Ajker Patrika

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন: সংশোধনীর কয়েকটি ধারা নিয়ে বিতর্ক

  • প্রাপ্তবয়স্কদের সম্মতির যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ নয়
  • শুধু পুরুষের জন্য সাজার বিধান
  • মিথ্যা মামলার সাজা কমিয়ে দুই বছর
এস এম নূর মোহাম্মদ, ঢাকা 
আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১১: ৪৮
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মাগুরার আলোচিত শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত করার জন্য আইন সংশোধন করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে গত ২৫ মার্চ গেজেট প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশোধিত আইনে ধর্ষণের বিচারের সময়সীমা কমিয়ে ৯০ কার্যদিবসে আনা হয়। ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল উপযুক্ত মনে করলে মেডিকেল সার্টিফিকেট এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে বিচারকাজ সম্পন্ন করতে পারবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগের আইনে অভিযুক্ত ও অপরাধের শিকার ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল।

সংশোধিত আইনে পারস্পরিক সম্মতির শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। তবু এ ক্ষেত্রে শুধু পুরুষের জন্য সাত বছরের সাজার বিধান রাখা এবং মিথ্যা মামলার বাদীর সাজা কমিয়ে দুই বছর করা হয়েছে। আইনের এসব সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে এরই মধ্যে রিট করা হয়েছে হাইকোর্টে। আইনজ্ঞেরা বলেছেন, এই আইনে পুরুষদের হয়রানির প্রচুর সুযোগ রয়েছে। কেননা এসব ঘটনায় বাদীর পরিচয় প্রকাশ করতে না পারলেও আসামির পরিচয় নানাভাবে প্রকাশ করা হয়।

সংশোধিত আইনের ৯খ ধারায় বলা হয়েছে, “যদি কোন ব্যক্তি দৈহিক বল প্রয়োগ ব্যতীত বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে ষোলো বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সঙ্গে যৌনকর্ম করেন এবং যদি উক্ত ঘটনার সময় উক্ত ব্যক্তির সহিত উক্ত নারীর আস্থাভাজন সম্পর্ক থাকে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক সাত বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।”

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই আইনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে নারী ও শিশুদের বিশেষ সুরক্ষা প্রদান। নারীরা বর্তমানে অনেক এগিয়েছে। নারীরা সব ক্ষেত্রে সমানভাবে কাজ করছে। সুতরাং নারীদের পশ্চাৎপদ ভেবে শুধু তাদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ আইন করে বরং তাদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। তাই শিশুদের নিরাপত্তার জন্য আইন রেখে নারীদের জন্য এ রকম বিশেষ আইন না রাখার পক্ষে আমার অবস্থান।’

নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা আইনজীবী ইশরাত হাসানও প্রায় একই রকম মন্তব্য করেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, সম্মতির ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্কে ‘কন্ট্রিবিউটরি পার্টিসিপেশন’ থাকে। এখানে একপক্ষকে শাস্তি দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। অনেক ক্ষেত্রে নারীরাও প্রেম বা সম্পর্ক ভেঙে দেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রাক্তন একইভাবে সেই নারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন না।

হানিফ শেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলায় ১৯৯৮ সালে হাইকোর্ট তার রায়ে বলেন, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে, তাহলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। যা ৫১ ডিএলআর (ঢাকা ল রিপোর্ট)-এ উল্লেখ রয়েছে। আর সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় ২০০৫ সালের রায়ে হাইকোর্ট বলেন, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনোরূপ বাধা না দেয় অথবা বাধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয়, তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে। বিষয়টি ৫৭ ডিএলআরে উল্লেখ রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান বলেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে শারীরিক সম্পর্কের পর প্রতিশ্রুতি না রাখা প্রতারণার অপরাধ হতে পারে। প্রতারণার অপরাধের বিচারের ব্যবস্থা দণ্ডবিধিতে রয়েছে। তাই প্রতারণার অপরাধ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আলাদা করে না থাকাই সমীচীন। কেননা এই বিধানের প্রচুর অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ২০১৭ সালে ২৮ মার্চ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দুজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে নিয়ে ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার ৩৮ দিন পর করা হয় মামলা। দীর্ঘ শুনানির পর ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর রায় দেন আদালত। যাতে ৫ আসামির সবাইকে খালাস দেওয়া হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে ওই সময় আদালত ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেল পরীক্ষা এবং মামলা করার পরামর্শ দেন।

ভারতের ওড়িশা হাইকোর্ট ২০২৩ সালে জানিয়েছেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ নয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভুবনেশ্বরের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে করা ধর্ষণ মামলা খারিজ করে দেন ওড়িশা হাইকোর্ট। আর দীর্ঘ শারীরিক সম্পর্কের পরও কেউ যদি বিয়ে করতে অসম্মত হন, তবে তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে না বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্ট।

এর আগে কোনো নারী যদি স্বেচ্ছায় পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং পরে সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়, তাহলে ওই নারী ধর্ষণের অভিযোগ করতে পারেন না বলে জানিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ২০২২ সালের জুলাইয়ে বিচারপতি হেমন্ত গুপ্ত ও বিক্রম নাথের বেঞ্চ এমনটি উল্লেখ করেন।

সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯খ ধারা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হয় ৭ এপ্রিল। রিটকারীদের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে কেউ এ আইনের অপব্যবহার করতে পারেন। কেউ কেউ এ রকম ধারায় মামলা করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করতে পারেন। এর ফলে মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া; এমনকি মামলাবাণিজ্যও হতে পারে। তাই, অপরাধ হলে দুজনেরই হবে। শুধু পুরুষকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বিধান করে আইন পাস করা সংবিধান ও ন্যায়বিচার পরিপন্থী। এ ছাড়া মিথ্যা মামলার সাজা কমিয়ে দুই বছর করা কোনোভাবেই সমীচীন নয় বলে মনে করেন তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত