং প্রতিবেদনটি যদি সরকার ইতিবাচকভাবে দেখে, তা দেশের জন্য ভালো ফলও বয়ে আনতে পারে। এ রকম অসংখ্য বিষয় রয়েছে, যেগুলো আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের মাধ্যমে গণমাধ্যমে উঠে আসে, যা থেকে জনগণ জানতে পারে। এমনকি অনেক ঘটনা সরকারের নীতি-কৌশল প্রণয়নেও খুব কাজে দেয়। এসব প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সরকারের ভেতরে ও বাইরে থাকা স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং করণীয় ঠিক করা যায়। যদি কোনো অনুসন্ধানী ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ না থাকে, তাহলে ভেতরে ভেতরে নীরবে দুর্নীতিবাজ, লুটপাটে জড়িত চক্র তাদের পকেট ভারী করতেই থাকবে, তারা নিজেদের আখের গোছাতে থাকবে। কেউ জানবে না জনগণের করের টাকা কীভাবে গুটিকয়েক মানুষের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে; আবার তা নানান অপরাধেও খরচ হচ্ছে।
আমার বিশ্বাস—সরকারও চায় দেশ দুর্নীতিমুক্ত হোক, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। হয়তো স্বার্থান্বেষী কোনো কোনো মহল তা চায় না। সংখ্যায় এরা নগণ্য। মোটাদাগে সরকারের উচ্চপর্যায় নিশ্চয় দেশের মঙ্গলই চায়। যদি তা সত্যিই হয়, তবে রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যা হয়েছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর অন্যায়, অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি সত্যিকার অর্থে আমাদের মূলধারার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাবিরোধী।
একজন সংবাদকর্মী ভালো নিউজের জন্য ঘুরবেন, তাঁর নিজস্ব কিছু বিশ্বস্ত সোর্স থাকবেন, যাঁরা তাঁকে দেশের প্রয়োজনে সংবাদের উৎস দিয়ে সহায়তা করবেন। কখনো কখনো সেই সোর্স কোনো তদন্ত প্রতিবেদন, অফিশিয়াল পরিস্থিতিপত্র বা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের অনুলিপি সংবাদকর্মীকে দিতে পারেন বা দেওয়ায় সহায়তা করতে পারেন। রোজিনা ইসলামের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তাতে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে এর আগে তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রোজিনা তো কয়েকজন ব্যক্তির স্বার্থ না দেখে, দেশের স্বার্থে প্রতিবেদন করেছিলেন। পরে তিনি নিশ্চয় তথ্য খুঁজতে গিয়েছেন, এমন আরও কিছু পাওয়ার আশায়। এতেই ফাঁদ পেতে তাঁকে ধরে হেনস্তা করা হয়ে থাকতে পারে। এসব দলিলপত্র রোজিনার নিজের বা পরিবারের কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করার উপযোগিতা আছে বলে মনে হয় না। রোজিনা যা করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন, এ রকম ঘটনা প্রতিটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরই কাজ। এভাবেই তাঁরা সত্য সংবাদ খুঁজে ফেরেন। শুধু তা–ই নয়, নিশ্চয় তাঁকে যাঁরা ধরেছেন, তাঁদেরও কেউ কেউ রোজিনার তথ্যের সোর্স হতে পারেন। হয়তো স্বার্থের কারণে রোজিনাকে বলির পাঁঠা বানিয়েছেন।
এই ঘটনার মাধ্যমে শুধু রোজিনাকে হেনস্তা করা হয়েছে তা নয়—এটি সুস্থ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের মতো অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য খবরের অনুসন্ধান করা এখন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো অবস্থা কে চাইবেন? আর এভাবে সাংবাদিকতা করেই বা কী লাভ? অনিয়ম–দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের চাপ বা সমালোচনা সহ্য করার বা একে ইতিবাচকভাবে গ্রহণের মানসিকতা না থাকলে, তা থেকে সংশোধনের চেষ্টা না করলে, বরং সাংবাদিকতাই বন্ধ করে দেওয়া ভালো। ধারণার ওপর জানা কথা, শোনা কথা দিয়ে প্রতিবেদন করে সত্যিকার সাংবাদিকতা হয় না। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে হলে দালিলিক নথিপত্র লাগবে। আর এসব নথিপত্র তো রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই করা হয়। তাহলে তা প্রকাশ পেলে এ থেকে সংশোধনের সুযোগ না নিয়ে বিক্ষুব্ধ হওয়াটাই সন্দেহজনক। নথিপত্র সংগ্রহের কাজকে যদি চৌর্যবৃত্তি, গুপ্তচরবৃত্তি বলে অভিযুক্ত করা হয়, মামলা-হামলায় জড়িয়ে হয়রানি কিংবা হেনস্তা করা হয়, তবে এ সাংবাদিকতাও বিপন্ন হতে সময় লাগবে না।
সরকারের উচিত এগুলোর সত্যিকার পর্যালোচনা করে উপসংহারে আসা। মুক্ত সাংবাদিকতা না থাকলে সরকার বা জনগণেরই ক্ষতি। বৃহত্তর স্বার্থে সরকারকে চিন্তা করতে হবে। কারও স্বার্থে লাগল বলে কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিককে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা কাজের কাজ হবে না। বরং এতে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আরও আশকারা পেয়ে বাড়তি উদ্যমে অনিয়ম–দুর্নীতি–লুটপাটে নেমে পড়বে। এটা হতে দিলে রাষ্ট্রের সমালোচক বলে কেউ থাকবে না, সংশোধনেরও সুযোগ সংকুচিত হবে।
বাংলাদেশের মতো দ্রুত অগ্রসরমাণ একটি দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া অনিয়ম–দুর্নীতির বিষবাষ্প দূর করতে হলে মুক্ত ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চা আরও প্রসারিত করতে হবে। একে রুদ্ধ করে নয়; বরং এর জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে এর পরিচর্যা করতে হবে। না হলে বেড়ার খেত খাওয়ার মতো অবস্থা হবে, যখন দেখার আর কেউ থাকবে না।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন আমাদের এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সহকর্মী রোজিনা ইসলাম নথি চুরির দায়ে মামলার শিকার। সর্বত্র তাঁকে নিয়ে আলোচনা। এ ঘটনার পর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ বলে কথা উঠেছে। আমি নিজেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে দেশসেরা সাংবাদিকের একাধিক পুরস্কারও পাওয়া হয়েছে। এ পরিচয়টা আমার গর্বের এবং আনন্দের। আমি আমার সংবাদের সত্যতা, বস্তুনিষ্ঠতার জন্য দালিলিক তথ্যপ্রমাণের খোঁজে থাকি সবসময়। এ বিষয়ে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেই আজকের লেখা শুরু করব। আমি তখন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের বিজনেস এডিটর। অর্থনীতি ও বাণিজ্য সংবাদ বিভাগের প্রধান হলেও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা আমার নেশার অংশ। আমি অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যসংক্রান্ত অনিয়ম–দুর্নীতি ও রাজস্ব ফাঁকিসহ নানান বিষয়ে নিয়মিত দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন করে থাকি।
২০১৭ সালের অক্টোবরের কোনো একদিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের চেয়ারম্যানের দপ্তরে একজন কাস্টমস কর্মকর্তার সঙ্গে নানান বিষয়ে আলাপ হচ্ছিল। তিনি কাজ করেন চট্টগ্রাম কাস্টমসে। সেখানে মেগা পোর্ট ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় তিনি বন্দরে পণ্যের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে যাতে কোনো ক্ষতিকর পণ্য আসা-যাওয়া না করতে পারে তার সঙ্গে জড়িত। খুবই দক্ষ কর্মকর্তা। কথার ফাঁকে জানালেন, চট্টগ্রাম বন্দরে সম্প্রতি তাঁরা চীনগামী একটি কনটেইনার জব্দ করেছেন, যেটাতে ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। তাঁরা গবেষণা করে দেখেছেন, এতে যেসব পদার্থ রয়েছে, তা মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। তিনি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করার জন্য উৎসাহিত করলেন।
বললাম, আমার গবেষণা প্রতিবেদনটি লাগবে। তিনি প্রথমে আপত্তি করলেও, দেশের প্রয়োজনে সংবাদ প্রতিবেদন করা উচিত মনে করে, তা দিতে রাজি হলেন। অফিসে এসে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে পরের দিনই সকালের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম চলে যাই। সেখানে নেমে স্থানীয় কার্যালয়ের একজন ক্যামেরাম্যানকে সঙ্গে নিয়ে বন্দরে গিয়ে হাজির হই। বন্দর কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিলেও নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আপত্তি তুলে অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান। পরের দিন তিনি কী মনে করে আমাকে ফোন করে অনুমোদন দেওয়ার আশ্বাস দেন। তাঁর অনুমোদন নিয়ে বন্দরে ঢুকে একজন কাস্টমস কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই কনটেইনারটি যেখানে রয়েছে, সেখানে যাই। ক্যামেরাম্যান ছবি তুলতে থাকেন। নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিজের অফিস কক্ষের সিসি ক্যামেরায় সম্ভবত বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং আমাকে অবিলম্বে ছবি তোলা বন্ধ করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমি কাজ অসমাপ্ত রেখেই তাঁর অফিসে ফিরে আসি। তিনি ব্যাপক হম্বিতম্বি করেন। পারলে আমাকে মারেন এমন অবস্থা। শুধু তা–ই নয়, ক্যামেরাম্যানের কাছ থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে তাতে কী কী ছবি তোলা হয়েছে, তা মুছে ফেলার চেষ্টা করেন। তিনি ছবি খুঁজে পাননি বলে তা মুছতে পারেননি। হুমকি দিয়ে বলেন, যদি এ বিষয়ে আমি কোনো প্রতিবেদন করি, তাহলে আমাকে তিনি জেলে পাঠাবেন। আমি সেখান থেকে বের হয়ে আমার সিইও সাহেবকে জানালাম। তিনি বললেন, ‘তুমি টেনশন কোরো না। আমরা প্রতিবেদন করব।’
ঢাকায় ফিরে আমরা প্রতিবেদনটি ব্রেকিং নিউজ আকারে ব্রডকাস্ট করি। সঙ্গে সঙ্গে তোলপাড়। শীর্ষ দৈনিকসহ প্রায় সব পত্রপত্রিকা তাদের অনলাইনে এ নিউজটি প্রকাশ করে। পরে তদন্ত কমিটি হয়, কনটেইনারটি কীভাবে সংরক্ষণ এবং ধ্বংস করা হবে, তা নিয়ে ধারাবাহিক কার্যক্রম চলতে থাকে। এরপর ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থ ধরায় আরও কঠোর হওয়া এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্ক্যানার বসানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ রকম আরও অনেক প্রতিবেদন করা হয়েছে, যেগুলোর প্রতিটি নথিপত্র পাওয়াসাপেক্ষে করা এবং এসবের পেছনে হুমকি, মৃত্যুঝুঁকিসহ নানান গল্প রয়েছে, যা হয়তো এখানে স্বল্প পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না।
বলার বিষয় হলো, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ও বড় সংবাদ করতে হলে দালিলিক তথ্যপ্রমাণ থাকতে হয়। না হলে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, যেকোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে– বিষয়টি এমন নয়। বরং প্রতিবেদনটি যদি সরকার ইতিবাচকভাবে দেখে, তা দেশের জন্য ভালো ফলও বয়ে আনতে পারে। এ রকম অসংখ্য বিষয় রয়েছে, যেগুলো আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের মাধ্যমে গণমাধ্যমে উঠে আসে, যা থেকে জনগণ জানতে পারে। এমনকি অনেক ঘটনা সরকারের নীতি-কৌশল প্রণয়নেও খুব কাজে দেয়। এসব প্রতিবেদন আমলে নিয়ে সরকারের ভেতরে ও বাইরে থাকা স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং করণীয় ঠিক করা যায়। যদি কোনো অনুসন্ধানী ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ না থাকে, তাহলে ভেতরে ভেতরে নীরবে দুর্নীতিবাজ, লুটপাটে জড়িত চক্র তাদের পকেট ভারী করতেই থাকবে, তারা নিজেদের আখের গোছাতে থাকবে। কেউ জানবে না জনগণের করের টাকা কীভাবে গুটিকয়েক মানুষের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে; আবার তা নানান অপরাধেও খরচ হচ্ছে।
আমার বিশ্বাস—সরকারও চায় দেশ দুর্নীতিমুক্ত হোক, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। হয়তো স্বার্থান্বেষী কোনো কোনো মহল তা চায় না। সংখ্যায় এরা নগণ্য। মোটাদাগে সরকারের উচ্চপর্যায় নিশ্চয় দেশের মঙ্গলই চায়। যদি তা সত্যিই হয়, তবে রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যা হয়েছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর অন্যায়, অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি সত্যিকার অর্থে আমাদের মূলধারার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাবিরোধী।
একজন সংবাদকর্মী ভালো নিউজের জন্য ঘুরবেন, তাঁর নিজস্ব কিছু বিশ্বস্ত সোর্স থাকবেন, যাঁরা তাঁকে দেশের প্রয়োজনে সংবাদের উৎস দিয়ে সহায়তা করবেন। কখনো কখনো সেই সোর্স কোনো তদন্ত প্রতিবেদন, অফিশিয়াল পরিস্থিতিপত্র বা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের অনুলিপি সংবাদকর্মীকে দিতে পারেন বা দেওয়ায় সহায়তা করতে পারেন। রোজিনা ইসলামের ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তাতে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে এর আগে তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রোজিনা তো কয়েকজন ব্যক্তির স্বার্থ না দেখে, দেশের স্বার্থে প্রতিবেদন করেছিলেন। পরে তিনি নিশ্চয় তথ্য খুঁজতে গিয়েছেন, এমন আরও কিছু পাওয়ার আশায়। এতেই ফাঁদ পেতে তাঁকে ধরে হেনস্তা করা হয়ে থাকতে পারে। এসব দলিলপত্র রোজিনার নিজের বা পরিবারের কোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করার উপযোগিতা আছে বলে মনে হয় না। রোজিনা যা করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন, এ রকম ঘটনা প্রতিটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরই কাজ। এভাবেই তাঁরা সত্য সংবাদ খুঁজে ফেরেন। শুধু তা–ই নয়, নিশ্চয় তাঁকে যাঁরা ধরেছেন, তাঁদেরও কেউ কেউ রোজিনার তথ্যের সোর্স হতে পারেন। হয়তো স্বার্থের কারণে রোজিনাকে বলির পাঁঠা বানিয়েছেন।
এই ঘটনার মাধ্যমে শুধু রোজিনাকে হেনস্তা করা হয়েছে তা নয়—এটি সুস্থ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের মতো অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য খবরের অনুসন্ধান করা এখন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো অবস্থা কে চাইবেন? আর এভাবে সাংবাদিকতা করেই বা কী লাভ? অনিয়ম–দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের চাপ বা সমালোচনা সহ্য করার বা একে ইতিবাচকভাবে গ্রহণের মানসিকতা না থাকলে, তা থেকে সংশোধনের চেষ্টা না করলে, বরং সাংবাদিকতাই বন্ধ করে দেওয়া ভালো। ধারণার ওপর জানা কথা, শোনা কথা দিয়ে প্রতিবেদন করে সত্যিকার সাংবাদিকতা হয় না। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে হলে দালিলিক নথিপত্র লাগবে। আর এসব নথিপত্র তো রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই করা হয়। তাহলে তা প্রকাশ পেলে এ থেকে সংশোধনের সুযোগ না নিয়ে বিক্ষুব্ধ হওয়াটাই সন্দেহজনক। নথিপত্র সংগ্রহের কাজকে যদি চৌর্যবৃত্তি, গুপ্তচরবৃত্তি বলে অভিযুক্ত করা হয়, মামলা-হামলায় জড়িয়ে হয়রানি কিংবা হেনস্তা করা হয়, তবে এ সাংবাদিকতাও বিপন্ন হতে সময় লাগবে না।
সরকারের উচিত এগুলোর সত্যিকার পর্যালোচনা করে উপসংহারে আসা। মুক্ত সাংবাদিকতা না থাকলে সরকার বা জনগণেরই ক্ষতি। বৃহত্তর স্বার্থে সরকারকে চিন্তা করতে হবে। কারও স্বার্থে লাগল বলে কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিককে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা কাজের কাজ হবে না। বরং এতে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আরও আশকারা পেয়ে বাড়তি উদ্যমে অনিয়ম–দুর্নীতি–লুটপাটে নেমে পড়বে। এটা হতে দিলে রাষ্ট্রের সমালোচক বলে কেউ থাকবে না, সংশোধনেরও সুযোগ সংকুচিত হবে।
বাংলাদেশের মতো দ্রুত অগ্রসরমাণ একটি দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া অনিয়ম–দুর্নীতির বিষবাষ্প দূর করতে হলে মুক্ত ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চা আরও প্রসারিত করতে হবে। একে রুদ্ধ করে নয়; বরং এর জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে এর পরিচর্যা করতে হবে। না হলে বেড়ার খেত খাওয়ার মতো অবস্থা হবে, যখন দেখার আর কেউ থাকবে না।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) যে তদন্ত করেছে, ২৭ জানুয়ারি সে তদন্তের ৫৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এইচআরডব্লিউর একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে...
১৫ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি একটি অনন্য মাস। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য যে পথ রচনা করে দিয়েছে, সেই পথই দেশকে পৌঁছে দিয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। প্রকৃতপক্ষে এ দেশের আপামর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে সেই পথকে করেছে মসৃণ...
১৫ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি একধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নানা বাধা দেখা যাচ্ছে। এসব ঘটনা শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবন্ধকতা নয়; বরং বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন।
১৫ ঘণ্টা আগেআজ থেকে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা শুরু হচ্ছে। মাসব্যাপী এই আয়োজন প্রাণের মেলায় পরিণত হোক, সেই কামনা করি। তবে আজ বইমেলা নিয়ে নয়, বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে যে নাটক অভিনীত হলো, তা নিয়েই কিছু কথা বলা সংগত হবে।
১৫ ঘণ্টা আগে