Ajker Patrika

মাস্টারদা সূর্য সেনের প্রয়াণ

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬: ৪৮
Thumbnail image

ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মাস্টারদা সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালের আজকের দিনে, মানে ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামে এই বিপ্লবীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। 

১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ায় জন্ম সূর্য সেনের। মাস্টারদা সূর্য সেন নামেই সবার কাছে পরিচিত হলেও তাঁর নাম ছিল সূর্য কুমার সেন। বাবার নাম রাজমণি সেন, মা শশীবালা সেন। পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর বড় কাকা গৌরমণি সেন তাঁকে লালনপালন করেন। 

১৯১২ সালে চট্টগ্রামের ন্যাশনাল স্কুল থেকে অঙ্কে লেটারসহ প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন সূর্য সেন। এরই মধ্যে দেশকে ব্রিটিশদের হাত থেকে রক্ষার কাজে যোগ দেন। নাম লেখান গুপ্ত সমিতিতে। 
চট্টগ্রাম কলেজে আইএতে ভর্তি হওয়ার পর কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক শতীশ চক্রবর্তীর সংস্পর্শে বৈপ্লবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘অনুশীলন সমিতি’তে যুক্ত হন। ব্রিটিশবিরোধী একটি সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন ছিল এই অনুশীলন সমিতি। 

আইএ পাসের পর পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বিএ শ্রেণিতে ভর্তি হন সূর্য সেন। এ সময় বিপ্লবী ‘যুগান্তর’ দলে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯১৮ সালে বিএ পাস করেন। 
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের (গুপ্ত সমিতি) বেশির ভাগ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ সরকার। সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী শহরের দেওয়ানবাজার দেওয়ানজী পুকুরপাড়ে শান্তি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে থেকে বিপ্লবী দল গোছানোর চেষ্টা শুরু করেন দুজন। পরে সূর্য সেন ‘যুগান্তর’ দলের সভাপতি হন। 

বিয়ের পিঁড়িতে বসার ইচ্ছা না থাকলেও ১৯১৯ সালে দাদা-বৌদির পীড়াপীড়িতে চট্টগ্রামের কানুনগোপাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের মেয়ে পুষ্পকুন্তলা দেবীকে বিয়ে করেন সূর্য সেন। বিয়ের আসরে খবর পান, তাঁর সহযোগীরা নতুন করে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করতে চান। তাঁদের চাওয়া, সূর্য সেনই এই সংগঠনের দায়িত্ব নেবেন। বিয়ের রাতেই পুষ্পকুন্তলা দেবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে বাড়ি ছেড়ে গেলেন। মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন বিপ্লবী আন্দোলনে। 

কলকাতা হাইকোর্টের সামনে নির্মিত মাস্টারদার মূর্তি১৯২০ সালের অসহযোগ আন্দোলনে সূর্য সেন ও তাঁর দল অংশ নেয়। এ সময় স্থানীয় জনগণের সাহায্যে একটি জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। সূর্য সেন এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। উমাতারা স্কুল নামে পরিচিত হয় বিদ্যালয়টি। এ সময়ই ‘মাস্টারদা’ নামে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন সূর্য সেন। একসময় স্কুলই সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। 

বিপ্লবীরা অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাকাতির আশ্রয়ও নিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর দিনের বেলায় সূর্য সেনের নেতৃত্বে রেলওয়ে কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭ হাজার টাকা ছিনতাই করা হয়। পুলিশ বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দেয়। পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের যে যুদ্ধ হয়, তা ‘নাগরথানা পাহাড়খণ্ড যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের পর সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী ধরা পড়েন। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করতে না পারায় তাঁরা ছাড়া পান। 

 ১৯২৪ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গোটা ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়লে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে ব্রিটিশ সরকার ‘১ নং বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স’ নামে জরুরি আইন পাস করে। উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক রাখা। এরপর ব্রিটিশ সরকার সারা বাংলায় বিপ্লবীদের গণহারে গ্রেপ্তার শুরু করে। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা গ্রেপ্তার এড়াতে কলকাতায় আশ্রয় নেন। ১৯২৫ সালের ১০ নভেম্বর শোভাবাজারে বিপ্লবীদের আস্তানায় পুলিশ হানা দিলে সূর্য সেন কৌশলে পালিয়ে যান। 

মাস্টারদা সূর্যসেনকে ধরার জন্য ১০০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল, ১৯৩২ সালে চট্টগ্রাম পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্তৃক বিতরণ করা পোস্টার।১৯২৬ সালের ৮ অক্টোবর কলকাতার এক মেস থেকে পুলিশ সূর্য সেনকে গ্রেপ্তার করে। ১৯২৮ সালের শেষের দিকে মুক্তি পাওয়ার পর স্ত্রী পুষ্পকুন্তলার অসুস্থতার খবর পেয়ে তাঁকে দেখতে যান। যেদিন বাড়ি পৌঁছান, সেদিনই মৃত্যুবরণ করেন পুষ্পকুন্তলা। এরপর অনেকটা সময় আত্মগোপনে থাকতে হয় সূর্য সেনকে। 

১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক হন মাস্টারদা সূর্য সেন। ১৯৩০ সালের শুরু থেকেই তাঁর উদ্যোগে ভবিষ্যৎ সশস্ত্র আন্দোলনের পরিকল্পনা শুরু হয়। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল অস্ত্র সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেন তাঁরা। এ ঘটনাকে রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘ভারতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ব্রিটিশ সরকার সূর্য সেনসহ কয়েকজনকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করে। 

 ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৮০ জন মারা যান এবং ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন। 

১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। চট্টগ্রামের পটিয়ার গৈরিলা গ্রামের ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনসহ আরও কয়েক বিপ্লবী। এক বিশ্বাসঘাতকের মাধ্যমে খবর পৌঁছে যায় ব্রিটিশ পুলিশের কাছে। বাড়িটি ঘিরে ফেলে পুলিশ। তুমুল লড়াইয়ের পর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন মাস্টারদা। হাত-পা শিকলে বেঁধে মাস্টারদাকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামে। ২০ ফেব্রুয়ারি জেলে পাঠানো হয়। মাস্টারদার ফাঁসির আদেশ দেয় ব্রিটিশ শাসক। 

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে সুর্যসেনের ফাঁসির মঞ্চ। স্মৃতিফলকে ফাঁসি কার্যকর করার সাল উল্লেখ করা আছেসূর্য সেন গ্রেপ্তার হওয়ার পর তারকেশ্বর দস্তিদার দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের ১৮ মে আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রাম থেকে তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্তকে বিচারের জন্য ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১/ ১২১ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৫ জুন ১৯৩৩ সালে শুরু হওয়া এই মামলায় কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল সূর্য সেনকে ১২১ ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন। একই ধারায় তারকেশ্বর দস্তিদারের প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়। কল্পনা দত্তকে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। মামলার রায়ের পর তিনজন বিপ্লবীর পক্ষে কলকাতা হাইকোর্টে আপিলের আবেদন করা হয়। ১৪ নভেম্বর ১৯৩৩ সালে হাইকোর্ট রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের দণ্ড বহাল রাখেন। 

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি হাসিমুখে ফাঁসির দড়িতে জীবন বিসর্জন দিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। এ সময় ফাঁসি দেওয়া হয় বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারেরও। 

সূত্র
গুণীজন ডটকম, উইকিপিডিয়া

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত