রাখাইন পরিস্থিতি
এ কে এম শামসুদ্দিন

বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকা বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে রাখাইনের ১৭টি শহরের ভেতর ১৪টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে আরাকান আর্মি দাবি করছে। দখল করা শহরের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মংডু, বুথিডাং এবং চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন তাদের হাতে। যদিও পালেতোয়ার সঙ্গে ভারতেরও সীমান্ত রয়েছে। এই তিনটি শহর দখলে নেওয়ার পর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আরাকান আর্মি প্রচণ্ড লড়াই শেষে ২০ ডিসেম্বর আন শহরে অবস্থিত জান্তা বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক সদর দপ্তরও দখলে নেয়। ফলে যুদ্ধরত বিদ্রোহ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ে দ্বিতীয় কোনো আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ হারাল মিয়ানমার সামরিক জান্তা। মিয়ানমারের জান্তা আগের মতো আর ক্ষমতাধর নেই। বিদ্রোহীদের অব্যাহত হামলার মুখে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্তা বাহিনী এখন কোণঠাসা। তবে সীমান্ত অঞ্চল ও রাজ্যের অধিকাংশ শহরের নিয়ন্ত্রণ হারালেও রাখাইনের রাজধানী আকিয়াব, মুনাং ও কাইয়াকফু এখনো নিজেদের দখলে রেখেছে জান্তা। এই তিনটি শহরই অর্থনৈতিকভাবে রাখাইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সামরিক জান্তা এখন আকিয়াব দখলে রাখার চেষ্টা করছে। আকিয়াবের পার্শ্ববর্তী নদীপথগুলো বন্ধ রেখে ছোট ও মাঝারি শক্তির যুদ্ধজাহাজ দিয়ে এ শহরটি রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে আরাকান আর্মি রাখাইনের মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন পেয়ে রাখাইনে তারা পূর্বের মতো আবারও স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। মানুষের প্রবল সমর্থন আছে বলেই আরাকান আর্মি রাখাইনের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ইতিমধ্যেই তারা ওই সব এলাকায় নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। বিচারব্যবস্থা ও কর ব্যবস্থাপনাও তৈরি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নতুন পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ১৯৯০ সালের আগে রাখাইন আরাকান নামে পরিচিত ছিল। এখানকার প্রধান জনগোষ্ঠী হলো আরাকানি। ধর্মে তারা থেরোবাদী বৌদ্ধ। তবে তারা নিজেদের মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের বৌদ্ধদের থেকে আলাদা দাবি করে। আরাকান একসময় স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ১৭৮৪-৮৫ সালে যুদ্ধে তৎকালীন বার্মার অধীন হয় আরাকান। তারপরেই ইংরেজদের হাতে চলে যায় পুরো বার্মা। অতঃপর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার একটি প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় আরাকান। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বার্মার নতুন ফেডারেল প্রজাতন্ত্রে আরাকান একটি বিশেষ অঙ্গরাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
রোহিঙ্গা এমন একটি জনগোষ্ঠীর নাম, যারা শত শত বছর ধরে বর্তমান মিয়ানমারের রাখাইনে বসবাস করলেও আজ তারা এক অবাঞ্ছিত রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। নিজ দেশ এবং ভিটেমাটি হারিয়ে সবার করুণার পাত্র হয়েছে। মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা তাদের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতে রাজি নয়। ১৯৭৪ সালের পর মিয়ানমার সামরিক জান্তারা প্রকাশ্যে রোহিঙ্গাদের বহিরাগত ‘বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করা শুরু করে। এই জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ যেহেতু ইসলাম ধর্মাবলম্বী, ভাষাগত দিক দিয়ে বাংলার সঙ্গে মিল আছে, এ কারণে মিয়ানমারের বৃহত্তর বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা তাদের ‘রোহিঙ্গা’ জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যতগুলো জনগোষ্ঠী আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল ও নিরীহ। এ কারণে রোহিঙ্গারা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য কিছুই করতে পারেনি। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং বেসামরিক প্রশাসন রাখাইন অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতেও অস্বীকার করছে। এ জন্য তারা ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে ১৮২৪-কে বেসলাইন ধরেছে। মিয়ানমার সরকারের সংজ্ঞায় ১৮২৪ সালে বার্মা যুদ্ধে আরাকান দখলের আগে যারা ওই অঞ্চলের বাসিন্দা ছিল, তারাই কেবল সে দেশের নাগরিক—এর পরের কোনো জনগোষ্ঠী নয়। তাদের যুক্তি, ব্রিটিশরাজ চাষাবাদ এবং অন্যান্য কাজের জন্য পূর্ব বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে বেশ কিছু বাঙালি রাখাইন অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল। তাদেরই বংশধর বর্তমান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এমন আইন বা যুক্তি আধুনিক বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য অথবা ইউরোপের বহু দেশের বহু জনগোষ্ঠীকে ওই সব দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে হতো। অতএব এ যুক্তি ধোপে টেকে না।
আগেই উল্লেখ করেছি, আরাকান বা রাখাইন ঐতিহাসিকভাবে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত স্বাধীন রাজ্য ছিল, যার পরিধি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের রামু পর্যন্ত এবং উত্তরে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য মণিপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন অষ্টম শতাব্দীতে, যাদের সংস্পর্শে এখানকার বহু নাগরিক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। উত্তর রাখাইন প্রভাবিত হয়েছিল চট্টগ্রাম, মংডু ও কক্সবাজার অঞ্চলে আরব বণিকদের বাণিজ্যের পরিধি বৃদ্ধির সময় থেকে।
রাখাইনের যেসব অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বসবাস, সেইসব অঞ্চল এখন আরাকান আর্মির দখলে। বর্তমানে রাখাইনে আনুমানিক পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। অথচ এর প্রায় দ্বিগুণের বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এমতাবস্থায় সেখানে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে বাংলাদেশ ও রাখাইন উভয় পাশেই রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাঝুঁকি বেড়েছে। যদিও আরাকান আর্মির অবস্থা কী, তা স্পষ্ট নয়। তবু সীমান্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং রোহিঙ্গাদের জানমালের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের বিষয়ে এখন থেকেই বাংলাদেশের আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। আমার বিশ্বাস, সে উদ্যোগ ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে। যদি ভবিষ্যতে রাখাইনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে রোহিঙ্গাদের নিজ বাস্তুভিটায় পুনর্বাসনের বিষয়টি আরাকান আর্মির ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করবে। এমনকি মিয়ানমার সরকারও যদি ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে সম্মত হয় তাহলেও আরাকান আর্মির অনুমোদন ছাড়া তা সম্ভব হবে না। তিন বছর আগেও রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আর্মির মনোভাব ছিল নমনীয় এবং তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিতে তাদের কোনো আপত্তি ছিল ন। আরাকান আর্মির প্রধান জেনারেল থোয়াই ম্রা নাইং বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে এ কথা বলেছিলেন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার এক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার স্বীকার করি। তবে কয়েকটি কথায় এ রকম সমস্যার উত্তর দেওয়া মুশকিল। এটা এত বড় সমস্যা যে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশও একা সমাধান করতে পারবে না। আমাদের জন্যও এটা একটি বড় ইস্যু। বাংলাদেশের সঙ্গে এ বিষয়ে আমরা কাজ করতে চাই।’ বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার তাঁর সেদিনের কথায় কোনো আগ্রহ দেখায়নি, এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে গোপনেও কোনো যোগাযোগ করেনি। জেনারেল নাইংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের যোগাযোগ ঘটেছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি নানা সময়ে। প্রত্যাশিত সাড়া পেয়েছি বলতে পারব না। আমার দিক থেকে সিদ্ধান্ত রয়েছে, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার। আমরা যথাযথ সাড়ার অপেক্ষায় আছি।’ বাংলাদেশ থেকে সাড়া না পেলেও তিনি হতাশ হননি। আশা ব্যক্ত করে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ইচ্ছুক। বিশেষভাবে চাই বাংলাদেশের মানুষ আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে প্রকৃত সত্য জানুক। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভাবুক—সেই সম্পর্ক হতে পারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব ধরনের।’
তিন বছর আগের আরাকান আর্মির অবস্থান এখনো একই থাকবে সে কথা বলা বোধ হয় ঠিক হবে না। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। তবে আরাকান আর্মির বর্তমান সাফল্য রোহিঙ্গাদের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাতে তাদের দুর্ভোগ বাড়াবে বলেই মনে হয়। বর্তমান পরিস্থিতি তাদের জন্য বিপর্যয়করও বটে। রাজনীতির কৌশলে ভুল চাল দিয়ে নিজেদের বিপদ যেন নিজেরাই ডেকে এনেছে। যে জান্তার বুলেট ও বেয়নেটে শরীর ঝাঁঝরা হয়েছে, যে জান্তা গোষ্ঠীর হাতে মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন হয়েছে, বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়েছে, সেই জান্তার ডাকেই তারা কোন বিবেচনায় আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, তা বোধগম্য নয়! নিরাপদ পুনর্বাসন, নাকি নাগরিকত্বের স্বীকৃতির টোপের ফাঁদে তারা পা দিয়েছে? যা ৪০ বছরে হয়নি তা ভবিষ্যতেও যে হবে, সে নিশ্চয়তা তারা কাদের কাছে পেল? যে ভুল তারা করেছে তার কিছুটা মাশুল তো তাদের দিতেই হবে।
এ ব্যাপারে অবশ্য বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যে ভুল শেখ হাসিনা করে গেছেন, সে ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সে বিষয়ে ড. ইউনূস সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। যে করেই হোক এ সরকারকে আরাকান আর্মির সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতেই হবে। শুধু যোগাযোগ স্থাপন করলেই চলবে না; এ যোগাযোগ অব্যাহতও রাখতে হবে। তবে এ জন্য সরকারকে রাখাইন সম্প্রদায়কে যুক্ত করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। সম্পর্ক ভালো করার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়বে। প্রয়োজনে কিছু সুবিধা দিয়ে হলেও আরাকান আর্মির আস্থাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। জেনারেল নাইং নিজেও জানেন, তাঁরা ‘অভ্যন্তরীণ সার্বভৌম’ কিংবা ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’, যে পথেই এগিয়ে যাক না কেন, নিজ ভূখণ্ড পুনর্গঠনে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রয়োজন পড়বে।
আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশকে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গেও গ্রহণযোগ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। রাখাইনের বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়ার দরকার আছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গেও যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আগের বিদেশনীতির পরিবর্তন করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার প্রকৃত সমাধান চায়— এমন বন্ধুরাষ্ট্রকে সঙ্গী করতে হবে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার বিষয়ে জাতিসংঘে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, বাংলাদেশ তার পূর্ণ সুযোগ নিতে পারে। অতএব সময় নষ্ট না করে মিয়ানমার সরকার, আরাকান আর্মি এবং আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।

বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকা বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে রাখাইনের ১৭টি শহরের ভেতর ১৪টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে আরাকান আর্মি দাবি করছে। দখল করা শহরের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মংডু, বুথিডাং এবং চিন রাজ্যের পালেতোয়া শহরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন তাদের হাতে। যদিও পালেতোয়ার সঙ্গে ভারতেরও সীমান্ত রয়েছে। এই তিনটি শহর দখলে নেওয়ার পর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আরাকান আর্মি প্রচণ্ড লড়াই শেষে ২০ ডিসেম্বর আন শহরে অবস্থিত জান্তা বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক সদর দপ্তরও দখলে নেয়। ফলে যুদ্ধরত বিদ্রোহ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ে দ্বিতীয় কোনো আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ হারাল মিয়ানমার সামরিক জান্তা। মিয়ানমারের জান্তা আগের মতো আর ক্ষমতাধর নেই। বিদ্রোহীদের অব্যাহত হামলার মুখে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্তা বাহিনী এখন কোণঠাসা। তবে সীমান্ত অঞ্চল ও রাজ্যের অধিকাংশ শহরের নিয়ন্ত্রণ হারালেও রাখাইনের রাজধানী আকিয়াব, মুনাং ও কাইয়াকফু এখনো নিজেদের দখলে রেখেছে জান্তা। এই তিনটি শহরই অর্থনৈতিকভাবে রাখাইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সামরিক জান্তা এখন আকিয়াব দখলে রাখার চেষ্টা করছে। আকিয়াবের পার্শ্ববর্তী নদীপথগুলো বন্ধ রেখে ছোট ও মাঝারি শক্তির যুদ্ধজাহাজ দিয়ে এ শহরটি রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে আরাকান আর্মি রাখাইনের মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন পেয়ে রাখাইনে তারা পূর্বের মতো আবারও স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। মানুষের প্রবল সমর্থন আছে বলেই আরাকান আর্মি রাখাইনের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ইতিমধ্যেই তারা ওই সব এলাকায় নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। বিচারব্যবস্থা ও কর ব্যবস্থাপনাও তৈরি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নতুন পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ১৯৯০ সালের আগে রাখাইন আরাকান নামে পরিচিত ছিল। এখানকার প্রধান জনগোষ্ঠী হলো আরাকানি। ধর্মে তারা থেরোবাদী বৌদ্ধ। তবে তারা নিজেদের মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের বৌদ্ধদের থেকে আলাদা দাবি করে। আরাকান একসময় স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ১৭৮৪-৮৫ সালে যুদ্ধে তৎকালীন বার্মার অধীন হয় আরাকান। তারপরেই ইংরেজদের হাতে চলে যায় পুরো বার্মা। অতঃপর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার একটি প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় আরাকান। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বার্মার নতুন ফেডারেল প্রজাতন্ত্রে আরাকান একটি বিশেষ অঙ্গরাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
রোহিঙ্গা এমন একটি জনগোষ্ঠীর নাম, যারা শত শত বছর ধরে বর্তমান মিয়ানমারের রাখাইনে বসবাস করলেও আজ তারা এক অবাঞ্ছিত রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। নিজ দেশ এবং ভিটেমাটি হারিয়ে সবার করুণার পাত্র হয়েছে। মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা তাদের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতে রাজি নয়। ১৯৭৪ সালের পর মিয়ানমার সামরিক জান্তারা প্রকাশ্যে রোহিঙ্গাদের বহিরাগত ‘বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করা শুরু করে। এই জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ যেহেতু ইসলাম ধর্মাবলম্বী, ভাষাগত দিক দিয়ে বাংলার সঙ্গে মিল আছে, এ কারণে মিয়ানমারের বৃহত্তর বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা তাদের ‘রোহিঙ্গা’ জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যতগুলো জনগোষ্ঠী আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল ও নিরীহ। এ কারণে রোহিঙ্গারা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য কিছুই করতে পারেনি। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং বেসামরিক প্রশাসন রাখাইন অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতেও অস্বীকার করছে। এ জন্য তারা ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে ১৮২৪-কে বেসলাইন ধরেছে। মিয়ানমার সরকারের সংজ্ঞায় ১৮২৪ সালে বার্মা যুদ্ধে আরাকান দখলের আগে যারা ওই অঞ্চলের বাসিন্দা ছিল, তারাই কেবল সে দেশের নাগরিক—এর পরের কোনো জনগোষ্ঠী নয়। তাদের যুক্তি, ব্রিটিশরাজ চাষাবাদ এবং অন্যান্য কাজের জন্য পূর্ব বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে বেশ কিছু বাঙালি রাখাইন অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল। তাদেরই বংশধর বর্তমান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এমন আইন বা যুক্তি আধুনিক বিশ্বের আর কোনো দেশে নেই। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য অথবা ইউরোপের বহু দেশের বহু জনগোষ্ঠীকে ওই সব দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে হতো। অতএব এ যুক্তি ধোপে টেকে না।
আগেই উল্লেখ করেছি, আরাকান বা রাখাইন ঐতিহাসিকভাবে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত স্বাধীন রাজ্য ছিল, যার পরিধি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের রামু পর্যন্ত এবং উত্তরে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য মণিপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন অষ্টম শতাব্দীতে, যাদের সংস্পর্শে এখানকার বহু নাগরিক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। উত্তর রাখাইন প্রভাবিত হয়েছিল চট্টগ্রাম, মংডু ও কক্সবাজার অঞ্চলে আরব বণিকদের বাণিজ্যের পরিধি বৃদ্ধির সময় থেকে।
রাখাইনের যেসব অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বসবাস, সেইসব অঞ্চল এখন আরাকান আর্মির দখলে। বর্তমানে রাখাইনে আনুমানিক পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। অথচ এর প্রায় দ্বিগুণের বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এমতাবস্থায় সেখানে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে বাংলাদেশ ও রাখাইন উভয় পাশেই রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাঝুঁকি বেড়েছে। যদিও আরাকান আর্মির অবস্থা কী, তা স্পষ্ট নয়। তবু সীমান্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং রোহিঙ্গাদের জানমালের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের বিষয়ে এখন থেকেই বাংলাদেশের আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। আমার বিশ্বাস, সে উদ্যোগ ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে। যদি ভবিষ্যতে রাখাইনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে রোহিঙ্গাদের নিজ বাস্তুভিটায় পুনর্বাসনের বিষয়টি আরাকান আর্মির ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করবে। এমনকি মিয়ানমার সরকারও যদি ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে সম্মত হয় তাহলেও আরাকান আর্মির অনুমোদন ছাড়া তা সম্ভব হবে না। তিন বছর আগেও রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আর্মির মনোভাব ছিল নমনীয় এবং তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিতে তাদের কোনো আপত্তি ছিল ন। আরাকান আর্মির প্রধান জেনারেল থোয়াই ম্রা নাইং বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে এ কথা বলেছিলেন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার এক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার স্বীকার করি। তবে কয়েকটি কথায় এ রকম সমস্যার উত্তর দেওয়া মুশকিল। এটা এত বড় সমস্যা যে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশও একা সমাধান করতে পারবে না। আমাদের জন্যও এটা একটি বড় ইস্যু। বাংলাদেশের সঙ্গে এ বিষয়ে আমরা কাজ করতে চাই।’ বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার তাঁর সেদিনের কথায় কোনো আগ্রহ দেখায়নি, এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে গোপনেও কোনো যোগাযোগ করেনি। জেনারেল নাইংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের যোগাযোগ ঘটেছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি নানা সময়ে। প্রত্যাশিত সাড়া পেয়েছি বলতে পারব না। আমার দিক থেকে সিদ্ধান্ত রয়েছে, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার। আমরা যথাযথ সাড়ার অপেক্ষায় আছি।’ বাংলাদেশ থেকে সাড়া না পেলেও তিনি হতাশ হননি। আশা ব্যক্ত করে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ইচ্ছুক। বিশেষভাবে চাই বাংলাদেশের মানুষ আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে প্রকৃত সত্য জানুক। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভাবুক—সেই সম্পর্ক হতে পারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব ধরনের।’
তিন বছর আগের আরাকান আর্মির অবস্থান এখনো একই থাকবে সে কথা বলা বোধ হয় ঠিক হবে না। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। তবে আরাকান আর্মির বর্তমান সাফল্য রোহিঙ্গাদের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাতে তাদের দুর্ভোগ বাড়াবে বলেই মনে হয়। বর্তমান পরিস্থিতি তাদের জন্য বিপর্যয়করও বটে। রাজনীতির কৌশলে ভুল চাল দিয়ে নিজেদের বিপদ যেন নিজেরাই ডেকে এনেছে। যে জান্তার বুলেট ও বেয়নেটে শরীর ঝাঁঝরা হয়েছে, যে জান্তা গোষ্ঠীর হাতে মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন হয়েছে, বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়েছে, সেই জান্তার ডাকেই তারা কোন বিবেচনায় আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, তা বোধগম্য নয়! নিরাপদ পুনর্বাসন, নাকি নাগরিকত্বের স্বীকৃতির টোপের ফাঁদে তারা পা দিয়েছে? যা ৪০ বছরে হয়নি তা ভবিষ্যতেও যে হবে, সে নিশ্চয়তা তারা কাদের কাছে পেল? যে ভুল তারা করেছে তার কিছুটা মাশুল তো তাদের দিতেই হবে।
এ ব্যাপারে অবশ্য বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যে ভুল শেখ হাসিনা করে গেছেন, সে ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সে বিষয়ে ড. ইউনূস সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। যে করেই হোক এ সরকারকে আরাকান আর্মির সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতেই হবে। শুধু যোগাযোগ স্থাপন করলেই চলবে না; এ যোগাযোগ অব্যাহতও রাখতে হবে। তবে এ জন্য সরকারকে রাখাইন সম্প্রদায়কে যুক্ত করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। সম্পর্ক ভালো করার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়বে। প্রয়োজনে কিছু সুবিধা দিয়ে হলেও আরাকান আর্মির আস্থাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। জেনারেল নাইং নিজেও জানেন, তাঁরা ‘অভ্যন্তরীণ সার্বভৌম’ কিংবা ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’, যে পথেই এগিয়ে যাক না কেন, নিজ ভূখণ্ড পুনর্গঠনে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রয়োজন পড়বে।
আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশকে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গেও গ্রহণযোগ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। রাখাইনের বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়ার দরকার আছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গেও যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আগের বিদেশনীতির পরিবর্তন করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার প্রকৃত সমাধান চায়— এমন বন্ধুরাষ্ট্রকে সঙ্গী করতে হবে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার বিষয়ে জাতিসংঘে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, বাংলাদেশ তার পূর্ণ সুযোগ নিতে পারে। অতএব সময় নষ্ট না করে মিয়ানমার সরকার, আরাকান আর্মি এবং আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
১৯ ঘণ্টা আগে
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
১৯ ঘণ্টা আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
২০ ঘণ্টা আগেআবু তাহের খান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি। বরং নতুন কৌশলে তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তাকে অধিক শক্তিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করছে উপনিবেশিত দেশগুলোয়। নিজেদের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সম্প্রসারিত করে এর নাম দেয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই চতুর বিশেষণের মাধ্যমে অনগ্রসর দেশগুলোর নানা খাতের বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করা এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই হলো এর মূল্য উদ্দেশ্য।
কিন্তু তাদের দ্বারা নীরব শোষণের শিকার দেশের জনগণ বুঝতেই পারে না নতুন ধারার এসব প্রযুক্তি কীভাবে তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ নিজেদের অজান্তে অন্য দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে! যেমন ফেসবুক, লিংকডইন, এক্স বা টুইটার ইত্যাদির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জনগণকে নেশায় বুঁদ বানিয়ে রেখে তাদের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে তারা মুনাফার বিস্তার ও একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করছে কৃষি খাতে। অনুন্নত দেশগুলোর ভবিষ্যতের কৃষিকে বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়িক চক্রের হাতে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলছে। এটা তারা করছে কৃষির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহারের চক্রে ফেলে, যা কৃষির প্রাকৃতিক উৎসকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়।
১৯৭০-এর দশক থেকেই বিশ্বব্যাপী কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়। ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশই কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় পরিসরের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের প্রথমার্ধ থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে বীজ ও অন্যান্য কৃষিসংশ্লিষ্ট জীবের জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) নামের এমন সব নতুন প্রজাতি উদ্ভাবিত হতে থাকে, যেগুলোর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একধরনের পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবসা যুক্ত হয়ে পড়ে। আর এ-জাতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করা জিএমওভিত্তিক কৃষি উপকরণ কৃষকের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জমির উর্বরতা ও কৃষিসংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্র্যকে শুধু ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়নি—সংশ্লিষ্ট কৃষককে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে। এর বড় প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টো কর্তৃক ভারতের পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের মধ্যে ১৯৯৮ সালে বিটি বীজ সরবরাহ করে তাঁদের সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।
একসময়ে পাঞ্জাবের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল তুলা। তুলা চাষের সঙ্গে জড়িত সেখানকার হাজার হাজার চাষি সে সময় মনসান্টোর প্রলোভনের খপ্পরে পড়ে বেশি ফলনের আশায় বিটি বীজ কিনে তাঁদের অধিকাংশ জমিতে বপন করেন। এতে করে প্রথম এক-দুই বছর তাঁরা ভালো ফলনও পান। কিন্তু দুই বছর পরেই তুলার মাঠে সর্বনাশের লক্ষণগুলো একটু একটু করে প্রকাশ পেতে শুরু করে। একসময় দেখা যায়—বিটি প্রজাতির ফসলের বীজ নতুন বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে নতুনভাবে চাষের জন্য তাঁদের উচ্চ দামের মনসান্টোর জিএমও বীজের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এ বীজ বপনের পর প্রচলিত ধাঁচের সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ইত্যাদি কোনো কাজে আসছে না। তাই সেই কোম্পানির কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এবং এ ক্ষেত্রেও তাঁদের এসব জিএমও উপকরণ মনসান্টো বা তার মনোনীত ডিলারদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে।
যে জমিতে একবার সেই বীজ ব্যবহার করা হয়েছে, সে জমিতে আর দেশীয় প্রজাতির বীজ ও উপকরণ দ্বারা ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। শেষে দেখা গেছে, এসব বিটি বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এরপর পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের কয়েক বছরের মধ্যেই তুলা চাষ নিয়ে তাঁদের অতীতের সব গর্ব ও অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে অনেকটাই মাথায় হাত দিয়ে পথে বসতে হয়। তুলা আর এখন গম উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া পাঞ্জাবের এক নম্বর অর্থকরী ফসল নয়।
মনসান্টো ও তাদের সমগোত্রীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশেও লোভের থাবা বিস্তার করতে শুরু করেছে। বিটি বেগুনসহ বিভিন্ন ফসলের জিএমও প্রজাতি বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে গছাবার জন্য এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছে এবং কৃষকের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বস্তুত কতিপয় অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও ন্যূনতম দেশাত্মবোধহীন অসৎ আমলাদের হীন তৎপরতা ও যোগসাজশের কারণে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কি আসলেই জানেন জিএমও বীজ কীভাবে কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে?
বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে। পরবর্তী সময়ে সোনালি ধান বা গোল্ডেন রাইস নামের অন্য একটি জিএমও বীজ প্রবর্তনের অনুমতি লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারাও তদবিরে নামেন। যদিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন এখনো মেলেনি। বস্তুত পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর বাধা ও আপত্তির কারণেই এখন পর্যন্ত তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু অত্যন্ত হতাশা ও পরিতাপের বিষয় এই যে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই ২০১৬-২০ মেয়াদি দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিএমওভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে দৃঢ় অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলটি যাঁরা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বসে অনুমোদন করেছিলেন, তাঁরা কি সত্যি সত্যি ওই দলিলে জিএমও প্রযুক্তির পক্ষে অঙ্গীকার থাকার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কত সর্বনাশা সিদ্ধান্ত যে এভাবে নিজেদের অজান্তেই গ্রহণ করছেন, তা বোধকরি তাঁরা নিজেরাও জানেন না।
উল্লেখ্য, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে তো বটেই—এমনকি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক অনুন্নত বা মাঝারি পর্যায়ের দেশের কৃষিতেও জিএমও উপকরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। পাঞ্জাবের তুলা চাষের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ইতিমধ্যে তাদের দেশে জিএমওর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ফিলিপাইন একেবারে গোড়া থেকেই মার্কিন প্রভাববলয়ের দেশ হওয়ার কারণে মনসান্টোর মতো মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিকে ঠেকানোর জন্য তাদেরকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তারপরও আদালতের সহায়তায় তারা কৃষিতে জিএমওকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে জিএমও ঠেকাতে উল্টো এখানে সাধারণ মানুষকেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল এর বিপরীতটি।
প্রধান উপদেষ্টা প্রায় তাঁর তিন শূন্য তত্ত্বের কথা বলে থাকেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করা। কিন্তু কৃষিতে জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ রাখত সেই তিন শূন্য তত্ত্বেরই সম্পূরক কার্যক্রম। তিনি কেন জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ করছেন না? অথচ এ কাজটি করলে কৃষি ও কৃষকের জন্য একটি সুরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন।
অন্যদিকে জিএমওর ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যকার সচেতনতার স্তরও অত্যন্ত নিম্নবর্তী। কৃষকদের মধ্যে উল্লিখিত সচেতনতার স্তর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে তেমন কিছুই করছে না। এ অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুরোধ, জিএমওর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে কৃষকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলুন। তাতে আপনাদের দৈনন্দিন কাজের বোঝা অনেকখানি হালকা হয়ে আসবে।
দেশের কৃষি ও কৃষকদের জিএমওর হাত থেকে বাঁচান। নইলে বাংলাদেশের কৃষি খাত অচিরেই মনসান্টোর মতো জিএমও বাজারজাতকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি দেশের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি। বরং নতুন কৌশলে তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তাকে অধিক শক্তিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করছে উপনিবেশিত দেশগুলোয়। নিজেদের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে সম্প্রসারিত করে এর নাম দেয় চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই চতুর বিশেষণের মাধ্যমে অনগ্রসর দেশগুলোর নানা খাতের বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করা এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই হলো এর মূল্য উদ্দেশ্য।
কিন্তু তাদের দ্বারা নীরব শোষণের শিকার দেশের জনগণ বুঝতেই পারে না নতুন ধারার এসব প্রযুক্তি কীভাবে তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ নিজেদের অজান্তে অন্য দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে! যেমন ফেসবুক, লিংকডইন, এক্স বা টুইটার ইত্যাদির মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জনগণকে নেশায় বুঁদ বানিয়ে রেখে তাদের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে। একইভাবে তারা মুনাফার বিস্তার ও একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করছে কৃষি খাতে। অনুন্নত দেশগুলোর ভবিষ্যতের কৃষিকে বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়িক চক্রের হাতে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলছে। এটা তারা করছে কৃষির প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহারের চক্রে ফেলে, যা কৃষির প্রাকৃতিক উৎসকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়।
১৯৭০-এর দশক থেকেই বিশ্বব্যাপী কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধিত হয়। ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশই কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় পরিসরের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের প্রথমার্ধ থেকে পশ্চিমের দেশগুলোতে বীজ ও অন্যান্য কৃষিসংশ্লিষ্ট জীবের জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম) নামের এমন সব নতুন প্রজাতি উদ্ভাবিত হতে থাকে, যেগুলোর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একধরনের পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবসা যুক্ত হয়ে পড়ে। আর এ-জাতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বাজারজাত করা জিএমওভিত্তিক কৃষি উপকরণ কৃষকের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জমির উর্বরতা ও কৃষিসংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্র্যকে শুধু ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়নি—সংশ্লিষ্ট কৃষককে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করে। এর বড় প্রমাণ হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টো কর্তৃক ভারতের পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের মধ্যে ১৯৯৮ সালে বিটি বীজ সরবরাহ করে তাঁদের সম্পূর্ণভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়।
একসময়ে পাঞ্জাবের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল তুলা। তুলা চাষের সঙ্গে জড়িত সেখানকার হাজার হাজার চাষি সে সময় মনসান্টোর প্রলোভনের খপ্পরে পড়ে বেশি ফলনের আশায় বিটি বীজ কিনে তাঁদের অধিকাংশ জমিতে বপন করেন। এতে করে প্রথম এক-দুই বছর তাঁরা ভালো ফলনও পান। কিন্তু দুই বছর পরেই তুলার মাঠে সর্বনাশের লক্ষণগুলো একটু একটু করে প্রকাশ পেতে শুরু করে। একসময় দেখা যায়—বিটি প্রজাতির ফসলের বীজ নতুন বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে নতুনভাবে চাষের জন্য তাঁদের উচ্চ দামের মনসান্টোর জিএমও বীজের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এ বীজ বপনের পর প্রচলিত ধাঁচের সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ইত্যাদি কোনো কাজে আসছে না। তাই সেই কোম্পানির কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। এবং এ ক্ষেত্রেও তাঁদের এসব জিএমও উপকরণ মনসান্টো বা তার মনোনীত ডিলারদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে।
যে জমিতে একবার সেই বীজ ব্যবহার করা হয়েছে, সে জমিতে আর দেশীয় প্রজাতির বীজ ও উপকরণ দ্বারা ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। শেষে দেখা গেছে, এসব বিটি বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এরপর পাঞ্জাবের তুলাচাষিদের কয়েক বছরের মধ্যেই তুলা চাষ নিয়ে তাঁদের অতীতের সব গর্ব ও অহংকারকে বিসর্জন দিয়ে অনেকটাই মাথায় হাত দিয়ে পথে বসতে হয়। তুলা আর এখন গম উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া পাঞ্জাবের এক নম্বর অর্থকরী ফসল নয়।
মনসান্টো ও তাদের সমগোত্রীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশেও লোভের থাবা বিস্তার করতে শুরু করেছে। বিটি বেগুনসহ বিভিন্ন ফসলের জিএমও প্রজাতি বাংলাদেশের কৃষকদের কাছে গছাবার জন্য এক যুগের বেশি সময় ধরে তারা নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছে এবং কৃষকের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে তারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বস্তুত কতিপয় অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও ন্যূনতম দেশাত্মবোধহীন অসৎ আমলাদের হীন তৎপরতা ও যোগসাজশের কারণে। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কি আসলেই জানেন জিএমও বীজ কীভাবে কৃষির অন্তর্গত শক্তিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে?
বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৩ সালে। পরবর্তী সময়ে সোনালি ধান বা গোল্ডেন রাইস নামের অন্য একটি জিএমও বীজ প্রবর্তনের অনুমতি লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারাও তদবিরে নামেন। যদিও এ বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন এখনো মেলেনি। বস্তুত পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর বাধা ও আপত্তির কারণেই এখন পর্যন্ত তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু অত্যন্ত হতাশা ও পরিতাপের বিষয় এই যে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই ২০১৬-২০ মেয়াদি দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিএমওভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে দৃঢ় অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলটি যাঁরা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বসে অনুমোদন করেছিলেন, তাঁরা কি সত্যি সত্যি ওই দলিলে জিএমও প্রযুক্তির পক্ষে অঙ্গীকার থাকার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন? আসলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা কত সর্বনাশা সিদ্ধান্ত যে এভাবে নিজেদের অজান্তেই গ্রহণ করছেন, তা বোধকরি তাঁরা নিজেরাও জানেন না।
উল্লেখ্য, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে তো বটেই—এমনকি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক অনুন্নত বা মাঝারি পর্যায়ের দেশের কৃষিতেও জিএমও উপকরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। পাঞ্জাবের তুলা চাষের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ইতিমধ্যে তাদের দেশে জিএমওর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ফিলিপাইন একেবারে গোড়া থেকেই মার্কিন প্রভাববলয়ের দেশ হওয়ার কারণে মনসান্টোর মতো মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিকে ঠেকানোর জন্য তাদেরকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। তারপরও আদালতের সহায়তায় তারা কৃষিতে জিএমওকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে জিএমও ঠেকাতে উল্টো এখানে সাধারণ মানুষকেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল এর বিপরীতটি।
প্রধান উপদেষ্টা প্রায় তাঁর তিন শূন্য তত্ত্বের কথা বলে থাকেন। এ তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি পৃথিবীর পরিবেশকে রক্ষা করা। কিন্তু কৃষিতে জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ রাখত সেই তিন শূন্য তত্ত্বেরই সম্পূরক কার্যক্রম। তিনি কেন জিএমওর প্রবর্তন বন্ধ করছেন না? অথচ এ কাজটি করলে কৃষি ও কৃষকের জন্য একটি সুরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন।
অন্যদিকে জিএমওর ব্যাপারে কৃষকদের মধ্যকার সচেতনতার স্তরও অত্যন্ত নিম্নবর্তী। কৃষকদের মধ্যে উল্লিখিত সচেতনতার স্তর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে তেমন কিছুই করছে না। এ অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুরোধ, জিএমওর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে কৃষকদের এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলুন। তাতে আপনাদের দৈনন্দিন কাজের বোঝা অনেকখানি হালকা হয়ে আসবে।
দেশের কৃষি ও কৃষকদের জিএমওর হাত থেকে বাঁচান। নইলে বাংলাদেশের কৃষি খাত অচিরেই মনসান্টোর মতো জিএমও বাজারজাতকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে পারে। বিষয়টি দেশের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকা বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে রাখাইনের ১৭টি শহরের ভেতর ১৪টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে আরাকান আর্মি দাবি করছে। দখল করা শহরের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মংডু, বুথিডাং এবং চিন রাজ্যের প
০৪ জানুয়ারি ২০২৫
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
১৯ ঘণ্টা আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
২০ ঘণ্টা আগেমাহফুজা খাতুন

আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি আমাদের কাছাকাছি এনেছে, কিন্তু হৃদয়ের দূরত্ব যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে একাকিত্ব ডিজিটাল যুগের এক বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়েছে।
একসময় বন্ধুর মানে ছিল একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা এবং মাঠে দল বেঁধে খেলা করা। এখন বন্ধুত্ব মানে জুম কলে দেখা, মেসেঞ্জারে ‘রিঅ্যাক্ট’ দেওয়া কিংবা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে একে অপরের পোস্টে মন্তব্য করা। এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ অনেক সময় আমাদের বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে কি সত্যিকারের বন্ধন তৈরি হয়?
গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ, আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি ও একাকিত্বের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ, অনলাইন জগৎ এমন এক স্থান যেখানে সবাই নিজেদের সেরা হিসেবে দেখতে এবং উপস্থাপন করতে চায়। এই নিখুঁত জীবনের প্রদর্শনীতে অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে করতে অনেকেই হারিয়ে ফেলেন আত্মবিশ্বাস।
যেকোনো ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে দেখে নেয় কতজন তার স্টোরিতে ‘ভিউ’ দিয়েছে। সারা দিনের কাজের মধ্যেও বারবার ফোন চেক করে, নতুন মেসেজের অপেক্ষায় থাকে। বাইরে থেকে সে খুবই সক্রিয় ও সংযুক্ত মনে হলেও, দিন শেষে নিজের ঘরে বসে অনুভব করে ভয়ংকর এক নিঃসঙ্গতা। এই চিত্র শুধু তার নয়, এ আমাদের প্রজন্মের গল্প। ডিজিটাল মাধ্যমে যে যত বেশি সক্রিয়, বাস্তবজীবনে সে তত বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে।
মানুষ সামাজিক প্রাণী। যোগাযোগ, সহানুভূতি ও সম্পর্কই তাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এই মৌলিক চাহিদাগুলো ভার্চুয়াল পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, একাকিত্ব মানে কেবল শারীরিকভাবে একা থাকা নয়; বরং মানসিকভাবে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা।
ফেসবুকে হাজার ফ্রেন্ড বা ইনস্টাগ্রামে হাজার ফলোয়ার থাকলেও, কেউ যদি মনের কথা বলার মতো একজনকেও না পায়, তবে সে নিঃসন্দেহে একা। এ একাকিত্ব ধীরে ধীরে তৈরি করে অবসাদ, উদ্বেগ, এমনকি আত্মসম্মানহীনতা।
তবে একে একেবারে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। ডিজিটাল মাধ্যম অনেকের জন্য আশীর্বাদও বটে। দূর দেশে থাকা পরিবার বা প্রবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ, অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ, মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং—এসবই প্রযুক্তির দান। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন বাস্তব সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল সম্পর্কের চাপে ম্লান হয়ে যায়। যখন ফোনের পর্দার মানুষগুলো আমাদের কাছে বাস্তবজীবনের মানুষদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল যুগে একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া মানে প্রযুক্তিকে বর্জন নয়; বরং তার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ডিজিটাল ডিটক্স করুন মানে ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছু সময় দূরে থাকা অভ্যাস গড়ে তুলুন। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, মনের কথা মুখে বলা। সর্বোপরি, নিজেকে সময় দেওয়া, বই পড়া, হাঁটাহাঁটি, গান শোনা ও সিনেমা দেখার মাধ্যমে নিজের ভেতরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন। কেবল নিজের পোস্টে ‘লাইক’ নয়, অন্যের গল্প মনোযোগ দিয়ে শোনাও একধরনের সংযোগ।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু যদি আমরা মানবিক সম্পর্কের সেতু হারিয়ে ফেলি। তবে এই অগ্রগতি অর্থহীন। ডিজিটাল যুগের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো—সংযোগের ভেতর মানবিকতা ধরে রাখা।
আমরা সবাই অনলাইনে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয়, কিন্তু মন থেকে যদি সংযুক্ত না থাকি, তবে একে অপরের জীবনে আমরা কেবল নোটিফিকেশন মাত্র।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি আমাদের কাছাকাছি এনেছে, কিন্তু হৃদয়ের দূরত্ব যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে একাকিত্ব ডিজিটাল যুগের এক বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়েছে।
একসময় বন্ধুর মানে ছিল একসঙ্গে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা এবং মাঠে দল বেঁধে খেলা করা। এখন বন্ধুত্ব মানে জুম কলে দেখা, মেসেঞ্জারে ‘রিঅ্যাক্ট’ দেওয়া কিংবা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে একে অপরের পোস্টে মন্তব্য করা। এই ভার্চুয়াল যোগাযোগ অনেক সময় আমাদের বাস্তব সম্পর্কের বিকল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু এতে কি সত্যিকারের বন্ধন তৈরি হয়?
গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ, আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি ও একাকিত্বের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ, অনলাইন জগৎ এমন এক স্থান যেখানে সবাই নিজেদের সেরা হিসেবে দেখতে এবং উপস্থাপন করতে চায়। এই নিখুঁত জীবনের প্রদর্শনীতে অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে করতে অনেকেই হারিয়ে ফেলেন আত্মবিশ্বাস।
যেকোনো ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে দেখে নেয় কতজন তার স্টোরিতে ‘ভিউ’ দিয়েছে। সারা দিনের কাজের মধ্যেও বারবার ফোন চেক করে, নতুন মেসেজের অপেক্ষায় থাকে। বাইরে থেকে সে খুবই সক্রিয় ও সংযুক্ত মনে হলেও, দিন শেষে নিজের ঘরে বসে অনুভব করে ভয়ংকর এক নিঃসঙ্গতা। এই চিত্র শুধু তার নয়, এ আমাদের প্রজন্মের গল্প। ডিজিটাল মাধ্যমে যে যত বেশি সক্রিয়, বাস্তবজীবনে সে তত বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করে।
মানুষ সামাজিক প্রাণী। যোগাযোগ, সহানুভূতি ও সম্পর্কই তাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে এই মৌলিক চাহিদাগুলো ভার্চুয়াল পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, একাকিত্ব মানে কেবল শারীরিকভাবে একা থাকা নয়; বরং মানসিকভাবে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা।
ফেসবুকে হাজার ফ্রেন্ড বা ইনস্টাগ্রামে হাজার ফলোয়ার থাকলেও, কেউ যদি মনের কথা বলার মতো একজনকেও না পায়, তবে সে নিঃসন্দেহে একা। এ একাকিত্ব ধীরে ধীরে তৈরি করে অবসাদ, উদ্বেগ, এমনকি আত্মসম্মানহীনতা।
তবে একে একেবারে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয়। ডিজিটাল মাধ্যম অনেকের জন্য আশীর্বাদও বটে। দূর দেশে থাকা পরিবার বা প্রবাসী প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ, অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপ, মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং—এসবই প্রযুক্তির দান। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন বাস্তব সম্পর্কগুলো ভার্চুয়াল সম্পর্কের চাপে ম্লান হয়ে যায়। যখন ফোনের পর্দার মানুষগুলো আমাদের কাছে বাস্তবজীবনের মানুষদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল যুগে একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া মানে প্রযুক্তিকে বর্জন নয়; বরং তার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা। সপ্তাহে অন্তত এক দিন ডিজিটাল ডিটক্স করুন মানে ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছু সময় দূরে থাকা অভ্যাস গড়ে তুলুন। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, মনের কথা মুখে বলা। সর্বোপরি, নিজেকে সময় দেওয়া, বই পড়া, হাঁটাহাঁটি, গান শোনা ও সিনেমা দেখার মাধ্যমে নিজের ভেতরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করুন। কেবল নিজের পোস্টে ‘লাইক’ নয়, অন্যের গল্প মনোযোগ দিয়ে শোনাও একধরনের সংযোগ।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু যদি আমরা মানবিক সম্পর্কের সেতু হারিয়ে ফেলি। তবে এই অগ্রগতি অর্থহীন। ডিজিটাল যুগের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো—সংযোগের ভেতর মানবিকতা ধরে রাখা।
আমরা সবাই অনলাইনে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয়, কিন্তু মন থেকে যদি সংযুক্ত না থাকি, তবে একে অপরের জীবনে আমরা কেবল নোটিফিকেশন মাত্র।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকা বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে রাখাইনের ১৭টি শহরের ভেতর ১৪টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে আরাকান আর্মি দাবি করছে। দখল করা শহরের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মংডু, বুথিডাং এবং চিন রাজ্যের প
০৪ জানুয়ারি ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
১৯ ঘণ্টা আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
১৯ ঘণ্টা আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
২০ ঘণ্টা আগেশাইখ সিরাজ

কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০১৫ সালে যখন প্রথম সেখানে যাই, তখনো বিস্ময়ে ভরে গিয়েছিল মন। সাত বছর পর ২০২২ সালে গিয়ে দেখলাম—তাদের অগ্রগতির গতি আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে।
এক উজ্জ্বল রোদের দিন, নীল আকাশের নিচে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নির্ধারিত গাড়িতে। গন্তব্য—অ্যাগ্রোপার্ক লিংগেজেন। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, কৃষিতে এমন প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকায়ন কীভাবে সম্ভব হলো নেদারল্যান্ডসে? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম এডে সেন্ট্রাল স্টেশনে, যেখানে আমাদের স্বাগত জানালেন ড. পিটার স্মিটস, সেদিনের গাইড ও হোস্ট। ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোকের চেহারায় বয়সের রেখা থাকলেও তাঁর চলন-বলনে ছিল এক অনন্য তারুণ্য।
পিটার আমাদের জানালেন, খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে জৈব নিরাপত্তার কারণে নেদারল্যান্ডসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের লোকজনকে উৎপাদনকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে বেশির ভাগ জায়গাই আমাদের দেখতে হবে গাড়ি থেকে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে আমি চেয়েছিলাম দর্শকদের ক্যামেরার চোখে দেখাতে, কীভাবে কাজ করছে আধুনিক ইউরোপের কৃষি।
প্রথম গন্তব্য ছিল ভেনলো এলাকার ‘ফ্রেশ পার্ক’। এলাকাটা আমাদের দেশের শিল্পনগরীর মতোই, এটি একধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পার্ক। গ্রিনহাউস বা খামার থেকে আসা কৃষিপণ্য এখানে সর্টিং, প্যাকেজিং ও ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য আসে। বড় বড় লরি পণ্য নিয়ে ছুটে চলে বিভিন্ন দেশে। গাড়ির ভেতর বসে পিটার আমাদের জানালেন, এখান থেকেই তাজা সবজি ও ফল বিদেশে যায়। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখা হয় প্রতিটি পণ্যকে সতেজ রাখার জন্য।
একপর্যায়ে দূরের এক ভবন দেখিয়ে পিটার বললেন, ওটা রয়্যাল জন, একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে কিছু কৃষক মিলে শুরু করেছিলেন। এখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত চার শতাধিক কৃষক। প্রতিদিন সকালে অনলাইনে অকশন হয়, সারা দিন ধরে সেই পণ্য দেশের বাজারে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাইরে থেকে দেখা যতটুকু সম্ভব দেখলাম। ভেতরে খুব কম মানুষ, সবকিছু করছে রোবট। পুরো প্রক্রিয়া অটোমেটেড। প্রযুক্তির শৃঙ্খলা ও কার্যকারিতা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।
তারপর আমাদের গাড়ি চলল বারেনড্রেখ্টের দিকে। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্রিনহাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। কারখানাই বটে, তবে ফসল উৎপাদনের কারখানা। পিটার বলছিলেন, এখানে কোনো গ্রিনহাউসই ৫ হেক্টরের কম নয়। সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে একেকটা গ্রিনহাউস। সারি সারি অসংখ্য গ্রিনহাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিনহাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে নেদারল্যান্ডস পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। পিটার আমাদের পুনরায় হতাশ করলেন। বললেন, এখানেও কোনো গ্রিনহাউসে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি গ্রিনহাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের চাষপদ্ধতি আমার দেশের কৃষককে দেখাতে পারব না। কোনো মানে হয়! পিটারকে বুঝিয়ে বললাম, আমি যদি ক্যামেরায় কোনো কিছু ধারণ করতে না পারি, আমার দর্শককে না দেখাতে পারলে শুধু বাইরে থেকে আমি দেখে গেলে লাভ কী?
পিটার ব্যাপারটা বুঝলেন। কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমাদের জানালেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের একটা ক্যাপসিকামের গ্রিনহাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট লাইন অতিক্রম করা যাবে না।’ আমরা রাজি হলাম। কোনো কিছুতেই হাত দেব না। কোনো সীমাই আমরা অতিক্রম করব না। কেবল ক্যামেরায় দর্শকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ ধারণ করব।
অবশেষে আমরা পৌঁছালাম বেমোলে, ফির্মা ফান ডার হার্ঘ নামের একটি গ্রিনহাউসে। ওখানে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ভেতরে ঢোকার আগে পিটার দেখালেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের বড় ট্যাংক। বললেন, ‘ফসল বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে আমরা বিদ্যুৎ, তাপ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড পাই। বিদ্যুৎ যায় জাতীয় গ্রিডে, তাপ ব্যবহৃত হয় গ্রিনহাউসে, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড সংরক্ষিত থাকে এমন ট্যাংকে।’
ভেতরে ঢুকে দেখা হলো ইয়ন ফান ডের অলেখ-এর সঙ্গে। তিনিই গ্রিনহাউসের তরুণ মালিক। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও উদ্যমী মানুষ। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম, গ্রিনহাউসটির জমির আয়তন ৮.৬ হেক্টর, গাছের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ, বার্ষিক উৎপাদন ২৫০০ টন লাল ক্যাপসিকাম, ফসলের সময়কাল ডিসেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।
ইয়ন জানালেন, ‘সবকিছুই কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত। সেচ, সার, পুষ্টি—সব নির্ধারিত হয় সফটওয়্যারের নির্দেশে। আমরা মূলত ‘ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশন’ ব্যবহার করি। পানির সঙ্গে মিশে থাকে সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। একফোঁটাও অপচয় হয় না।’
তিনি আরও বললেন, ‘আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করি, সেটিই সেচে ব্যবহার হয়। এমনকি তাপ নিয়ন্ত্রণ ও আলোর ব্যবস্থাও রোবট দ্বারা সম্পন্ন হয়।’ সত্যিই, এই গ্রিনহাউস যেন প্রযুক্তির এক নিখুঁত সাম্রাজ্য, যেখানে মানুষ কেবল নিয়ন্ত্রক, শ্রমিক নয়।
সবচেয়ে অবাক লাগল তাঁদের বায়োপেস্ট কন্ট্রোল পদ্ধতি দেখে। ইয়ন বললেন, ‘আমরা কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি না। উপকারী পোকাই ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে। লুপারস, হোয়াইট ফ্লাই বা স্পাইডার মাইট দমন করা হয় এমন পদ্ধতিতে।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, অর্থাৎ পোকা খায় পোকাকে? তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ঠিক তাই!
এই দৃশ্যগুলো দেখে আমি বুঝেছিলাম, উন্নত জাতি মানেই শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তাও। নেদারল্যান্ডস প্রমাণ করেছে—প্রযুক্তি, দক্ষতা আর সততার সমন্বয় ঘটালে কৃষি হতে পারে এক সমৃদ্ধ শিল্প।
আজ যখন বিশ্বের নানা দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে, তখন নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে পথ—কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করেও উৎপাদন বাড়ানো যায়। তাদের কৃষি মডেল শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি টেকসই উন্নয়নেরও প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশেও আমরা যদি কৃষিতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে আরও শক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তবে কৃষি যেমন জীবিকার উৎস, তেমনি এটি হতে পারে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তিও।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০১৫ সালে যখন প্রথম সেখানে যাই, তখনো বিস্ময়ে ভরে গিয়েছিল মন। সাত বছর পর ২০২২ সালে গিয়ে দেখলাম—তাদের অগ্রগতির গতি আরও বহুগুণ বেড়ে গেছে।
এক উজ্জ্বল রোদের দিন, নীল আকাশের নিচে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নির্ধারিত গাড়িতে। গন্তব্য—অ্যাগ্রোপার্ক লিংগেজেন। পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম, কৃষিতে এমন প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকায়ন কীভাবে সম্ভব হলো নেদারল্যান্ডসে? কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম এডে সেন্ট্রাল স্টেশনে, যেখানে আমাদের স্বাগত জানালেন ড. পিটার স্মিটস, সেদিনের গাইড ও হোস্ট। ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোকের চেহারায় বয়সের রেখা থাকলেও তাঁর চলন-বলনে ছিল এক অনন্য তারুণ্য।
পিটার আমাদের জানালেন, খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে জৈব নিরাপত্তার কারণে নেদারল্যান্ডসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের লোকজনকে উৎপাদনকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে বেশির ভাগ জায়গাই আমাদের দেখতে হবে গাড়ি থেকে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, একজন টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে আমি চেয়েছিলাম দর্শকদের ক্যামেরার চোখে দেখাতে, কীভাবে কাজ করছে আধুনিক ইউরোপের কৃষি।
প্রথম গন্তব্য ছিল ভেনলো এলাকার ‘ফ্রেশ পার্ক’। এলাকাটা আমাদের দেশের শিল্পনগরীর মতোই, এটি একধরনের কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পার্ক। গ্রিনহাউস বা খামার থেকে আসা কৃষিপণ্য এখানে সর্টিং, প্যাকেজিং ও ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য আসে। বড় বড় লরি পণ্য নিয়ে ছুটে চলে বিভিন্ন দেশে। গাড়ির ভেতর বসে পিটার আমাদের জানালেন, এখান থেকেই তাজা সবজি ও ফল বিদেশে যায়। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখা হয় প্রতিটি পণ্যকে সতেজ রাখার জন্য।
একপর্যায়ে দূরের এক ভবন দেখিয়ে পিটার বললেন, ওটা রয়্যাল জন, একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে কিছু কৃষক মিলে শুরু করেছিলেন। এখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত চার শতাধিক কৃষক। প্রতিদিন সকালে অনলাইনে অকশন হয়, সারা দিন ধরে সেই পণ্য দেশের বাজারে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বাইরে থেকে দেখা যতটুকু সম্ভব দেখলাম। ভেতরে খুব কম মানুষ, সবকিছু করছে রোবট। পুরো প্রক্রিয়া অটোমেটেড। প্রযুক্তির শৃঙ্খলা ও কার্যকারিতা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।
তারপর আমাদের গাড়ি চলল বারেনড্রেখ্টের দিকে। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্রিনহাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। কারখানাই বটে, তবে ফসল উৎপাদনের কারখানা। পিটার বলছিলেন, এখানে কোনো গ্রিনহাউসই ৫ হেক্টরের কম নয়। সকালের রোদ পড়ে চিকচিক করে উঠছে একেকটা গ্রিনহাউস। সারি সারি অসংখ্য গ্রিনহাউস। ২০১৪-১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্রিনহাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে নেদারল্যান্ডস পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে গ্রিনহাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। পিটার আমাদের পুনরায় হতাশ করলেন। বললেন, এখানেও কোনো গ্রিনহাউসে আপনারা প্রবেশ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি গ্রিনহাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করে তাঁদের চাষপদ্ধতি আমার দেশের কৃষককে দেখাতে পারব না। কোনো মানে হয়! পিটারকে বুঝিয়ে বললাম, আমি যদি ক্যামেরায় কোনো কিছু ধারণ করতে না পারি, আমার দর্শককে না দেখাতে পারলে শুধু বাইরে থেকে আমি দেখে গেলে লাভ কী?
পিটার ব্যাপারটা বুঝলেন। কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। আমাদের জানালেন, ‘ঠিক আছে, আপনাদের একটা ক্যাপসিকামের গ্রিনহাউসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তবে কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট লাইন অতিক্রম করা যাবে না।’ আমরা রাজি হলাম। কোনো কিছুতেই হাত দেব না। কোনো সীমাই আমরা অতিক্রম করব না। কেবল ক্যামেরায় দর্শকদের জন্য ভিডিও ফুটেজ ধারণ করব।
অবশেষে আমরা পৌঁছালাম বেমোলে, ফির্মা ফান ডার হার্ঘ নামের একটি গ্রিনহাউসে। ওখানে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ভেতরে ঢোকার আগে পিটার দেখালেন কার্বন ডাই-অক্সাইডের বড় ট্যাংক। বললেন, ‘ফসল বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রয়োজন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে আমরা বিদ্যুৎ, তাপ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড পাই। বিদ্যুৎ যায় জাতীয় গ্রিডে, তাপ ব্যবহৃত হয় গ্রিনহাউসে, আর কার্বন ডাই-অক্সাইড সংরক্ষিত থাকে এমন ট্যাংকে।’
ভেতরে ঢুকে দেখা হলো ইয়ন ফান ডের অলেখ-এর সঙ্গে। তিনিই গ্রিনহাউসের তরুণ মালিক। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও উদ্যমী মানুষ। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানতে পারলাম, গ্রিনহাউসটির জমির আয়তন ৮.৬ হেক্টর, গাছের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ, বার্ষিক উৎপাদন ২৫০০ টন লাল ক্যাপসিকাম, ফসলের সময়কাল ডিসেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।
ইয়ন জানালেন, ‘সবকিছুই কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত। সেচ, সার, পুষ্টি—সব নির্ধারিত হয় সফটওয়্যারের নির্দেশে। আমরা মূলত ‘ড্রিপ ওয়াটার ইরিগেশন’ ব্যবহার করি। পানির সঙ্গে মিশে থাকে সার ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। একফোঁটাও অপচয় হয় না।’
তিনি আরও বললেন, ‘আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করি, সেটিই সেচে ব্যবহার হয়। এমনকি তাপ নিয়ন্ত্রণ ও আলোর ব্যবস্থাও রোবট দ্বারা সম্পন্ন হয়।’ সত্যিই, এই গ্রিনহাউস যেন প্রযুক্তির এক নিখুঁত সাম্রাজ্য, যেখানে মানুষ কেবল নিয়ন্ত্রক, শ্রমিক নয়।
সবচেয়ে অবাক লাগল তাঁদের বায়োপেস্ট কন্ট্রোল পদ্ধতি দেখে। ইয়ন বললেন, ‘আমরা কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করি না। উপকারী পোকাই ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলে। লুপারস, হোয়াইট ফ্লাই বা স্পাইডার মাইট দমন করা হয় এমন পদ্ধতিতে।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, অর্থাৎ পোকা খায় পোকাকে? তিনি হেসে উত্তর দিলেন, ঠিক তাই!
এই দৃশ্যগুলো দেখে আমি বুঝেছিলাম, উন্নত জাতি মানেই শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তাও। নেদারল্যান্ডস প্রমাণ করেছে—প্রযুক্তি, দক্ষতা আর সততার সমন্বয় ঘটালে কৃষি হতে পারে এক সমৃদ্ধ শিল্প।
আজ যখন বিশ্বের নানা দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে, তখন নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে পথ—কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করেও উৎপাদন বাড়ানো যায়। তাদের কৃষি মডেল শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, এটি টেকসই উন্নয়নেরও প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশেও আমরা যদি কৃষিতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে আরও শক্তভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তবে কৃষি যেমন জীবিকার উৎস, তেমনি এটি হতে পারে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তিও।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকা বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে রাখাইনের ১৭টি শহরের ভেতর ১৪টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে আরাকান আর্মি দাবি করছে। দখল করা শহরের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মংডু, বুথিডাং এবং চিন রাজ্যের প
০৪ জানুয়ারি ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
১৯ ঘণ্টা আগে
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
২০ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। রোববার ফার্মগেটের কাছে মেট্রোরেলের ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গিয়ে একজন পথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং দুজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ঘটনাটি এবারে নতুন নয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে একই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেবার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
গত বছর যখন ৪৩০ নম্বর পিলারের কাছাকাছি এলাকা থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তখনই বিশেষজ্ঞরা নকশাগত ত্রুটির কথা বলেছিলেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান সে সময় গণমাধ্যমে বলেছিলেন, মেট্রোরেলের যেখান থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে গেছে, সেই জায়গাটিতে বাঁক আছে। ট্রেন যখন সেই জায়গাটি অতিক্রম করে তখন লাইনের এক পাশে বাড়তি চাপ তৈরি হয়। তখন বিয়ারিং প্যাডের একদিকে বাড়তি চাপ পড়লে অন্য রাবারের বিয়ারিং প্যাড ছিটকে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেই সাবধানতার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে রোববারের ঘটনাটি ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, এক বছর সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এবং নকশা তৈরি ও নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? তারা যে সেটা করেনি, এই ঘটনাই তার বড় প্রমাণ। এ জন্য প্রাণহানির দায় তারা এড়াতে পারে না।
কারণ, বাংলাদেশের মেট্রোরেলের নির্মাণব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ছিল। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ন্যায্যতা হিসেবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা উচ্চ গুণগত মান রক্ষার কথা বলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ কম হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ গুণগত মান রক্ষা করেনি তারা। মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে যখন এমন উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে, তখন এই অতিরিক্ত ব্যয়ের হিসাব এবং উচ্চমানের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন নয় কি?
ছিটকে পড়া বিয়ারিং প্যাডের ছবিতে আয়তাকার প্যাডের এক কোণে ভর বেশি থাকার যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা পিলারের সংযোগস্থলে সমান ভরের ত্রুটিকেই তুলে ধরে। এটি সুস্পষ্টভাবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং যথাযথ তদারকির অভাবকেই দায়ী করে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়েই তাদের দায় শেষ করতে পারে না। মানুষের জীবনের মূল্য কোনো আর্থিক সাহায্য দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
এখন খুব জরুরি করণীয় হলো, জাইকার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করে আন্তর্জাতিক মানের কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো মেট্রোরেলের লাইনের নকশা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা করা। এটা না করে যদি আবার ওই কোম্পানির ওপর ত্রুটি সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সেটা কোনো বিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না। কারণ মেট্রোরেল কেবল একটি পরিবহনব্যবস্থা নয়, এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ।

সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। কথাটি স্বাধীনতার পরপরই দেশে হইচই ফেলে দেয়। নির্মল সেনের কথাটি সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন থাকলেও, এরপর নানা ঘটনায় কথাটির প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। রোববার ফার্মগেটের কাছে মেট্রোরেলের ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গিয়ে একজন পথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং দুজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। ঘটনাটি এবারে নতুন নয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে একই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেবার কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
গত বছর যখন ৪৩০ নম্বর পিলারের কাছাকাছি এলাকা থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল, তখনই বিশেষজ্ঞরা নকশাগত ত্রুটির কথা বলেছিলেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান সে সময় গণমাধ্যমে বলেছিলেন, মেট্রোরেলের যেখান থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে গেছে, সেই জায়গাটিতে বাঁক আছে। ট্রেন যখন সেই জায়গাটি অতিক্রম করে তখন লাইনের এক পাশে বাড়তি চাপ তৈরি হয়। তখন বিয়ারিং প্যাডের একদিকে বাড়তি চাপ পড়লে অন্য রাবারের বিয়ারিং প্যাড ছিটকে বেরিয়ে আসে।
কিন্তু মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেই সাবধানতার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে রোববারের ঘটনাটি ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, এক বছর সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এবং নকশা তৈরি ও নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? তারা যে সেটা করেনি, এই ঘটনাই তার বড় প্রমাণ। এ জন্য প্রাণহানির দায় তারা এড়াতে পারে না।
কারণ, বাংলাদেশের মেট্রোরেলের নির্মাণব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ছিল। এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ন্যায্যতা হিসেবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাইকা উচ্চ গুণগত মান রক্ষার কথা বলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ কম হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, উচ্চ গুণগত মান রক্ষা করেনি তারা। মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে যখন এমন উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে, তখন এই অতিরিক্ত ব্যয়ের হিসাব এবং উচ্চমানের প্রতিশ্রুতি অর্থহীন নয় কি?
ছিটকে পড়া বিয়ারিং প্যাডের ছবিতে আয়তাকার প্যাডের এক কোণে ভর বেশি থাকার যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা পিলারের সংযোগস্থলে সমান ভরের ত্রুটিকেই তুলে ধরে। এটি সুস্পষ্টভাবে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং যথাযথ তদারকির অভাবকেই দায়ী করে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বা সরকার নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়েই তাদের দায় শেষ করতে পারে না। মানুষের জীবনের মূল্য কোনো আর্থিক সাহায্য দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
এখন খুব জরুরি করণীয় হলো, জাইকার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর না করে আন্তর্জাতিক মানের কোনো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো মেট্রোরেলের লাইনের নকশা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা করা। এটা না করে যদি আবার ওই কোম্পানির ওপর ত্রুটি সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সেটা কোনো বিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না। কারণ মেট্রোরেল কেবল একটি পরিবহনব্যবস্থা নয়, এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ।

বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন এলাকা বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে রাখাইনের ১৭টি শহরের ভেতর ১৪টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে আরাকান আর্মি দাবি করছে। দখল করা শহরের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মংডু, বুথিডাং এবং চিন রাজ্যের প
০৪ জানুয়ারি ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাদের উপনিবেশ দেশগুলোর অধিকাংশকেই স্বাধীনতা দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তবে তারা উপনিবেশ পরিত্যাগ করলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাকে একমুহূর্তের জন্যও বিসর্জন দেয়নি।
১৯ ঘণ্টা আগে
আজকের পৃথিবী সত্যিই হাতের মুঠোয়। সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাতে নিই মোবাইল ফোন। এরপর নোটিফিকেশন, মেসেজ, স্টোরি, ভিডিও—সবকিছু এক স্পর্শেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই অগণিত সংযোগের মাঝেই মানুষ যেন ক্রমেই আরও নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
কৃষিপ্রযুক্তির প্রসার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা পেয়েছি নেদারল্যান্ডসে গিয়ে। ইউরোপের এই ছোট দেশটি কৃষিতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই উদ্ভাবনী। যেখানে কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তির প্রয়োগ, উৎপাদন ও বিপণন এক সুসমন্বিত চক্রে ঘুরছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
১৯ ঘণ্টা আগে