Ajker Patrika

নিরীক্ষা প্রতিবেদন: কেনাকাটায় হাতখোলা মাউশি

  • আসবাব কেনাকাটায় ৩০ কোটি টাকার অনিয়মের তথ্য প্রতিবেদনে।
  • আসবাব না দিলেও বিল পরিশোধ। কাজ পায়নি সর্বনিম্ন দরদাতারা।
  • প্রকল্পে কেনাকাটার বেশ কিছু নথি গায়েব, থানায় জিডি।
  • অভিযোগ তদন্তে একাধিক কমিটি, তদন্তে দুদকও।
রাহুল শর্মা, ঢাকা
নিরীক্ষা প্রতিবেদন: কেনাকাটায় হাতখোলা মাউশি

সব মালপত্র (আসবাব) সরবরাহ না পেয়েও ঠিকাদারকে পুরো বিল দিতে কার্পণ্য করা হয়নি। আবার দুটি ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে অনেক বেশি দরে দেওয়া হয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ দরদাতাকে। খরচে এমন হাতখোলা মনোভাব দেখা গেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন ‘সরকারি কলেজসমূহে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ (ফোসেপ) প্রকল্পে (১ম সংশোধিত)।’

তবে এতে সরকারের ৩০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) অধীন। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, প্রকল্পের মূল কাজ ভবন নির্মাণ ও পদ সৃজনের পরিবর্তে কেনা-কাটায় বেশি মনোযোগ দেখা গেছে। এই কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় একাধিক তদন্ত কমিটিও হয়েছে। দুই দফায় প্রকল্প পরিচালক বদল করা হয়েছে। তবে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারেনি প্রকল্পটি।

শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকা অনিয়মের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মজিবর রহমান বলেন, বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

মাউশির বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৫১১ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার টাকা এবং প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করে ব্যয় ২ হাজার ৫৫০ কোটি ১৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা করা হয় এবং দুই দফায় দুই বছর করে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। সম্প্রতি প্রকল্পের মেয়াদ আবার বাড়াতে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দেওয়া হলেও তা নাকচ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে বিভিন্ন কলেজে ১৭৬টি ছয়তলা একাডেমিক ভবন ও ৩৫টি হোস্টেল নির্মাণ এবং কয়েকটি ভবন সংস্কার করা হচ্ছে। এ ছাড়া ২০০টি কলেজে অফিস সরঞ্জাম, কম্পিউটার সামগ্রী, বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি ও আসবাব সরবরাহ এবং ১ হাজার ৯১৪টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কথা। বাজারের চাহিদার আলোকে ১০টি নতুন বিষয় চালু, ৮ হাজার ৬২৫টি বিজ্ঞান শিক্ষকের ও হোস্টেলের কর্মচারীর ৪৫৫টি পদ সৃজনও এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।

শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চারটি কলেজ ও একটি হোস্টেলের জন্য ২ কোটি ৩৫ লাখ ২ হাজার ৪০২ টাকার আসবাব কিনতে দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। দরপত্রের শর্তে ৬৫৬টি সিঙ্গেল খাট সরবরাহের কথা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেয় ৪১৭টি। বাকি ২৩৯টি খাট না দিলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এসব খাটের মূল্য হিসেবে অতিরিক্ত ৫৬ লাখ ৬৩ হাজার ৬২০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। একইভাবে আরেকটি দরপত্রে মালপত্র সরবরাহ না করলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৪৮ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পিপিআর, ২০০৮ অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে চুক্তি না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে একটি দরপত্রে ৮৬ লাখ ৬৩ হাজার ৯৯২ টাকা এবং অন্যটিতে ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার ৯০০ টাকা। আসবাব কেনাকাটার একটি কাজকে একাধিক প্যাকেজে ভাগ করে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৯ কোটি ১৭ লাখ ৭৪ হাজার ৩৩০ টাকা। আর অর্থবছরের শেষ সময়ে কেনাকাটা করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৯ কোটি ১৪ লাখ ১৩ হাজার ২২৭ টাকা।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিপিপির নির্দেশনা অনুযায়ী আইসিটি, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ সামগ্রী উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে কেনার কথা। কিন্তু কেনা হয়েছে কোটেশন পদ্ধতিতে। এতে ৯ লাখ ৭১ হাজার ৯৬৫ হাজার টাকা অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রয় কাজে সাধারণ বীমা করপোরেশন থেকে বিমা কভারেজ না খোলায় ৪ লাখ ৩ হাজার ৩৩ টাকা, প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সম্মানী দেওয়ায় দেড় লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

এসব অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত রোববার ফোসেপ প্রকল্পের কার্যালয়ে গেলে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আপনি জানেন আমি কে? আপনি যা পারেন লিখে দেন। আমি কোনো বক্তব্য দেব না।’

অভিযোগ তদন্তে কমিটি, তদন্তে দুদকও

প্রকল্পের নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, এই প্রকল্পে শুরু থেকে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বেশি অভিযোগ কেনাকাটায় অনিয়ম নিয়ে। অভিযোগ তদন্তে একাধিক কমিটিও হয়েছে। তবে কোনো কমিটিই প্রতিবেদন দেয়নি। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া একাধিক কর্মকর্তাকে পরে ক্রয় কমিটিতে যুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ইতিপূর্বে দুই প্রকল্প পরিচালক যথাক্রমে অধ্যাপক নুরুল হুদা এবং ড. খন্দকার মুজাহিদুল ইসলামকে সরিয়ে দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তদন্ত করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর ড. খন্দকার মুজাহিদুল হককে সরিয়ে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয় অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদ হোসেনকে। তবে অভিযোগে লাগাম পড়েনি।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের বিরাগভাজন হলেই প্রকল্পের অর্থ ও ক্রয় শাখার কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। গত ৬ বছরে ছয়জন গবেষণা কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে।

এই প্রকল্পের কেনাকাটাসহ সব নথি সংরক্ষণ করেন হিসাবরক্ষক মো. শাহ আলম শিকদার। প্রকল্পের কেনাকাটার বেশ কিছু নথি গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনায় গত বছরের ২৪ অক্টোবর রমনা মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দুর্নীতি ও অনিয়ম ঢাকতেই এসব নথি গায়েব করা হয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মে বাধা হওয়ায় সম্প্রতি উপ-প্রকল্প পরিচালক রওশন আরা বেগমকে অন্যত্র বদলি করানো হয়েছে।

নথি গায়েবের বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত সোমবার শাহ আলম শিকদারকে একাধিকবার মোবাইলে ফোন ও এসএমএস করে সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্রকল্পের পূর্ত অংশে মনিটরিংয়ের নামে কোটি কোটি টাকার ভুয়া বিল-ভাউচার বানানোর অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী প্রকল্প পরিচালক শরফুদ্দীন মোহাম্মদ আবু ইউসুফ মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।

কেনাকাটায় হঠাৎ তাড়াহুড়ো

প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি পর্যালোচনা সভার তথ্য বলছে, প্রকল্পের ১৭৬টি ছয়তলা একাডেমিক ভবনের মধ্যে ৮৬টি ভবন হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৮৬টি ভবনের কাজ চলছে। বাকি ৪টি জায়গা না পাওয়াসহ নানান জটিলতায় স্থগিত রয়েছে। ১৩টি ছাত্রাবাসের মধ্যে ৯টি শেষ হয়েছে, বাকিগুলোর কাজ চলছে। ২২টি ছাত্রীনিবাসের মধ্যে ১৪টি সম্পূর্ণ হয়েছে, বাকিগুলোর কাজ চলছে। ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ হয়েছে ৬টির, মেরামত হয়েছে ৫টি ভবনের।

তবে প্রকল্পের কেনাকাটায় অগ্রগতি বেশি। প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে ২০০টি ফটোকপিয়ার, ৬০০টি মাইক্রোওভেন-ফ্লাক্স ও ফ্রিজ, ২০০ ক্যামেরা, ১৮২টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), ১ লাখ ৬ হাজার ৯২৬টি আসবাব, ১০ হাজার ৫২০টি কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক, ১ হাজার ২০০ সেট ল্যাবরেটরি সরঞ্জামাদি, হোস্টেলের জন্য ১৫ হাজার ৯৩০টি আসবাব, ৪৬টি টেলিভিশন ও ডিপ ফ্রিজ, হোস্টেলের জন্য ৮ হাজার ৫৫০টি আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৬টি এসি, ৯৯ হাজার ৯৯৫টি আসবাব, ১৩ হাজার ২৮৬টি কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক, হোস্টেলের জন্য ৪ হাজার ২০টি আসবাব, হোস্টেলের জন্য ২৪টি টেলিভিশন ও ডিপ ফ্রিজ, হোস্টেলের জন্য ৪ হাজার ৪৬১টি আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সরবরাহের অপেক্ষায় রয়েছে। লিফট ও জেনারেটর কেনাও প্রায় অর্ধেক শেষ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাউশির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শুরু থেকে এই প্রকল্পের মূল কাজ অর্থাৎ বিজ্ঞান শিক্ষকের পদ সৃজন, নতুন ১০ বিষয় চালু, ভবন নির্মাণে জোর দেওয়া হয়নি। প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বেশি মনোযোগ কেনাকাটায়। এসব কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। বর্তমান প্রকল্প পরিচালকের চাকরির মেয়াদ আছে মাত্র ১ মাস।

প্রকল্প নিয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রকল্পে যারা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড না হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ