Ajker Patrika

ঘুরে আসুন পুঠিয়া রাজবাড়ি

রোকনুজ্জামান মনি, ঢাকা
ঘুরে আসুন পুঠিয়া রাজবাড়ি

সকালের সূর্য যখন রক্তিম আভা নিয়ে পুব আকাশে উঁকিঝুঁকি দেয়, ঠিক তখনই রাজবাড়ির প্রতিচ্ছবি জ্বলজ্বল করে পরিখার টলটলে পানিতে। সবুজ ঐশ্বর্যে মোড়ানো এই প্রকৃতি মুখরিত হয় হাজারো পাখির কলকাকলিতে। মন্দির থেকে ভেসে আসে শঙ্খের জয়ধ্বনি। প্রকৃতির নিয়মেই শুরু হয় জীবনের জয়গান। দিনভর বিরতিহীনভাবে চোখে পড়ে হাজারো দর্শনার্থীর মুখরিত পদচারণ। ধাপে ধাপে বৈচিত্র্যময় আয়োজনের মধ্য দিয়ে দুপুর গড়িয়ে গোধূলি লগ্নের সূচনা হয়। পরমুহূর্তেই সন্ধ্যা নামে এক অপরূপ সৌন্দর্যকে শামিল করে। দিনের আলোকে বিদায় জানিয়ে নিস্তব্ধতা ভর করে চারদিকে। সন্ধ্যায় ধূপের গন্ধের সঙ্গে পাগলা হাওয়ায় হৃদয় জুড়িয়ে আসে ভ্রমণপিপাসুদের। জোনাকির মতো মিটমিট করে জ্বলে রংবেরঙের আলো। এ যেন এক রূপকথার রাজ্য। যে রাজ্যের রাজপুরীর দেয়ালে দেয়ালে এখনো ভেসে বেড়ায় রাজা, রানি, রাজকুমার, রাজকুমারী আর সৈন্যসামন্ত।

সবুজ দূর্বাদলের ওপারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের সাক্ষী সেই প্রাচীন রাজপ্রাসাদ। বিশালাকৃতির পরিখা চারপাশ থেকে আগলে রেখেছে ইতিহাসের এই অমর কীর্তিকে। যেখানে আজও আজানের ধ্বনি আর শঙ্খের জয়ধ্বনি বেজে ওঠে পাশাপাশি। জটিল জীবনের কঠিন সমীকরণকে দুমড়েমুচড়ে ফেলে সহজ-সরল মানুষগুলো এখনো নিজেদের সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ঐতিহ্যকে লালন করে চলেছেন আপন সত্তায়। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে যাঁদের জানার আগ্রহ, তাঁরা অবশ্য ঘুরে আসতে পারেন রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার চারআনি বাজারে অবস্থিত পুঠিয়া রাজবাড়ি থেকে।

কালের সাক্ষী
রাজশাহী-নাটোর গেলে এই অঞ্চলের নারীদের শক্তি টের পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিলেন রানি ভবানী, শরৎসুন্দরী দেবী, মহারানি হেমন্তকুমারী দেবীর মতো জনহিতৈষী প্রতাপশালী নারী জমিদারেরা। রাজশাহী, নাটোর অঞ্চলের রাজাদের প্রভাবও তখন ছিল বেশ। সতেরো শতকে মোগল আমলে তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন এলাকার মধ্যে পুঠিয়া জমিদারি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেই আমলে এই জমিদারির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। ১৮৯৫ সালে মহারানি হেমন্তকুমারী দেবী ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে তৈরি করেছিলেন পুঠিয়ার এই নান্দনিক রাজবাড়িটি। অপরূপ এ প্রাসাদটি মহারানি হেমন্তকুমারী দেবী নির্মাণ করেছিলেন তাঁর শাশুড়ি মহারানি শরৎসুন্দরী দেবীর সম্মানে।

পুঠিয়া জমিদারির নারী জমিদারেরা ছিলেন বেশ উজ্জ্বল মানুষ। তাঁরা পুরো জমিদারি পরিচালনা তো করেছেনই, প্রজাদের উন্নয়নের কথাও ভেবেছেন। একই সঙ্গে পরিবারের ঐশ্বর্য-সম্পদ বাড়ানোর দিকেও ছিল তাঁদের সমান আগ্রহ। এসব বোঝা যায় তাঁদের রানি ও মহারানি খেতাব পাওয়ার ঘটনায়। হেমন্ত কুমারী দেবী প্রজাদের উন্নয়নের জন্য লর্ড কার্জনের আমলে ১৯০১ সালে রানি উপাধি পান। ১৯২০ সালে লর্ড আর উইনের আমলে তিনি মহারানি উপাধি পান। ১৯৪২ সালে মহারানি হেমন্ত কুমারী দেবী পরলোকগমন করেন।

নজর কাড়বে স্থাপনা
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, পুঠিয়া রাজবাড়িতে আছে এ দেশের সবচেয়ে বেশি টেরাকোটা শোভিত মন্দির। রাজবাড়িকে ঘিরে রয়েছে ছয়টি মন্দির। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম শিবমন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির,  গোপাল মন্দির,  গোবিন্দ মন্দির,  দোল মঞ্চ ইত্যাদি। শিবমন্দির বাদে প্রতিটি মন্দিরের দেয়ালে আছে অপূর্ব সব পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটা। যেখানে ফুটে উঠেছে তৎকালীন সংস্কৃতি ও জীবনধারা। প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এই মন্দিরগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই রাজবাড়িতে অবস্থিত শিবমন্দিরটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম বড় শিবমন্দির হিসেবে পরিচিত। এর অন্য নাম ভুবনেশ্বর মন্দির। এর গম্বুজ এবং গঠনশৈলী যে কারও নজর কাড়বে। শিবমন্দিরের দুই দিকে আছে সিঁড়ি। একদিক দিয়ে উঠে যেমন মন্দিরে যাওয়া যাবে, অন্যদিক দিয়ে নেমে যাওয়া যাবে দিঘিতে। সুউচ্চ এই মন্দিরের প্রতিচ্ছবি যখন দিঘির পানিতে ঠিকরে পড়ে, তখন মনে হয় এ যেন আরেক তাজমহল।

 রাজপ্রাসাদের সঙ্গে যুক্ত রানির স্নানঘাট। পরিখার ওপর এমন দৃষ্টিনন্দন স্নানঘাট বিস্মিত করবে যে কাউকে। এ ছাড়া অন্দর মহল, বিচারালয়, বিশাল প্রাঙ্গণ– সবটা মিলিয়ে এ যেন এক কল্পনার রাজ্য। রাজবাড়ির চারপাশে যে পরিখার কথা বলা হচ্ছে, তা খনন করা হয়েছিল মূলত নিরাপত্তার জন্য। 
 
পুঠিয়া রাজবাড়ির শিবমন্দিরটি এশিয়ার অন্যতম বড় শিবমন্দিরসম্প্রীতির বন্ধন
কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে জমিদারি। তবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজবাড়িটি মিশে আছে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে। এখনো এখানে প্রতিবছর আষাঢ় মাসে বসে রথের মেলা। মাসব্যাপী চলা এই মেলা এ অঞ্চলের মানুষের বড় মিলনকেন্দ্র। ঈদ-পার্বণেও এখানে জমে ওঠে উৎসবের আমেজ। বসে মেলা, নাগরদোলার ঝলকও চোখে পড়ে। ঐতিহ্যবাহী এই রাজবাড়ির মাঠেই হয় বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

যাওয়ার উপায়
ঢাকা থেকে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়ার পথে নাটোর অতিক্রম করে কিছু দূর এগোলেই পুঠিয়া উপজেলা। এই উপজেলা শহরের বাসস্ট্যান্ডে নেমে যেকোনো ভ্যান বা অটোরিকশায় চেপে পাঁচ টাকা ভাড়া দিলেই যাওয়া যাবে চারআনি বাজার তথা রাজবাড়িতে।

আবাসিক ব্যবস্থা
পুঠিয়ায় থাকার হোটেল আছে। তবে ভালো হোটেলে থাকতে চাইলে যেতে হবে রাজশাহী বা নাটোর। যেখানেই থাকুন না কেন, দুই দিনে ঘুরে ফেলা যাবে নাটোরের উত্তরা গণভবন, বঙ্গজল, চলনবিল, বাঘা মসজিদ ও রাজশাহী শহরের বিভিন্ন জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চার মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সেবা ডিজিটাইজ করার নির্দেশ দিল সরকার

গত দশ বছর ভিসা না পাওয়ার কারণে বাংলাদেশে আসতে পারিনি: মাইলাম

মাগুরার শিশুটি এখনো অচেতন, চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন তারেক রহমান

ঈদে পুলিশের সহযোগী ফোর্স হবে বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মী, পাবে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা

তিন নারী আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: তারেক রহমান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত