Ajker Patrika

শেষ হলো ফাল্গুনী আবাহন

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা
আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ১০: ৪৮
শেষ হলো ফাল্গুনী আবাহন

করোনা-পরবর্তী সময়ে যে শব্দগুলোর সঙ্গে মানুষ বেশি পরিচিত হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো উদ্যোক্তা। কেউ নিজের পরিচয় তৈরি করতে, কেউ জীবিকার তাগিদে, আবার কেউ প্রায় শখের বসেই ঘরে বসে শুরু করেছিলেন অনলাইন ব্যবসা। করোনার আগেও উদ্যোক্তারা কাজ করে গেছেন। তবে করোনাকালে ও পরবর্তী সময়ে তাঁরা আলোচনায় এসেছেন বেশি। উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশীয় জিনিস বারবার ঘুরেফিরে এসেছে ক্রেতাদের কাছে। কোনো উদ্যোক্তার মাধ্যমে সরাসরি হারিয়ে যাওয়া পণ্যগুলোই ফিরে এসেছে। আবার কেউ দেশীয় পণ্যকে হাল ফ্যাশনের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন মেলবন্ধন তৈরি করেছেন। আর সফল উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এর মধ্যে অন্যতম একটি প্ল্যাটফর্ম হলো হার-ই-ট্রেড। 

রাজধানীর মাইডাস ভবনের ১২ তলায় আজ শেষ হলো ‘ফাল্গুনী আবাহন’ শিরোনামে হার-ই-ট্রেডের পঞ্চম প্রদর্শনী। এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সাদেকা হালিম, সিটিজেন ব্যাংক ও দেশ টিভির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট তওফিকা করিম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও স্থপতি মেহের আফরোজ শাওন। এবার এ আয়োজনে ছিল ৬৮ জন উদ্যোক্তার ৬৪টি স্টল। একেকটি স্টলের পণ্যের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। 

মেলার একটি অংশ। ছবি: সংগৃহীত

সংসারের প্রয়োজনে শিক্ষকতা ও এনজিওর চাকরি ছেড়ে রাঙামাটি থেকে ঢাকায় আসেন উপমা নীলই চাকমা। ২০১২ সালে অনলাইনে শুরু করেন তাঁর ব্যবসা। চাকমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হাল ফ্যাশানের সঙ্গে মিশিয়ে নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি করেন স্কার্ট, ওয়ান পিস, ব্লাউজসহ মেয়েদের বিভিন্ন পোশাক। উপমা জানান, তাঁদের ঐতিহ্যবাহী কোমরতাঁতের কাপড়ে ফিউশন করে পোশাক বানান তিনি। সেখানে ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশিয়ে দেন সমকালের ফ্যাশন। একদম শুরুর দিকে অনলাইনে ব্যবসা দাঁড় করাতে প্রতিবন্ধকতা বেশি এলেও উপমা এখন স্বাবলম্বী এবং নিজের ব্যবসা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী।  

উপমার মতো শিউলি আক্তারও কাজ করছেন ঐতিহ্যবাহী পণ্য নিয়ে। শিউলি কাজ করছেন কাঁসা পিতল নিয়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঁসা ও পিতলের জিনিস নিয়ে আসেন তিনি। এভাবেই দেশীয় পণ্যকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখতে চান বলে উল্লেখ করেন শিউলি। তিনি বলেন, একসময় কাগমারী ও জামালপুরের কাঁসা অনেক বিখ্যাত ছিল। বিশ্বজুড়ে এর খ্যাতি থাকলেও কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে এগুলো। যাঁরা এগুলো বানাতেন, তাঁরা পেশা পরিবর্তন করছেন মজুরি কমসহ বিভিন্ন কারণে। শিউলি আক্তার আশা করেন, তাঁর মতো আরও অনেকেই যদি পণ্যগুলো তুলে ধরেন, সেগুলো নিয়ে কাজ করেন, তাহলে আদি পেশায় আবারও আশার আলো দেখবেন কারিগরেরা। হারিয়ে যাবে না এসব দেশীয় পণ্য।  

মেলায় আসা একটি দোকান। ছবি: সংগৃহীত

ভিন্নধর্মী পণ্য নিয়ে কাজ করছেন ইমরোজা তামিম। তাঁর নিজের সাজপোশাকও অন্যদের তুলনায় একটু ভিন্ন। মাথায় গামছার টুপি, গায়ে ঢিলেঢালা কুর্তি পায়জামা। মানুষ নিজেকে একটু ভিন্নভাবে দেখতে চায় সব সময়। আর যাঁরা চান নিজেকে দেখার আয়নাটাও ভিন্নভাবে সাজানো থাকবে, ঘরটাও সুন্দর দেখাবে, তাঁদের জন্যই কাজ করেন ইমরোজা। ছেলেবেলার আঁকাআঁকির শখকে বড়বেলায় পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। চারুকলার ছাত্রী ছিলেন কি না জানতে চাইলে মিষ্টি হেসে ইমরোজা বলেন, ‘নাহ, চারুকলা নয়। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে পড়েছি। শখ ছিল চারুকলায় পড়ব, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। কারণ পরিবার চায়নি।’ লেখাপড়া শেষ করে শিল্পকলা থেকে একটি ডিপ্লোমা করেছেন ইমরোজা। আয়না ছাড়াও তিনি তৈরি করেন বাদ্যযন্ত্র ও খোদাই চিত্র। ৯ বছর ধরে চলে আসা নিজের পেজে অনলাইন ও অফলাইন দুইভাবেই সমান সাড়া পান ইমরোজা। 

২০১৯ সাল থেকে ব্যবসা শুরু করলেও করোনার পর থেকে মূলত দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছেন উম্মে রুমানা ইসলাম। নতুন নতুন থিমে দেশীয় নকশার মেলবন্ধনে তরুণদের কাছে নিজের পণ্য নিয়ে বেশি সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান তিনি। উম্মে রুমানা বলেন, ‘তরুণদের কাছে দেশীয় ডিজাইনগুলো তুলে ধরেছি। এ ক্ষেত্রে তাঁদের বাজেটের কথাও বিবেচনায় রাখার চেষ্টা করি।’ মৌমাছি, প্যাঁচা, পাখি, বর্ণমালা দিয়ে কুর্তি তৈরি করেন রুমানা। এ ছাড়া ঘর সাজানোর জন্য বিভিন্ন কাপড়ের জিনিস, যেমন পর্দা আছে তাঁর কাছে। পর্দা ও কাপড়ের রঙের ক্ষেত্রে মানুষের চাওয়াকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেন তিনি। উম্মে রুমানা বলেন, ‘পর্দার রঙের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। অনেক সময় এই রং মুড বদলে দিতে পারে। তাই গাঢ় ও হালকা রং মিলিয়ে একটা মাইন্ড রিল্যাক্সেশনের কথাও আমরা মাথায় রেখে কাজ করি।' 

ক্রেতারা কেনাকাটা করছেন মেলায়। ছবি: সংগৃহীতশুধু গৃহসজ্জা আর জামা-কাপড় নয়, আছে খাবারের দোকানও। ছেলেমেয়েদের জন্য কেক বানাতে ভালোবাসেন সামিউন রহমান। সেই ভাবনা আর বেকিংয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে কাজ শুরু করেন অনলাইনে। কেমিক্যাল-মুক্ত ও প্রিজারভেটিভ ছাড়া কেক, চকলেট ও অন্যান্য খাবার তৈরি করেন সামিউন। তিনি বলে, ‘অনেক পরিকল্পনা করে এখানে আসিনি। বেকিং করতে ভালোবাসতাম দেখে বন্ধুরা বলেছিল একটা পেজ খুলে ফেলতে। সেখান থেকেই এই উদ্যোগ। অনেক কিছু করে ফেলতে হবে এমন নয়। আমি চাই সবাইকে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়াতে।' 

খাবারের পরেই আছে আচারের দোকান। চিরাচরিত আচারের পাশাপাশি আফসানা ইসলাম তরি করেন ভিন্ন স্বাদের ও ভিন্নধর্মী আচার। অনেক সময় ক্রেতার স্বাদ অনুযায়ী, অনেক সময় নিজে থেকেই ভিন্ন স্বাদের আচার তৈরি করেন তিনি। ২০১৮ সাল থেকে নিজেকে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন তরী। আচার নিয়ে তাঁরা অনেক গবেষণা করেন বলেও জানালেন। সেই গবেষণার ফলেও তৈরি হয় নতুন ধরনের অনেক আচার। সেগুলোর স্বাদের ওপর ভিত্তি করে নতুন নাম দেন তিনি। ছয়জন এখন কাজ করছেন তরীর সঙ্গে। 

মেলায় চলছে বিকিকিনি। ছবি: সংগৃহীতএত এত উদ্যোক্তাকে একটি মঞ্চে এনে দাঁড় করিয়েছেন যিনি, তাঁর নাম ওয়ারেসা খানম প্রীতি। হার-ই-ট্রেডের সভাপতি তিনি। করোনার থাবায় জনজীবন যখন স্থবির হয়ে গিয়েছিল, সেই সময় হার-ই-ট্রেড যাত্রা শুরু করে। প্রীতি জানান, করোনার সময় যখন ক্রেতারা বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না, তখন একটা নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম তৈরির চিন্তা থেকে হার-ই-ট্রেডের যাত্রা শুরু। একটা ইতিবাচক ভাবনা থেকে এখানে ব্যবসা করা এবং উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে করে উদ্যোক্তারা তাঁদের ব্যবসাকে গ্রোথ লেভেলে নিয়ে যেতে পারেন। ইতিমধ্যে উদ্যোক্তাদের এই প্ল্যাটফর্ম অনলাইনে ২৫টি এক্সিবিশন শেষ করেছে বলে জানান ওয়ারেসা খানম প্রীতি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত