Ajker Patrika

গণভোটের প্রশ্ন ও সময় পরিবর্তনের চিন্তা নেই

  • প্রশ্ন সংশোধন করে আপত্তির বিষয়গুলো সংযুক্ত করার দাবি বিএনপির।
  • আপত্তির বিষয়গুলো যে নেই, তা স্পষ্ট করতে বলেছে এনসিপি।
  • জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা দলগুলোর চাওয়া গণভোট আগে হোক।
তানিম আহমেদ, ঢাকা 
গণভোটের প্রশ্ন ও সময় পরিবর্তনের চিন্তা নেই

রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারই সিদ্ধান্ত নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো এই আদেশের সরাসরি বিরোধিতা না করলেও নিজ নিজ অবস্থান থেকে গণভোটের সময় ও প্রশ্নসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। তবে সরকার বলেছে, গণভোটের প্রশ্ন পরিবর্তন করার সম্ভাবনা আপাতত নেই। ভোটের সময় পরিবর্তনেরও চিন্তা নেই সরকারের।

১৩ নভেম্বর জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ জারি করে সরকার। এই আদেশের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। একটি প্রশ্নে চারটি বিষয়ের ওপর জনগণ হ্যাঁ বা না ভোট দিতে পারবে।

গণভোটের প্রশ্নে সংশোধনী এনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নোট অব ডিসেন্ট না রাখার বিষয়টি স্পষ্ট করতে বলেছে। আর জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর দাবি, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হোক। তবে ভোটের আগে গণভোট নিয়ে জামায়াত শেষ পর্যন্ত অনড় অবস্থানে থাকবে না বলে সূত্রে জানা গেছে।

গণভোটের প্রশ্ন ও দিনক্ষণ পরিবর্তনে সরকারের কোনো চিন্তাভাবনা নেই বলে জানান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, যে তারিখ (গণভোট) ঘোষিত হয়েছে এবং আয়োজনের সুবিধার্থে সরকার সে তারিখকেই বাস্তবসম্মত মনে করছে। প্রশ্ন পরিবর্তনের বিষয়েও সরকার কিছু চিন্তা করছে না।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিএনপি-এনসিপির দাবি অনুযায়ী গণভোটের প্রশ্ন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছি না। এ ক্ষেত্রে সরকার একটি বিষয়ে পরিবর্তন করলে, অনেক বিষয় পরিবর্তন করতে হবে। তখন জামায়াতের দাবি অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করতে হবে। তাই আদেশের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সরে আসার সম্ভাবনা দেখি না।’

গণভোটের ফলাফল ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন সরকারের দায়িত্বশীলেরা। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি তো গণভোটে ‘না’ ভোটের প্রচার করতে পারবে না। যদি করে তখন তারা সংস্কারবিরোধী হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিতি পাবে। অন্যদিকে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলে বাস্তবায়নে বিএনপির ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে, সেটি নিয়ে তারা চিন্তিত।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। তারা প্রশ্নের সরাসরি সমালোচনা করতে পারবে না। আবার সমর্থনও করতে পারছে না। বিরোধিতা করলে ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে পারে। অন্যদিকে, গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলে রাষ্ট্র পরিচালনায় জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা করছে দলটি। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গণভোট প্রশ্নের ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা নিয়ে আপত্তি আছে। যেখানে ‘ক’ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী হবে, যেখানে প্রক্রিয়া বলতে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) রাখা হয়নি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), ন্যায়পাল, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনে বিএনপির আপত্তি রয়েছে।

অন্যদিকে ‘খ’ ধারায় দুই কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) উচ্চকক্ষ ও উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদনে সংবিধান সংশোধনের বিধানেও বিএনপির আপত্তি আছে। যেখানে আদেশ মানলে বিএনপিকে ‘হ্যাঁ’ ভোটের পক্ষে ভোট দিতে হবে। ‘ক’ ও ‘খ’ ধারাটি পরিবর্তনের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দাবি জানানো হবে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। তবে প্রশ্নের ‘গ’ ও ‘ঘ’ ধারা নিয়ে বিএনপির আপত্তি নেই।

বিষয়টি নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা স্বাক্ষরিত জুলাই সনদকেই রাষ্ট্র সংস্কারের ভিত্তি হিসেবে দেখছি। সেখানে গণভোটে যেসব বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে, যেসব বিষয়ে গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। সেসব বিষয়ের সঙ্গে স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থা থাকলে, তা পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হবে।’

গণভোটের মূল প্রশ্ন নিয়ে এনসিপির আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার। তবে প্রশ্নের অতিরিক্ত ধারাগুলো নিয়ে দলটির আপত্তি রয়েছে। বিশেষ করে ‘ক’ ধারাটি স্পষ্ট করার দাবি তাদের। সেখানে বলা আছে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে। এটাকে এমনভাবে বলা হয়েছে, যে সরকার আসবে, তারা দলীয় অবস্থান অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতে পারবে। বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে।

সরোয়ার তুষার আজকের পত্রিকাকে বলেন, গণভোটের মূল প্রশ্নটা ঠিক আছে। সেখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই। কিন্তু ব্যাখ্যামূলক (ক, খ, গ ও ঘ) প্রশ্নে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে, সেগুলো দূর করা উচিত।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আরও বলেন, অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। সেটার মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পড়বে কি? পড়বে না? এটা তো ফাঁকা রাখলে সমস্যা। আবার বলা হয়েছে, স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের কথা বলা আছে। সে ক্ষেত্রে কোন কোন দল বলতে পারে, আমরা যেহেতু আপত্তিসহ (নোট অব ডিসেন্ট) স্বাক্ষর করেছি। তাই সেটি কার্যকর হবে। গণভোটে আপত্তিগুলো কার্যকর হবে না—সেটি পরিষ্কার হয়নি।

জামায়াতের পক্ষ থেকে গণভোটের বিষয়ে সরকারকে প্রচার চালানোর অনুরোধ করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কোন কোন সেক্টরে পরিবর্তন হবে, সেগুলো তুলে ধরার আহ্বান জানানো হচ্ছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গতকাল রোববার এক কর্মসূচিতে বলেন, নির্বাচন কমিশন তার ওয়েবসাইটে পাবলিক করতে পারে, সরকারি প্রচারপত্র বিলি করে, জাতীয় প্রচারমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করে, জনগণ যেন এই সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারে। তার প্রয়োজনীয় উৎসাহ দেওয়া, প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে জিনিসটাকে সহজ করা দরকার। তিনি আরও বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বক্তব্যে যেভাবে বলেছেন, সাধারণ স্বল্পশিক্ষিত মানুষ সংস্কারের ইন্টারনাল এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ খুব কমই বোঝে। এটাকে অতি সহজ করে, কিসে আমরা “হ্যাঁ” বলতে যাচ্ছি—সংস্কারে গৃহীত সব বিষয়কে অতি সহজ করে ভোটারদের কাছে, দেশবাসীর কাছে সরকারকে পেশ করতে হবে।’

গণভোটের বিষয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ভিডিও তথ্যচিত্র, পোস্টার বানানোসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন, পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ছাড়াও দেয়ালে টানানো হতে পারে। সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, সেখানে গণভোটে কোন সংস্কারের বিষয়ে মানুষ ভোটে দেবে, সেগুলো আলাদা আলাদা এবং একসঙ্গে প্রচার করা হবে। নির্বাচন পর্যন্ত এ প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।

সূত্রে জানা গেছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন, সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ এবং পিআরে উচ্চকক্ষ গঠিত হলে রাষ্ট্র কাঠামোয় যে জবাবদিহি নিশ্চিত হবে, প্রচারে সেগুলো তুলে ধরা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...