শরিফুল হাসান

চার বছর তিন মাস আগে ২০১৯ সালের ৯ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪১তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য শূন্য পদের অধিযাচন পাঠায় সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ২ হাজার ১৬৬টি পদের বিপরীতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে পিএসসি। কিন্তু চার বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো বিসিএসের ফল প্রকাশে এমন দীর্ঘসূত্রতা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে রেকর্ড হিসেবে গণ্য হতে পারে।
চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর উত্তীর্ণদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, তথ্য যাচাই-বাছাই, গেজেট প্রকাশ, যোগদান—এসব ধরলে এই বিসিএসে নিয়োগ পেতে শেষ পর্যন্ত কত সময় লাগবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষায় থাকা ১৩ হাজার প্রার্থী।
কেবল ৪১ বিসিএস নয়, ৪৩, ৪৪ ও ৪৫—এই চার বিসিএস নিয়ে এখন বিসিএস-জটে আক্রান্ত পিএসসি। এর মধ্যে ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল বাকি।
৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা এ বছরের অক্টোবরে শুরু হওয়ার কথা। অন্যদিকে ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার পদের নিয়োগও ঝুলে আছে।
২০২১ সালে চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ ৪২তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা ছিল না। শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়েই নিয়োগ হয়েছে। এই বিসিএস বাদ দিলে পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলে শুরু হওয়া একটি বিসিএসও পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ হয়নি।
অথচ পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যোগ দেওয়ার পরপরই বলেছিলেন, এক বছরের মধ্যেই একটা বিসিএসে নিয়োগ শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য তিনি রোডম্যাপ করার কথাও বলেছিলেন। অথচ এক বছরে নিয়োগ শেষ করা তো পরের কথা, লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতেই এক বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা লাখো চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা সেই অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। প্রশ্ন উঠেছে পিএসসির সক্ষমতা নিয়েও।
সামাজিক নিরাপত্তা, ভালো বেতনকাঠামো এবং গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে লাখো তরুণের। ফলে দেখা যাচ্ছে, একেকটি বিসিএসে এখন ৪ থেকে ৫ লাখ তরুণ অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা নেওয়া, এর ফল প্রকাশ করে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া, এরপর চূড়ান্ত ফল, পুলিশ যাচাই, যোগদান—এসব মিলিয়ে তিন থেকে চার বছরেরও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে একটা বিসিএসের পেছনেই চার বছর চলে যাচ্ছে তারুণ্যের।
চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, চার বছরে পৃথিবীর বহু দেশে এক সরকার ক্ষমতা শেষ করে আরেক মেয়াদ আসে। চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যেকোনো বিষয়ে স্নাতক শেষ করা যায়। কিন্তু চার বছরেও একটা বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারছে না পিএসসি।
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন সাবেক শিক্ষাসচিব সোহরাব হোসাইন। তিনি যোগ দেওয়ার পর ২০২১ সালের ১৯ মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেয় পিএসসি। কম্পিউটার পদ্ধতিতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না থাকলেও পাঁচ মাস লেগে যায়। ২০২১ সালের ১ আগস্ট এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়।
এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয় ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে। শেষ হয় পরের বছরের ১২ জানুয়ারি। ১৮ হাজার ৮৭০ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষা দেন। প্রায় দুই বছর পর ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। কোনো বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশে এটি একটি রেকর্ড।
২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২২৯ জন প্রার্থী। গত বছরের জুলাই মাসে লিখিত পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও লিখিত পরীক্ষার ফল হয়নি।
৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে জানুয়ারিতে। ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ফল প্রকাশ হয়নি। অন্যদিকে অক্টোবর থেকে ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা। দেখা যাচ্ছে, বারবার পিএসসি লিখিত পরীক্ষার পর হোঁচট খাচ্ছে।
পিএসসির দাবি, ৪১তম বিসিএসে ৩১৮ জন পরীক্ষক ভুল করেছিলেন। তাতে ১৫ হাজার খাতায় গরমিল দেখা দেয়। এ কারণে খাতা আবার তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায় এবং ফল প্রকাশ পিছিয়ে যায়। প্রশ্ন হলো, পরীক্ষকের অবহেলার দায় কেন পরীক্ষার্থীরা নেবেন? আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে সমস্যার সমাধান হবে?
সমাধান যে হয়নি, তার প্রমাণ মেলে পরের বিসিএসগুলোতেও। কারণ পরের বিসিএসগুলোতেও একই সমস্যা হচ্ছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কারণ বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতা দুজন কাটেন। যে পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন করা হয়, তাতে প্রথম পরীক্ষক ও দ্বিতীয় পরীক্ষকের দেখা খাতায় ২০ নম্বর বা অধিক নম্বরের পার্থক্য থেকে যায়। আর তখন খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠাতে হয়।
সমস্যার সমাধানে পিএসসি পরীক্ষক ও নিরীক্ষকদের কমিশনে ডেকে কয়েক দিনে টানা লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে পারে। আবার এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কোনো একটা সুনির্দিষ্ট উপায় ছাড়া লিখিত পরীক্ষার এই জট কাটানো সম্ভব নয়।
অন্যদিকে ৪০তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশের এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো নন-ক্যাডারে নিয়োগ দিতে পারেনি পিএসসি। সাধারণত, পরবর্তী বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আগের বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দিত পিএসসি। কিন্তু এবার এখনো নন-ক্যাডারের কোনো তালিকাই দিতে পারেনি পিএসসি।
নন-ক্যাডারে নিয়োগ বাড়াতে হবে: সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বাড়ার পাশাপাশি নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকে বলে চাকরিপ্রার্থীদের বিসিএস নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। একেকটা বিসিএস পরীক্ষায় এখন ৪ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন,সাধারণভাবে গড়ে ২ হাজার ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে বিসিএসে উত্তীর্ণ হলেও বিপুলসংখ্যক প্রার্থী চাকরি থেকে বঞ্চিত হতেন।
উত্তীর্ণ এই প্রার্থীদের প্রথম শ্রেণির অন্যান্য পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্যই ২০১০ সালে নন-ক্যাডার নিয়োগে বিশেষ বিধিমালা করার উদ্যোগ নেন সেই সময়ের চেয়ারম্যান প্রয়াত সা’দত হুসাইন। ২০১৪ সালে প্রথম শ্রেণির পাশাপাশি দ্বিতীয় শ্রেণির পদেও নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।
নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী, একটি বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর ননক্যাডারের আবেদন নেওয়া হতো এবং পরের বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগপর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যত চাহিদা আসত, সেখান থেকে নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান এই বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেন। ফলে ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগ আটকে যায়। এ নিয়ে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা আন্দোলনে নামেন।
২০২৩ সালের জুন মাসে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী নতুন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার পদের পাশাপাশি নন-ক্যাডার পদের সংখ্যাও উল্লেখ থাকবে। এরপর দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ৪০তম বিসিএসের ননক্যাডারে নিয়োগের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
নন-ক্যাডারে নিয়োগসহ ছয় দফা দাবিতে গত বছরের অক্টোবরে পিএসসির সামনে মানববন্ধন ও মিছিল করেছিলেন প্রার্থীরা। এখনো নন-ক্যাডার নিয়োগ না হওয়ায় তারাও হতাশ। ৪০তম নন-ক্যাডারের নিয়োগ না দিয়ে ৪১তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করলে জটিলতা হবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কায় আছেন প্রার্থীরা।
অবশ্য পিএসসি বলছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রথম শ্রেণির (গ্রেড-৯) সহকারী প্রকৌশলীর ১৫৬ পদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জটিলতা শুরু হয়েছে। চাহিদা দিলেও এলজিইডি এখন ওই প্রকৌশলীদের নিয়োগ না দিতে বলেছে।
এই জটিলতায় নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। একটি বিষয় না বললেই নয়। বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ায় দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। পিএসসির অসংখ্য পরীক্ষা নেওয়ার জটিলতাও কমেছে। এখন বিসিএস-জট তৈরি হওয়ায় এর প্রভাব যেন নন-ক্যাডারে না পড়ে, সে জন্য পিএসসির সতর্ক থাকা উচিত। আসলে নন-ক্যাডারে যত বেশিসংখ্যক পদ বিসিএস থেকে নিয়োগ দেওয়া যাবে, ততই দেশের মঙ্গল।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার জরুরি: ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হওয়া বিসিএসগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি বিসিএসেই পরীক্ষা হয়েছে এক বছর, নিয়োগ হয়েছে আরেক বছর। যতই দিন গেছে, দীর্ঘসূত্রতা বেড়েই চলেছে। ২০০৩ সালের ২৪তম বিসিএস থেকে শুরু করে গত ২০ বছরের ২২ বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি, লিখিত ও চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলের সময়সূচি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩৫তম বিসিএসে সবচেয়ে কম সময় নিয়েছিল পিএসসি। মাত্র দেড় বছরে এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফল হয়েছিল। কিন্তু এখন বেশির ভাগ বিসিএস শেষ করতে গড়ে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। গেজেট প্রকাশ ও যোগদানের তারিখ ধরলে দেখা যাচ্ছে, চার বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে দীর্ঘসূত্রতা বেড়েই চলছে। এই দীর্ঘসূত্রতা কমানো জরুরি।
বাংলাদেশে এত সময় লাগার একটা বড় কারণ লিখিত পরীক্ষার খাতা দেরিতে মূল্যায়ন। ১০-১৫ হাজার ছেলেমেয়ের লিখিত পরীক্ষার ফল দিতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। অথচ কয়েক লাখ ছেলেমেয়ের পরীক্ষা নিয়ে তিন মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল এক বছরেও দিতে পারছে না পিএসসি। দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হলে এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে।
আবার বাংলাদেশে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। এর মধ্যে জেনারেল, টেকনিক্যাল আর উভয় ক্যাডার আছে। এক শিক্ষা ক্যাডারেই
অসংখ্য বিষয়। ফলে নিয়োগে সময় বেশি লাগে। এতগুলো ক্যাডার একসঙ্গে রাখার প্রয়োজন আছে কি না, ভাবতে হবে। পাশাপাশি বিসিএসে বা নিয়োগ পরীক্ষার সংস্কারের কথাও ভাবতে হবে। আবার একেকটা বিসএসে কেন এত দেরি হয়, সে জন্য পিএসসিকে জবাবদিহির আওতায় আনাটাও জরুরি।
উন্নত বিশ্বে বিসিএস বা সরকারি চাকরি নিয়ে আলাদা করে উন্মাদনা নেই। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের সিভিল সার্ভিস সবচেয়ে পুরোনো। ভারতের কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা নেয় ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন। প্রতিবছরের জুনে তারা প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেয় এবং আগস্টে ফল প্রকাশ করে। এরপর অক্টোবরে লিখিত পরীক্ষা এবং জানুয়ারিতে ফল প্রকাশিত হয়। উত্তীর্ণদের মার্চে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে মে মাসে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। যাঁরা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন, সেপ্টেম্বর থেকেই তাঁদের চাকরির মূল প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অথচ বাংলাদেশে একেকটা বিসিএসের প্রক্রিয়া শেষ করতেই তারুণ্যের চার বছর বা আরও বেশি সময় শেষ হয়ে যায়। পিএসসিকে তারুণ্যের আস্থায় আনতে হলে নিয়োগে স্বচ্ছতার পাশাপাশি এই দীর্ঘসূত্রতা কমাতেই হবে।
শরিফুল হাসান, কলামিস্ট

চার বছর তিন মাস আগে ২০১৯ সালের ৯ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪১তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য শূন্য পদের অধিযাচন পাঠায় সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ২ হাজার ১৬৬টি পদের বিপরীতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে পিএসসি। কিন্তু চার বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো বিসিএসের ফল প্রকাশে এমন দীর্ঘসূত্রতা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে রেকর্ড হিসেবে গণ্য হতে পারে।
চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর উত্তীর্ণদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, তথ্য যাচাই-বাছাই, গেজেট প্রকাশ, যোগদান—এসব ধরলে এই বিসিএসে নিয়োগ পেতে শেষ পর্যন্ত কত সময় লাগবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষায় থাকা ১৩ হাজার প্রার্থী।
কেবল ৪১ বিসিএস নয়, ৪৩, ৪৪ ও ৪৫—এই চার বিসিএস নিয়ে এখন বিসিএস-জটে আক্রান্ত পিএসসি। এর মধ্যে ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল বাকি।
৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা এ বছরের অক্টোবরে শুরু হওয়ার কথা। অন্যদিকে ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার পদের নিয়োগও ঝুলে আছে।
২০২১ সালে চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ ৪২তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা ছিল না। শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়েই নিয়োগ হয়েছে। এই বিসিএস বাদ দিলে পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলে শুরু হওয়া একটি বিসিএসও পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ হয়নি।
অথচ পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যোগ দেওয়ার পরপরই বলেছিলেন, এক বছরের মধ্যেই একটা বিসিএসে নিয়োগ শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য তিনি রোডম্যাপ করার কথাও বলেছিলেন। অথচ এক বছরে নিয়োগ শেষ করা তো পরের কথা, লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতেই এক বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা লাখো চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা সেই অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। প্রশ্ন উঠেছে পিএসসির সক্ষমতা নিয়েও।
সামাজিক নিরাপত্তা, ভালো বেতনকাঠামো এবং গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে লাখো তরুণের। ফলে দেখা যাচ্ছে, একেকটি বিসিএসে এখন ৪ থেকে ৫ লাখ তরুণ অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা নেওয়া, এর ফল প্রকাশ করে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া, এরপর চূড়ান্ত ফল, পুলিশ যাচাই, যোগদান—এসব মিলিয়ে তিন থেকে চার বছরেরও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে একটা বিসিএসের পেছনেই চার বছর চলে যাচ্ছে তারুণ্যের।
চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, চার বছরে পৃথিবীর বহু দেশে এক সরকার ক্ষমতা শেষ করে আরেক মেয়াদ আসে। চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যেকোনো বিষয়ে স্নাতক শেষ করা যায়। কিন্তু চার বছরেও একটা বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারছে না পিএসসি।
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন সাবেক শিক্ষাসচিব সোহরাব হোসাইন। তিনি যোগ দেওয়ার পর ২০২১ সালের ১৯ মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেয় পিএসসি। কম্পিউটার পদ্ধতিতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না থাকলেও পাঁচ মাস লেগে যায়। ২০২১ সালের ১ আগস্ট এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়।
এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয় ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে। শেষ হয় পরের বছরের ১২ জানুয়ারি। ১৮ হাজার ৮৭০ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষা দেন। প্রায় দুই বছর পর ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। কোনো বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশে এটি একটি রেকর্ড।
২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২২৯ জন প্রার্থী। গত বছরের জুলাই মাসে লিখিত পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও লিখিত পরীক্ষার ফল হয়নি।
৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে জানুয়ারিতে। ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ফল প্রকাশ হয়নি। অন্যদিকে অক্টোবর থেকে ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা। দেখা যাচ্ছে, বারবার পিএসসি লিখিত পরীক্ষার পর হোঁচট খাচ্ছে।
পিএসসির দাবি, ৪১তম বিসিএসে ৩১৮ জন পরীক্ষক ভুল করেছিলেন। তাতে ১৫ হাজার খাতায় গরমিল দেখা দেয়। এ কারণে খাতা আবার তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায় এবং ফল প্রকাশ পিছিয়ে যায়। প্রশ্ন হলো, পরীক্ষকের অবহেলার দায় কেন পরীক্ষার্থীরা নেবেন? আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে সমস্যার সমাধান হবে?
সমাধান যে হয়নি, তার প্রমাণ মেলে পরের বিসিএসগুলোতেও। কারণ পরের বিসিএসগুলোতেও একই সমস্যা হচ্ছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কারণ বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতা দুজন কাটেন। যে পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন করা হয়, তাতে প্রথম পরীক্ষক ও দ্বিতীয় পরীক্ষকের দেখা খাতায় ২০ নম্বর বা অধিক নম্বরের পার্থক্য থেকে যায়। আর তখন খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠাতে হয়।
সমস্যার সমাধানে পিএসসি পরীক্ষক ও নিরীক্ষকদের কমিশনে ডেকে কয়েক দিনে টানা লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে পারে। আবার এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কোনো একটা সুনির্দিষ্ট উপায় ছাড়া লিখিত পরীক্ষার এই জট কাটানো সম্ভব নয়।
অন্যদিকে ৪০তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশের এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো নন-ক্যাডারে নিয়োগ দিতে পারেনি পিএসসি। সাধারণত, পরবর্তী বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আগের বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দিত পিএসসি। কিন্তু এবার এখনো নন-ক্যাডারের কোনো তালিকাই দিতে পারেনি পিএসসি।
নন-ক্যাডারে নিয়োগ বাড়াতে হবে: সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বাড়ার পাশাপাশি নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকে বলে চাকরিপ্রার্থীদের বিসিএস নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। একেকটা বিসিএস পরীক্ষায় এখন ৪ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন,সাধারণভাবে গড়ে ২ হাজার ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে বিসিএসে উত্তীর্ণ হলেও বিপুলসংখ্যক প্রার্থী চাকরি থেকে বঞ্চিত হতেন।
উত্তীর্ণ এই প্রার্থীদের প্রথম শ্রেণির অন্যান্য পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্যই ২০১০ সালে নন-ক্যাডার নিয়োগে বিশেষ বিধিমালা করার উদ্যোগ নেন সেই সময়ের চেয়ারম্যান প্রয়াত সা’দত হুসাইন। ২০১৪ সালে প্রথম শ্রেণির পাশাপাশি দ্বিতীয় শ্রেণির পদেও নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।
নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী, একটি বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর ননক্যাডারের আবেদন নেওয়া হতো এবং পরের বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগপর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যত চাহিদা আসত, সেখান থেকে নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান এই বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেন। ফলে ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগ আটকে যায়। এ নিয়ে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা আন্দোলনে নামেন।
২০২৩ সালের জুন মাসে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী নতুন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার পদের পাশাপাশি নন-ক্যাডার পদের সংখ্যাও উল্লেখ থাকবে। এরপর দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ৪০তম বিসিএসের ননক্যাডারে নিয়োগের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
নন-ক্যাডারে নিয়োগসহ ছয় দফা দাবিতে গত বছরের অক্টোবরে পিএসসির সামনে মানববন্ধন ও মিছিল করেছিলেন প্রার্থীরা। এখনো নন-ক্যাডার নিয়োগ না হওয়ায় তারাও হতাশ। ৪০তম নন-ক্যাডারের নিয়োগ না দিয়ে ৪১তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করলে জটিলতা হবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কায় আছেন প্রার্থীরা।
অবশ্য পিএসসি বলছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রথম শ্রেণির (গ্রেড-৯) সহকারী প্রকৌশলীর ১৫৬ পদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জটিলতা শুরু হয়েছে। চাহিদা দিলেও এলজিইডি এখন ওই প্রকৌশলীদের নিয়োগ না দিতে বলেছে।
এই জটিলতায় নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। একটি বিষয় না বললেই নয়। বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ায় দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। পিএসসির অসংখ্য পরীক্ষা নেওয়ার জটিলতাও কমেছে। এখন বিসিএস-জট তৈরি হওয়ায় এর প্রভাব যেন নন-ক্যাডারে না পড়ে, সে জন্য পিএসসির সতর্ক থাকা উচিত। আসলে নন-ক্যাডারে যত বেশিসংখ্যক পদ বিসিএস থেকে নিয়োগ দেওয়া যাবে, ততই দেশের মঙ্গল।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার জরুরি: ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হওয়া বিসিএসগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি বিসিএসেই পরীক্ষা হয়েছে এক বছর, নিয়োগ হয়েছে আরেক বছর। যতই দিন গেছে, দীর্ঘসূত্রতা বেড়েই চলেছে। ২০০৩ সালের ২৪তম বিসিএস থেকে শুরু করে গত ২০ বছরের ২২ বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি, লিখিত ও চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলের সময়সূচি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩৫তম বিসিএসে সবচেয়ে কম সময় নিয়েছিল পিএসসি। মাত্র দেড় বছরে এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফল হয়েছিল। কিন্তু এখন বেশির ভাগ বিসিএস শেষ করতে গড়ে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। গেজেট প্রকাশ ও যোগদানের তারিখ ধরলে দেখা যাচ্ছে, চার বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে দীর্ঘসূত্রতা বেড়েই চলছে। এই দীর্ঘসূত্রতা কমানো জরুরি।
বাংলাদেশে এত সময় লাগার একটা বড় কারণ লিখিত পরীক্ষার খাতা দেরিতে মূল্যায়ন। ১০-১৫ হাজার ছেলেমেয়ের লিখিত পরীক্ষার ফল দিতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। অথচ কয়েক লাখ ছেলেমেয়ের পরীক্ষা নিয়ে তিন মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল এক বছরেও দিতে পারছে না পিএসসি। দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হলে এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে।
আবার বাংলাদেশে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। এর মধ্যে জেনারেল, টেকনিক্যাল আর উভয় ক্যাডার আছে। এক শিক্ষা ক্যাডারেই
অসংখ্য বিষয়। ফলে নিয়োগে সময় বেশি লাগে। এতগুলো ক্যাডার একসঙ্গে রাখার প্রয়োজন আছে কি না, ভাবতে হবে। পাশাপাশি বিসিএসে বা নিয়োগ পরীক্ষার সংস্কারের কথাও ভাবতে হবে। আবার একেকটা বিসএসে কেন এত দেরি হয়, সে জন্য পিএসসিকে জবাবদিহির আওতায় আনাটাও জরুরি।
উন্নত বিশ্বে বিসিএস বা সরকারি চাকরি নিয়ে আলাদা করে উন্মাদনা নেই। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের সিভিল সার্ভিস সবচেয়ে পুরোনো। ভারতের কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা নেয় ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন। প্রতিবছরের জুনে তারা প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেয় এবং আগস্টে ফল প্রকাশ করে। এরপর অক্টোবরে লিখিত পরীক্ষা এবং জানুয়ারিতে ফল প্রকাশিত হয়। উত্তীর্ণদের মার্চে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে মে মাসে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। যাঁরা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন, সেপ্টেম্বর থেকেই তাঁদের চাকরির মূল প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অথচ বাংলাদেশে একেকটা বিসিএসের প্রক্রিয়া শেষ করতেই তারুণ্যের চার বছর বা আরও বেশি সময় শেষ হয়ে যায়। পিএসসিকে তারুণ্যের আস্থায় আনতে হলে নিয়োগে স্বচ্ছতার পাশাপাশি এই দীর্ঘসূত্রতা কমাতেই হবে।
শরিফুল হাসান, কলামিস্ট
শরিফুল হাসান

চার বছর তিন মাস আগে ২০১৯ সালের ৯ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪১তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য শূন্য পদের অধিযাচন পাঠায় সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ২ হাজার ১৬৬টি পদের বিপরীতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে পিএসসি। কিন্তু চার বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো বিসিএসের ফল প্রকাশে এমন দীর্ঘসূত্রতা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে রেকর্ড হিসেবে গণ্য হতে পারে।
চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর উত্তীর্ণদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, তথ্য যাচাই-বাছাই, গেজেট প্রকাশ, যোগদান—এসব ধরলে এই বিসিএসে নিয়োগ পেতে শেষ পর্যন্ত কত সময় লাগবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষায় থাকা ১৩ হাজার প্রার্থী।
কেবল ৪১ বিসিএস নয়, ৪৩, ৪৪ ও ৪৫—এই চার বিসিএস নিয়ে এখন বিসিএস-জটে আক্রান্ত পিএসসি। এর মধ্যে ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল বাকি।
৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা এ বছরের অক্টোবরে শুরু হওয়ার কথা। অন্যদিকে ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার পদের নিয়োগও ঝুলে আছে।
২০২১ সালে চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ ৪২তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা ছিল না। শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়েই নিয়োগ হয়েছে। এই বিসিএস বাদ দিলে পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলে শুরু হওয়া একটি বিসিএসও পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ হয়নি।
অথচ পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যোগ দেওয়ার পরপরই বলেছিলেন, এক বছরের মধ্যেই একটা বিসিএসে নিয়োগ শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য তিনি রোডম্যাপ করার কথাও বলেছিলেন। অথচ এক বছরে নিয়োগ শেষ করা তো পরের কথা, লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতেই এক বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা লাখো চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা সেই অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। প্রশ্ন উঠেছে পিএসসির সক্ষমতা নিয়েও।
সামাজিক নিরাপত্তা, ভালো বেতনকাঠামো এবং গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে লাখো তরুণের। ফলে দেখা যাচ্ছে, একেকটি বিসিএসে এখন ৪ থেকে ৫ লাখ তরুণ অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা নেওয়া, এর ফল প্রকাশ করে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া, এরপর চূড়ান্ত ফল, পুলিশ যাচাই, যোগদান—এসব মিলিয়ে তিন থেকে চার বছরেরও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে একটা বিসিএসের পেছনেই চার বছর চলে যাচ্ছে তারুণ্যের।
চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, চার বছরে পৃথিবীর বহু দেশে এক সরকার ক্ষমতা শেষ করে আরেক মেয়াদ আসে। চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যেকোনো বিষয়ে স্নাতক শেষ করা যায়। কিন্তু চার বছরেও একটা বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারছে না পিএসসি।
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন সাবেক শিক্ষাসচিব সোহরাব হোসাইন। তিনি যোগ দেওয়ার পর ২০২১ সালের ১৯ মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেয় পিএসসি। কম্পিউটার পদ্ধতিতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না থাকলেও পাঁচ মাস লেগে যায়। ২০২১ সালের ১ আগস্ট এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়।
এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয় ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে। শেষ হয় পরের বছরের ১২ জানুয়ারি। ১৮ হাজার ৮৭০ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষা দেন। প্রায় দুই বছর পর ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। কোনো বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশে এটি একটি রেকর্ড।
২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২২৯ জন প্রার্থী। গত বছরের জুলাই মাসে লিখিত পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও লিখিত পরীক্ষার ফল হয়নি।
৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে জানুয়ারিতে। ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ফল প্রকাশ হয়নি। অন্যদিকে অক্টোবর থেকে ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা। দেখা যাচ্ছে, বারবার পিএসসি লিখিত পরীক্ষার পর হোঁচট খাচ্ছে।
পিএসসির দাবি, ৪১তম বিসিএসে ৩১৮ জন পরীক্ষক ভুল করেছিলেন। তাতে ১৫ হাজার খাতায় গরমিল দেখা দেয়। এ কারণে খাতা আবার তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায় এবং ফল প্রকাশ পিছিয়ে যায়। প্রশ্ন হলো, পরীক্ষকের অবহেলার দায় কেন পরীক্ষার্থীরা নেবেন? আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে সমস্যার সমাধান হবে?
সমাধান যে হয়নি, তার প্রমাণ মেলে পরের বিসিএসগুলোতেও। কারণ পরের বিসিএসগুলোতেও একই সমস্যা হচ্ছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কারণ বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতা দুজন কাটেন। যে পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন করা হয়, তাতে প্রথম পরীক্ষক ও দ্বিতীয় পরীক্ষকের দেখা খাতায় ২০ নম্বর বা অধিক নম্বরের পার্থক্য থেকে যায়। আর তখন খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠাতে হয়।
সমস্যার সমাধানে পিএসসি পরীক্ষক ও নিরীক্ষকদের কমিশনে ডেকে কয়েক দিনে টানা লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে পারে। আবার এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কোনো একটা সুনির্দিষ্ট উপায় ছাড়া লিখিত পরীক্ষার এই জট কাটানো সম্ভব নয়।
অন্যদিকে ৪০তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশের এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো নন-ক্যাডারে নিয়োগ দিতে পারেনি পিএসসি। সাধারণত, পরবর্তী বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আগের বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দিত পিএসসি। কিন্তু এবার এখনো নন-ক্যাডারের কোনো তালিকাই দিতে পারেনি পিএসসি।
নন-ক্যাডারে নিয়োগ বাড়াতে হবে: সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বাড়ার পাশাপাশি নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকে বলে চাকরিপ্রার্থীদের বিসিএস নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। একেকটা বিসিএস পরীক্ষায় এখন ৪ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন,সাধারণভাবে গড়ে ২ হাজার ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে বিসিএসে উত্তীর্ণ হলেও বিপুলসংখ্যক প্রার্থী চাকরি থেকে বঞ্চিত হতেন।
উত্তীর্ণ এই প্রার্থীদের প্রথম শ্রেণির অন্যান্য পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্যই ২০১০ সালে নন-ক্যাডার নিয়োগে বিশেষ বিধিমালা করার উদ্যোগ নেন সেই সময়ের চেয়ারম্যান প্রয়াত সা’দত হুসাইন। ২০১৪ সালে প্রথম শ্রেণির পাশাপাশি দ্বিতীয় শ্রেণির পদেও নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।
নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী, একটি বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর ননক্যাডারের আবেদন নেওয়া হতো এবং পরের বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগপর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যত চাহিদা আসত, সেখান থেকে নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান এই বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেন। ফলে ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগ আটকে যায়। এ নিয়ে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা আন্দোলনে নামেন।
২০২৩ সালের জুন মাসে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী নতুন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার পদের পাশাপাশি নন-ক্যাডার পদের সংখ্যাও উল্লেখ থাকবে। এরপর দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ৪০তম বিসিএসের ননক্যাডারে নিয়োগের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
নন-ক্যাডারে নিয়োগসহ ছয় দফা দাবিতে গত বছরের অক্টোবরে পিএসসির সামনে মানববন্ধন ও মিছিল করেছিলেন প্রার্থীরা। এখনো নন-ক্যাডার নিয়োগ না হওয়ায় তারাও হতাশ। ৪০তম নন-ক্যাডারের নিয়োগ না দিয়ে ৪১তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করলে জটিলতা হবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কায় আছেন প্রার্থীরা।
অবশ্য পিএসসি বলছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রথম শ্রেণির (গ্রেড-৯) সহকারী প্রকৌশলীর ১৫৬ পদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জটিলতা শুরু হয়েছে। চাহিদা দিলেও এলজিইডি এখন ওই প্রকৌশলীদের নিয়োগ না দিতে বলেছে।
এই জটিলতায় নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। একটি বিষয় না বললেই নয়। বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ায় দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। পিএসসির অসংখ্য পরীক্ষা নেওয়ার জটিলতাও কমেছে। এখন বিসিএস-জট তৈরি হওয়ায় এর প্রভাব যেন নন-ক্যাডারে না পড়ে, সে জন্য পিএসসির সতর্ক থাকা উচিত। আসলে নন-ক্যাডারে যত বেশিসংখ্যক পদ বিসিএস থেকে নিয়োগ দেওয়া যাবে, ততই দেশের মঙ্গল।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার জরুরি: ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হওয়া বিসিএসগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি বিসিএসেই পরীক্ষা হয়েছে এক বছর, নিয়োগ হয়েছে আরেক বছর। যতই দিন গেছে, দীর্ঘসূত্রতা বেড়েই চলেছে। ২০০৩ সালের ২৪তম বিসিএস থেকে শুরু করে গত ২০ বছরের ২২ বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি, লিখিত ও চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলের সময়সূচি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩৫তম বিসিএসে সবচেয়ে কম সময় নিয়েছিল পিএসসি। মাত্র দেড় বছরে এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফল হয়েছিল। কিন্তু এখন বেশির ভাগ বিসিএস শেষ করতে গড়ে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। গেজেট প্রকাশ ও যোগদানের তারিখ ধরলে দেখা যাচ্ছে, চার বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে দীর্ঘসূত্রতা বেড়েই চলছে। এই দীর্ঘসূত্রতা কমানো জরুরি।
বাংলাদেশে এত সময় লাগার একটা বড় কারণ লিখিত পরীক্ষার খাতা দেরিতে মূল্যায়ন। ১০-১৫ হাজার ছেলেমেয়ের লিখিত পরীক্ষার ফল দিতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। অথচ কয়েক লাখ ছেলেমেয়ের পরীক্ষা নিয়ে তিন মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল এক বছরেও দিতে পারছে না পিএসসি। দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হলে এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে।
আবার বাংলাদেশে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। এর মধ্যে জেনারেল, টেকনিক্যাল আর উভয় ক্যাডার আছে। এক শিক্ষা ক্যাডারেই
অসংখ্য বিষয়। ফলে নিয়োগে সময় বেশি লাগে। এতগুলো ক্যাডার একসঙ্গে রাখার প্রয়োজন আছে কি না, ভাবতে হবে। পাশাপাশি বিসিএসে বা নিয়োগ পরীক্ষার সংস্কারের কথাও ভাবতে হবে। আবার একেকটা বিসএসে কেন এত দেরি হয়, সে জন্য পিএসসিকে জবাবদিহির আওতায় আনাটাও জরুরি।
উন্নত বিশ্বে বিসিএস বা সরকারি চাকরি নিয়ে আলাদা করে উন্মাদনা নেই। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের সিভিল সার্ভিস সবচেয়ে পুরোনো। ভারতের কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা নেয় ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন। প্রতিবছরের জুনে তারা প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেয় এবং আগস্টে ফল প্রকাশ করে। এরপর অক্টোবরে লিখিত পরীক্ষা এবং জানুয়ারিতে ফল প্রকাশিত হয়। উত্তীর্ণদের মার্চে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে মে মাসে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। যাঁরা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন, সেপ্টেম্বর থেকেই তাঁদের চাকরির মূল প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অথচ বাংলাদেশে একেকটা বিসিএসের প্রক্রিয়া শেষ করতেই তারুণ্যের চার বছর বা আরও বেশি সময় শেষ হয়ে যায়। পিএসসিকে তারুণ্যের আস্থায় আনতে হলে নিয়োগে স্বচ্ছতার পাশাপাশি এই দীর্ঘসূত্রতা কমাতেই হবে।
শরিফুল হাসান, কলামিস্ট

চার বছর তিন মাস আগে ২০১৯ সালের ৯ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪১তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য শূন্য পদের অধিযাচন পাঠায় সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ২ হাজার ১৬৬টি পদের বিপরীতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে পিএসসি। কিন্তু চার বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো বিসিএসের ফল প্রকাশে এমন দীর্ঘসূত্রতা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে রেকর্ড হিসেবে গণ্য হতে পারে।
চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর উত্তীর্ণদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, তথ্য যাচাই-বাছাই, গেজেট প্রকাশ, যোগদান—এসব ধরলে এই বিসিএসে নিয়োগ পেতে শেষ পর্যন্ত কত সময় লাগবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষায় থাকা ১৩ হাজার প্রার্থী।
কেবল ৪১ বিসিএস নয়, ৪৩, ৪৪ ও ৪৫—এই চার বিসিএস নিয়ে এখন বিসিএস-জটে আক্রান্ত পিএসসি। এর মধ্যে ৪৩ ও ৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল বাকি।
৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা এ বছরের অক্টোবরে শুরু হওয়ার কথা। অন্যদিকে ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার পদের নিয়োগও ঝুলে আছে।
২০২১ সালে চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ ৪২তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা ছিল না। শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়েই নিয়োগ হয়েছে। এই বিসিএস বাদ দিলে পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলে শুরু হওয়া একটি বিসিএসও পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ হয়নি।
অথচ পিএসসির বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যোগ দেওয়ার পরপরই বলেছিলেন, এক বছরের মধ্যেই একটা বিসিএসে নিয়োগ শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য তিনি রোডম্যাপ করার কথাও বলেছিলেন। অথচ এক বছরে নিয়োগ শেষ করা তো পরের কথা, লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতেই এক বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা লাখো চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা সেই অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। প্রশ্ন উঠেছে পিএসসির সক্ষমতা নিয়েও।
সামাজিক নিরাপত্তা, ভালো বেতনকাঠামো এবং গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে লাখো তরুণের। ফলে দেখা যাচ্ছে, একেকটি বিসিএসে এখন ৪ থেকে ৫ লাখ তরুণ অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষা নেওয়া, এর ফল প্রকাশ করে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া, এরপর চূড়ান্ত ফল, পুলিশ যাচাই, যোগদান—এসব মিলিয়ে তিন থেকে চার বছরেরও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে একটা বিসিএসের পেছনেই চার বছর চলে যাচ্ছে তারুণ্যের।
চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, চার বছরে পৃথিবীর বহু দেশে এক সরকার ক্ষমতা শেষ করে আরেক মেয়াদ আসে। চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যেকোনো বিষয়ে স্নাতক শেষ করা যায়। কিন্তু চার বছরেও একটা বিসিএসের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারছে না পিএসসি।
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন সাবেক শিক্ষাসচিব সোহরাব হোসাইন। তিনি যোগ দেওয়ার পর ২০২১ সালের ১৯ মার্চ ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেয় পিএসসি। কম্পিউটার পদ্ধতিতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না থাকলেও পাঁচ মাস লেগে যায়। ২০২১ সালের ১ আগস্ট এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়।
এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয় ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে। শেষ হয় পরের বছরের ১২ জানুয়ারি। ১৮ হাজার ৮৭০ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষা দেন। প্রায় দুই বছর পর ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। কোনো বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশে এটি একটি রেকর্ড।
২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২২৯ জন প্রার্থী। গত বছরের জুলাই মাসে লিখিত পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও লিখিত পরীক্ষার ফল হয়নি।
৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে জানুয়ারিতে। ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ফল প্রকাশ হয়নি। অন্যদিকে অক্টোবর থেকে ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা। দেখা যাচ্ছে, বারবার পিএসসি লিখিত পরীক্ষার পর হোঁচট খাচ্ছে।
পিএসসির দাবি, ৪১তম বিসিএসে ৩১৮ জন পরীক্ষক ভুল করেছিলেন। তাতে ১৫ হাজার খাতায় গরমিল দেখা দেয়। এ কারণে খাতা আবার তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায় এবং ফল প্রকাশ পিছিয়ে যায়। প্রশ্ন হলো, পরীক্ষকের অবহেলার দায় কেন পরীক্ষার্থীরা নেবেন? আর এই সমস্যা সমাধানের জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে সমস্যার সমাধান হবে?
সমাধান যে হয়নি, তার প্রমাণ মেলে পরের বিসিএসগুলোতেও। কারণ পরের বিসিএসগুলোতেও একই সমস্যা হচ্ছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কারণ বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতা দুজন কাটেন। যে পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়ন করা হয়, তাতে প্রথম পরীক্ষক ও দ্বিতীয় পরীক্ষকের দেখা খাতায় ২০ নম্বর বা অধিক নম্বরের পার্থক্য থেকে যায়। আর তখন খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠাতে হয়।
সমস্যার সমাধানে পিএসসি পরীক্ষক ও নিরীক্ষকদের কমিশনে ডেকে কয়েক দিনে টানা লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে পারে। আবার এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কোনো একটা সুনির্দিষ্ট উপায় ছাড়া লিখিত পরীক্ষার এই জট কাটানো সম্ভব নয়।
অন্যদিকে ৪০তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশের এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো নন-ক্যাডারে নিয়োগ দিতে পারেনি পিএসসি। সাধারণত, পরবর্তী বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আগের বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দিত পিএসসি। কিন্তু এবার এখনো নন-ক্যাডারের কোনো তালিকাই দিতে পারেনি পিএসসি।
নন-ক্যাডারে নিয়োগ বাড়াতে হবে: সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা বাড়ার পাশাপাশি নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকে বলে চাকরিপ্রার্থীদের বিসিএস নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। একেকটা বিসিএস পরীক্ষায় এখন ৪ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন,সাধারণভাবে গড়ে ২ হাজার ক্যাডার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে বিসিএসে উত্তীর্ণ হলেও বিপুলসংখ্যক প্রার্থী চাকরি থেকে বঞ্চিত হতেন।
উত্তীর্ণ এই প্রার্থীদের প্রথম শ্রেণির অন্যান্য পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্যই ২০১০ সালে নন-ক্যাডার নিয়োগে বিশেষ বিধিমালা করার উদ্যোগ নেন সেই সময়ের চেয়ারম্যান প্রয়াত সা’দত হুসাইন। ২০১৪ সালে প্রথম শ্রেণির পাশাপাশি দ্বিতীয় শ্রেণির পদেও নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।
নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী, একটি বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর ননক্যাডারের আবেদন নেওয়া হতো এবং পরের বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগপর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে যত চাহিদা আসত, সেখান থেকে নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান এই বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেন। ফলে ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগ আটকে যায়। এ নিয়ে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা আন্দোলনে নামেন।
২০২৩ সালের জুন মাসে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা সংশোধন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী নতুন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডার পদের পাশাপাশি নন-ক্যাডার পদের সংখ্যাও উল্লেখ থাকবে। এরপর দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ৪০তম বিসিএসের ননক্যাডারে নিয়োগের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
নন-ক্যাডারে নিয়োগসহ ছয় দফা দাবিতে গত বছরের অক্টোবরে পিএসসির সামনে মানববন্ধন ও মিছিল করেছিলেন প্রার্থীরা। এখনো নন-ক্যাডার নিয়োগ না হওয়ায় তারাও হতাশ। ৪০তম নন-ক্যাডারের নিয়োগ না দিয়ে ৪১তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করলে জটিলতা হবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কায় আছেন প্রার্থীরা।
অবশ্য পিএসসি বলছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রথম শ্রেণির (গ্রেড-৯) সহকারী প্রকৌশলীর ১৫৬ পদে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জটিলতা শুরু হয়েছে। চাহিদা দিলেও এলজিইডি এখন ওই প্রকৌশলীদের নিয়োগ না দিতে বলেছে।
এই জটিলতায় নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। একটি বিষয় না বললেই নয়। বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়ায় দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। পিএসসির অসংখ্য পরীক্ষা নেওয়ার জটিলতাও কমেছে। এখন বিসিএস-জট তৈরি হওয়ায় এর প্রভাব যেন নন-ক্যাডারে না পড়ে, সে জন্য পিএসসির সতর্ক থাকা উচিত। আসলে নন-ক্যাডারে যত বেশিসংখ্যক পদ বিসিএস থেকে নিয়োগ দেওয়া যাবে, ততই দেশের মঙ্গল।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার জরুরি: ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হওয়া বিসিএসগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি বিসিএসেই পরীক্ষা হয়েছে এক বছর, নিয়োগ হয়েছে আরেক বছর। যতই দিন গেছে, দীর্ঘসূত্রতা বেড়েই চলেছে। ২০০৩ সালের ২৪তম বিসিএস থেকে শুরু করে গত ২০ বছরের ২২ বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি, লিখিত ও চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলের সময়সূচি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩৫তম বিসিএসে সবচেয়ে কম সময় নিয়েছিল পিএসসি। মাত্র দেড় বছরে এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফল হয়েছিল। কিন্তু এখন বেশির ভাগ বিসিএস শেষ করতে গড়ে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। গেজেট প্রকাশ ও যোগদানের তারিখ ধরলে দেখা যাচ্ছে, চার বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে দীর্ঘসূত্রতা বেড়েই চলছে। এই দীর্ঘসূত্রতা কমানো জরুরি।
বাংলাদেশে এত সময় লাগার একটা বড় কারণ লিখিত পরীক্ষার খাতা দেরিতে মূল্যায়ন। ১০-১৫ হাজার ছেলেমেয়ের লিখিত পরীক্ষার ফল দিতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। অথচ কয়েক লাখ ছেলেমেয়ের পরীক্ষা নিয়ে তিন মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল এক বছরেও দিতে পারছে না পিএসসি। দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হলে এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে।
আবার বাংলাদেশে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। এর মধ্যে জেনারেল, টেকনিক্যাল আর উভয় ক্যাডার আছে। এক শিক্ষা ক্যাডারেই
অসংখ্য বিষয়। ফলে নিয়োগে সময় বেশি লাগে। এতগুলো ক্যাডার একসঙ্গে রাখার প্রয়োজন আছে কি না, ভাবতে হবে। পাশাপাশি বিসিএসে বা নিয়োগ পরীক্ষার সংস্কারের কথাও ভাবতে হবে। আবার একেকটা বিসএসে কেন এত দেরি হয়, সে জন্য পিএসসিকে জবাবদিহির আওতায় আনাটাও জরুরি।
উন্নত বিশ্বে বিসিএস বা সরকারি চাকরি নিয়ে আলাদা করে উন্মাদনা নেই। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের সিভিল সার্ভিস সবচেয়ে পুরোনো। ভারতের কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা নেয় ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন। প্রতিবছরের জুনে তারা প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেয় এবং আগস্টে ফল প্রকাশ করে। এরপর অক্টোবরে লিখিত পরীক্ষা এবং জানুয়ারিতে ফল প্রকাশিত হয়। উত্তীর্ণদের মার্চে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে মে মাসে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। যাঁরা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন, সেপ্টেম্বর থেকেই তাঁদের চাকরির মূল প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অথচ বাংলাদেশে একেকটা বিসিএসের প্রক্রিয়া শেষ করতেই তারুণ্যের চার বছর বা আরও বেশি সময় শেষ হয়ে যায়। পিএসসিকে তারুণ্যের আস্থায় আনতে হলে নিয়োগে স্বচ্ছতার পাশাপাশি এই দীর্ঘসূত্রতা কমাতেই হবে।
শরিফুল হাসান, কলামিস্ট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
১ দিন আগে
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
১ দিন আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
১ দিন আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
১ দিন আগেআবু তাহের খান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি। বরং নতুন কৌশলে তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তাকে অধিক শক্তিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করছে উপনিবেশিত দেশগুলোয়। নিজেদের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সম্প্রসারিত করে এর নাম দেয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই চতুর বিশেষণের মাধ্যমে অনগ্রসর দেশগুলোর নানা খাতের বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করা এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই হলো এর মূল্য উদ্দেশ্য।
কিন্তু তাদের দ্বারা নীরব শোষণের শিকার দেশের জনগণ বুঝতেই পারে না নতুন ধারার এসব প্রযুক্তি কীভাবে তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ নিজেদের অজান্তে অন্য দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে! যেমন ফেসবুক, লিংকডইন, এক্স বা টুইটার ইত্যাদির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জনগণকে নেশায় বুঁদ বানিয়ে রেখে তাদের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে তারা মুনাফার বিস্তার ও একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করছে কৃষি খাতে। অনুন্নত দেশগুলোর ভবিষ্যতের কৃষিকে বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়িক চক্রের হাতে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলছে। এটা তারা করছে কৃষির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহারের চক্রে ফেলে, যা কৃষির প্রাকৃতিক উৎসকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়।
১৯৭০-এর দশক থেকেই বিশ্বব্যাপী কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়। ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশই কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় পরিসরের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের প্রথমার্ধ থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে বীজ ও অন্যান্য কৃষিসংশ্লিষ্ট জীবের জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) নামের এমন সব নতুন প্রজাতি উদ্ভাবিত হতে থাকে, যেগুলোর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একধরনের পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবসা যুক্ত হয়ে পড়ে। আর এ-জাতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করা জিএমওভিত্তিক কৃষি উপকরণ কৃষকের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জমির উর্বরতা ও কৃষিসংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্র্যকে শুধু ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়নি—সংশ্লিষ্ট কৃষককে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে। এর বড় প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টো কর্তৃক ভারতের পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের মধ্যে ১৯৯৮ সালে বিটি বীজ সরবরাহ করে তাঁদের সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।
একসময়ে পাঞ্জাবের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল তুলা। তুলা চাষের সঙ্গে জড়িত সেখানকার হাজার হাজার চাষি সে সময় মনসান্টোর প্রলোভনের খপ্পরে পড়ে বেশি ফলনের আশায় বিটি বীজ কিনে তাঁদের অধিকাংশ জমিতে বপন করেন। এতে করে প্রথম এক-দুই বছর তাঁরা ভালো ফলনও পান। কিন্তু দুই বছর পরেই তুলার মাঠে সর্বনাশের লক্ষণগুলো একটু একটু করে প্রকাশ পেতে শুরু করে। একসময় দেখা যায়—বিটি প্রজাতির ফসলের বীজ নতুন বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে নতুনভাবে চাষের জন্য তাঁদের উচ্চ দামের মনসান্টোর জিএমও বীজের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এ বীজ বপনের পর প্রচলিত ধাঁচের সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ইত্যাদি কোনো কাজে আসছে না। তাই সেই কোম্পানির কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এবং এ ক্ষেত্রেও তাঁদের এসব জিএমও উপকরণ মনসান্টো বা তার মনোনীত ডিলারদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে।
যে জমিতে একবার সেই বীজ ব্যবহার করা হয়েছে, সে জমিতে আর দেশীয় প্রজাতির বীজ ও উপকরণ দ্বারা ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। শেষে দেখা গেছে, এসব বিটি বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এরপর পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের কয়েক বছরের মধ্যেই তুলা চাষ নিয়ে তাঁদের অতীতের সব গর্ব ও অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে অনেকটাই মাথায় হাত দিয়ে পথে বসতে হয়। তুলা আর এখন গম উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া পাঞ্জাবের এক নম্বর অর্থকরী ফসল নয়।
মনসান্টো ও তাদের সমগোত্রীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশেও লোভের থাবা বিস্তার করতে শুরু করেছে। বিটি বেগুনসহ বিভিন্ন ফসলের জিএমও প্রজাতি বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে গছাবার জন্য এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছে এবং কৃষকের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বস্তুত কতিপয় অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও ন্যূনতম দেশাত্মবোধহীন অসৎ আমলাদের হীন তৎপরতা ও যোগসাজশের কারণে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কি আসলেই জানেন জিএমও বীজ কীভাবে কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে?
বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে। পরবর্তী সময়ে সোনালি ধান বা গোল্ডেন রাইস নামের অন্য একটি জিএমও বীজ প্রবর্তনের অনুমতি লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারাও তদবিরে নামেন। যদিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন এখনো মেলেনি। বস্তুত পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর বাধা ও আপত্তির কারণেই এখন পর্যন্ত তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু অত্যন্ত হতাশা ও পরিতাপের বিষয় এই যে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই ২০১৬-২০ মেয়াদি দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিএমওভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে দৃঢ় অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলটি যাঁরা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বসে অনুমোদন করেছিলেন, তাঁরা কি সত্যি সত্যি ওই দলিলে জিএমও প্রযুক্তির পক্ষে অঙ্গীকার থাকার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কত সর্বনাশা সিদ্ধান্ত যে এভাবে নিজেদের অজান্তেই গ্রহণ করছেন, তা বোধকরি তাঁরা নিজেরাও জানেন না।
উল্লেখ্য, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে তো বটেই—এমনকি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক অনুন্নত বা মাঝারি পর্যায়ের দেশের কৃষিতেও জিএমও উপকরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। পাঞ্জাবের তুলা চাষের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ইতিমধ্যে তাদের দেশে জিএমওর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ফিলিপাইন একেবারে গোড়া থেকেই মার্কিন প্রভাববলয়ের দেশ হওয়ার কারণে মনসান্টোর মতো মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিকে ঠেকানোর জন্য তাদেরকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তারপরও আদালতের সহায়তায় তারা কৃষিতে জিএমওকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে জিএমও ঠেকাতে উল্টো এখানে সাধারণ মানুষকেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল এর বিপরীতটি।
প্রধান উপদেষ্টা প্রায় তাঁর তিন শূন্য তত্ত্বের কথা বলে থাকেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করা। কিন্তু কৃষিতে জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ রাখত সেই তিন শূন্য তত্ত্বেরই সম্পূরক কার্যক্রম। তিনি কেন জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ করছেন না? অথচ এ কাজটি করলে কৃষি ও কৃষকের জন্য একটি সুরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন।
অন্যদিকে জিএমওর ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যকার সচেতনতার স্তরও অত্যন্ত নিম্নবর্তী। কৃষকদের মধ্যে উল্লিখিত সচেতনতার স্তর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে তেমন কিছুই করছে না। এ অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুরোধ, জিএমওর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে কৃষকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলুন। তাতে আপনাদের দৈনন্দিন কাজের বোঝা অনেকখানি হালকা হয়ে আসবে।
দেশের কৃষি ও কৃষকদের জিএমওর হাত থেকে বাঁচান। নইলে বাংলাদেশের কৃষি খাত অচিরেই মনসান্টোর মতো জিএমও বাজারজাতকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি দেশের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি। বরং নতুন কৌশলে তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তাকে অধিক শক্তিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করছে উপনিবেশিত দেশগুলোয়। নিজেদের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সম্প্রসারিত করে এর নাম দেয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই চতুর বিশেষণের মাধ্যমে অনগ্রসর দেশগুলোর নানা খাতের বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করা এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই হলো এর মূল্য উদ্দেশ্য।
কিন্তু তাদের দ্বারা নীরব শোষণের শিকার দেশের জনগণ বুঝতেই পারে না নতুন ধারার এসব প্রযুক্তি কীভাবে তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ নিজেদের অজান্তে অন্য দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে! যেমন ফেসবুক, লিংকডইন, এক্স বা টুইটার ইত্যাদির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জনগণকে নেশায় বুঁদ বানিয়ে রেখে তাদের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে তারা মুনাফার বিস্তার ও একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করছে কৃষি খাতে। অনুন্নত দেশগুলোর ভবিষ্যতের কৃষিকে বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়িক চক্রের হাতে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলছে। এটা তারা করছে কৃষির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহারের চক্রে ফেলে, যা কৃষির প্রাকৃতিক উৎসকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়।
১৯৭০-এর দশক থেকেই বিশ্বব্যাপী কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়। ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশই কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় পরিসরের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের প্রথমার্ধ থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে বীজ ও অন্যান্য কৃষিসংশ্লিষ্ট জীবের জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) নামের এমন সব নতুন প্রজাতি উদ্ভাবিত হতে থাকে, যেগুলোর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একধরনের পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবসা যুক্ত হয়ে পড়ে। আর এ-জাতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করা জিএমওভিত্তিক কৃষি উপকরণ কৃষকের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জমির উর্বরতা ও কৃষিসংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্র্যকে শুধু ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়নি—সংশ্লিষ্ট কৃষককে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে। এর বড় প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টো কর্তৃক ভারতের পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের মধ্যে ১৯৯৮ সালে বিটি বীজ সরবরাহ করে তাঁদের সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।
একসময়ে পাঞ্জাবের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল তুলা। তুলা চাষের সঙ্গে জড়িত সেখানকার হাজার হাজার চাষি সে সময় মনসান্টোর প্রলোভনের খপ্পরে পড়ে বেশি ফলনের আশায় বিটি বীজ কিনে তাঁদের অধিকাংশ জমিতে বপন করেন। এতে করে প্রথম এক-দুই বছর তাঁরা ভালো ফলনও পান। কিন্তু দুই বছর পরেই তুলার মাঠে সর্বনাশের লক্ষণগুলো একটু একটু করে প্রকাশ পেতে শুরু করে। একসময় দেখা যায়—বিটি প্রজাতির ফসলের বীজ নতুন বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে নতুনভাবে চাষের জন্য তাঁদের উচ্চ দামের মনসান্টোর জিএমও বীজের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এ বীজ বপনের পর প্রচলিত ধাঁচের সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ইত্যাদি কোনো কাজে আসছে না। তাই সেই কোম্পানির কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এবং এ ক্ষেত্রেও তাঁদের এসব জিএমও উপকরণ মনসান্টো বা তার মনোনীত ডিলারদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে।
যে জমিতে একবার সেই বীজ ব্যবহার করা হয়েছে, সে জমিতে আর দেশীয় প্রজাতির বীজ ও উপকরণ দ্বারা ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। শেষে দেখা গেছে, এসব বিটি বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এরপর পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের কয়েক বছরের মধ্যেই তুলা চাষ নিয়ে তাঁদের অতীতের সব গর্ব ও অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে অনেকটাই মাথায় হাত দিয়ে পথে বসতে হয়। তুলা আর এখন গম উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া পাঞ্জাবের এক নম্বর অর্থকরী ফসল নয়।
মনসান্টো ও তাদের সমগোত্রীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশেও লোভের থাবা বিস্তার করতে শুরু করেছে। বিটি বেগুনসহ বিভিন্ন ফসলের জিএমও প্রজাতি বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে গছাবার জন্য এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছে এবং কৃষকের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বস্তুত কতিপয় অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও ন্যূনতম দেশাত্মবোধহীন অসৎ আমলাদের হীন তৎপরতা ও যোগসাজশের কারণে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কি আসলেই জানেন জিএমও বীজ কীভাবে কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে?
বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে। পরবর্তী সময়ে সোনালি ধান বা গোল্ডেন রাইস নামের অন্য একটি জিএমও বীজ প্রবর্তনের অনুমতি লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারাও তদবিরে নামেন। যদিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন এখনো মেলেনি। বস্তুত পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর বাধা ও আপত্তির কারণেই এখন পর্যন্ত তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু অত্যন্ত হতাশা ও পরিতাপের বিষয় এই যে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই ২০১৬-২০ মেয়াদি দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিএমওভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে দৃঢ় অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলটি যাঁরা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বসে অনুমোদন করেছিলেন, তাঁরা কি সত্যি সত্যি ওই দলিলে জিএমও প্রযুক্তির পক্ষে অঙ্গীকার থাকার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কত সর্বনাশা সিদ্ধান্ত যে এভাবে নিজেদের অজান্তেই গ্রহণ করছেন, তা বোধকরি তাঁরা নিজেরাও জানেন না।
উল্লেখ্য, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে তো বটেই—এমনকি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক অনুন্নত বা মাঝারি পর্যায়ের দেশের কৃষিতেও জিএমও উপকরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। পাঞ্জাবের তুলা চাষের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ইতিমধ্যে তাদের দেশে জিএমওর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ফিলিপাইন একেবারে গোড়া থেকেই মার্কিন প্রভাববলয়ের দেশ হওয়ার কারণে মনসান্টোর মতো মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিকে ঠেকানোর জন্য তাদেরকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তারপরও আদালতের সহায়তায় তারা কৃষিতে জিএমওকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে জিএমও ঠেকাতে উল্টো এখানে সাধারণ মানুষকেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল এর বিপরীতটি।
প্রধান উপদেষ্টা প্রায় তাঁর তিন শূন্য তত্ত্বের কথা বলে থাকেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করা। কিন্তু কৃষিতে জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ রাখত সেই তিন শূন্য তত্ত্বেরই সম্পূরক কার্যক্রম। তিনি কেন জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ করছেন না? অথচ এ কাজটি করলে কৃষি ও কৃষকের জন্য একটি সুরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন।
অন্যদিকে জিএমওর ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যকার সচেতনতার স্তরও অত্যন্ত নিম্নবর্তী। কৃষকদের মধ্যে উল্লিখিত সচেতনতার স্তর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে তেমন কিছুই করছে না। এ অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুরোধ, জিএমওর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে কৃষকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলুন। তাতে আপনাদের দৈনন্দিন কাজের বোঝা অনেকখানি হালকা হয়ে আসবে।
দেশের কৃষি ও কৃষকদের জিএমওর হাত থেকে বাঁচান। নইলে বাংলাদেশের কৃষি খাত অচিরেই মনসান্টোর মতো জিএমও বাজারজাতকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি দেশের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

চার বছর তিন মাস আগে ২০১৯ সালের ৯ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪১তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য শূন্য পদের অধিযাচন পাঠায় সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ২ হাজার ১৬৬টি পদের বিপরীতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে পিএসসি। কিন্তু চার বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো বিসিএসের ফল প্রকাশে এমন
০৪ আগস্ট ২০২৩
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
১ দিন আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
১ দিন আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
১ দিন আগেমাহফুজা খাতুন

আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি আমাদের কাছাকাছি এনেছে, কিন্তু হৃদয়ের দূরত্ব যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে একাকিত্ব ডিজিটাল যুগের এক বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়েছে।
একসময় বন্ধুর মানে ছিল একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা এবং মাঠে দল বেঁধে খেলা করা। এখন বন্ধুত্ব মানে জুম কলে দেখা, মেসেঞ্জারে ‘রিঅ্যাক্ট’ দেওয়া কিংবা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে একে অপরের পোস্টে মন্তব্য করা। এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ অনেক সময় আমাদের বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে কি সত্যিকারের বন্ধন তৈরি হয়?
গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ, আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি ও একাকিত্বের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ, অনলাইন জগৎ এমন এক স্থান যেখানে সবাই নিজেদের সেরা হিসেবে দেখতে এবং উপস্থাপন করতে চায়। এই নিখুঁত জীবনের প্রদর্শনীতে অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে করতে অনেকেই হারিয়ে ফেলেন আত্মবিশ্বাস।
যেকোনো ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে দেখে নেয় কতজন তার স্টোরিতে ‘ভিউ’ দিয়েছে। সারা দিনের কাজের মধ্যেও বারবার ফোন চেক করে, নতুন মেসেজের অপেক্ষায় থাকে। বাইরে থেকে সে খুবই সক্রিয় ও সংযুক্ত মনে হলেও, দিন শেষে নিজের ঘরে বসে অনুভব করে ভয়ংকর এক নিঃসঙ্গতা। এই চিত্র শুধু তার নয়, এ আমাদের প্রজন্মের গল্প। ডিজিটাল মাধ্যমে যে যত বেশি সক্রিয়, বাস্তবজীবনে সে তত বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে।
মানুষ সামাজিক প্রাণী। যোগাযোগ, সহানুভূতি ও সম্পর্কই তাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এই মৌলিক চাহিদাগুলো ভার্চুয়াল পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, একাকিত্ব মানে কেবল শারীরিকভাবে একা থাকা নয়; বরং মানসিকভাবে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা।
ফেসবুকে হাজার ফ্রেন্ড বা ইনস্টাগ্রামে হাজার ফলোয়ার থাকলেও, কেউ যদি মনের কথা বলার মতো একজনকেও না পায়, তবে সে নিঃসন্দেহে একা। এ একাকিত্ব ধীরে ধীরে তৈরি করে অবসাদ, উদ্বেগ, এমনকি আত্মসম্মানহীনতা।
তবে একে একেবারে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। ডিজিটাল মাধ্যম অনেকের জন্য আশীর্বাদও বটে। দূর দেশে থাকা পরিবার বা প্রবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ, অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ, মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং—এসবই প্রযুক্তির দান। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন বাস্তব সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল সম্পর্কের চাপে ম্লান হয়ে যায়। যখন ফোনের পর্দার মানুষগুলো আমাদের কাছে বাস্তবজীবনের মানুষদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল যুগে একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া মানে প্রযুক্তিকে বর্জন নয়; বরং তার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ডিজিটাল ডিটক্স করুন মানে ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছু সময় দূরে থাকা অভ্যাস গড়ে তুলুন। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, মনের কথা মুখে বলা। সর্বোপরি, নিজেকে সময় দেওয়া, বই পড়া, হাঁটাহাঁটি, গান শোনা ও সিনেমা দেখার মাধ্যমে নিজের ভেতরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন। কেবল নিজের পোস্টে ‘লাইক’ নয়, অন্যের গল্প মনোযোগ দিয়ে শোনাও একধরনের সংযোগ।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু যদি আমরা মানবিক সম্পর্কের সেতু হারিয়ে ফেলি। তবে এই অগ্রগতি অর্থহীন। ডিজিটাল যুগের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো—সংযোগের ভেতর মানবিকতা ধরে রাখা।
আমরা সবাই অনলাইনে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয়, কিন্তু মন থেকে যদি সংযুক্ত না থাকি, তবে একে অপরের জীবনে আমরা কেবল নোটিফিকেশন মাত্র।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি আমাদের কাছাকাছি এনেছে, কিন্তু হৃদয়ের দূরত্ব যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে একাকিত্ব ডিজিটাল যুগের এক বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়েছে।
একসময় বন্ধুর মানে ছিল একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা এবং মাঠে দল বেঁধে খেলা করা। এখন বন্ধুত্ব মানে জুম কলে দেখা, মেসেঞ্জারে ‘রিঅ্যাক্ট’ দেওয়া কিংবা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে একে অপরের পোস্টে মন্তব্য করা। এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ অনেক সময় আমাদের বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে কি সত্যিকারের বন্ধন তৈরি হয়?
গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ, আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি ও একাকিত্বের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ, অনলাইন জগৎ এমন এক স্থান যেখানে সবাই নিজেদের সেরা হিসেবে দেখতে এবং উপস্থাপন করতে চায়। এই নিখুঁত জীবনের প্রদর্শনীতে অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে করতে অনেকেই হারিয়ে ফেলেন আত্মবিশ্বাস।
যেকোনো ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে দেখে নেয় কতজন তার স্টোরিতে ‘ভিউ’ দিয়েছে। সারা দিনের কাজের মধ্যেও বারবার ফোন চেক করে, নতুন মেসেজের অপেক্ষায় থাকে। বাইরে থেকে সে খুবই সক্রিয় ও সংযুক্ত মনে হলেও, দিন শেষে নিজের ঘরে বসে অনুভব করে ভয়ংকর এক নিঃসঙ্গতা। এই চিত্র শুধু তার নয়, এ আমাদের প্রজন্মের গল্প। ডিজিটাল মাধ্যমে যে যত বেশি সক্রিয়, বাস্তবজীবনে সে তত বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে।
মানুষ সামাজিক প্রাণী। যোগাযোগ, সহানুভূতি ও সম্পর্কই তাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এই মৌলিক চাহিদাগুলো ভার্চুয়াল পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, একাকিত্ব মানে কেবল শারীরিকভাবে একা থাকা নয়; বরং মানসিকভাবে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা।
ফেসবুকে হাজার ফ্রেন্ড বা ইনস্টাগ্রামে হাজার ফলোয়ার থাকলেও, কেউ যদি মনের কথা বলার মতো একজনকেও না পায়, তবে সে নিঃসন্দেহে একা। এ একাকিত্ব ধীরে ধীরে তৈরি করে অবসাদ, উদ্বেগ, এমনকি আত্মসম্মানহীনতা।
তবে একে একেবারে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। ডিজিটাল মাধ্যম অনেকের জন্য আশীর্বাদও বটে। দূর দেশে থাকা পরিবার বা প্রবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ, অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ, মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং—এসবই প্রযুক্তির দান। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন বাস্তব সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল সম্পর্কের চাপে ম্লান হয়ে যায়। যখন ফোনের পর্দার মানুষগুলো আমাদের কাছে বাস্তবজীবনের মানুষদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল যুগে একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া মানে প্রযুক্তিকে বর্জন নয়; বরং তার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ডিজিটাল ডিটক্স করুন মানে ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছু সময় দূরে থাকা অভ্যাস গড়ে তুলুন। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, মনের কথা মুখে বলা। সর্বোপরি, নিজেকে সময় দেওয়া, বই পড়া, হাঁটাহাঁটি, গান শোনা ও সিনেমা দেখার মাধ্যমে নিজের ভেতরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন। কেবল নিজের পোস্টে ‘লাইক’ নয়, অন্যের গল্প মনোযোগ দিয়ে শোনাও একধরনের সংযোগ।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু যদি আমরা মানবিক সম্পর্কের সেতু হারিয়ে ফেলি। তবে এই অগ্রগতি অর্থহীন। ডিজিটাল যুগের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো—সংযোগের ভেতর মানবিকতা ধরে রাখা।
আমরা সবাই অনলাইনে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয়, কিন্তু মন থেকে যদি সংযুক্ত না থাকি, তবে একে অপরের জীবনে আমরা কেবল নোটিফিকেশন মাত্র।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

চার বছর তিন মাস আগে ২০১৯ সালের ৯ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪১তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য শূন্য পদের অধিযাচন পাঠায় সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ২ হাজার ১৬৬টি পদের বিপরীতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে পিএসসি। কিন্তু চার বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো বিসিএসের ফল প্রকাশে এমন
০৪ আগস্ট ২০২৩
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
১ দিন আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
১ দিন আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
১ দিন আগেশাইখ সিরাজ

কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০১৫ সালে যখন প্রথম সেখানে যাই, তখনো বিস্ময়ে ভরে গিয়েছিল মন। সাত বছর পর ২০২২ সালে গিয়ে দেখলাম—তাদের অগ্রগতির গতি আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে।
এক উজ্জ্বল রোদের দিন, নীল আকাশের নিচে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নির্ধারিত গাড়িতে। গন্তব্য—অ্যাগ্রোপার্ক লিংগেজেন। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, কৃষিতে এমন প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকায়ন কীভাবে সম্ভব হলো নেদারল্যান্ডসে? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম এডে সেন্ট্রাল স্টেশনে, যেখানে আমাদের স্বাগত জানালেন ড. পিটার স্মিটস, সেদিনের গাইড ও হোস্ট। ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোকের চেহারায় বয়সের রেখা থাকলেও তাঁর চলন-বলনে ছিল এক অনন্য তারুণ্য।
পিটার আমাদের জানালেন, খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে জৈব নিরাপত্তার কারণে নেদারল্যান্ডসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের লোকজনকে উৎপাদনকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে বেশির ভাগ জায়গাই আমাদের দেখতে হবে গাড়ি থেকে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে আমি চেয়েছিলাম দর্শকদের ক্যামেরার চোখে দেখাতে, কীভাবে কাজ করছে আধুনিক ইউরোপের কৃষি।
প্রথম গন্তব্য ছিল ভেনলো এলাকার ‘ফ্রেশ পার্ক’। এলাকাটা আমাদের দেশের শিল্পনগরীর মতোই, এটি একধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পার্ক। গ্রিনহাউস বা খামার থেকে আসা কৃষিপণ্য এখানে সর্টিং, প্যাকেজিং ও ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য আসে। বড় বড় লরি পণ্য নিয়ে ছুটে চলে বিভিন্ন দেশে। গাড়ির ভেতর বসে পিটার আমাদের জানালেন, এখান থেকেই তাজা সবজি ও ফল বিদেশে যায়। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখা হয় প্রতিটি পণ্যকে সতেজ রাখার জন্য।
একপর্যায়ে দূরের এক ভবন দেখিয়ে পিটার বললেন, ওটা রয়্যাল জন, একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে কিছু কৃষক মিলে শুরু করেছিলেন। এখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত চার শতাধিক কৃষক। প্রতিদিন সকালে অনলাইনে অকশন হয়, সারা দিন ধরে সেই পণ্য দেশের বাজারে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাইরে থেকে দেখা যতটুকু সম্ভব দেখলাম। ভেতরে খুব কম মানুষ, সবকিছু করছে রোবট। পুরো প্রক্রিয়া অটোমেটেড। প্রযুক্তির শৃঙ্খলা ও কার্যকারিতা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।
তারপর আমাদের গাড়ি চলল বারেনড্রেখ্টের দিকে। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্রিনহাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। কারখানাই বটে, তবে ফসল উৎপাদনের কারখানা। পিটার বলছিলেন, এখানে কোনো গ্রিনহাউসই ৫ হেক্টরের কম নয়। সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে একেকটা গ্রিনহাউস। সারি সারি অসংখ্য গ্রিনহাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিনহাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে নেদারল্যান্ডস পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। পিটার আমাদের পুনরায় হতাশ করলেন। বললেন, এখানেও কোনো গ্রিনহাউসে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি গ্রিনহাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের চাষপদ্ধতি আমার দেশের কৃষককে দেখাতে পারব না। কোনো মানে হয়! পিটারকে বুঝিয়ে বললাম, আমি যদি ক্যামেরায় কোনো কিছু ধারণ করতে না পারি, আমার দর্শককে না দেখাতে পারলে শুধু বাইরে থেকে আমি দেখে গেলে লাভ কী?
পিটার ব্যাপারটা বুঝলেন। কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমাদের জানালেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের একটা ক্যাপসিকামের গ্রিনহাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট লাইন অতিক্রম করা যাবে না।’ আমরা রাজি হলাম। কোনো কিছুতেই হাত দেব না। কোনো সীমাই আমরা অতিক্রম করব না। কেবল ক্যামেরায় দর্শকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ ধারণ করব।
অবশেষে আমরা পৌঁছালাম বেমোলে, ফির্মা ফান ডার হার্ঘ নামের একটি গ্রিনহাউসে। ওখানে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ভেতরে ঢোকার আগে পিটার দেখালেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের বড় ট্যাংক। বললেন, ‘ফসল বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে আমরা বিদ্যুৎ, তাপ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড পাই। বিদ্যুৎ যায় জাতীয় গ্রিডে, তাপ ব্যবহৃত হয় গ্রিনহাউসে, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড সংরক্ষিত থাকে এমন ট্যাংকে।’
ভেতরে ঢুকে দেখা হলো ইয়ন ফান ডের অলেখ-এর সঙ্গে। তিনিই গ্রিনহাউসের তরুণ মালিক। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও উদ্যমী মানুষ। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম, গ্রিনহাউসটির জমির আয়তন ৮.৬ হেক্টর, গাছের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ, বার্ষিক উৎপাদন ২৫০০ টন লাল ক্যাপসিকাম, ফসলের সময়কাল ডিসেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।
ইয়ন জানালেন, ‘সবকিছুই কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত। সেচ, সার, পুষ্টি—সব নির্ধারিত হয় সফটওয়্যারের নির্দেশে। আমরা মূলত ‘ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশন’ ব্যবহার করি। পানির সঙ্গে মিশে থাকে সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। একফোঁটাও অপচয় হয় না।’
তিনি আরও বললেন, ‘আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করি, সেটিই সেচে ব্যবহার হয়। এমনকি তাপ নিয়ন্ত্রণ ও আলোর ব্যবস্থাও রোবট দ্বারা সম্পন্ন হয়।’ সত্যিই, এই গ্রিনহাউস যেন প্রযুক্তির এক নিখুঁত সাম্রাজ্য, যেখানে মানুষ কেবল নিয়ন্ত্রক, শ্রমিক নয়।
সবচেয়ে অবাক লাগল তাঁদের বায়োপেস্ট কন্ট্রোল পদ্ধতি দেখে। ইয়ন বললেন, ‘আমরা কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি না। উপকারী পোকাই ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে। লুপারস, হোয়াইট ফ্লাই বা স্পাইডার মাইট দমন করা হয় এমন পদ্ধতিতে।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, অর্থাৎ পোকা খায় পোকাকে? তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ঠিক তাই!
এই দৃশ্যগুলো দেখে আমি বুঝেছিলাম, উন্নত জাতি মানেই শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তাও। নেদারল্যান্ডস প্রমাণ করেছে—প্রযুক্তি, দক্ষতা আর সততার সমন্বয় ঘটালে কৃষি হতে পারে এক সমৃদ্ধ শিল্প।
আজ যখন বিশ্বের নানা দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে, তখন নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে পথ—কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করেও উৎপাদন বাড়ানো যায়। তাদের কৃষি মডেল শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি টেকসই উন্নয়নেরও প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশেও আমরা যদি কৃষিতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে আরও শক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তবে কৃষি যেমন জীবিকার উৎস, তেমনি এটি হতে পারে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তিও।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০১৫ সালে যখন প্রথম সেখানে যাই, তখনো বিস্ময়ে ভরে গিয়েছিল মন। সাত বছর পর ২০২২ সালে গিয়ে দেখলাম—তাদের অগ্রগতির গতি আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে।
এক উজ্জ্বল রোদের দিন, নীল আকাশের নিচে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নির্ধারিত গাড়িতে। গন্তব্য—অ্যাগ্রোপার্ক লিংগেজেন। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, কৃষিতে এমন প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকায়ন কীভাবে সম্ভব হলো নেদারল্যান্ডসে? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম এডে সেন্ট্রাল স্টেশনে, যেখানে আমাদের স্বাগত জানালেন ড. পিটার স্মিটস, সেদিনের গাইড ও হোস্ট। ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোকের চেহারায় বয়সের রেখা থাকলেও তাঁর চলন-বলনে ছিল এক অনন্য তারুণ্য।
পিটার আমাদের জানালেন, খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে জৈব নিরাপত্তার কারণে নেদারল্যান্ডসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের লোকজনকে উৎপাদনকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে বেশির ভাগ জায়গাই আমাদের দেখতে হবে গাড়ি থেকে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে আমি চেয়েছিলাম দর্শকদের ক্যামেরার চোখে দেখাতে, কীভাবে কাজ করছে আধুনিক ইউরোপের কৃষি।
প্রথম গন্তব্য ছিল ভেনলো এলাকার ‘ফ্রেশ পার্ক’। এলাকাটা আমাদের দেশের শিল্পনগরীর মতোই, এটি একধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পার্ক। গ্রিনহাউস বা খামার থেকে আসা কৃষিপণ্য এখানে সর্টিং, প্যাকেজিং ও ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য আসে। বড় বড় লরি পণ্য নিয়ে ছুটে চলে বিভিন্ন দেশে। গাড়ির ভেতর বসে পিটার আমাদের জানালেন, এখান থেকেই তাজা সবজি ও ফল বিদেশে যায়। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখা হয় প্রতিটি পণ্যকে সতেজ রাখার জন্য।
একপর্যায়ে দূরের এক ভবন দেখিয়ে পিটার বললেন, ওটা রয়্যাল জন, একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে কিছু কৃষক মিলে শুরু করেছিলেন। এখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত চার শতাধিক কৃষক। প্রতিদিন সকালে অনলাইনে অকশন হয়, সারা দিন ধরে সেই পণ্য দেশের বাজারে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাইরে থেকে দেখা যতটুকু সম্ভব দেখলাম। ভেতরে খুব কম মানুষ, সবকিছু করছে রোবট। পুরো প্রক্রিয়া অটোমেটেড। প্রযুক্তির শৃঙ্খলা ও কার্যকারিতা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।
তারপর আমাদের গাড়ি চলল বারেনড্রেখ্টের দিকে। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্রিনহাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। কারখানাই বটে, তবে ফসল উৎপাদনের কারখানা। পিটার বলছিলেন, এখানে কোনো গ্রিনহাউসই ৫ হেক্টরের কম নয়। সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে একেকটা গ্রিনহাউস। সারি সারি অসংখ্য গ্রিনহাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিনহাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে নেদারল্যান্ডস পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। পিটার আমাদের পুনরায় হতাশ করলেন। বললেন, এখানেও কোনো গ্রিনহাউসে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি গ্রিনহাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের চাষপদ্ধতি আমার দেশের কৃষককে দেখাতে পারব না। কোনো মানে হয়! পিটারকে বুঝিয়ে বললাম, আমি যদি ক্যামেরায় কোনো কিছু ধারণ করতে না পারি, আমার দর্শককে না দেখাতে পারলে শুধু বাইরে থেকে আমি দেখে গেলে লাভ কী?
পিটার ব্যাপারটা বুঝলেন। কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমাদের জানালেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের একটা ক্যাপসিকামের গ্রিনহাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট লাইন অতিক্রম করা যাবে না।’ আমরা রাজি হলাম। কোনো কিছুতেই হাত দেব না। কোনো সীমাই আমরা অতিক্রম করব না। কেবল ক্যামেরায় দর্শকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ ধারণ করব।
অবশেষে আমরা পৌঁছালাম বেমোলে, ফির্মা ফান ডার হার্ঘ নামের একটি গ্রিনহাউসে। ওখানে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ভেতরে ঢোকার আগে পিটার দেখালেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের বড় ট্যাংক। বললেন, ‘ফসল বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে আমরা বিদ্যুৎ, তাপ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড পাই। বিদ্যুৎ যায় জাতীয় গ্রিডে, তাপ ব্যবহৃত হয় গ্রিনহাউসে, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড সংরক্ষিত থাকে এমন ট্যাংকে।’
ভেতরে ঢুকে দেখা হলো ইয়ন ফান ডের অলেখ-এর সঙ্গে। তিনিই গ্রিনহাউসের তরুণ মালিক। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও উদ্যমী মানুষ। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম, গ্রিনহাউসটির জমির আয়তন ৮.৬ হেক্টর, গাছের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ, বার্ষিক উৎপাদন ২৫০০ টন লাল ক্যাপসিকাম, ফসলের সময়কাল ডিসেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।
ইয়ন জানালেন, ‘সবকিছুই কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত। সেচ, সার, পুষ্টি—সব নির্ধারিত হয় সফটওয়্যারের নির্দেশে। আমরা মূলত ‘ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশন’ ব্যবহার করি। পানির সঙ্গে মিশে থাকে সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। একফোঁটাও অপচয় হয় না।’
তিনি আরও বললেন, ‘আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করি, সেটিই সেচে ব্যবহার হয়। এমনকি তাপ নিয়ন্ত্রণ ও আলোর ব্যবস্থাও রোবট দ্বারা সম্পন্ন হয়।’ সত্যিই, এই গ্রিনহাউস যেন প্রযুক্তির এক নিখুঁত সাম্রাজ্য, যেখানে মানুষ কেবল নিয়ন্ত্রক, শ্রমিক নয়।
সবচেয়ে অবাক লাগল তাঁদের বায়োপেস্ট কন্ট্রোল পদ্ধতি দেখে। ইয়ন বললেন, ‘আমরা কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি না। উপকারী পোকাই ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে। লুপারস, হোয়াইট ফ্লাই বা স্পাইডার মাইট দমন করা হয় এমন পদ্ধতিতে।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, অর্থাৎ পোকা খায় পোকাকে? তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ঠিক তাই!
এই দৃশ্যগুলো দেখে আমি বুঝেছিলাম, উন্নত জাতি মানেই শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তাও। নেদারল্যান্ডস প্রমাণ করেছে—প্রযুক্তি, দক্ষতা আর সততার সমন্বয় ঘটালে কৃষি হতে পারে এক সমৃদ্ধ শিল্প।
আজ যখন বিশ্বের নানা দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে, তখন নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে পথ—কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করেও উৎপাদন বাড়ানো যায়। তাদের কৃষি মডেল শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি টেকসই উন্নয়নেরও প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশেও আমরা যদি কৃষিতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে আরও শক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তবে কৃষি যেমন জীবিকার উৎস, তেমনি এটি হতে পারে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তিও।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

চার বছর তিন মাস আগে ২০১৯ সালের ৯ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪১তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য শূন্য পদের অধিযাচন পাঠায় সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ২ হাজার ১৬৬টি পদের বিপরীতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে পিএসসি। কিন্তু চার বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো বিসিএসের ফল প্রকাশে এমন
০৪ আগস্ট ২০২৩
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
১ দিন আগে
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
১ দিন আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। রোববার ফার্মগেটের কাছে মেট্রোরেলের ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গিয়ে একজন পথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং দুজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ঘটনাটি এবারে নতুন নয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে একই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেবার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
গত বছর যখন ৪৩০ নম্বর পিলারের কাছাকাছি এলাকা থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তখনই বিশেষজ্ঞরা নকশাগত ত্রুটির কথা বলেছিলেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান সে সময় গণমাধ্যমে বলেছিলেন, মেট্রোরেলের যেখান থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে গেছে, সেই জায়গাটিতে বাঁক আছে। ট্রেন যখন সেই জায়গাটি অতিক্রম করে তখন লাইনের এক পাশে বাড়তি চাপ তৈরি হয়। তখন বিয়ারিং প্যাডের একদিকে বাড়তি চাপ পড়লে অন্য রাবারের বিয়ারিং প্যাড ছিটকে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেই সাবধানতার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে রোববারের ঘটনাটি ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, এক বছর সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এবং নকশা তৈরি ও নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? তারা যে সেটা করেনি, এই ঘটনাই তার বড় প্রমাণ। এ জন্য প্রাণহানির দায় তারা এড়াতে পারে না।
কারণ, বাংলাদেশের মেট্রোরেলের নির্মাণব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ছিল। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ন্যায্যতা হিসেবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা উচ্চ গুণগত মান রক্ষার কথা বলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ কম হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ গুণগত মান রক্ষা করেনি তারা। মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে যখন এমন উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে, তখন এই অতিরিক্ত ব্যয়ের হিসাব এবং উচ্চমানের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন নয় কি?
ছিটকে পড়া বিয়ারিং প্যাডের ছবিতে আয়তাকার প্যাডের এক কোণে ভর বেশি থাকার যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা পিলারের সংযোগস্থলে সমান ভরের ত্রুটিকেই তুলে ধরে। এটি সুস্পষ্টভাবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং যথাযথ তদারকির অভাবকেই দায়ী করে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়েই তাদের দায় শেষ করতে পারে না। মানুষের জীবনের মূল্য কোনো আর্থিক সাহায্য দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
এখন খুব জরুরি করণীয় হলো, জাইকার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করে আন্তর্জাতিক মানের কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো মেট্রোরেলের লাইনের নকশা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা করা। এটা না করে যদি আবার ওই কোম্পানির ওপর ত্রুটি সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সেটা কোনো বিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না। কারণ মেট্রোরেল কেবল একটি পরিবহনব্যবস্থা নয়, এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ।

সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। রোববার ফার্মগেটের কাছে মেট্রোরেলের ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গিয়ে একজন পথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং দুজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ঘটনাটি এবারে নতুন নয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে একই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেবার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
গত বছর যখন ৪৩০ নম্বর পিলারের কাছাকাছি এলাকা থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তখনই বিশেষজ্ঞরা নকশাগত ত্রুটির কথা বলেছিলেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান সে সময় গণমাধ্যমে বলেছিলেন, মেট্রোরেলের যেখান থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে গেছে, সেই জায়গাটিতে বাঁক আছে। ট্রেন যখন সেই জায়গাটি অতিক্রম করে তখন লাইনের এক পাশে বাড়তি চাপ তৈরি হয়। তখন বিয়ারিং প্যাডের একদিকে বাড়তি চাপ পড়লে অন্য রাবারের বিয়ারিং প্যাড ছিটকে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেই সাবধানতার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে রোববারের ঘটনাটি ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, এক বছর সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এবং নকশা তৈরি ও নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? তারা যে সেটা করেনি, এই ঘটনাই তার বড় প্রমাণ। এ জন্য প্রাণহানির দায় তারা এড়াতে পারে না।
কারণ, বাংলাদেশের মেট্রোরেলের নির্মাণব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ছিল। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ন্যায্যতা হিসেবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা উচ্চ গুণগত মান রক্ষার কথা বলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ কম হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ গুণগত মান রক্ষা করেনি তারা। মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে যখন এমন উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে, তখন এই অতিরিক্ত ব্যয়ের হিসাব এবং উচ্চমানের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন নয় কি?
ছিটকে পড়া বিয়ারিং প্যাডের ছবিতে আয়তাকার প্যাডের এক কোণে ভর বেশি থাকার যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা পিলারের সংযোগস্থলে সমান ভরের ত্রুটিকেই তুলে ধরে। এটি সুস্পষ্টভাবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং যথাযথ তদারকির অভাবকেই দায়ী করে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়েই তাদের দায় শেষ করতে পারে না। মানুষের জীবনের মূল্য কোনো আর্থিক সাহায্য দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
এখন খুব জরুরি করণীয় হলো, জাইকার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করে আন্তর্জাতিক মানের কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো মেট্রোরেলের লাইনের নকশা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা করা। এটা না করে যদি আবার ওই কোম্পানির ওপর ত্রুটি সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সেটা কোনো বিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না। কারণ মেট্রোরেল কেবল একটি পরিবহনব্যবস্থা নয়, এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ।

চার বছর তিন মাস আগে ২০১৯ সালের ৯ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৪১তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য শূন্য পদের অধিযাচন পাঠায় সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ২ হাজার ১৬৬টি পদের বিপরীতে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে পিএসসি। কিন্তু চার বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো বিসিএসের ফল প্রকাশে এমন
০৪ আগস্ট ২০২৩
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
১ দিন আগে
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
১ দিন আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
১ দিন আগে