Ajker Patrika

নৌকার গলুইয়ে নেচে ভাইরাল রায়ান এখন পর্যটন দূত

ফাহিম হাসনাত
নৌকার গলুইয়ে এই নাচের জন্যই ভাইরাল হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার ১১ বছর বয়সী বালক রায়ান আরকান ধিখা। ছবি: সংগৃহীত
নৌকার গলুইয়ে এই নাচের জন্যই ভাইরাল হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার ১১ বছর বয়সী বালক রায়ান আরকান ধিখা। ছবি: সংগৃহীত

স্রোতের তীব্র গতির বিপরীতে ছুটে চলেছে একটি রেসিং নৌকা। তার সরু গলুইয়ে দাঁড়িয়ে নেচে চলেছে এক বালক। মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি, শরীরে জাদুকরি ছন্দ; এই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। ১১ বছর বয়সী এই বালকের নাম রায়ান আরকান ধিখা, দেশ ইন্দোনেশিয়া। দেশটির এক প্রত্যন্ত গ্রামের এই বালকের অবিশ্বাস্য প্রতিভা জয় করে নিয়েছে কোটি মানুষের হৃদয়।

১১ বছর বয়সী রায়ানকে দেওয়া হয়েছে ‘দ্য আলটিমেট অরা ফার্মার’ তকমা। এই ‘অরা ফার্মিং’ বিষয়টি আসলে কী? এক কথায়, এটি জেন জি প্রজন্মের নাচের স্টাইল, যা দিয়ে নিজেকে ‘কুল’ দেখানো হয়। যারা এই নাচ করে তারা নিজের ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে অন্যদের মুগ্ধ করে। রায়ানের স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল নাচকে এই ট্রেন্ডের নিখুঁত উদাহরণ হিসেবে দেখছে বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক। রায়ানের নাচের জনপ্রিয়তা এতটাই যে আমেরিকান ফুটবল তারকা ট্রাভিস কেলসি থেকে শুরু করে ফর্মুলা ওয়ান রেসার অ্যালেক্স অ্যালবনের মতো ক্রীড়াবিদেরাও তা অনুকরণের চেষ্টা করেছেন।

ভাইরাল হওয়ার পর রিয়াউ প্রদেশের ‘পর্যটন দূত’ হয়েছে রায়ান। সঙ্গে পেয়েছে ২০ মিলিয়ন রুপিয়াহ বা প্রায় দেড় লাখ টাকার শিক্ষাবৃত্তি। ছবি: সংগৃহীত
ভাইরাল হওয়ার পর রিয়াউ প্রদেশের ‘পর্যটন দূত’ হয়েছে রায়ান। সঙ্গে পেয়েছে ২০ মিলিয়ন রুপিয়াহ বা প্রায় দেড় লাখ টাকার শিক্ষাবৃত্তি। ছবি: সংগৃহীত

২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের রিয়াউ প্রদেশের কুয়ান্তান সিঙ্গিঙ্গি নামের এক ছোট্ট গ্রামে রায়ানের জন্ম। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া এই বালক হঠাৎ এমন নিখুঁত নাচ করেনি। তার রক্তে মিশে আছে সে নাচের ঐতিহ্য। ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী নৌকা প্রতিযোগিতা ‘পাচু জলুর’। তাতে ব্যবহার করা হয় নির্দিষ্ট আকারের নৌকা, যার গলুইতে আমরা দেখেছি রায়ানের নাচ। এটি সুমাত্রা দ্বীপের সংস্কৃতি।

বাবা ও চাচার হাত ধরে মাত্র ৯ বছর বয়সে এই কঠিন শিল্পে রায়ানের হাতেখড়ি। তার বাবা ও চাচা দুজনই ‘পাচু জলুর’-এর দক্ষ খেলোয়াড়। তবে যে নাচ তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে, সেটি ছিল রায়ানের সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রায়ান জানায়, ‘নাচটা আমি নিজেই ঠিক করেছি। ওই পরিস্থিতিতে হঠাৎ এ রকমভাবে নেচে ফেলেছিলাম।’ রায়ানের এই সরল স্বীকারোক্তিই তার সহজাত প্রতিভার প্রমাণ দেয়।

ইন্টারনেটের এই খ্যাতি রায়ানের জীবনে এনেছে এক নতুন মোড়। বৈশ্বিক পরিচিতি এবং স্থানীয় ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য সম্প্রতি রিয়াউ প্রদেশের গভর্নর তাকে ‘পর্যটন দূত’ ঘোষণা করেছেন। ফলে সে এখন নিজের অঞ্চলের ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে। পাশাপাশি গভর্নর আবদুল ওয়াহিদ আনুষ্ঠানিকভাবে রায়ানকে ২০ মিলিয়ন রুপিয়াহ বা প্রায় দেড় লাখ টাকা শিক্ষাবৃত্তি দিয়েছেন।

সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় গিয়ে রায়ান দেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী ও পর্যটন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছে এবং মায়ের সঙ্গে জাতীয় টেলিভিশনের অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছে।

হঠাৎ পাওয়া এই তারকাখ্যাতি বেশ উপভোগ করছে রায়ান। সে হাসতে হাসতে বলেছে, ‘বন্ধুরা এখন আমাকে দেখে মজা করে বলে, ওই দেখ, ভাইরাল ছেলেটা যাচ্ছে!’ তবে এই খ্যাতির আলোয় তার স্বপ্নগুলো আরও রঙিন হয়েছে। ভবিষ্যতে সে পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে দেশের সেবা করতে চায়। তরুণদের প্রতি তার পরামর্শ হলো, ‘নিজের শরীরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। শরীর ঠিক থাকলেই তুমি, আমি, আমরা সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।’

ছেলের এই ঝুঁকিপূর্ণ নাচ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত তার মা রানি রিদাওয়াতি। যেকোনো মুহূর্তে রায়ান নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে দ্রুতগতির বৈঠার আঘাতে আহত হতে পারে মনে করে তিনি ভয় পান। তবে তাঁর এই ভয়ের পাশাপাশি রয়েছে গর্ব ও আস্থা। তিনি জানেন, প্রতিযোগিতার সময় নদীতে উদ্ধারকারী দল প্রস্তুত থাকে এবং রায়ান নিজেও একজন দক্ষ সাঁতারু।

ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রী ফাদলি জন রায়ানের প্রতিভার প্রশংসা করে বলেছেন, ‘দ্রুতগতির নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে নাচা মোটেও সহজ কাজ নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিশুদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষমতা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে অনেক ভালো। তাই তারাই এই কঠিন কাজ সহজে করতে পারে।’

রায়ান আরকান ধিখা আজ শুধু ইন্দোনেশিয়ার এক সাধারণ বালক নয়, সে বিশ্বজুড়ে এক অনুপ্রেরণার নাম। তার নাচের মধ্যে মিশে আছে আনন্দ, সাহস আর নিজের ঐতিহ্যের প্রতি গভীর ভালোবাসা। সে এক নতুন প্রজন্মের বার্তা নিয়ে এসেছে— যদি মনেপ্রাণে কিছু করা যায়, তবে নদীর উত্তাল ঢেউও তোমার ছন্দে নাচতে বাধ্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত