Ajker Patrika

পদের অতিরিক্ত কর্মকর্তা, তবু দায়িত্বের বোঝা

  • কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নপ্রক্রিয়ায় জটিলতা এখনো কাটেনি।
  • মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সর্বোচ্চ চার উইংয়ের দায়িত্ব এক কর্মকর্তার।
  • সহকারী সচিব থেকে জ্যেষ্ঠ সচিব পর্যন্ত অনুমোদিত পদ ৩৬৯৬টি।
  • সহকারী সচিব থেকে জ্যেষ্ঠ সচিব পদে আছেন ৬৪৯০ কর্মকর্তা।
শহীদুল ইসলাম, ঢাকা
আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯: ২২
পদের অতিরিক্ত কর্মকর্তা, তবু দায়িত্বের বোঝা

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীমের মূল দায়িত্ব জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগে। এর অতিরিক্ত হিসেবে তাঁকে প্রশাসন ও বিধি অনুবিভাগ, কমিটি ও অর্থনৈতিক অনুবিভাগ এবং অতিরিক্ত সচিবের দপ্তরও সামলাতে হচ্ছে। এই বিভাগের নিচের স্তরের অনেক কর্মকর্তাকেও একাধিক দায়িত্বে রাখা হয়েছে।

শুধু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগই নয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক উইংয়ের দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে একজন কর্মকর্তাকে। অথচ জনপ্রশাসনে পদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ কর্মকর্তা রয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আট মাসের বেশি সময় পরও জনপ্রশাসনে এমন অবস্থা। কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নপ্রক্রিয়ায় জটিলতা এখনো কাটেনি। ফলে প্রশাসনে কাজেও গতিসঞ্চার হয়নি।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, অনুমোদিত পদের থেকে বেশি কর্মকর্তা থাকার পরও একজনকে একাধিক উইংয়ের দায়িত্বে রাখা শীর্ষ আমলাদের প্রশাসনিক ব্যর্থতা। এতে জনসেবা বিঘ্নিত হবে, প্রশাসনের কাজও ব্যাহত হবে। কারণ, একজন কর্মকর্তার পক্ষে একাধিক উইং সামলানো সম্ভব নয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, যেসব উইংয়ের শীর্ষ পদে যুগ্ম সচিবদের পদায়নের কথা ছিল, সেগুলোর বেশির ভাগ পদে এখন অতিরিক্ত সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া আছে। গত ২০ মার্চ যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে উইং প্রধান হিসেবে পদায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

একজন কর্মকর্তার একাধিক দায়িত্ব থাকলে প্রশাসনে কাজ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি জনসেবা বিঘ্নিত হবে বলে মত সাবেক আমলাদের। তাঁরা বলছেন, কাউকে দীর্ঘদিন একাধিক দায়িত্বে রাখা ঠিক নয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখন জ্যেষ্ঠ সচিবের ১০টি, সচিবের ৭৯টি, অতিরিক্ত সচিবের ২১২টি, যুগ্ম সচিবের ৫০২টি, উপসচিবের ১ হাজার ৭৫০টি এবং জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ও সহকারী সচিবের ১ হাজার ১৪৩টি পদ রয়েছে। এর বিপরীতে ১৪ জন জ্যেষ্ঠ সচিব, ৬৯ সচিব, ৩৭৮ অতিরিক্ত সচিব, ১ হাজার ৩৬ যুগ্ম সচিব, ১ হাজার ৪০৩ উপসচিব এবং ৩ হাজার ৫৯০ জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব কাজ করছেন।

সহকারী সচিব থেকে জ্যেষ্ঠ সচিব পর্যন্ত অনুমোদিত পদ ৩ হাজার ৬৯৬টি। এসব পদের বিপরীতে কাজ করছেন ৬ হাজার ৪৯০ জন। অর্থাৎ পদের থেকে ২ হাজার ৭৯৪ জন বেশি কর্মকর্তা থাকলেও একজন কর্মকর্তাকে একাধিক উইংয়ের দায়িত্বে রাখা হয়েছে।

এ এন এম মঈনুল ইসলাম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও প্রশিক্ষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব। এই দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে তাঁকে বিধি অনুবিভাগের দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে। আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোজাফফর আহমেদকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগের দায়িত্বে রাখা হয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হকের মূল দায়িত্ব সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগে হলেও অতিরিক্ত হিসেবে শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগের দায়িত্বও সামলাতে হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. শামীম খান একই সঙ্গে নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগ এবং প্রশাসন ও অর্থ অনুবিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। এই বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আবু নঈম আইন ও শৃঙ্খলা অনুবিভাগ এবং অগ্নি অনুবিভাগের দায়িত্বের পাশাপাশি নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অনুবিভাগের প্রধান মোহাম্মদ আবদুল কাদের শেখকে প্রশাসন ও অর্থ অনুবিভাগ এবং আইন ও শৃঙ্খলা অনুবিভাগের যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।

জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আতাউর রহমান খান একই সঙ্গে প্রশাসন ও অর্থ অনুবিভাগ, মেডিকেল অনুবিভাগ এবং উন্নয়ন অনুবিভাগের দায়িত্বে আছেন। অতিরিক্ত সচিব ড. নাসিম আহমেদকে আইন ও শৃঙ্খলা অনুবিভাগ এবং আনসার ও সীমান্ত অনুবিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুবিভাগ এবং জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্বে আছেন শাহ্ আসিফ রহমান। মো. আবুল হাসান মৃধাকে একই সঙ্গে পূর্ব ইউরোপ ও সিআইএস অনুবিভাগ এবং পশ্চিম ইউরোপ ও ইইউ অনুবিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্বে রাখা হয়েছে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের মো. মাহমুদ হাসান অধিগ্রহণ ও খাসজমি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব। অতিরিক্ত হিসেবে প্রশাসন অনুবিভাগের দায়িত্বও তাঁর। এই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. এমদাদুল হক চৌধুরীকে উন্নয়ন অনুবিভাগ এবং ডিজিটাইজেশন, নলেজ ম্যানেজমেন্ট ও পারফরম্যান্স অনুবিভাগের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মনিরুল ইসলামকে প্রশাসন অনুবিভাগ এবং সমন্বয় অনুবিভাগের দায়িত্ব দেওয়া আছে। এ ছাড়া এখন তিনি এই মন্ত্রণালয়ের সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন।

কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে প্রশাসনে বদলি ও পদায়ন করে। জটিলতা দেখা দিলে পরে বেশ কিছু বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। সরকারের চারজন উপদেষ্টা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে তাঁদের মতামত না নিয়ে তাঁদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন না করার নির্দেশনা দেন। এতে জটিলতায় পড়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে কয়েক শ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় এবং বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।

এদিকে জনপ্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বদলি, শৃঙ্খলা ও নিয়োগের ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে সরকার। এসব কমিটির অনুমোদন ছাড়া বদলি-পদায়নের পথ বন্ধ হওয়ায় ওই সব দপ্তরে অনেক পদ ফাঁকা রয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, উপদেষ্টাদের পছন্দ না হলে অনেক দপ্তরে কর্মকর্তাদের পদায়ন করা যায় না। ফলে অনেকের ঘাড়ে একাধিক উইংয়ের দায়িত্ব পড়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই মন্ত্রণালয়ে আসার জন্য অনেক কর্মকর্তা নানাভাবে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু যাঁরা নিজে থেকে আসতে চান তাঁদের কাউকেই নেওয়া হবে না। তাঁরা যোগ্য কর্মকর্তা খুঁজছেন।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ১ হাজার ১০০ প্রকল্প চলছিল। এসব প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কর্মকর্তারা জানান, এসব প্রকল্প বিবেচনায় রেখে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদের অতিরিক্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, যুগ্ম সচিবের পদে থাকা অতিরিক্ত সচিবেরা অবসরে গেলে সেখানে যুগ্ম সচিবদের পদায়ন করা হবে। এ ছাড়া যাঁদের নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে অন্য উইংয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, সেখানেও নতুন কর্মকর্তাদের শিগগির পদায়ন করা হবে।

যুগ্ম সচিব, উপসচিব, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবদের অনেককেও একাধিক উইংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে একাধিক দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বেশির ভাগ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, মন্ত্রণালয় দায়িত্ব দিলে কর্মকর্তাদের তা ম্যানেজ করে নিতে হয়। একাধিক দায়িত্বে থাকলে কাজে একটু সমস্যা হবে, এটিই স্বাভাবিক।

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং উপসচিব পুলে যুক্ত হওয়া কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নে গভর্নমেন্ট ইমপ্লয়ি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই পোর্টালের মাধ্যমে কোন দপ্তরে কোন যোগ্যতার কর্মকর্তা প্রয়োজন, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানা যায়। তবে অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থার সহায়তা না নিয়ে উপদেষ্টাদের পছন্দের ভিত্তিতে কর্মকর্তাদের বদলি করা হচ্ছে।

উপদেষ্টাদের ব্যক্তিগত পছন্দে কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন করা হলে প্রশাসনে সুশাসনের জন্য বড় অন্তরায় হবে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া।

অবশ্য উপদেষ্টা কমিটির কারণে জনপ্রশাসনে বদলি ও পদায়নপ্রক্রিয়ায় বিলম্ব হচ্ছে না বলে দাবি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হকের। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় তাঁরা আমাদের কিছু মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেন। সেটি অনুসরণ করে আমরা কাজ করি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উইংয়ে অতিরিক্ত সচিব নাকি যুগ্ম সচিব দেওয়া হবে, আমরা সেটি নিয়ে চিন্তা করছিলাম। আমরা বিভিন্ন উইংয়ে এখন যুগ্ম সচিবদের পদায়ন করব।’

দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, অল্প দিনের জন্য কাউকে অতিরিক্ত হিসেবে অন্য দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, তবে এটা রেগুলার প্র্যাকটিস হতে পারে না। কাউকে তিন-চারটি দায়িত্ব দিয়ে রাখলে তিনি ঠিকমতো কাজ করতে পারবেন না, এটা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের দলীয় ট্যাগিং দেওয়া এখনো বন্ধ হয়নি। সরকারি কর্মচারীকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে তাঁকে সুরক্ষাও দিতে হবে।

আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, উপদেষ্টাদের একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এরপর তাঁদের বিভিন্ন কমিটিতে রাখা হচ্ছে। নিয়মিত কাজ তো কমিটি দিয়ে হয় না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত