মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

বঙ্গবন্ধুর সরকারের শাসনামলের মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ভারত প্রত্যাগত প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে ৫ লক্ষাধিক বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা, ১২১টি দেশের স্বীকৃতি অর্জন, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সদস্যপদ লাভ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, ভারতের সাথে বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিষ্পত্তির লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর, দেশের অভ্যন্তরে অব্যাহত সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, চোরাচালানি এবং সব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থা গ্রহণ, বন্যা-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি মোকাবিলা করে দেশে যখন শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে যখন অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেমে আসে এক অকল্পনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ।
মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ তাঁর পরিবার, মন্ত্রিসভা, আওয়ামী লীগের নেতারাসহ দেশের আপামর জনতা যা কোনো দিন কল্পনাও করেনি, ইতিহাসের নির্মম ও জঘন্য সেই হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হলো ১৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে। অন্যান্য কর্মব্যস্ত দিনের মতো ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখেও বঙ্গবন্ধু রাত ৮-৯টায় গণভবন থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসায় ফেরেন। তারপর যথারীতি আহার ও অন্যান্য কার্য শেষ করে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু ঘুমাতে গেলেন। ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করতে যাবেন। সে জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
পূর্বপরিকল্পনামতো ঘাতক দলের অপারেশন কমান্ডার আর্মার্ড কোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রশিদ, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর বজলুল হুদা, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর আজিজ পাশা প্রমুখ তাঁদের অধীন সৈন্য, ট্যাংক, কামান, মেশিনগান, স্টেনগান নিয়ে ১৪ আগস্ট রাত থেকেই অভিযানের প্রস্তুতি নেন। তাঁরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৫ আগস্ট ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তিনটি দল ধানমন্ডি ও সংলগ্ন এলাকায় রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ও ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাড়ি ঘেরাও করে আক্রমণ করে। শেষোক্ত দুজনের বাড়িতে ভোর ৫টার আগেই আক্রমণ করে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর স্ত্রী আরজু মণি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর কন্যা বেবী ও পুত্র আরিফ, নাতি সুকান্তসহ সেরানিবাতের বাড়িতে সেই রাতে অবস্থানরত আরও কয়েকজন আত্মীয় ও আশ্রিতজন এবং গৃহপরিচারিকাকে হত্যা করে। এই অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন।
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানের বিশ্বস্ত মেজর মহিউদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন মেজর নূর, মেজর হুদা ও আরও অনেকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হলে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে আক্রমণকারী সেনাদের তুমুল গোলাগুলি হয়। তখন ভোর সাড়ে ৫টা। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন দিকে বেশ কয়েকটি ফোন করেন। তিনি তাঁর মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন। সেনাবাহিনীপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকেও খবর দিতে বলেন যেন সেনাপ্রধান ফোর্স পাঠান। কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসার পথে সোবহানবাগ মসজিদের কাছে বিদ্রোহী সৈনিকদের গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেনাপ্রধানের কথা হয়। জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, ক্যান ইউ গেটআউট। আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং।’ কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সেনাসদস্যরা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। সফিউল্লাহ ফোনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল বাড়ির গেটের সামনে গোলমাল ও উত্তেজনা দেখে নিচে নেমে আসেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে ঘাতক সৈনিকেরা শেখ কামালকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার পথে মেজর নূরসহ কয়েকজনের মুখোমুখি হন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস?’ অমনি অতর্কিত ব্রাশফায়ারে তাঁর বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। তিনি সিঁড়িতে পড়ে গেলেন। তারপর একে একে হত্যা করা হয় শেখ জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজীকে, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকি, বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের এবং সর্বশেষে কনিষ্ঠ পুত্র ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেলকে। আক্রমণকালে ওই বাড়িতে বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। সে জন্য তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক ট্যাংক নিয়ে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিরোধের দায়িত্বে ছিলেন। অন্য অফিসাররা টার্গেট করা বাড়িগুলোর চারদিকে সম্ভাব্য বাধাদানে আসা কোনো পুলিশ বা সৈন্যদের প্রতিরোধে নিয়োজিত ছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদের দায়িত্ব ছিল অপারেশন-পরবর্তী অবস্থা সামাল দেওয়া ও সার্বিক রাজনৈতিক সমন্বয়সাধন।
জেনারেল সফিউল্লাহ যখন বঙ্গবন্ধুর ফোনের জবাব দিচ্ছিলেন, তখন ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিট। সেনাপ্রধান বিভিন্ন দিকে ফোন করতে থাকেন। ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ফোন করে প্রথম বেঙ্গল ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুভ করতে বলেন। তাঁর নির্দেশ সত্ত্বেও শাফায়াত জামিল কোনো ব্যবস্থা নেননি। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রমুখকেও ফোন করেছিলেন, কিন্তু কোনো ট্রুপস মুভ করাতে পারেননি। তিনি নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গেও কথা বলেন।
অপারেশন শেষ করে মেজর ডালিম ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখল করেন এবং নিজেই বেতারে প্রচার করলেন ‘স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ সকাল ৭টায় ঢাকা বেতারে ফারুক হোসেইনের নিয়মিত সংবাদ পাঠে জানা গেল, খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।
গোটা জাতি এই হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। যে মানুষটি তাঁর সারা জীবন বাংলার মানুষের অধিকার আদায়, তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, পাকিস্তানের কারাগারে নিঃসঙ্গ, অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, জাতিকে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, তাঁকে কিনা হত্যা করেছে একদল বিপথগামী ষড়যন্ত্রকারী সৈনিক। আর্মার্ড কোরের মাত্র দুটি ইউনিট এ অভিযানে যোগ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও চাইলেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রতিরক্ষা বাহিনী বিদ্রোহীদের কাবু করতে পারত। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে তারা তা করেনি। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। দেশ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যাঁরা ভালোবাসেন কিংবা তাঁকে নিয়ে গবেষণা করেন বা আলোচনা করেন, তাঁরা অনেক সময় বিস্ময় বোধ করেন বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি শুরু করে, বাংলার মানুষকে ভালোবেসে, তাদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তেরো বছরের অধিক সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, বলতে গেলে তাঁর জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে নির্জন বন্দিশালায়, তিনি জীবনে আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেননি, দীর্ঘসময় অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, ক্ষমতার লোভ কিংবা সম্পদের উচ্চাভিলাষ তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি, সেই মানুষটিকে বাঙালিরা কীভাবে হত্যা করল? তাহলে ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি, ছলচাতুরী এই সব কি বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সংস্থাপন বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন মাহবুবুর রহমান। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত তাঁর রচিত ‘কিছু স্মৃতি কিছু ধৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ কেমন দেশ বা এ কেমন জাতি? যার মুখের কথা শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক জমা হতো, আর যাকে লক্ষ লক্ষ লোক মিছিল করে অভ্যর্থনা করত, যার জয়ধ্বনিতে গগন বিদারিত হতো, তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, মনে কোনো দুঃখ হলো না। যার জন্ম না হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ হতো না, আর বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না, তার হত্যার সাথে সাথে সবাই তার কথা হেলায় মন থেকে মুছে ফেলল। এ ঘটনার নজির খুঁজে বের করা কঠিন। এ ব্যাপারে আজও অনেকের আত্মজিজ্ঞাসা রয়ে গেছে।’
বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়িতে সাধারণ নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে থাকতেন। দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাপ্য কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা তিনি নেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, ‘বাঙালি আমাকে মারবে না। তাঁর এ বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল তাঁর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম। বাংলাদেশকে ও বাঙালিদের তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এর প্রকাশ দেখা যায় বাংলায় ১৯৫০-এর মন্বন্তরের সময় মুসলিম যুব কর্মীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ, দুর্গতদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও সেবাদান করার মধ্যে। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আহতদের সেবা করেছেন। ১৯৫৪ সালে আদমজী জুট মিলের দাঙ্গা হামলার সময়, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি দলীয় কর্মীদের নিয়ে বাংলার মানুষকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেছেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দিয়ে তিনি বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন, স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে তিনি যেমন এ দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, বাংলার মানুষও তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর ডাকে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করেছে। তাঁর একটি স্বপ্ন বাংলার মানুষ খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে বাস করুক। আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে নিজের স্থান করে নিক। তিনি বলতেন, ‘ভিক্ষুক জাতির পৃথিবীতে কোনো সম্মান নেই।’
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের প্রারম্ভে উল্লিখিত তাঁর নোটবুকে ৩০.০৫.৭৩ তারিখে ইংরেজিতে লেখা একটি উক্তির বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ: ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তন সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বাংলার মানুষের প্রতি হৃদয়ের এই উষ্ণতা ও ভালোবাসার কারণে সব চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের মুখে এই বিশ্বাস প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন যে কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে না। তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান ও চিন্তিত হয়ে অনেকে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তাদের সোর্স মারফত জানতে পারে যে বাংলাদেশে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিয়ে ‘র’-এর অন্যতম নীতিনির্ধারক আর এন কাড ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করলে বঙ্গবন্ধু তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সবাই আমার সন্তান, আমাকে কেউ মারবে না।’
বাংলার মানুষের প্রতি এই অবিচল ও সীমাহীন বিশ্বাসই তাঁর উত্তম চরিত্রের ও মহৎ গুণাবলির বৈশিষ্ট্য। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস একদল বিপথগামী বাঙালিই তাঁকে হত্যা করেছে। তবে হত্যাকারীরা বাঙালি হলেও তারা ছিল বহিঃশত্রুর মদদপুষ্ট ও বেতনভুক্ত জল্লাদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ‘মোশতাক-ফারুক-রশীদরা চেয়েছিলেন’ যেকোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। ফারুক-রশীদ পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধেও যোগদান করেছেন বিলম্বে। তাঁরা কোনো সেক্টরে যুদ্ধ করেননি। কলকাতায় অবস্থান করেছেন।
জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে সিআইএর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। পৃথিবীর কোটি কোটি দরিদ্র, শোষিত, নির্যাতিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দের হত্যাকাণ্ডের (১৯৭৩) পর অবশ্য বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একে একে আমাদের সবাইকে এভাবে শেষ করা হবে। এবার টার্গেট করা হবে আমাকে।’
কী আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী! হয়তো মনের অগোচরে তিনি এ কথাটি বলে ফেলেছিলেন।
ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা ছিল দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লব ও একদলীয় শাসন প্রবর্তনের সময় খন্দকার মোশতাক এর বিরোধিতা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে তাঁর সঙ্গে উত্তেজিতভাবে তর্কাতর্কি করেন, কিন্তু জেনারেল এমএজি ওসমানী বা ব্যারিস্টার মইনুলের মতো পদত্যাগ করেননি। তিনি পার্লামেন্টেও ছিলেন, মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থেকে ঘাতকদের হত্যাকাণ্ডের সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আছে যে খন্দকার মোশতাক ১৪ আগস্ট বাসা থেকে খাবার রান্না করে এনে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে খাইয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর লাশ নিয়ে কবরে নেমেছিলেন, এ ছাড়া শেখ কামালের বিবাহের উকিলও ছিলেন খন্দকার মোশতাক। বিশ্বাসঘাতক আর কাকে বলে!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্বাসন দেওয়ার প্রয়াস চলে। কিন্তু ঘন কালো মেঘের আড়ালে লুকায়িত সূর্যের উদয়কে যেমন ঠেকানো যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় পর্বতপ্রমাণ অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে এবং ২০০৯ থেকে একনাগাড়ে আরও তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে যেমন পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে, তেমনি তাঁর আদর্শ ও পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, বৈরী সময়ের ঘটনাবহুল শাসনামলের আজ নতুনভাবে পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে। কীভাবে একটি দেশ ও জাতিকে শূন্যাবস্থা থেকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, উপর্যুপরি বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, সন্ত্রাস, উগ্রবাদী তৎপরতা, দুর্নীতি ইত্যাদি কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
পঁচাত্তরে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট কোনো এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কী?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল।’ পরের প্রশ্ন ‘আপনার দুর্বলতা কী?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল টু মাচ। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার হানি না ঘটে।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উৎসই ছিল জনগণ। এ রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে গ্রাম বাংলার হাটে-ঘাটে, প্রতারিত, শোষিত বাঙালির পর্ণকুটিরে। মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা, আন্দোলন-সংগ্রাম নিঃস্বার্থ ত্যাগের ওপর রচিত এবং ত্যাগেই ভালোবাসা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আজীবন সংগ্রামী এ মানুষটি তাঁর আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার আগেই ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের নির্মম হত্যার শিকার হন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিন লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়, ‘সবকিছু সত্ত্বেও শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ জন্য যে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনো বাস্তবে পরিণত হতো না’ (১৬.৮.১৯৭৫)।
কিউবার সংগ্রামী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল হিমালয়ের মতোই বিশাল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বিবিসি প্রচার করে, শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচ বোধ করেছে।
ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত মন্তব্য করেন আপসহীন-সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডট মন্তব্য করেন, মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে, তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার সংবাদ বেতারে শোনার পর তাৎক্ষণিকভাবে সাহিত্যিক সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে শক্তিশালীরূপে আবির্ভূত হবেন।’
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ। আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জার্মানিতে অবস্থানরত তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশায় ভারতে আসার পথে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসারকে শেখ হাসিনা তাঁর পাসপোর্ট দেখালে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে সেই অফিসার শেখ হাসিনাকে বললেন, ‘ছিঃ, তোমরা বাংলাদেশিরা জঘন্য জাতি। যে মানুষটি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, তাঁকেই তোমরা হত্যা করে ফেললে?’ শেখ হাসিনা চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এয়ারপোর্টের লোক দেখল দুই বোনের আহাজারি।
বিবিসি বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের জনমত জরিপে ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল, ১৪১১ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ উপাধিতে ভূষিত হন। যুগে যুগে যেসব বাঙালি মনীষী, কবি সাহিত্যিক বাংলাকে ভালোবেসে অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তাই বলা যায়:
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
(রচনাটি লেখকের ‘চিরঞ্জীব শেখ মুজিব-জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পাঠ’ গ্রন্থের অংশবিশেষ)
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

বঙ্গবন্ধুর সরকারের শাসনামলের মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ভারত প্রত্যাগত প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, পাকিস্তান থেকে ৫ লক্ষাধিক বাঙালিকে ফিরিয়ে আনা, ১২১টি দেশের স্বীকৃতি অর্জন, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সদস্যপদ লাভ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণ, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, ভারতের সাথে বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিষ্পত্তির লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর, দেশের অভ্যন্তরে অব্যাহত সন্ত্রাস, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, চোরাচালানি এবং সব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থা গ্রহণ, বন্যা-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি মোকাবিলা করে দেশে যখন শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে যখন অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেমে আসে এক অকল্পনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ।
মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ তাঁর পরিবার, মন্ত্রিসভা, আওয়ামী লীগের নেতারাসহ দেশের আপামর জনতা যা কোনো দিন কল্পনাও করেনি, ইতিহাসের নির্মম ও জঘন্য সেই হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হলো ১৫ আগস্ট প্রথম প্রহরে। অন্যান্য কর্মব্যস্ত দিনের মতো ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখেও বঙ্গবন্ধু রাত ৮-৯টায় গণভবন থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসায় ফেরেন। তারপর যথারীতি আহার ও অন্যান্য কার্য শেষ করে রাত সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু ঘুমাতে গেলেন। ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করতে যাবেন। সে জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
পূর্বপরিকল্পনামতো ঘাতক দলের অপারেশন কমান্ডার আর্মার্ড কোরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর রশিদ, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর বজলুল হুদা, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর আজিজ পাশা প্রমুখ তাঁদের অধীন সৈন্য, ট্যাংক, কামান, মেশিনগান, স্টেনগান নিয়ে ১৪ আগস্ট রাত থেকেই অভিযানের প্রস্তুতি নেন। তাঁরা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে ১৫ আগস্ট ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তিনটি দল ধানমন্ডি ও সংলগ্ন এলাকায় রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর রোডের বাড়ি, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ও ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রোডের বাড়ি ঘেরাও করে আক্রমণ করে। শেষোক্ত দুজনের বাড়িতে ভোর ৫টার আগেই আক্রমণ করে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর স্ত্রী আরজু মণি, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর কন্যা বেবী ও পুত্র আরিফ, নাতি সুকান্তসহ সেরানিবাতের বাড়িতে সেই রাতে অবস্থানরত আরও কয়েকজন আত্মীয় ও আশ্রিতজন এবং গৃহপরিচারিকাকে হত্যা করে। এই অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন।
বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানের বিশ্বস্ত মেজর মহিউদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন মেজর নূর, মেজর হুদা ও আরও অনেকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হলে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে আক্রমণকারী সেনাদের তুমুল গোলাগুলি হয়। তখন ভোর সাড়ে ৫টা। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন দিকে বেশ কয়েকটি ফোন করেন। তিনি তাঁর মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বললেন। সেনাবাহিনীপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকেও খবর দিতে বলেন যেন সেনাপ্রধান ফোর্স পাঠান। কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে আসার পথে সোবহানবাগ মসজিদের কাছে বিদ্রোহী সৈনিকদের গুলিতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেনাপ্রধানের কথা হয়। জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছিলেন, ‘স্যার, ক্যান ইউ গেটআউট। আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং।’ কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সেনাসদস্যরা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। সফিউল্লাহ ফোনে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল বাড়ির গেটের সামনে গোলমাল ও উত্তেজনা দেখে নিচে নেমে আসেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে ঘাতক সৈনিকেরা শেখ কামালকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার পথে মেজর নূরসহ কয়েকজনের মুখোমুখি হন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস?’ অমনি অতর্কিত ব্রাশফায়ারে তাঁর বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। তিনি সিঁড়িতে পড়ে গেলেন। তারপর একে একে হত্যা করা হয় শেখ জামাল ও তাঁর স্ত্রী রোজীকে, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকি, বেগম মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের এবং সর্বশেষে কনিষ্ঠ পুত্র ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেলকে। আক্রমণকালে ওই বাড়িতে বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। সে জন্য তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক ট্যাংক নিয়ে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিরোধের দায়িত্বে ছিলেন। অন্য অফিসাররা টার্গেট করা বাড়িগুলোর চারদিকে সম্ভাব্য বাধাদানে আসা কোনো পুলিশ বা সৈন্যদের প্রতিরোধে নিয়োজিত ছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদের দায়িত্ব ছিল অপারেশন-পরবর্তী অবস্থা সামাল দেওয়া ও সার্বিক রাজনৈতিক সমন্বয়সাধন।
জেনারেল সফিউল্লাহ যখন বঙ্গবন্ধুর ফোনের জবাব দিচ্ছিলেন, তখন ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিট। সেনাপ্রধান বিভিন্ন দিকে ফোন করতে থাকেন। ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ফোন করে প্রথম বেঙ্গল ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুভ করতে বলেন। তাঁর নির্দেশ সত্ত্বেও শাফায়াত জামিল কোনো ব্যবস্থা নেননি। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রমুখকেও ফোন করেছিলেন, কিন্তু কোনো ট্রুপস মুভ করাতে পারেননি। তিনি নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গেও কথা বলেন।
অপারেশন শেষ করে মেজর ডালিম ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখল করেন এবং নিজেই বেতারে প্রচার করলেন ‘স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ সকাল ৭টায় ঢাকা বেতারে ফারুক হোসেইনের নিয়মিত সংবাদ পাঠে জানা গেল, খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।
গোটা জাতি এই হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। যে মানুষটি তাঁর সারা জীবন বাংলার মানুষের অধিকার আদায়, তাদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, পাকিস্তানের কারাগারে নিঃসঙ্গ, অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, জাতিকে স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, তাঁকে কিনা হত্যা করেছে একদল বিপথগামী ষড়যন্ত্রকারী সৈনিক। আর্মার্ড কোরের মাত্র দুটি ইউনিট এ অভিযানে যোগ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও চাইলেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রতিরক্ষা বাহিনী বিদ্রোহীদের কাবু করতে পারত। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে তারা তা করেনি। ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। দেশ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যাঁরা ভালোবাসেন কিংবা তাঁকে নিয়ে গবেষণা করেন বা আলোচনা করেন, তাঁরা অনেক সময় বিস্ময় বোধ করেন বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি শুরু করে, বাংলার মানুষকে ভালোবেসে, তাদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তেরো বছরের অধিক সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারা প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, বলতে গেলে তাঁর জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে নির্জন বন্দিশালায়, তিনি জীবনে আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখেননি, দীর্ঘসময় অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছেন, ক্ষমতার লোভ কিংবা সম্পদের উচ্চাভিলাষ তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি, সেই মানুষটিকে বাঙালিরা কীভাবে হত্যা করল? তাহলে ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি, ছলচাতুরী এই সব কি বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সংস্থাপন বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন মাহবুবুর রহমান। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত তাঁর রচিত ‘কিছু স্মৃতি কিছু ধৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ কেমন দেশ বা এ কেমন জাতি? যার মুখের কথা শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ লোক জমা হতো, আর যাকে লক্ষ লক্ষ লোক মিছিল করে অভ্যর্থনা করত, যার জয়ধ্বনিতে গগন বিদারিত হতো, তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, মনে কোনো দুঃখ হলো না। যার জন্ম না হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ হতো না, আর বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না, তার হত্যার সাথে সাথে সবাই তার কথা হেলায় মন থেকে মুছে ফেলল। এ ঘটনার নজির খুঁজে বের করা কঠিন। এ ব্যাপারে আজও অনেকের আত্মজিজ্ঞাসা রয়ে গেছে।’
বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়িতে সাধারণ নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে থাকতেন। দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাপ্য কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা তিনি নেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, ‘বাঙালি আমাকে মারবে না। তাঁর এ বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল তাঁর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম। বাংলাদেশকে ও বাঙালিদের তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। এর প্রকাশ দেখা যায় বাংলায় ১৯৫০-এর মন্বন্তরের সময় মুসলিম যুব কর্মীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ, দুর্গতদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ ও সেবাদান করার মধ্যে। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আহতদের সেবা করেছেন। ১৯৫৪ সালে আদমজী জুট মিলের দাঙ্গা হামলার সময়, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিনি দলীয় কর্মীদের নিয়ে বাংলার মানুষকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেছেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দিয়ে তিনি বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন, স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে তিনি যেমন এ দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, বাংলার মানুষও তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর ডাকে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করেছে। তাঁর একটি স্বপ্ন বাংলার মানুষ খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে বাস করুক। আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে নিজের স্থান করে নিক। তিনি বলতেন, ‘ভিক্ষুক জাতির পৃথিবীতে কোনো সম্মান নেই।’
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের প্রারম্ভে উল্লিখিত তাঁর নোটবুকে ৩০.০৫.৭৩ তারিখে ইংরেজিতে লেখা একটি উক্তির বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ: ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তন সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ বাংলার মানুষের প্রতি হৃদয়ের এই উষ্ণতা ও ভালোবাসার কারণে সব চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের মুখে এই বিশ্বাস প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন যে কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে না। তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে সন্দিহান ও চিন্তিত হয়ে অনেকে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তাদের সোর্স মারফত জানতে পারে যে বাংলাদেশে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমতি নিয়ে ‘র’-এর অন্যতম নীতিনির্ধারক আর এন কাড ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করলে বঙ্গবন্ধু তা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সবাই আমার সন্তান, আমাকে কেউ মারবে না।’
বাংলার মানুষের প্রতি এই অবিচল ও সীমাহীন বিশ্বাসই তাঁর উত্তম চরিত্রের ও মহৎ গুণাবলির বৈশিষ্ট্য। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস একদল বিপথগামী বাঙালিই তাঁকে হত্যা করেছে। তবে হত্যাকারীরা বাঙালি হলেও তারা ছিল বহিঃশত্রুর মদদপুষ্ট ও বেতনভুক্ত জল্লাদ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ‘মোশতাক-ফারুক-রশীদরা চেয়েছিলেন’ যেকোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন। ফারুক-রশীদ পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধেও যোগদান করেছেন বিলম্বে। তাঁরা কোনো সেক্টরে যুদ্ধ করেননি। কলকাতায় অবস্থান করেছেন।
জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে সিআইএর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। পৃথিবীর কোটি কোটি দরিদ্র, শোষিত, নির্যাতিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দের হত্যাকাণ্ডের (১৯৭৩) পর অবশ্য বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একে একে আমাদের সবাইকে এভাবে শেষ করা হবে। এবার টার্গেট করা হবে আমাকে।’
কী আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণী! হয়তো মনের অগোচরে তিনি এ কথাটি বলে ফেলেছিলেন।
ষড়যন্ত্রকারীদের নীলনকশা ছিল দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লব ও একদলীয় শাসন প্রবর্তনের সময় খন্দকার মোশতাক এর বিরোধিতা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে তাঁর সঙ্গে উত্তেজিতভাবে তর্কাতর্কি করেন, কিন্তু জেনারেল এমএজি ওসমানী বা ব্যারিস্টার মইনুলের মতো পদত্যাগ করেননি। তিনি পার্লামেন্টেও ছিলেন, মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থেকে ঘাতকদের হত্যাকাণ্ডের সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আছে যে খন্দকার মোশতাক ১৪ আগস্ট বাসা থেকে খাবার রান্না করে এনে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে খাইয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর লাশ নিয়ে কবরে নেমেছিলেন, এ ছাড়া শেখ কামালের বিবাহের উকিলও ছিলেন খন্দকার মোশতাক। বিশ্বাসঘাতক আর কাকে বলে!
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্বাসন দেওয়ার প্রয়াস চলে। কিন্তু ঘন কালো মেঘের আড়ালে লুকায়িত সূর্যের উদয়কে যেমন ঠেকানো যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় পর্বতপ্রমাণ অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে এবং ২০০৯ থেকে একনাগাড়ে আরও তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার শাসনামলে বঙ্গবন্ধুকে যেমন পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে, তেমনি তাঁর আদর্শ ও পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, বৈরী সময়ের ঘটনাবহুল শাসনামলের আজ নতুনভাবে পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে। কীভাবে একটি দেশ ও জাতিকে শূন্যাবস্থা থেকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, উপর্যুপরি বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষ, সন্ত্রাস, উগ্রবাদী তৎপরতা, দুর্নীতি ইত্যাদি কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
পঁচাত্তরে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট কোনো এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি কী?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল।’ পরের প্রশ্ন ‘আপনার দুর্বলতা কী?’ বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল টু মাচ। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার হানি না ঘটে।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির উৎসই ছিল জনগণ। এ রাজনীতির গোড়াপত্তন হয়েছে গ্রাম বাংলার হাটে-ঘাটে, প্রতারিত, শোষিত বাঙালির পর্ণকুটিরে। মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা, আন্দোলন-সংগ্রাম নিঃস্বার্থ ত্যাগের ওপর রচিত এবং ত্যাগেই ভালোবাসা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আজীবন সংগ্রামী এ মানুষটি তাঁর আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার আগেই ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের নির্মম হত্যার শিকার হন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিন লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় লেখা হয়, ‘সবকিছু সত্ত্বেও শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ জন্য যে তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনো বাস্তবে পরিণত হতো না’ (১৬.৮.১৯৭৫)।
কিউবার সংগ্রামী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল হিমালয়ের মতোই বিশাল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বিবিসি প্রচার করে, শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচ বোধ করেছে।
ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত মন্তব্য করেন আপসহীন-সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুমকোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডট মন্তব্য করেন, মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে, তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার সংবাদ বেতারে শোনার পর তাৎক্ষণিকভাবে সাহিত্যিক সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে শক্তিশালীরূপে আবির্ভূত হবেন।’
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ। আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জার্মানিতে অবস্থানরত তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশায় ভারতে আসার পথে ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন অফিসারকে শেখ হাসিনা তাঁর পাসপোর্ট দেখালে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখে সেই অফিসার শেখ হাসিনাকে বললেন, ‘ছিঃ, তোমরা বাংলাদেশিরা জঘন্য জাতি। যে মানুষটি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, তাঁকেই তোমরা হত্যা করে ফেললে?’ শেখ হাসিনা চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এয়ারপোর্টের লোক দেখল দুই বোনের আহাজারি।
বিবিসি বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের জনমত জরিপে ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল, ১৪১১ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ উপাধিতে ভূষিত হন। যুগে যুগে যেসব বাঙালি মনীষী, কবি সাহিত্যিক বাংলাকে ভালোবেসে অমরত্ব লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তাই বলা যায়:
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
(রচনাটি লেখকের ‘চিরঞ্জীব শেখ মুজিব-জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পাঠ’ গ্রন্থের অংশবিশেষ)
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন।
১৭ ঘণ্টা আগে
কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত।
১৭ ঘণ্টা আগে
পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
১৮ ঘণ্টা আগে
মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার...
২ দিন আগে
ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ—এ চারটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার কারণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

আপনারা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নিলেন? আপনাদের মূল আপত্তিগুলো কী ছিল?
আমাদের প্রথম আপত্তি ছিল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত সংযুক্ত না করা। যেসব বিষয়ে সবাই মিলে একমত হয়েছি বা মোটামুটি একমত হয়েছি, সেসব যুক্ত করা ছাড়া আমরা স্বাক্ষর করব না। যেহেতু ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ কিছু বিষয়ে আপত্তি ছিল, সেটা স্বাক্ষর করলে তো মেনে নেওয়া হতো। সেটা জাতীয় সংসদে হলে অন্য কথা ছিল বা কোনো রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেটা হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সেটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন সে রকম কোনো ফোরাম না। এটা হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্যে আসার জন্য একটা চেষ্টা, একটা উদ্যোগ।
জুলাই সনদ তৈরি করার সময় এর পটভূমি ধরে আমরা ইতিহাসকে সঠিকভাবে লেখার জন্য বারবার ইনপুট দিয়েছি। আমাদের দলসহ অন্য দলের নেতারা সেটা বলেছেন। কিন্তু সনদে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকে পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ছোট ছোট অনেক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা কীভাবে এল, সেটা তো থাকা দরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তো থাকতে হবে। যদিও বিশাল আকারে ইতিহাস লেখার জায়গা এটা না। শেষে আসবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা। এর মধ্যে মাঝখানের ঘটনাগুলো শুধু উল্লেখ করলেই চলত। সেটা তো করা হয়নি। যাঁরা খসড়াটি করেছেন, তাঁদের আমি অবশ্যই অযোগ্য বলব না। একেকজনের কথায় একেকটা বিষয় ঢুকে গেছে। কারও সঙ্গে তাঁরা বিতর্ক করেননি। ফলে আমাদের বক্তব্যগুলোকে বেমালুম বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মনে করেছেন, আমাদের বক্তব্য বাদ দিলে বুঝি কোনো সমস্যা হবে না। আবার কোনো কোনো দল যা-ই বলেছে, সেটাই তাঁরা রেখেছেন; যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বক্তব্য একপেশে হয়েছে।
আবার অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের কথা হলো, এই সনদ পরিপূর্ণ হলে সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলো লিপিবদ্ধ থাকত। কিন্তু সেসব রাখা হয়নি। সনদের ভেতরে আবার তাঁরা লিখেছেন—যে দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়া কাজ করতে পারবে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, তারাও তো কাজ করবে। তারা প্রয়োজনবোধে একমত না হলে সংসদ ত্যাগ করবে। নতুবা সংসদের বাইরে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের কাছে মতামত তুলে ধরবে। এসব তো ম্যান্ডেট পাওয়া না-পাওয়ার ওপর নির্ভর করে না।
এটা তো বিএনপির ভাষা। বিএনপি মনে করে, তারা ম্যান্ডেট নিয়ে আগামী সংসদে যাবে। সেটা ভালো কথা। কিন্তু আমরা ম্যান্ডেট পাব কি পাব না সেটা ভিন্ন কথা। আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি চুপ না থাকার জন্য। আমরা যেমনভাবে সংসদের ভেতরে কথা বলব, তেমনি সংসদের বাইরেও কথা বলব। আমরা আবার রাজপথে আন্দোলনও করব। সবকিছু মিলিয়ে আমরা কয়েকটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করিনি।
তবে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি, যেসব বিষয়ে আমরা সহমত জ্ঞাপন করেছি (সেটার রেকর্ড আছে) সেটা খুব ভালো কাজ হয়েছে। আমরা ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই যে সাংবিধানিক প্রশ্ন, আইনের প্রশ্নসহ সংস্কার নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে তারা একটা ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করতে পেরেছে। এই দলিল থেকে বোঝা যাবে, কোন দলের কী দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু আমরা বলেছি, গায়ের জোরে সংবিধান বাতিল করার দাবি—এটা অসাংবিধানিক অপরাধ। আমরা মনে করি, সংবিধান বাতিল করার দাবি তোলা যাবে এবং নতুন সংবিধান করার দাবিও তোলা যাবে—সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ হবে না। কিন্তু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যদি বাতিল করতে চায়, সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ। তারা ৭ (ক) ধারার বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। এটা নিয়ে আমরা আপত্তি করেছি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষে আমরা পিআর পদ্ধতির পক্ষে, কিন্তু দুই বাসদ ও সিপিবি উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে না।
তবে আমরা যে কয়েকটি বাম দল এসব বিষয়ে একমত হয়েছি, আমরা আগামী দিনে সংসদের ভেতরে ও বাইরে এসব নিয়ে সংগ্রাম এবং রাজনৈতিকভাবে জনমত গঠনের কাজ করব। সেটা আমরা অঙ্গীকার করেছি।
এরপর আপনারা একটা স্মারকলিপি দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কারণ কী?
আমরা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলাম না, সেটা নিয়ে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করেছি। সেই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যটা আমাদের দুজন প্রতিনিধি হাতে হাতে ঐকমত্য কমিশনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
স্মারকলিপি দেওয়ার পর ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য কী?
তারা বলেছে, আপনারা অনেক কষ্ট করে, সময় নিয়ে বক্তব্য বা নোট দিয়েছেন, আপনারা এটার অংশীদার হন। আমরা বলেছি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে কেন আমরা আত্মসমর্পণ করব মৌলিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে? বিএনপি যেমন প্রত্যাশা করছে, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। তারাসহ তাদের মিত্ররা দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাবে। তারা যেসব নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলোতে তারা পক্ষে নিতে পারে। কিন্তু সংসদে যাওয়ার আগেই আমাদের মেনে নিতে হবে, সংবিধান বাতিলের ১৪ ধারা রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ না, নারী ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের দরকার নেই, সংবিধানের ১৫০ (২) ধারা মতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ না থাকা—এ বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে তো আমরা সনদে স্বাক্ষর করে দাসখত দিতে পারি না। এই ফাঁদেও পা দিতে পারি না। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এসব বিষয় যদি সংশোধন না করা হয়, তাহলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারি না।
এনসিপি সনদের বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্ন নিয়ে স্বাক্ষর করেনি। এটাকে আপনারা কীভাবে দেখেন?
তাদের তো সনদ নিয়ে কোনো দাবি নেই। তারা সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। আমাদের তো সনদের খসড়া নিয়েই আপত্তি। কিন্তু তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা শুধু বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিতর্ক তুলে স্বাক্ষর করেনি।
আপনি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন। সে সময়ে তিন জোটের রূপরেখাকে পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন কোনো দলই গুরুত্ব দেয়নি। এখন আপনি জুলাই সনদ নিয়ে কতটা আশাবাদী?
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখাকে নির্দিষ্ট করে সংবিধানের সঙ্গে আপগ্রেড করা হয়নি। সে সময় যে তিনটি জোট এই রূপরেখাতে স্বাক্ষর করেছিল, তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার অনেক কিছুই মানেনি। তারা সেখানকার রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। তা ছাড়া, এটার কোনো আইনি রূপও দেওয়া হয়নি। কথা ছিল তারা পরস্পরের প্রতি কোনো বৈরী আচরণ করবে না। সেই রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করার জন্য এক দল অন্য দলের প্রতি বিরূপ আচরণ করেছে। এগুলোকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক আচরণ বা সাংবিধানিক আইন মেনে চলা বলা যায় না।
কিন্তু এবারের জুলাই সনদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এর ধারা ও উপধারা ধরে বিতর্ক করে কে পক্ষে আছে আর কে বিপক্ষে আছে, তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। সে কারণে বলতে চাই, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখার সঙ্গে এবারের জুলাই সনদটা অনেক অগ্রসর দলিল বলতে হবে। কোনো দল যদি এর কোনো বক্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে পালন করতে না চায়, তাহলে সব রাজনৈতিক দল তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। জুলাই সনদ একেবারেই সুনির্দিষ্ট। কিন্তু নব্বইয়ের রূপরেখা এভাবে সুনির্দিষ্ট ছিল না। আবার সেই রূপরেখার মধ্যে কোনো গভীরতা ছিল না। তারপরেও যে কিছু হয়নি, সেটা বলা যাবে না। কারণ, নব্বইয়ের পরে সব দল কিন্তু সংসদীয় সরকার পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে সেই সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার পরেও নানা অঘটন ঘটেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আসলে কোন দিকে যাচ্ছে?
এখন দ্রুত দরকার একটা সংসদ নির্বাচন করা। যে নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। এখন কোনো জবাবদিহি করা যাচ্ছে না। আমরা যেভাবে গত স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পেরেছি, এখন কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তা করতে পারছি না। এখন কোনো বিষয়ে সরকারের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করলে তারা বলে, কোনো কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আবার পুলিশও একই কথা বলছে।
রাজনৈতিক দলগুলো দেশটাকে ভাগাভাগি করার মতো করে কথা বলছে। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, আবার সবাই মিলে ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এখানে এখন একটা আজব পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা এ সরকার দিতে পারছে না। এ জন্য নির্বাচন করা দরকার। যদিও সুষ্ঠু নির্বাচন করা নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তারপরও নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তখন আমরা একটা রাজনৈতিক ব্যাকরণের মধ্যে প্রবেশ করতে পারব।
নির্বাচিত সরকার ভালো কাজ করলে পক্ষে থাকব আর মন্দ কাজ করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। আগে থেকে বলা সম্ভব নয়, যারা দায়িত্বে থাকবে তারা কতটুকু পারছে বা পারছে না। তারা যদি জনগণের পক্ষে না থাকে, তাহলে প্রয়োজনে আগাম নির্বাচন দাবি করব।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
আপনারা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নিলেন? আপনাদের মূল আপত্তিগুলো কী ছিল?
আমাদের প্রথম আপত্তি ছিল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত সংযুক্ত না করা। যেসব বিষয়ে সবাই মিলে একমত হয়েছি বা মোটামুটি একমত হয়েছি, সেসব যুক্ত করা ছাড়া আমরা স্বাক্ষর করব না। যেহেতু ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ কিছু বিষয়ে আপত্তি ছিল, সেটা স্বাক্ষর করলে তো মেনে নেওয়া হতো। সেটা জাতীয় সংসদে হলে অন্য কথা ছিল বা কোনো রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে সেটা হতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সেটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন সে রকম কোনো ফোরাম না। এটা হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্যে আসার জন্য একটা চেষ্টা, একটা উদ্যোগ।
জুলাই সনদ তৈরি করার সময় এর পটভূমি ধরে আমরা ইতিহাসকে সঠিকভাবে লেখার জন্য বারবার ইনপুট দিয়েছি। আমাদের দলসহ অন্য দলের নেতারা সেটা বলেছেন। কিন্তু সনদে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকে পুরোপুরি গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ছোট ছোট অনেক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা কীভাবে এল, সেটা তো থাকা দরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তো থাকতে হবে। যদিও বিশাল আকারে ইতিহাস লেখার জায়গা এটা না। শেষে আসবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা। এর মধ্যে মাঝখানের ঘটনাগুলো শুধু উল্লেখ করলেই চলত। সেটা তো করা হয়নি। যাঁরা খসড়াটি করেছেন, তাঁদের আমি অবশ্যই অযোগ্য বলব না। একেকজনের কথায় একেকটা বিষয় ঢুকে গেছে। কারও সঙ্গে তাঁরা বিতর্ক করেননি। ফলে আমাদের বক্তব্যগুলোকে বেমালুম বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মনে করেছেন, আমাদের বক্তব্য বাদ দিলে বুঝি কোনো সমস্যা হবে না। আবার কোনো কোনো দল যা-ই বলেছে, সেটাই তাঁরা রেখেছেন; যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বক্তব্য একপেশে হয়েছে।
আবার অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের কথা হলো, এই সনদ পরিপূর্ণ হলে সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলো লিপিবদ্ধ থাকত। কিন্তু সেসব রাখা হয়নি। সনদের ভেতরে আবার তাঁরা লিখেছেন—যে দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়া কাজ করতে পারবে। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, তারাও তো কাজ করবে। তারা প্রয়োজনবোধে একমত না হলে সংসদ ত্যাগ করবে। নতুবা সংসদের বাইরে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে জনগণের কাছে মতামত তুলে ধরবে। এসব তো ম্যান্ডেট পাওয়া না-পাওয়ার ওপর নির্ভর করে না।
এটা তো বিএনপির ভাষা। বিএনপি মনে করে, তারা ম্যান্ডেট নিয়ে আগামী সংসদে যাবে। সেটা ভালো কথা। কিন্তু আমরা ম্যান্ডেট পাব কি পাব না সেটা ভিন্ন কথা। আমরা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি চুপ না থাকার জন্য। আমরা যেমনভাবে সংসদের ভেতরে কথা বলব, তেমনি সংসদের বাইরেও কথা বলব। আমরা আবার রাজপথে আন্দোলনও করব। সবকিছু মিলিয়ে আমরা কয়েকটি বামপন্থী দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করিনি।
তবে আমরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি, যেসব বিষয়ে আমরা সহমত জ্ঞাপন করেছি (সেটার রেকর্ড আছে) সেটা খুব ভালো কাজ হয়েছে। আমরা ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই যে সাংবিধানিক প্রশ্ন, আইনের প্রশ্নসহ সংস্কার নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে তারা একটা ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করতে পেরেছে। এই দলিল থেকে বোঝা যাবে, কোন দলের কী দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু আমরা বলেছি, গায়ের জোরে সংবিধান বাতিল করার দাবি—এটা অসাংবিধানিক অপরাধ। আমরা মনে করি, সংবিধান বাতিল করার দাবি তোলা যাবে এবং নতুন সংবিধান করার দাবিও তোলা যাবে—সেটা রাষ্ট্রদ্রোহ হবে না। কিন্তু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যদি বাতিল করতে চায়, সেটা অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ। তারা ৭ (ক) ধারার বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। এটা নিয়ে আমরা আপত্তি করেছি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষে আমরা পিআর পদ্ধতির পক্ষে, কিন্তু দুই বাসদ ও সিপিবি উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে না।
তবে আমরা যে কয়েকটি বাম দল এসব বিষয়ে একমত হয়েছি, আমরা আগামী দিনে সংসদের ভেতরে ও বাইরে এসব নিয়ে সংগ্রাম এবং রাজনৈতিকভাবে জনমত গঠনের কাজ করব। সেটা আমরা অঙ্গীকার করেছি।
এরপর আপনারা একটা স্মারকলিপি দিয়েছেন। এটা দেওয়ার কারণ কী?
আমরা কেন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলাম না, সেটা নিয়ে আমরা একটা সংবাদ সম্মেলন করেছি। সেই সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যটা আমাদের দুজন প্রতিনিধি হাতে হাতে ঐকমত্য কমিশনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
স্মারকলিপি দেওয়ার পর ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য কী?
তারা বলেছে, আপনারা অনেক কষ্ট করে, সময় নিয়ে বক্তব্য বা নোট দিয়েছেন, আপনারা এটার অংশীদার হন। আমরা বলেছি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে কেন আমরা আত্মসমর্পণ করব মৌলিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে? বিএনপি যেমন প্রত্যাশা করছে, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। তারাসহ তাদের মিত্ররা দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাবে। তারা যেসব নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সেগুলোতে তারা পক্ষে নিতে পারে। কিন্তু সংসদে যাওয়ার আগেই আমাদের মেনে নিতে হবে, সংবিধান বাতিলের ১৪ ধারা রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ না, নারী ১০০ আসনে সরাসরি নির্বাচনের দরকার নেই, সংবিধানের ১৫০ (২) ধারা মতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ না থাকা—এ বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে তো আমরা সনদে স্বাক্ষর করে দাসখত দিতে পারি না। এই ফাঁদেও পা দিতে পারি না। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, এসব বিষয় যদি সংশোধন না করা হয়, তাহলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারি না।
এনসিপি সনদের বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্ন নিয়ে স্বাক্ষর করেনি। এটাকে আপনারা কীভাবে দেখেন?
তাদের তো সনদ নিয়ে কোনো দাবি নেই। তারা সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে। আমাদের তো সনদের খসড়া নিয়েই আপত্তি। কিন্তু তাদের কোনো আপত্তি নেই। তারা শুধু বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিতর্ক তুলে স্বাক্ষর করেনি।
আপনি নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ছিলেন। সে সময়ে তিন জোটের রূপরেখাকে পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন কোনো দলই গুরুত্ব দেয়নি। এখন আপনি জুলাই সনদ নিয়ে কতটা আশাবাদী?
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখাকে নির্দিষ্ট করে সংবিধানের সঙ্গে আপগ্রেড করা হয়নি। সে সময় যে তিনটি জোট এই রূপরেখাতে স্বাক্ষর করেছিল, তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার অনেক কিছুই মানেনি। তারা সেখানকার রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। তা ছাড়া, এটার কোনো আইনি রূপও দেওয়া হয়নি। কথা ছিল তারা পরস্পরের প্রতি কোনো বৈরী আচরণ করবে না। সেই রাজনৈতিক অঙ্গীকারও পালন করেনি। পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করার জন্য এক দল অন্য দলের প্রতি বিরূপ আচরণ করেছে। এগুলোকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক আচরণ বা সাংবিধানিক আইন মেনে চলা বলা যায় না।
কিন্তু এবারের জুলাই সনদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এর ধারা ও উপধারা ধরে বিতর্ক করে কে পক্ষে আছে আর কে বিপক্ষে আছে, তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। সে কারণে বলতে চাই, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখার সঙ্গে এবারের জুলাই সনদটা অনেক অগ্রসর দলিল বলতে হবে। কোনো দল যদি এর কোনো বক্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে পালন করতে না চায়, তাহলে সব রাজনৈতিক দল তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। জুলাই সনদ একেবারেই সুনির্দিষ্ট। কিন্তু নব্বইয়ের রূপরেখা এভাবে সুনির্দিষ্ট ছিল না। আবার সেই রূপরেখার মধ্যে কোনো গভীরতা ছিল না। তারপরেও যে কিছু হয়নি, সেটা বলা যাবে না। কারণ, নব্বইয়ের পরে সব দল কিন্তু সংসদীয় সরকার পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে সেই সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার পরেও নানা অঘটন ঘটেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আসলে কোন দিকে যাচ্ছে?
এখন দ্রুত দরকার একটা সংসদ নির্বাচন করা। যে নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে। এখন কোনো জবাবদিহি করা যাচ্ছে না। আমরা যেভাবে গত স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পেরেছি, এখন কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তা করতে পারছি না। এখন কোনো বিষয়ে সরকারের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করলে তারা বলে, কোনো কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আবার পুলিশও একই কথা বলছে।
রাজনৈতিক দলগুলো দেশটাকে ভাগাভাগি করার মতো করে কথা বলছে। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, আবার সবাই মিলে ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এখানে এখন একটা আজব পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা এ সরকার দিতে পারছে না। এ জন্য নির্বাচন করা দরকার। যদিও সুষ্ঠু নির্বাচন করা নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তারপরও নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তখন আমরা একটা রাজনৈতিক ব্যাকরণের মধ্যে প্রবেশ করতে পারব।
নির্বাচিত সরকার ভালো কাজ করলে পক্ষে থাকব আর মন্দ কাজ করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করব। আগে থেকে বলা সম্ভব নয়, যারা দায়িত্বে থাকবে তারা কতটুকু পারছে বা পারছে না। তারা যদি জনগণের পক্ষে না থাকে, তাহলে প্রয়োজনে আগাম নির্বাচন দাবি করব।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে...
১৫ আগস্ট ২০২২
কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত।
১৭ ঘণ্টা আগে
পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
১৮ ঘণ্টা আগে
মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার...
২ দিন আগেমৃত্যুঞ্জয় রায়

কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত। আহা, কী পরিষ্কার সেই খালের জল, কোথাও একটা শুকনো পাতা পড়ে নেই জলের ওপর। খালের পাড়ে স্বর্ণচাঁপা, বকুল, কাঠবাদাম, চালতা, ছাতিম গাছগুলোর ছত্রবৎ পত্রাচ্ছাদন, গোড়া বাঁধানো নারকেলগাছের সারি। খালের জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, লাফ দিচ্ছে মাছেরা। মাঝে মাঝে পাড়ে রয়েছে জলের ওপর বাড়ানো জেটির মতো রেলিংঘেরা পাকা চাতাল, যার ওপর দাঁড়িয়ে জলের কাছে যাওয়া যায়, খালের জলে বড়শি ফেলে মাছ ধরা যায়। ওপরে হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশ, রোদের ঝিলিক। খালের পশ্চিম পাড়ে একটি অভিজাত এলাকার মনোরম ভবন। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন ঢাকা শহর নয়—নেদারল্যান্ডসের কোনো এক জায়গা।
নেদারল্যান্ডসের গিথুর্ন গ্রামের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা হয়তো জানেন, সেই গ্রামে গাড়ি চালানোর মতো কোনো রাস্তা নেই, আছে গ্রামজুড়ে চলাচলের জন্য চমৎকার খাল আর হাঁটার পথ। একটা গ্রামে কোনো গাড়ির রাস্তা নেই, খাল ও খালের ওপর আছে ১৭০টির বেশি সেতু। বৈদ্যুতিক নৌকায় করে সেই গ্রামের অধিবাসীরা এখান থেকে সেখানে যায়। আহা, গাড়ি ও জ্বালানির দূষণমুক্ত কী শান্ত মনোরম সে গ্রাম! খালের পাড় বাঁধানো, দুই পাড়ে থাকা অনুচ্চ ঘরবাড়ি, আঙিনার কোথাও কোনো খোলা মাটি নেই, পুরোটাই সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসে ঢাকা, মাঝে মাঝে ফুলগাছের ঝোপ। যেন সে এক স্বপ্নের জায়গা, পৃথিবীর বুকেই স্বর্গের শোভা। ঢাকার এ জায়গাটি দেখেও সেই গিথুর্ন গ্রামের ছবিটা চোখে ভাসছিল। ধন্যবাদ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে—নিকুঞ্জ খালের এমন সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য।
আহা রে, ঢাকা শহরের সব খাল যদি এরূপ সুন্দর হতো! এ কথা ভাবতেই মনের মধ্যে ভেসে উঠল এর বিপরীত দৃশ্য। খাল দখল করতে করতে সেগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যতটুকু অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও হয়ে পড়েছে ময়লার ভাগাড়, কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ে ভরা মশককুলের অভয়ারণ্য। বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নির্গমনের নিকাশনালার মতো ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো কোনো খাল। পচা দুর্গন্ধযুক্ত অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশেই কেটে যাচ্ছে পথচারী ও এলাকাবাসীর দিনকাল। খালগুলো যেভাবে মরতে বসেছে, তাতে আগামী ১০ বছরও লাগবে না ঢাকা শহর খালশূন্য হতে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরে খালের সংখ্যা ৪৭টি। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী ৫৬টি। ড্যাপেও খালের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৪৩টি।
ধরা হয়, অতীতে ঢাকা শহরে ৪৭টি খাল সচল ছিল। শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেসব খাল। নৌকা ও নৌযান চলত সেসব খালে। পণ্য পরিবহন ও লোক চলাচলে সে সময় খালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। একসময় শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত একটি খাল ছিল—পরীবাগ খাল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে তার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সেই খাল আর এখন নেই। এভাবে ধোলাই খাল, রায়েরবাজার, গোপীবাগ, নারিন্দা, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি ইত্যাদি খালগুলোরও এখন আর অস্তিত্ব নেই। ধানমন্ডি লেকটাই একসময় ছিল খাল, হাতিরঝিলের খালে পিলখানা থেকে হাতির পালকে নিয়ে যাওয়া হতো গোসল করাতে। মোগল শাসকেরা ঢাকা শহরে বহুসংখ্যক খাল থাকায় ঢাকাকে রাজধানী করার চিন্তা করেছিল, খালগুলো তাদের চলাচল ও প্রতিরক্ষার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শহরের জলাবদ্ধতা দূর ও পানি নিষ্কাশনের জন্যও ছিল সেগুলো সহায়ক। সেসব এখন ইতিহাস। এখন এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়।
ঢাকা শহরের সব খাল উদ্ধার করা প্রথম কাজ। উদ্ধারের পর সেসব খালের দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে বা হাঁটার পথ তৈরি ও বাহারি গাছপালা লাগিয়ে সুশোভন করা দ্বিতীয় কাজ। তৃতীয় কাজ হলো খালগুলোতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যাটারি, বিদ্যুৎ ও হস্তচালিত নৌযান চালনার উদ্যোগ নেওয়া। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কোনো নৌযান সেসব খালে চলাচলের অনুমতি না দেওয়া হবে খালের জলজ জীবগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা এবং দূষণ কমানোর গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ওয়াকওয়ে যেন শুধু ওয়াক তথা হাঁটার জন্যই ব্যবহৃত হয়, সে রাস্তায় যেন কোনো গাড়ি বা মোটরসাইকেল না চলে। সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো খাল এবং তার চারপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখতে উত্তম ব্যবস্থাপনার চর্চা অব্যাহত রাখা। খাল ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে সেখানকার সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণই এসব ব্যবস্থাপনাকে সুচারুরূপে বাস্তবায়নের মূল সূত্র, এর সঙ্গে থাকবে সঠিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনা, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনার প্রচারণা। এ কাজে দরকার রাষ্ট্রীয় বা সরকারের সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং জনগণের অংশগ্রহণ। অনেক তরুণ এখন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এরূপ কাজে অংশ নিতে আগ্রহী। তাদের উৎসাহিত করে নিরাপদভাবে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত মালি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ করবেন জবাবদিহির মধ্যে, স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মিলেমিশে। শোভাবর্ধনের চারাগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে সিটি করপোরেশনগুলোকেই। তবে এককভাবে শুধু দুই সিটি করপোরেশনের ওপর সম্পূর্ণ বিষয়টি চাপিয়ে দিলে হবে না। খালগুলোর দখলদারেরা অনেক শক্তিশালী, নিশ্চিত যে তাঁরা কেউই সেসব খালের দখল স্বেচ্ছায় ছাড়বেন না। দখলমুক্ত করার জন্য জোর প্রশাসনিক প্রচেষ্টা ও আইন প্রয়োগ করা দরকার।
প্রকৃতিতে প্রবহমান নদী আর খালগুলো হলো আমাদের দেহের শিরা-উপশিরার মতো। একটি ভূখণ্ডের জীবনরেখা বলা হয় এসব জলস্রোতকে। প্রবহমান এসব জলাশয় যেমন জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মাটিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও সহায়ক। ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও খালগুলোকে সচল করা দরকার। বর্তমানে ঢাকা শহরে ২৬টি খালের অস্তিত্ব চোখে দেখা গেলেও বাকি ২১টি খাল নেই। কোথায় কোথায় সেসব খাল ছিল, তা নিশ্চয় অতীতের মানচিত্রগুলোতে পাওয়া যাবে। সেগুলো আদৌ উদ্ধার বা দখলমুক্ত করা যাবে, তা দুরাশা। উদ্ধার করা গেলে সেগুলো খনন করে সচল ও শোভাময় করা উচিত। জার্মানির বার্লিন শহরে খালে করে ক্যানালক্রুজ করার সময় খালপাড়ের দুই পাশের বিভিন্ন স্থাপনা ও নাগরিক সৌন্দর্য, সেতু, রেস্তোরাঁ দেখতে দেখতে অভিভূত হতাম। ভাবতাম, জলের দেশ, নদীর দেশ, খালের দেশ বাংলাদেশ; অথচ সে দেশের শহরগুলোর খালে কেন এ রকম নৌ-পর্যটন করা যাবে না?
খালপাড় ভেঙে যাতে কোনো নগরবাসীর এক ফুট জমিও নষ্ট না হয়, সে জন্য ভেনিস, কোপেনহেগেন, প্যারিস ইত্যাদি শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল ও নদীর দুই পাড় যেভাবে পাকা করে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে, সেভাবে আমাদের প্রবহমান খালগুলোর পাড়ও বেঁধে দেওয়া যায়। নগরীর খালগুলো নিয়ে একটি চমৎকার পরিকল্পনার সুযোগ রয়েছে ড্যাপ বাস্তবায়নের কারণে। চলাচল, পরিবহন, জলাবদ্ধতা নিরসন, দূষণ হ্রাস, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পর্যটন, সৌন্দর্যবর্ধন, স্থানীয় মানুষের আয়বর্ধন, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা ও জরিপকাজ নিশ্চয় সহায়ক হবে। সবার মনে রাখা উচিত, প্রাকৃতিক প্রবাহকে রুদ্ধ করার অধিকার কারও নেই, তার ফল কখনো ভালো হয় না। এ নিয়ে কোনো খণ্ডিত পরিকল্পনা নয়, নিতে হবে সমন্বিত সামগ্রিক পরিকল্পনা। তাহলে আমরাও দেখতে পাব একটি মনোরম মহানগর, সুশোভিত খালসমৃদ্ধ একটি সুশোভন পরিবেশ। কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে নিকুঞ্জ খালটি যদি এত সুন্দর করা যায়, সুন্দর রাখা যায়, তাহলে অন্যগুলো কেন এরূপ সুন্দর হবে না?
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক
আরও খবর পড়ুন:

কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত। আহা, কী পরিষ্কার সেই খালের জল, কোথাও একটা শুকনো পাতা পড়ে নেই জলের ওপর। খালের পাড়ে স্বর্ণচাঁপা, বকুল, কাঠবাদাম, চালতা, ছাতিম গাছগুলোর ছত্রবৎ পত্রাচ্ছাদন, গোড়া বাঁধানো নারকেলগাছের সারি। খালের জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, লাফ দিচ্ছে মাছেরা। মাঝে মাঝে পাড়ে রয়েছে জলের ওপর বাড়ানো জেটির মতো রেলিংঘেরা পাকা চাতাল, যার ওপর দাঁড়িয়ে জলের কাছে যাওয়া যায়, খালের জলে বড়শি ফেলে মাছ ধরা যায়। ওপরে হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশ, রোদের ঝিলিক। খালের পশ্চিম পাড়ে একটি অভিজাত এলাকার মনোরম ভবন। দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন ঢাকা শহর নয়—নেদারল্যান্ডসের কোনো এক জায়গা।
নেদারল্যান্ডসের গিথুর্ন গ্রামের ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা হয়তো জানেন, সেই গ্রামে গাড়ি চালানোর মতো কোনো রাস্তা নেই, আছে গ্রামজুড়ে চলাচলের জন্য চমৎকার খাল আর হাঁটার পথ। একটা গ্রামে কোনো গাড়ির রাস্তা নেই, খাল ও খালের ওপর আছে ১৭০টির বেশি সেতু। বৈদ্যুতিক নৌকায় করে সেই গ্রামের অধিবাসীরা এখান থেকে সেখানে যায়। আহা, গাড়ি ও জ্বালানির দূষণমুক্ত কী শান্ত মনোরম সে গ্রাম! খালের পাড় বাঁধানো, দুই পাড়ে থাকা অনুচ্চ ঘরবাড়ি, আঙিনার কোথাও কোনো খোলা মাটি নেই, পুরোটাই সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসে ঢাকা, মাঝে মাঝে ফুলগাছের ঝোপ। যেন সে এক স্বপ্নের জায়গা, পৃথিবীর বুকেই স্বর্গের শোভা। ঢাকার এ জায়গাটি দেখেও সেই গিথুর্ন গ্রামের ছবিটা চোখে ভাসছিল। ধন্যবাদ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে—নিকুঞ্জ খালের এমন সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য।
আহা রে, ঢাকা শহরের সব খাল যদি এরূপ সুন্দর হতো! এ কথা ভাবতেই মনের মধ্যে ভেসে উঠল এর বিপরীত দৃশ্য। খাল দখল করতে করতে সেগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যতটুকু অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও হয়ে পড়েছে ময়লার ভাগাড়, কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ে ভরা মশককুলের অভয়ারণ্য। বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নির্গমনের নিকাশনালার মতো ব্যবহৃত হচ্ছে কোনো কোনো খাল। পচা দুর্গন্ধযুক্ত অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশেই কেটে যাচ্ছে পথচারী ও এলাকাবাসীর দিনকাল। খালগুলো যেভাবে মরতে বসেছে, তাতে আগামী ১০ বছরও লাগবে না ঢাকা শহর খালশূন্য হতে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরে খালের সংখ্যা ৪৭টি। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী ৫৬টি। ড্যাপেও খালের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৪৩টি।
ধরা হয়, অতীতে ঢাকা শহরে ৪৭টি খাল সচল ছিল। শহরের চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেসব খাল। নৌকা ও নৌযান চলত সেসব খালে। পণ্য পরিবহন ও লোক চলাচলে সে সময় খালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। একসময় শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত একটি খাল ছিল—পরীবাগ খাল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে তার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সেই খাল আর এখন নেই। এভাবে ধোলাই খাল, রায়েরবাজার, গোপীবাগ, নারিন্দা, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, ধানমন্ডি ইত্যাদি খালগুলোরও এখন আর অস্তিত্ব নেই। ধানমন্ডি লেকটাই একসময় ছিল খাল, হাতিরঝিলের খালে পিলখানা থেকে হাতির পালকে নিয়ে যাওয়া হতো গোসল করাতে। মোগল শাসকেরা ঢাকা শহরে বহুসংখ্যক খাল থাকায় ঢাকাকে রাজধানী করার চিন্তা করেছিল, খালগুলো তাদের চলাচল ও প্রতিরক্ষার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শহরের জলাবদ্ধতা দূর ও পানি নিষ্কাশনের জন্যও ছিল সেগুলো সহায়ক। সেসব এখন ইতিহাস। এখন এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়।
ঢাকা শহরের সব খাল উদ্ধার করা প্রথম কাজ। উদ্ধারের পর সেসব খালের দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে বা হাঁটার পথ তৈরি ও বাহারি গাছপালা লাগিয়ে সুশোভন করা দ্বিতীয় কাজ। তৃতীয় কাজ হলো খালগুলোতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যাটারি, বিদ্যুৎ ও হস্তচালিত নৌযান চালনার উদ্যোগ নেওয়া। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কোনো নৌযান সেসব খালে চলাচলের অনুমতি না দেওয়া হবে খালের জলজ জীবগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা এবং দূষণ কমানোর গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ওয়াকওয়ে যেন শুধু ওয়াক তথা হাঁটার জন্যই ব্যবহৃত হয়, সে রাস্তায় যেন কোনো গাড়ি বা মোটরসাইকেল না চলে। সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো খাল এবং তার চারপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখতে উত্তম ব্যবস্থাপনার চর্চা অব্যাহত রাখা। খাল ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে সেখানকার সব অংশীজনের সক্রিয় অংশগ্রহণই এসব ব্যবস্থাপনাকে সুচারুরূপে বাস্তবায়নের মূল সূত্র, এর সঙ্গে থাকবে সঠিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনা, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনার প্রচারণা। এ কাজে দরকার রাষ্ট্রীয় বা সরকারের সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং জনগণের অংশগ্রহণ। অনেক তরুণ এখন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে এরূপ কাজে অংশ নিতে আগ্রহী। তাদের উৎসাহিত করে নিরাপদভাবে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত মালি ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কাজ করবেন জবাবদিহির মধ্যে, স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে মিলেমিশে। শোভাবর্ধনের চারাগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে সিটি করপোরেশনগুলোকেই। তবে এককভাবে শুধু দুই সিটি করপোরেশনের ওপর সম্পূর্ণ বিষয়টি চাপিয়ে দিলে হবে না। খালগুলোর দখলদারেরা অনেক শক্তিশালী, নিশ্চিত যে তাঁরা কেউই সেসব খালের দখল স্বেচ্ছায় ছাড়বেন না। দখলমুক্ত করার জন্য জোর প্রশাসনিক প্রচেষ্টা ও আইন প্রয়োগ করা দরকার।
প্রকৃতিতে প্রবহমান নদী আর খালগুলো হলো আমাদের দেহের শিরা-উপশিরার মতো। একটি ভূখণ্ডের জীবনরেখা বলা হয় এসব জলস্রোতকে। প্রবহমান এসব জলাশয় যেমন জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মাটিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও সহায়ক। ঢাকা শহরের প্রায় দুই কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও খালগুলোকে সচল করা দরকার। বর্তমানে ঢাকা শহরে ২৬টি খালের অস্তিত্ব চোখে দেখা গেলেও বাকি ২১টি খাল নেই। কোথায় কোথায় সেসব খাল ছিল, তা নিশ্চয় অতীতের মানচিত্রগুলোতে পাওয়া যাবে। সেগুলো আদৌ উদ্ধার বা দখলমুক্ত করা যাবে, তা দুরাশা। উদ্ধার করা গেলে সেগুলো খনন করে সচল ও শোভাময় করা উচিত। জার্মানির বার্লিন শহরে খালে করে ক্যানালক্রুজ করার সময় খালপাড়ের দুই পাশের বিভিন্ন স্থাপনা ও নাগরিক সৌন্দর্য, সেতু, রেস্তোরাঁ দেখতে দেখতে অভিভূত হতাম। ভাবতাম, জলের দেশ, নদীর দেশ, খালের দেশ বাংলাদেশ; অথচ সে দেশের শহরগুলোর খালে কেন এ রকম নৌ-পর্যটন করা যাবে না?
খালপাড় ভেঙে যাতে কোনো নগরবাসীর এক ফুট জমিও নষ্ট না হয়, সে জন্য ভেনিস, কোপেনহেগেন, প্যারিস ইত্যাদি শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল ও নদীর দুই পাড় যেভাবে পাকা করে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে, সেভাবে আমাদের প্রবহমান খালগুলোর পাড়ও বেঁধে দেওয়া যায়। নগরীর খালগুলো নিয়ে একটি চমৎকার পরিকল্পনার সুযোগ রয়েছে ড্যাপ বাস্তবায়নের কারণে। চলাচল, পরিবহন, জলাবদ্ধতা নিরসন, দূষণ হ্রাস, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পর্যটন, সৌন্দর্যবর্ধন, স্থানীয় মানুষের আয়বর্ধন, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদির জন্য এ ধরনের পরিকল্পনা ও জরিপকাজ নিশ্চয় সহায়ক হবে। সবার মনে রাখা উচিত, প্রাকৃতিক প্রবাহকে রুদ্ধ করার অধিকার কারও নেই, তার ফল কখনো ভালো হয় না। এ নিয়ে কোনো খণ্ডিত পরিকল্পনা নয়, নিতে হবে সমন্বিত সামগ্রিক পরিকল্পনা। তাহলে আমরাও দেখতে পাব একটি মনোরম মহানগর, সুশোভিত খালসমৃদ্ধ একটি সুশোভন পরিবেশ। কুড়িল বিশ্বরোডের কাছে নিকুঞ্জ খালটি যদি এত সুন্দর করা যায়, সুন্দর রাখা যায়, তাহলে অন্যগুলো কেন এরূপ সুন্দর হবে না?
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক
আরও খবর পড়ুন:

মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে...
১৫ আগস্ট ২০২২
ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন।
১৭ ঘণ্টা আগে
পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
১৮ ঘণ্টা আগে
মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার...
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
বহু প্রচার করার পরও কোথাও কোথাও অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিবারের পক্ষ থেকে। কোথাও কোথাও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, কোথাও কোথাও তৈরি হচ্ছে না। অনেকে ভুলে যাচ্ছেন, কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের বিয়ের পিঁড়িতে না বসানোই মঙ্গল।
বাল্যবিবাহের শিকার অল্প বয়সী মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে না। এতে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, পুষ্টিহীনতা এবং প্রসবজনিত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সে সন্তানের মা হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনেক সময় তারা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ে। সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ নষ্ট হয়। আত্মনির্ভরশীল হতে না পারার কারণে সংসারে নানা ধরনের সংকটে তাদের পড়তে হয়। শিক্ষাবঞ্চিত ও অল্প বয়সে সংসার শুরু করা মেয়েরা সাধারণত আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকে। এতে পরিবারে দারিদ্র্য দূর হয় না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা চলতে থাকে।
এতে যে নারীর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেটাও বিবেচনায় আনা দরকার। বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে নিজস্ব মতামত-সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বাধীন জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সামাজিকভাবে সে হেয় হতে থাকে। সংসারে তার মতামতের কোনো মূল্য থাকে না। পুরুষশাসিত সমাজে এমনিতেই মেয়েরা থাকে কোণঠাসা হয়ে, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটি সে ক্ষেত্রে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। এ যেন তার ব্যাপারে সামাজিক নিপীড়নের জন্য একটি মুক্ত জায়গা হয়ে দেখা দেয়।
একজন মানুষ যেন মুক্ত, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সমাজে অর্থনৈতিক অবদান রাখার মতো করে নিজেকে তৈরি করে নিতে পারে, সেসব দিক বিবেচনা করা না হলে সংকটে পড়ে রাষ্ট্র।
পিরোজপুরের নেছারাবাদের ঘটনাটি আশার আলো জাগায়। যদিও ইউএনও বিয়ের অনুষ্ঠানে বাধা দেননি, তবু তিনি সেখানে অংশ না নিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ চলে যাওয়ায় বিয়েটা হয়নি বলে একটি ভালো কাজ হয়েছে। যখন সমাজের একটি বড় অংশ অল্প বয়সে বিবাহ ও মাতৃত্বে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে না। ফলে জাতির অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক যে মেয়েটি অভিভাবকদের কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছিল, এখন হয়তোবা সে তা থেকে মুক্ত হবে। অভিভাবকেরাও সচেতন হয়ে এই শিশুকে শারীরিক, মানসিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারেন। তাতে একটি সমৃদ্ধ ও সমানাধিকারের সমাজ গঠিত হওয়ার পথে তাঁরা অবদান রাখতে পারেন।
আরও খবর পড়ুন:

পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
বহু প্রচার করার পরও কোথাও কোথাও অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিবারের পক্ষ থেকে। কোথাও কোথাও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, কোথাও কোথাও তৈরি হচ্ছে না। অনেকে ভুলে যাচ্ছেন, কেন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের বিয়ের পিঁড়িতে না বসানোই মঙ্গল।
বাল্যবিবাহের শিকার অল্প বয়সী মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে না। এতে মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, পুষ্টিহীনতা এবং প্রসবজনিত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম বয়সে সন্তানের মা হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং অনেক সময় তারা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ে। সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ নষ্ট হয়। আত্মনির্ভরশীল হতে না পারার কারণে সংসারে নানা ধরনের সংকটে তাদের পড়তে হয়। শিক্ষাবঞ্চিত ও অল্প বয়সে সংসার শুরু করা মেয়েরা সাধারণত আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকে। এতে পরিবারে দারিদ্র্য দূর হয় না, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা চলতে থাকে।
এতে যে নারীর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেটাও বিবেচনায় আনা দরকার। বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে নিজস্ব মতামত-সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বাধীন জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সামাজিকভাবে সে হেয় হতে থাকে। সংসারে তার মতামতের কোনো মূল্য থাকে না। পুরুষশাসিত সমাজে এমনিতেই মেয়েরা থাকে কোণঠাসা হয়ে, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটি সে ক্ষেত্রে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। এ যেন তার ব্যাপারে সামাজিক নিপীড়নের জন্য একটি মুক্ত জায়গা হয়ে দেখা দেয়।
একজন মানুষ যেন মুক্ত, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, সমাজে অর্থনৈতিক অবদান রাখার মতো করে নিজেকে তৈরি করে নিতে পারে, সেসব দিক বিবেচনা করা না হলে সংকটে পড়ে রাষ্ট্র।
পিরোজপুরের নেছারাবাদের ঘটনাটি আশার আলো জাগায়। যদিও ইউএনও বিয়ের অনুষ্ঠানে বাধা দেননি, তবু তিনি সেখানে অংশ না নিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ চলে যাওয়ায় বিয়েটা হয়নি বলে একটি ভালো কাজ হয়েছে। যখন সমাজের একটি বড় অংশ অল্প বয়সে বিবাহ ও মাতৃত্বে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে না। ফলে জাতির অগ্রগতিতেও বাধা সৃষ্টি হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক যে মেয়েটি অভিভাবকদের কারণে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছিল, এখন হয়তোবা সে তা থেকে মুক্ত হবে। অভিভাবকেরাও সচেতন হয়ে এই শিশুকে শারীরিক, মানসিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারেন। তাতে একটি সমৃদ্ধ ও সমানাধিকারের সমাজ গঠিত হওয়ার পথে তাঁরা অবদান রাখতে পারেন।
আরও খবর পড়ুন:

মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে...
১৫ আগস্ট ২০২২
ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন।
১৭ ঘণ্টা আগে
কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত।
১৭ ঘণ্টা আগে
মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার...
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার—তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ভাববেন। এ রকম একটা অবস্থায় দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়টিতে স্থানীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে মোটেও অনুকূল থাকে না, সেটা বোঝা দরকার।
সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেদক শিয়ালবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক গুদামে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে এখনো অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। রাসায়নিকের ড্রাম থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। প্রায়ই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-এক দিন সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়, তারপর একসময় সেটা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু যে মানুষেরা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতিটি দিনই যে কাটছে ভয়ংকর রাসায়নিকের সঙ্গে লড়াই করে, সে খবর কয়জন রাখে?
চিকিৎসকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পরও বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার ঘনত্ব বেশি থাকে। পরে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ ভুক্তভোগীর শরীরে ঢোকে। ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যতেও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।
বিষাক্ত কণিকা বা গ্যাস মানবদেহে ঢোকে শ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের মাধ্যমে এবং খাদ্যের মাধ্যমে। এই গ্যাস অ্যাজমা, কাশি, গলাজ্বলা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চোখ আর ত্বকও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তৈরি হতে পারে মাথাব্যথা, বমি ও ক্লান্তির মতো ঘটনা। ভারী ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
শিয়ালবাড়ীর দুর্ঘটনাস্থলের অন্তত এক হাজার গজ পর্যন্ত এলাকায় বাতাসে এখনো পোড়া জিনিস ও গ্যাসের মতো কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখনো রয়েছে সংকটের মুখে।
আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু দেশের মানুষ এ কথাও জানে, সেই মৌলিক অধিকার সব সময় সমুন্নত রাখা হয় না। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি কয়টি গুদামে আছে? এসব জায়গায় কি নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়? শুধু গুদাম কেন, কারখানাগুলোয় কি সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে? শ্রমিকেরা কি নিরাপদে তাঁদের কাজ করে যেতে পারেন?
এসব দুর্ঘটনায় মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা বিপদে পড়েন। তাঁদের পাশে যদি দাঁড়ানো না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, শিল্প-ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে, তা নিরসনের কোনো চিন্তা কারও নেই।

মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় একটি রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, সে কথা সবাই এখন জানেন। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা জানেন এটা তাঁদের পরিবারের জন্য কত বড় ক্ষতি। নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে কি না, তাদের জীবনে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে কী করা দরকার—তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই ভাববেন। এ রকম একটা অবস্থায় দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে খুব কম মানুষই মাথা ঘামায়। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়টিতে স্থানীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি যে মোটেও অনুকূল থাকে না, সেটা বোঝা দরকার।
সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেদক শিয়ালবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক গুদামে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন, এতগুলো দিন পার হওয়ার পরও বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে এখনো অসুস্থ হচ্ছে মানুষ। রাসায়নিকের ড্রাম থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়া মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছেন ঝুঁকির মধ্যে। প্রায়ই দেখা যায়, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর দু-এক দিন সংবাদপত্রে রিপোর্ট হয়, তারপর একসময় সেটা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু যে মানুষেরা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতিটি দিনই যে কাটছে ভয়ংকর রাসায়নিকের সঙ্গে লড়াই করে, সে খবর কয়জন রাখে?
চিকিৎসকেরা বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পরও বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার ঘনত্ব বেশি থাকে। পরে ধীরে ধীরে তা কমে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ ভুক্তভোগীর শরীরে ঢোকে। ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। এই কারণে ভবিষ্যতেও তা বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।
বিষাক্ত কণিকা বা গ্যাস মানবদেহে ঢোকে শ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের মাধ্যমে এবং খাদ্যের মাধ্যমে। এই গ্যাস অ্যাজমা, কাশি, গলাজ্বলা বা শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। চোখ আর ত্বকও তাতে আক্রান্ত হতে পারে। তৈরি হতে পারে মাথাব্যথা, বমি ও ক্লান্তির মতো ঘটনা। ভারী ধাতু দীর্ঘ মেয়াদে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে।
শিয়ালবাড়ীর দুর্ঘটনাস্থলের অন্তত এক হাজার গজ পর্যন্ত এলাকায় বাতাসে এখনো পোড়া জিনিস ও গ্যাসের মতো কটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখনো রয়েছে সংকটের মুখে।
আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক অধিকারের একটি। কিন্তু দেশের মানুষ এ কথাও জানে, সেই মৌলিক অধিকার সব সময় সমুন্নত রাখা হয় না। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি কয়টি গুদামে আছে? এসব জায়গায় কি নিয়মিত ইন্সপেকশন হয়? শুধু গুদাম কেন, কারখানাগুলোয় কি সঠিক নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে? শ্রমিকেরা কি নিরাপদে তাঁদের কাজ করে যেতে পারেন?
এসব দুর্ঘটনায় মূলত সমাজের নিচুতলার মানুষেরা বিপদে পড়েন। তাঁদের পাশে যদি দাঁড়ানো না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, শিল্প-ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে, তা নিরসনের কোনো চিন্তা কারও নেই।

মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের জন্য যা যা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা সরকারের কাছে আর কী প্রত্যাশা থাকতে পারে? তথাপি একদল ষড়যন্ত্রকারী, ক্ষমতালোভী বিপথগামী ব্যক্তি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে...
১৫ আগস্ট ২০২২
ডা. মুশতাক হোসেন এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। পেশাজীবনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন।
১৭ ঘণ্টা আগে
কুড়িল বিশ্বরোডের ফুটওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে একটি খালের চমৎকার শোভা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ঢাকার বুকে এত সুন্দর একটা খাল! ধনুকের মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দূরে, দুই পাড়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তা আর খালের পানির মাঝে সবুজ ঢাল সিঙ্গাপুর ডেইজির শায়িত লতায় আচ্ছাদিত।
১৭ ঘণ্টা আগে
পিরোজপুরের নেছারাবাদে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য ইউএনও সাহেব ধন্যবাদ পেতেই পারেন। সেখানে একটি বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন তিনি সপরিবারে। কিন্তু যখন জানতে পারলেন, বিয়ের কনে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তখন তিনি না খেয়েই ফিরে আসেন। এবং তিনি ফিরে আসায় কাজিও বিয়ে পড়াননি। ফলে এই বাল্যবিবাহ হয়নি।
১৮ ঘণ্টা আগে