Ajker Patrika

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমা চাইলেন মোস্তাফা জব্বার

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১১ জুন ২০২২, ২০: ৫৮
Thumbnail image

যারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে নানা রকম হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাঁদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। 

মন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা যারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন। আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই। তবে আমার ছোটখাটো বক্তব্য হচ্ছে এই, আমি যে ঘটনাগুলো শুনছি, সে ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে দোষটা বোধহয় আইনের থেকে বহুগুণে বেশি আইন প্রয়োগকারী এবং বিচার ব্যবস্থার মধ্যে। কারণ আমি এখানে যা দেখলাম, শুনলাম তাতে এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সব থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।’ 

আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আয়োজনে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভুক্তভোগী ও প্রকৃত অপরাধী’ শিরোনামে ভুক্তভোগীদের সম্মেলন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এসব কথা বলেন। 

আইনটি তৈরির আগে আইন সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেওয়া হয়েছিল। সেখানে সাংবাদিকদের একটু ক্ষোভ ছিল। কিন্তু সেটাকে অযৌক্তিক দাবি করে মন্ত্রী বলেন, ‘আইনটি সংসদে যাওয়ার পরে পুলিশেরা একটি বিষয়ে আমাকে বললেন। স্যার, কোথাও যখন ঘটনা ঘটবে, আমরা আদালতে গিয়ে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা নিয়ে এসে তারপরে যদি আসামিদের ধরতে যাই তাহলে তো ঘটনা ঘটে শেষ হয়ে যাবে। তখন আমরা কী করব? এমন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে একটি সংশোধনী এসেছিল, সেই সংশোধনী আমি গ্রহণ করেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে। যে, এটি পরিস্থিতি বুঝে সাব ইন্সপেক্টরের ওপরে যারা পুলিশ কর্মকর্তা আছেন, তাঁরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’ 

নারী ও শিশু নিরাপত্তা আইন, নারী এবং শিশুদের নিরাপত্তার জন্য করা হলেও, এটির সবচেয়ে বেশি অপপ্রয়োগ করা হয়েছে। তেমনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেরও অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ রাজনৈতিক কারণে করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন মোস্তাফা জব্বার। 

প্রয়োজনে এই আইনে পরিবর্তন আনা হবে ইঙ্গিত দিয়ে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেন, ‘আইন কোনো চিরস্থায়ী দলিল নয়। সংবিধান পর্যন্ত যদি আমরা পরিবর্তন করতে পারি, আইন পরিবর্তন করা কোনো বিষয় না। আইন যদি পরিবর্তন করার দরকার হয়, তাহলে পর্যালোচনা ও অন্যান্য যে বিষয়গুলো করার দরকার আছে, যেতে পারে।’ 

মন্ত্রী বলেন, ‘মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় সংঘটিত অপরাধগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তনের চিন্তাভাবনা এসেছিল। এই আইনের কারণে এমন পরিস্থিতি হবে এমনটা আমি ভাবতেও পারিনি! তখন যদি ভাবতে পারতাম, তাহলে আমি চেষ্টা করতাম যে, এই যে লাইন ধরে তারা বসে আছে...।’ 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়রানির শিকার ভুক্তভোগীদের দিকে ইঙ্গিত করে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘এটা এক ধরনের সংখ্যালঘু নির্যাতন। এই নির্যাতনগুলো যেন না হতে পারে আইনের দোহাই দিয়ে। এটার জন্য একটা রক্ষাকবচ রাখা যায় কি না সেটার জন্য আমাদের ভাবা উচিত ছিল।’ 

আলোচনা সভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীরা তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। 

গত বছর দুর্গাপূজার সময় দেশের পূজামণ্ডপ, মন্দিরগুলোতে হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন সরকারি বদরুন্নেসা কলেজের সহকারী অধ্যাপক রোমা সরকার। এর কারণে তাঁকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘এই আইনে মামলায় জড়িয়ে আমি চাকরিচ্যুত হয়েছি। এখনো চাকরিতে যোগদান করতে পারছি না। আমি অন্য দেশে গিয়ে উন্নত জীবনযাপন করতে পারতাম। কিন্তু দেশকে ভালোবাসি তাই সেটা করিনি। আমার কাছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই সমান। রাত আড়াইটায় দরজা ভেঙে আমাকে নিয়ে গেল। আমার সন্তান দুটো ঘুম থেকে উঠে এমন ভয়ানক পরিস্থিতি দেখল! পঁয়ত্রিশ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যখন কোনোভাবেই আমাকে দোষী প্রমাণ করতে পারল না, তখন তারা বলল, একে ছাড়া যাবে না, খুব ঘাউড়া। আমার মামলাটা যেন প্রত্যাহার করা হয়, আমি যেন শ্রেণিকক্ষে ফিরতে পারি। আমার বাচ্চারা যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে এই দাবি করি।’ 

সম্প্রতি শ্রেণিকক্ষে বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে ছাত্রের সঙ্গে তর্কের জেরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটকের পর জেলে যান মুন্সিগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘দেশে স্বাধীনতা নাই, স্কুলে বিজ্ঞান পড়াতে পারি না। পাঠ্যপুস্তকগুলো অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা দিয়ে ভরে যাচ্ছে। আমি মহানবীকে জ্ঞানীগুণী বলেছিলাম কিন্তু সেটাকে “না” লাগিয়ে দিয়ে আমাকে হয়রানি করা হয়েছে, শোকজ করা হয়েছে। আমি ১৯ দিন কারাবাসে ছিলাম। আমি কী অপরাধ করেছিলাম? ধর্মের প্রশ্ন তারা টেনেছে, আমি শুধু উত্তর দিয়েছি। আমি এই হয়রানি থেকে মুক্তি চাই। দেশে সত্যিকারের স্বাধীনতা চাই।’ 

সুনামগঞ্জের ঝুমন দাশ বলেন, ‘স্বাধীনতার সপক্ষে কথা বলে, মামুনুল হকের ভাস্কর্য বিরোধী কথার প্রতিবাদ করে আমি ধর্ম অবমাননার মামলা খেয়েছি। এই কারণে আমি জেলেও নিরাপদ ছিলাম না। আমাকে কারাগারে জবাই করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল অন্য ধর্মান্ধ কয়েদিরা!’ 

মোবাইল ফোন অন্য একজন নিয়ে ইসলাম অবমাননার পোস্ট দিয়ে তাঁকে নির্যাতন ও জেল খাটিয়েছে বলে দাবি করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পটুয়াখালীর জয়দেব চন্দ্র শীল। তিনি বলেন, ‘আমার ফোন কেউ একজন কথা বলার জন্য নিয়ে সেটা দিয়ে এসব পোস্ট করে। তারপর সেই আবার দলবল নিয়ে এসে আমাকে বেদম প্রহার করে। আমি আমার মেসে মারধরের শিকার হই, থানায় ও কারাগারে অন্য কয়েদিদের মারধরের শিকার হই। আমি নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে গেলেও কারাগারের চিকিৎসকেরা আমাকে চিকিৎসা সেবা দিতেও অস্বীকৃতি জানান।’ 

ভুক্তভোগীদের মধ্যে আরও কথা বলেন কুমিল্লার স্কুলশিক্ষক শংকর দেবনাথ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৎস্যজীবী জশরাজ দাস। 

অনুষ্ঠানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার এবং নির্যাতন এবং ভোগান্তির শিকার ভুক্তভোগীদের পরিত্রাণের বিষয়ে কথা বলেন বেশ কয়েকজন আলোচক। 

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন—একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ব্যারিস্টার তাপস পাল, অ্যাডভোকেট নাসির মিয়া, কাজল দেবনাথ, এ্যারোমা দত্ত এবং সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত