Ajker Patrika

জুলাই জাতীয় সনদ: ভোটের দিনই গণভোট করার চিন্তা সরকারের, থাকবে একাধিক প্রশ্ন

  • আইনি সংকট এড়াতে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরেই আদেশ জারি হবে
  • ৩৬৫ দিনের জন্য দ্বৈত ক্ষমতা পাবে সংসদ
  • সংবিধান-সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাবকে এক ব্যালটে চার-পাঁচটি প্রশ্নে ভাগ করার পরিকল্পনা
তানিম আহমেদ, ঢাকা 
আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ০৮
জুলাই জাতীয় সনদ: ভোটের দিনই গণভোট করার চিন্তা সরকারের, থাকবে একাধিক প্রশ্ন

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ কিছুটা সংশোধন করে আদেশ জারির প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। ১৫ নভেম্বর আদেশ জারি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে আদেশ জারির পাশাপাশি গণভোটে এক ব্যালটে একাধিক প্রশ্ন রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে আগামী জাতীয় সংসদকে ৩৬৫ দিনের জন্য দ্বৈত ক্ষমতা দিয়ে সনদে থাকা সুপারিশগুলো সংবিধানে সংযুক্ত করতে বলা হতে পারে।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর দুটি সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ জারির কথা বলা হয়েছে। তফসিলে সংবিধান-সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাব আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) ছাড়াই রাখা হয়েছে। তফসিলে থাকা সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবের পক্ষে ‘হ্যাঁ/না’ গণভোটের কথা বলা হয়েছে। গণভোটের ফল ইতিবাচক হলে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা একযোগে সংসদ সদস্য (এমপি) ও সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তারা প্রথম অধিবেশন থেকে ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করবেন।

ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ জমা দেওয়ার পর সনদে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) না রাখার সমালোচনা করেছে বিএনপি। দলটি আপত্তিসহ সনদ বাস্তবায়ন এবং জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট করার দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনের আগেই গণভোটের দাবিতে মাঠে কর্মসূচি পালন করছে জামায়াতে ইসলামীসহ আট সমমনা দল। এমন অবস্থায় গত ৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে সমঝোতায় পৌঁছাতে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সরকারের অনুরোধে দলগুলো সাড়া দেয়নি।

জানা গেছে, আদেশ চূড়ান্ত করতে ছয় উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাঁরা হলেন, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। এই উপদেষ্টারা আদেশ চূড়ান্ত করতে গত কয়েক দিন ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করেছেন।

সূত্র জানিয়েছে, কমিশনের সুপারিশ করা জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ নামেই আদেশ জারির বিষয়ে প্রায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা। দলগুলোর আপত্তি থাকায় গণভোটে একাধিক প্রশ্ন রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা আগামীকাল অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে চূড়ান্ত করে আগামী শনিবার রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জারির সম্ভাবনা আছে।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে আমাদের একটা ঐক্যবদ্ধ নির্দেশনা দেবে, এ ধরনের প্রত্যাশা আমরা করেছিলাম। কিন্তু প্রত্যাশা করেই আমরা বসে থাকিনি। আমরা নিজেদের মতো কাজ করেছি। সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি, তা আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে পরিষ্কারভাবে জানতে পারবেন। তিনি বলেন, আমরা উপদেষ্টা পরিষদের বিভিন্ন পর্যায়ে এটা আলোচনা করছি। সব দলের প্রত্যাশার সমন্বয় ঘটিয়ে দেশের এবং জনগণের স্বার্থে যা করা দরকার সেটাই আমরা করতে যাচ্ছি।

সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের প্রস্তাবের কিছু পরিবর্তন করছে সরকার। সনদে থাকা সংবিধান-সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাবকে এক ব্যালটে চার-পাঁচটি প্রশ্নে ভাগ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যার মধ্যে আপত্তি না থাকা ৩০টি বিষয়ে একটি প্রশ্ন। বাকি ১৮টি নিয়ে চারটি প্রশ্ন করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে আলাদা প্রশ্ন থাকতে পারে।

গণভোটে কি প্রশ্ন বাড়তে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, উপদেষ্টাদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে গণভোটে একাধিক প্রশ্ন করার বিষয়ে মতামত দেওয়া হয়েছে। সেইভাবে আদেশটি তৈরি করা হচ্ছে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) পদ্ধতি উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর বলে জানা গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে আপত্তি রাখার পক্ষে নয় সরকার। সে ক্ষেত্রে সনদে থাকা প্রস্তাবের পক্ষে হ্যাঁ/না ভোট হতে পারে।

জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করার দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে চলতি নভেম্বরে গণভোট করার দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে সমাবেশ করেছে জামায়াতসহ সমমনা আটটি দল। তবে জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করার পরিকল্পনা সরকার করছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ৪২ হাজার ৭৬১ ভোট কেন্দ্র স্থাপনের কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ভোটের দিন গণভোট হলে কেন্দ্রের সংখ্যা কমপক্ষে ১০ হাজার বাড়ানোর চিন্তা ভাবনা করছে সরকার।

সূত্রের দাবি, ভোটের দিন গণভোট করার পক্ষে সরকারের যুক্তি হলো—নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন আলাদাভাবে করার সক্ষমতা নেই। আবার আগে গণভোট হলে, সেটাকে কেন্দ্র কোনো ধরনের ঘটনা ঘটলে জাতীয় নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে হলে ভোট গণনা সময়সাপেক্ষ হওয়ার কথাটি সরকারের চিন্তায় আছে। সে ক্ষেত্রে গণনায় দুই দিন সময় লাগতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে আদেশ জারির পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। জামায়াত ও এনসিপি প্রধান উপদেষ্টার মাধ্যমে আদেশ জারির প্রস্তাবের বিষয়ে সরকারের একটি সূত্র বলছে, এটি সম্ভব না। প্রধান উপদেষ্টা জারি করলে নতুন আরেকটি সংকট তৈরির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিষয়টি এড়ানোর জন্য রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে আদেশ জারি করা হবে। তবে সেটি অবশ্যই প্রজ্ঞাপন না।

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রস্তাবগুলো সংবিধানে যুক্ত করার কথা আদেশে থাকবে বলে জানা গেছে। সে ক্ষেত্রে ২৭০ দিনের বদলে ৩৬৫ দিন বা এক বছর কিংবা কমিয়ে ১৮০ দিন বা ছয় মাস রাখা হতে পারে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন না হলে কী হবে, সেটি আদেশে নাও থাকতে পারে বলে সূত্রে জানা গেছে।

এক কর্মকর্তা বলেন, সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন না করার আশঙ্কাও আছে, সে ক্ষেত্রে তো আমাদের কিছুই করার নেই। সময়সীমা বেঁধে না দিয়ে পাঁচ বছর টানার কোনো মানেই হয় না। সে ক্ষেত্রে কি ২৭০ দিনের সময়সীমা বাড়াতে পারে—এমন প্রশ্নে ওই কর্মকর্তা বলেন, দিন তো কমানোও হতে পারে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে অত দিন লাগে না।

রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলেন, সবাইকে কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে। সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থানে থাকেন, তাহলে তো দেশে নির্বাচনই হবে না। গণভোটের বিষয়টি ছাড়া আদেশের অন্যান্য আইনি দিক কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রূপের ঈর্ষায় ৩ মেয়েশিশুকে চুবিয়ে হত্যা, দেখে ফেলায় রেহাই পায়নি নিজের ছেলে

সিসিইউতে নিবিড় তত্ত্বাবধানে খালেদা জিয়া, আশাবাদী চিকিৎসকেরা

ইউরোপ চাইলে রাশিয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত—পুতিনের এই মন্তব্যে ব্রিটেনের তীব্র প্রতিক্রিয়া

কে এই কৃষ্ণ নন্দী, তাঁকে জামায়াত প্রার্থী করল কেন

জামায়াতে ইসলামীর প্রথম হিন্দু প্রার্থী খুলনার কৃষ্ণ নন্দী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ