Ajker Patrika

ফৌজদারি মামলায় অব্যাহতি পেলেই কি আসামি বিপদমুক্ত?

সুলতান মাহমুদ, ঢাকা
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭: ০৭
Thumbnail image
প্রতীকী ছবি

২০০১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ডাকা হরতালের বিপক্ষে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি ডা. এইচ বি এম ইকবালের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের করা হয়। হরতালের পক্ষে বিএনপির মিছিল এবং বিপক্ষে ইকবালের নেতৃত্বে মিছিলটি মালিবাগ মোড়ে মুখোমুখি হয়।

তখন আওয়ামী লীগের মিছিল থেকে গুলি করা হলে বিএনপির চার কর্মী নিহত হন। নিহতরা হলেন জসিম উদ্দিন, খোকন, আব্দুর রশিদ মোল্লা ও নাজমা আক্তার।

পরে এ ঘটনায় তৎকালীন খিলগাঁও থানা বিএনপির সভাপতি ইউনুস মৃধা বাদীয় হয়ে একটি মামলা করেন। ২০০২ সালের ২৯ ডিসেম্বর এইচ বি এম ইকবাল, শাওনসহ ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে বিচারিক আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৭ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই মামলা থেকে ইকবাল, শাওনসহ ১৫ জনের নাম প্রত্যাহারের সুপারিশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর আদালত ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট ও ২৯ সেপ্টেম্বর ১৫ জন আসামিকে অব্যাহতি দেন।

গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ওই মামলার বাদী তৎকালীন খিলগাঁও থানা বিএনপির সভাপতি ইউনুস মৃধা ২০১০ সালের দুটি আদেশ বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন।

গত ৬ নভেম্বর বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. এইচ বি এম ইকবাল ও নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনসহ ১৫ জনের অব্যাহতির আদেশ স্থগিত করেন। সেই সঙ্গে অবিলম্বে তাঁদের বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অন্য আসামিরা হলেন শওকত হোসেন, কবির উদ্দিন আহমেদ, আব্দুস সালাম, মুন্সি কামরুজ্জামান কাজল, মনিরুজ্জামান ওরফে লিটন, ইমদাদুল হক ওরফে বাচ্চু, আব্দুল হালিম, আবুল বাশার, জসিম উদ্দিন, দুলাল ওরফে লন্ড্রি দুলাল, তারেক সামছুল খান, কামরুল মোর্শেদ ও এস এম আরমান।

আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম। আদেশের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিএনপির মিছিলে গুলি করে হত্যার ঘটনায় পুলিশ ও ভিকটিম ইউনুস মৃধা পৃথক মামলা করেছিলেন। দুই মামলায় চার্জশিট দেওয়ার পর মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন থাকাবস্থায় ১৫ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে বাকিদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান আছে।’

আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘৫ আগস্টে পটপরিবর্তনের পর মামলার বাদী ইউনুস মৃধা হাইকোর্টে ২০১০ সালের দুটি আদেশ (১৫ জনকে অব্যাহতি) চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেন। হাইকোর্ট দুটি আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত করে রুল জারি করেছেন। আর ১৫ আসামিকে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখন মামলাটিতে ১৫ জনের বিরুদ্ধে বিচার চলবে।’

এই মামলায় দেখা যায়, ফৌজদারি মামলায় কোনো আসামি আদালত থেকে অব্যাহতি পেলেও তিনি পুরোপুরি বিপদমুক্ত হন না। তার বিপদ কিছুটা থেকেই যায়। তবে ফৌজদারি মামলায় চার্জ গঠনের পর খালাস পেলে আসামি বিপদমুক্ত হন।

একটি ফৌজদারি মামলা-সংক্রান্ত সকল বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করেন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও দায়রা আদালত। ফৌজদারি মামলা সাধারণত তিনভাবে দায়ের হয়। যথা—

এক. পুলিশি মামলা (জিআর কেস)

দুই. নালিশি মামলা (সিআর কেস)

তিন. নন-জিআর মামলা

এর মধ্যে পুলিশি মামলা ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে আমলযোগ্য অপরাধ। আর নন-জিআর মামলা হলো আমল অযোগ্য অপরাধ। নালিশি মামলা আমলযোগ্য ও আমল অযোগ্য উভয়ই হতে পারে। আমল অযোগ্য হলে পুলিশ মামলা নিতে চায় না। এমতাবস্থায় ফরিয়াদি সরাসরি আদালতে বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মামলা দায়ের করেন।

মামলাটি যে ধরনেরই হোক না কেন, ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কর্তৃক বিচার্য হবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩২ ধারা মোতাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা সাপেক্ষে। দায়রা আদালত আমলযোগ্য অপরাধের বিচার করে ফৌজদারি ১৯৩ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট যখন আসামিকে দায়রা আদালতে প্রেরণ করে।

অব্যাহতি: কোনো ফৌজদারি মামলায় চার্জ গঠনের আগে চার্জ শুনানির সময় আদালত যদি দেখেন যে আসামি সম্পর্কে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন বা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণাদি পাওয়া না গেলে, তাকে সংশ্লিষ্ট অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেওয়াকে অব্যাহতি বলা হয়।

আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার ফলাফল: ফৌজদারি মামলায় কোনো আসামিকে অব্যাহতি দেওয়া হলে পরবর্তীকালে একই মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা যাবে, যদি পরবর্তী সময় তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। তারপর অভিযোগ সন্দেহাতীত প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী নির্ধারিত শাস্তি দেওয়া যাবে। তবে চার্জ গঠন করে সাক্ষ্য নেওয়ার পরে যদি অভিযোগ সন্দেহাতীত প্রমাণিত না হয়, তাহলে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় বলা আছে, ‘পাবলিক প্রসিকিউটর রায় ঘোষণার পূর্বে আদালতের অনুমতি নিয়ে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত মোকদ্দমা সাধারণভাবে বা যে সমস্ত অপরাধে তার বিচার করা হইতেছে, তার যেকোনো এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে প্রত্যাহার করতে পারবেন এবং এই প্রত্যাহারের ফলে—

(ক) অভিযোগ প্রণয়নের পূর্বে এটা করা হলে উক্ত এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে আসামিকে অব্যাহতি দান করতে হবে এবং

(খ) অভিযোগ প্রণয়নের পর এটা করা হলে অথবা এই বিধির আওতায় কোনো অভিযোগ প্রণয়ন আবশ্যক না হলে উক্ত এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে আসামিকে খালাস দিতে হবে।

খালাসের ফলাফল: আইনের সাধারণ নীতি হলো, একজন ব্যক্তিকে খালাস দেওয়া হলে তাকে পুনরায় একই মামলায় অভিযুক্ত করা যাবে না এবং দণ্ডিত কার যাবে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এক অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারিতে সোপর্দ ও দণ্ডিত করা যাইবে না।’

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে তার বিচার হলে এবং তাকে সাজা বা খালাস দেওয়া হলে ওই একই অপরাধে পুনরায় বিচার তার করা যাইবে না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত