Ajker Patrika

মন ভালো নেই: মেজাজের বিজ্ঞান, মন খারাপের মনোবিজ্ঞান

আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৫, ২৩: ৪৩
মন খারাপ হলে একটুখানি জায়গা দিন নিজেকে। মডেল: লিওনা, ছবি: আজকের পত্রিকা
মন খারাপ হলে একটুখানি জায়গা দিন নিজেকে। মডেল: লিওনা, ছবি: আজকের পত্রিকা

‘মন ভালো নেই’—তিনটি শব্দ যেন এখনকার সময়ের মৌলিক মুদ্রাদোষ। রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে, অফিসের টেবিলের পাশে, হাসপাতালের করিডরে কিংবা ফেসবুকের ইনবক্সে—সবখানে এই বাক্যের জয়জয়কার। কেউ বলছে, চোখের নিচে কালি জমেছে, কেউ মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ, তাদের মন ভালো নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই মনটা আসলে কী? ভালো বা খারাপ হওয়ার পেছনে বিজ্ঞান কী বলে? আর মানুষের মন কি আসলেই এমন তরল ও টেম্পারেচার-নির্ভর জিনিস, যেটা কখনো আকাশে ভেসে ওঠে, কখনো নিঃশব্দে ডুবে যায়?

মন মানে মস্তিষ্কের কেমিক্যাল কনসার্ট

বিজ্ঞান বলে, আমাদের ‘মন’ বলে যেটাকে আমরা চিনি, সেটি মূলত মস্তিষ্কের রাসায়নিক, বিদ্যুৎ তরঙ্গ ও স্মৃতির এক জটিল মহাযন্ত্রণা। দুঃখজনক হলেও সত্য, মনের ভালো বা খারাপ থাকা অনেক সময় আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না।

মন ভালো থাকার পেছনে যে চারজন মূল কারিগর কাজ করেন, তাদের নাম ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন আর এন্ডোরফিন। এই চার রাসায়নিককে বলা হয় ‘হ্যাপিনেস ককটেল’।
  • ডোপামিন হলো আমাদের পুরস্কার ও আনন্দের অনুভূতি। আমরা কোনো কাজ সফলভাবে শেষ করলেই ডোপামিনের গর্জন শোনা যায়।
  • সেরোটোনিন নিয়ন্ত্রণ করে মেজাজ ও ঘুম। এর অভাবে তৈরি হয় বিষণ্নতা।
  • অক্সিটোসিনকে বলা হয় ‘ভালোবাসার হরমোন’। ছুঁয়ে থাকা, বন্ধুত্ব, আস্থা—এসব থেকে জন্ম নেয় এটি।
  • এন্ডোরফিন তৈরি হয় ব্যায়াম বা হাসির মাধ্যমে। এটি শরীরের প্রাকৃতিক ব্যথানাশক।

এই চার রাসায়নিকের ভারসাম্য নষ্ট হলেই আমরা বলি, ‘কেন জানি মনটা ভালো লাগছে না।’

অর্থাৎ, প্রেমে প্রত্যাখ্যান হোক বা রিকশাওয়ালার সঙ্গে তর্ক— এগুলো মস্তিষ্কে হ্যাপিনেস ককটেলের রেশিও গুবলেট করে দেয়। ফলে আমাদের ভেতরে একধরনের ভারমুক্ত শূন্যতা তৈরি হয়। অনেকটা বাসি চায়ের মতো মনের অবস্থা—চিনি আছে, তৃপ্তি নেই।

মেজাজ মানে মাথার মেঘমালা

মানুষের মন আর আবহাওয়ার মধ্যে একটা গভীর মিল আছে। যেমন হঠাৎ করে ঝড় আসে, আবার হঠাৎই রোদ ওঠে। অনেক সময় আমরা জানিই না কেন মন খারাপ! গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক সময় আমাদের মন খারাপ হয় এমন সব কারণে, যেগুলোর অস্তিত্বই আমরা টের পাই না।

মন খারাপ হলে নিজেকে সময় দিন। এক কাপ চা নিয়ে বসে যান নিজের সঙ্গে। ছবি: আজকের পত্রিকা
মন খারাপ হলে নিজেকে সময় দিন। এক কাপ চা নিয়ে বসে যান নিজের সঙ্গে। ছবি: আজকের পত্রিকা

ধরুন, আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠলেন, একরকম মনমরা ভাব। কারণ? হয়তো গত রাতে আপনার ঘুম ঠিকমতো হয়নি। হয়তো হরমোনের কোনো অস্থিরতা চলছে শরীরে। অথবা আপনি আপনার অজান্তে সামাজিক চাপে আছেন। সেটা হতে পারে কারও সঙ্গে তুলনা, কারও দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া কিংবা ফেলে আসা কোনো অনুচ্চারিত আক্ষেপ।

আমাদের মস্তিষ্কের সামনের অংশ দায়িত্বে থাকে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এটাই নিয়ন্ত্রণ করে মেজাজ। কিন্তু যদি ঘুম ঠিকমতো না হয়, খাওয়া অনিয়মিত হয় বা শরীরে ব্যায়ামের অভাব থাকে, তাহলে ওই অংশ নিজের কাজ করতে পারে না। আর তখনই মন হয় অলস, ক্লান্ত, বিষণ্ন।

মন খারাপের সামাজিক ইনসেনটিভ

একটা মজার বিষয় হচ্ছে, মন খারাপ থাকা কখনো কখনো সামাজিক সুবিধা দেয়। হ্যাঁ, শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্য।

মন খারাপ হলে আমরা সহানুভূতি পাই। কাজের চাপে ক্লান্ত হলে যদি বলি, ‘আজ মন ভালো নেই’, তখন কেউ আর আমাদের ওপর দায়িত্ব চাপায় না। অনেকটা একধরনের ‘ইমোশনাল পাস’, যেটা দিয়ে সমাজের চাপে একটু বিশ্রাম নেওয়া যায়।

মন খারাপ থাকা একধরনের অভিজ্ঞতা। এটি আমাদের জ্ঞান, আত্মবিশ্লেষণ ও সম্পর্ক গভীর করে। ছবি: আজকের পত্রিকা
মন খারাপ থাকা একধরনের অভিজ্ঞতা। এটি আমাদের জ্ঞান, আত্মবিশ্লেষণ ও সম্পর্ক গভীর করে। ছবি: আজকের পত্রিকা

এমনকি গবেষণায় দেখা গেছে, কেউ মন খারাপের কথা বারবার বললে, একসময় নিজেও সেটায় বিশ্বাস করতে শুরু করে। এটা হয় মস্তিষ্কের সেলফ ফুলফিলিং প্রফেসি নামক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। মানে, আপনি যত ভাববেন আপনি দুঃখী; মস্তিষ্ক ততই সে অনুভূতি তৈরি করে ফেলবে।

তবে একে একেবারে খারাপও বলা যায় না। কারণ, মন খারাপ থাকাও একধরনের অভিজ্ঞতা, যা আমাদের জ্ঞান, আত্মবিশ্লেষণ ও সম্পর্ক গভীর করে।

মনের অবস্থা বদলানোর ছোট্ট বটিকা

মন ভালো না থাকলে কি আমরা কিছু করতে পারি? বিজ্ঞান বলে, হ্যাঁ, পারি। যদিও আমরা মনের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না, তবে কিছু শরীরঘেঁষা কৌশলে মনের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।

হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করুন। তাতে এন্ডোরফিন বাড়ে। এই হরমোন মন ভালো রাখতে সহায়তা করে। ছবি: আজকের পত্রিকা
হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করুন। তাতে এন্ডোরফিন বাড়ে। এই হরমোন মন ভালো রাখতে সহায়তা করে। ছবি: আজকের পত্রিকা
  • ঘুম ঠিক রাখুন। ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম সেরোটোনিনের উৎস।
  • হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করুন। অন্তত ২০ মিনিট হাঁটলে এন্ডোরফিন বাড়ে।
  • ভালো বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটান। অক্সিটোসিন তখন আপনার শরীরে নাচতে শুরু করবে।
  • নিজেকে ছোট লক্ষ্য দিন। কাজ শেষ করে তৃপ্তি পাবেন।
  • আয়নায় নিজেকে দেখে হাসুন। মস্তিষ্ক ‘হাসির অভিনয়কেও’ আসল হাসি মনে করে!

আরও চমৎকার কৌশল হলো, নিজেকে জোর করে ভালো কিছুর মধ্যে ঠেলে দেওয়া। যেমন পছন্দের বই পড়া, পুরোনো ছবি দেখা, ছোট প্রাণীদের ভিডিও দেখা বা শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো। এগুলো স্বাভাবিকভাবে আমাদের মনকে ‘রিসেট’ করে।

মন খারাপ, কিন্তু সব সময় নয়

‘মন খারাপ’ একটি মানবিক অভিজ্ঞতা। এটাকে ভয় না পেয়ে বরং বোঝা উচিত। মনে রাখা দরকার, মন ভালো থাকা যেমন সম্ভব, তেমনি মন খারাপ থাকাও স্বাভাবিক। এটা মানেই আপনি ব্যর্থ বা নিঃস্ব নন। বরং ভেবে নিন, আপনার অনুভব করার শক্তি অক্ষত আছে।

আমাদের সমাজে ‘ভালো থাকো’ বলতে বলা হয়। কিন্তু ‘দুঃখ পোষণ করো’ এই উপদেশ কেউ দেয় না। অথচ মাঝে মাঝে দুঃখ করা, নিজের ভেতরের আবেগের দিকে তাকানো, মেঘ জমা অনুভূতিগুলোর পাশে বসে থাকা—এসবও জীবনচর্চার অংশ।

তাই মন খারাপ হলে একটুখানি জায়গা দিন নিজেকে। এক কাপ চা হাতে নিয়ে চুপ করে বসুন, নিজের কাঁধে হাত রাখুন, আয়নায় তাকিয়ে বলুন, ‘সব সময় ভালো না লাগলেও সব সময় খারাপ থাকি না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বদলির আদেশ ছিঁড়ে বরখাস্ত হলেন এনবিআরের ১৪ কর্মকর্তা

বাংলাদেশের সোনালি মুরগিতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া: গবেষণা

দরপত্র ছাড়াই জুলাই স্মৃতি জাদুঘরের কাজ পেল দুই প্রতিষ্ঠান, এরা কারা

ট্রাকে করে ৪৩ হাজার পৃষ্ঠার নথি ইসিতে জমা দিয়েও নিবন্ধন পেল না এনসিপি

প্রেক্ষাপটবিহীন প্রতিবেদন কি সাংবাদিকতা হতে পারে?

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত