Ajker Patrika

মুরাদনগরের মা, মেয়ে ও ছেলে হত্যাকাণ্ডের হোতা চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল, নেপথ্যে মাসোহারা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও কুমিল্লা প্রতিনিধি
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৫৬
শিমুল বিল্লাল
শিমুল বিল্লাল

কুমিল্লার মুরাদনগরের আকুবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে মা, মেয়ে ও ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় মূল হোতা হিসেবে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লালের নাম। বিগত ১৭ বছরে দলীয় প্রভাব বিস্তার করে শূন্য থেকে কোটিপতি বনে যাওয়া এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মাটি ভরাট, ড্রেজার ব্যবসা, চাঁদাবাজি, সালিস-বাণিজ্য, মাদক কারবার থেকে মাসোহারা নেওয়ার মতো নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ বহুদিনের। চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল মুরাদনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক।

এদিকে এ ঘটনায় জড়িত আরও ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। ঢাকা ও কুমিল্লা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে দুজনকে গ্রেপ্তার করেন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। এ নিয়ে এ ঘটনায় আটজনকে গ্রেপ্তার করা হলো।

গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‍্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন।

গ্রেপ্তার নতুন ছয়জন হলেন বায়েজ মাস্টার, মুরাদনগরের আকুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাচ্চু মিয়া, রবিউল আউয়াল, আতিকুর রহমান, দুলাল ও আকাশ। তাঁদের গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর বনশ্রী ও কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুরাদনগরের বাঙ্গরা বাজার থানায় হস্তান্তর করা হয় বলেও জানান লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ। তিনি বলেন, আকুবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও একই ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাচ্চু মিয়াসহ কয়েকজনের ইন্ধনে এই মব ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে মুরাদনগরের বাঙ্গরা বাজার থানার কড়ইবাড়ি এলাকায় মোবাইল ফোন চুরিকে কেন্দ্র করে এই মব সৃষ্টি করা হয়।

নেপথ্যে মাদকের মাসোহারা

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া, আনু মিয়া, যুবলীগ কর্মী রাসেলসহ একটি চক্র পুরো ইউনিয়নে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করত। শিমুল বিল্লাল আওয়ামী লীগে যুক্ত হয়ে সাবেক সংসদ সদস্য ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের ছত্রচ্ছায়ায় দ্রুত ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। টিনশেড ঘরে বসবাস করা শিমুল এখন আকুবপুরে দোতলা বাড়ির মালিক। ঢাকায় রয়েছে ফ্ল্যাট ও জমি। গাজীরহাটে রয়েছে কোটি টাকার দোকান। তিনি ঠিকাদারিও করেন। বর্তমানে তাঁর নামে ১৩ কোটি টাকার সরকারি প্রকল্পের কাজ চলছে।

স্থানীয় সূত্রের ভাষ্য, নিহত রোখসানা বেগম রুবি ছিলেন এলাকার কুখ্যাত মাদক কারবারি। তাঁর কাছ থেকে প্রতি মাসে চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ৩০ হাজার, ইউপি সদস্য আনু মিয়া ও যুবলীগ কর্মী রাসেল ১০ হাজার টাকা করে মাসোহারা নিতেন। সম্প্রতি তাঁরা মাসোহারা বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা দাবি করলে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে।

মোবাইল ফোন চুরির সূত্রে হত্যাকাণ্ড

মঙ্গলবার (১ জুলাই) স্থানীয় এক শিক্ষকের মোবাইল ফোন চুরি হলে রুবির পরিবারের লোকজনকে সন্দেহ করা হয়। বোরহান নামের এক তরুণকে ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া ও ব্যবসায়ী বাছির উদ্দিন মারধর করেন। রুবি গিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে আনতে চাইলে কথা-কাটাকাটি হয়। বৃহস্পতিবার সকালে কড়ইবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আবার উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে রুবি বাচ্চু মিয়াকে চড় মারেন।

র‍্যাবের কর্মকর্তা লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ফোন চুরি নিয়ে ১ জুলাই সালিস হয়। সালিস করেন ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া। তবে কোনো মীমাংসা ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। এমনকি বোরহানকেও তাঁর পরিবার আর খুঁজে পাচ্ছিল না। এখনো তাঁকে পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে বোরহানের বাবা স্থানীয় থানায় বাচ্চু মেম্বারসহ চারজনের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দেন। এতে বাচ্চু মেম্বারসহ স্থানীয় ব্যক্তিরা ক্ষিপ্ত হন। ২ জুলাই রাতে ওই এলাকায় একটি সভা হয়। ওই সভায় রুবির পরিবারকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করেন বাচ্চু মেম্বারসহ অন্যরা।

৩ জুলাই সকালে চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও মেম্বার বাচ্চু মিয়াসহ শতাধিক ব্যক্তি রুবির ওই বাড়িতে যান। এ সময় রুবি ও তাঁর মেয়ের সঙ্গে চেয়ারম্যান ও মেম্বারের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তাঁদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এরপর সেখানে উপস্থিত সবাই হামলা করেন। তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করেন তাঁরা।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন রোকসানা বেগম রুবি (৫৩), তাঁর মেয়ে লিজা আক্তার (১৮) ও ছেলে রাসেল হোসেন (১৬। গুরুতর আহত হন আরও একজন। এ ঘটনায় প্রায় ৩৯ ঘণ্টা পর নিহত রুবির মেয়ে রিক্তা আক্তার বাদী হয়ে বাঙ্গরা বাজার থানায় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লালসহ ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

এলাকা থমথমে, আতঙ্কে মানুষজন

হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই পুরো কড়ইবাড়ি গ্রামে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেক বাসিন্দা এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা। সেনাবাহিনী ও পুলিশের টহল চলছে।

নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, ‘বাছির নেতৃত্ব দিয়ে পুরো হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছে। বাছিরের পরিবারের অনেক লোক হত্যাকাণ্ডে জড়িত। চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল ও মেম্বারের ইন্ধনে বাছির নেতৃত্ব দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। চেয়ারম্যান ঘটনার আগের দিনও এসেছিলেন কড়ইবাড়ি। ঘটনার দিন সকালে তিনি এখানেই ছিলেন। চেয়ারম্যান ও মেম্বার পুরো ঘটনায় জড়িত। তাঁরাই যুক্তি করে আমার স্বামীর পরিবারকে শেষ করে দিয়েছেন। আমি তাঁদের বিচার চাই।’

এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মহিউদ্দিন অঞ্জন বলেন, চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল বিগত ১৭ বছরে দলীয় প্রভাব বিস্তার করে বিপুল সম্পদের মালিক হন। এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করেননি। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর তিনি এনসিপির লোকদের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করেন।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করেও চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লালের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর মোবাইল ফোনটি বন্ধ রয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা যায়।

মুরাদনগর বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, শুক্রবার রাতে পুলিশের নিরাপত্তায় নিহত তিনজনের জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়। গ্রেপ্তার ৮ জনকে গতকাল বিকেলে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খানসামায় ১১ বছর আগের ঘটনায় সাবেক জামায়াত নেতার মামলা

‘স্ত্রী পরিচয়ে’ নারীর সঙ্গে রেস্ট হাউসে ওসি, খবর পেয়ে ছাত্রদল নেতার হাঙ্গামা

বিশেষ বিমানে ২৫০ জনকে সীমান্তে এনেছে ভারত, শিগগিরই ‘পুশইন’

হুসাইন (রা.)-এর হত্যার পেছনে দায়ীদের মৃত্যু হয়েছিল যেভাবে

মুরাদনগরের মা, মেয়ে ও ছেলে হত্যাকাণ্ডের হোতা চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল, নেপথ্যে মাসোহারা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত