Ajker Patrika

ঘুরে আসুন কাপ্তাইয়ের অরণ্যে

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ১৬: ৪৩
Thumbnail image

প্রকৃতি বিশেষ করে পাহাড়, অরণ্য যদি পছন্দ হয় তবে আজকের লেখাটি আপনারই জন্য। কারণ রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের জঙ্গলে চমৎকার একটি ভ্রমণের সুযোগ হবে আপনাদের আজ আমার সঙ্গে। এখন সময়টাও কিন্তু বনে ঘুরে বেড়াবার জন্য আদর্শ।

হেমন্ত চললেও অনেক এলাকাতেই বেশ একটা শীতের আমেজ চলে এসেছে। গাছপালায় ঠাসা কাপ্তাইয়েও বেশ আরামদায়ক একটি পরিবেশই পাবেন।

এখন নিশ্চয় জানতে চাইবেন এ সময় বনে ঘুরে বেড়াবার সুবিধা কী? বৃষ্টি না হওয়ায় অরণ্যপথে হাঁটা যেমন সহজ, তেমনি জোঁকের উপদ্রবেও পড়তে হবে না। আবার গরম কম থাকায় অনেকটা পথ হাঁটতে পারবেন অনায়াসে। প্রকৃতি এখনো বেশ সবুজ। তাই সবকিছু মিলিয়ে ভ্রমণটা আনন্দদায়ক হবে তাতে সন্দেহ নেই।

বেশ বড় এলাকা নিয়ে কাপ্তাইয়ের জঙ্গল। তবে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান বা কাপ্তাই ন্যাশনাল পার্কের সীমায় পড়েছে ৫৪ বর্গকিলোমিটারের মতো এলাকা।

কর্ণফুলীর দুই পাশের পাহাড়-অরণ্য মুগ্ধ করবে আপনাকে।কাপ্তাইয়ে কী নেই! পাহাড়ে উঠতে যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে দাঁড়িয়ে থাকা রাম পাহাড় ও সীতা পাহাড়ে উঠে ভারি আনন্দ পাবেন। আবার পাহাড়ি নদী কর্ণফুলী আর কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্যও মুগ্ধ করবে আপনাকে। কর্ণফুলী পেরিয়ে ওপাশে চিংম্রংয়ে গেলে দেখা মিলবে চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর কয়েকটি বৌদ্ধ মন্দিরের। জঙ্গল ভ্রমণের পাশাপাশি ঘুরে বেড়াতে পারবেন মারমাদের পাড়াগুলোতেও।

চলুন তাহলে ঢাকা থেকেই যাত্রাটা শুরু করি। সরাসরি উঠে পড়বেন কাপ্তাইয়ের বাসে। বিশেষ করে বড়ইছড়ি পেরোনোর পরই কর্ণফুলী নদী আর এর দুই পাশের পাহাড় আপনার নয়ন জুড়িয়ে দেবে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে যখন গাড়িটা ছুটে চলবে, রোমাঞ্চে কাঁটা দেবে শরীর।

কাপ্তাই মুখ খালের সেগুন বাগান।বড়ইছড়ি পেরোনোর পর শিলছড়ি পাড়ার কাছে বা বন বিভাগের রাম পাহাড় বিট অফিসের কাছের কোনো জায়গায় বাস থেকে নেমে পড়তে পারেন। এই চলার পথে হাতের ডানে পড়বে সীতা পাহাড়, বামে রাম পাহাড়। কর্ণফুলীর তীরে দাঁড়িয়ে সীতা পাহাড়ের দিকে তাকালে চমকে উঠবেন। আশ্চর্য সুন্দর উঁচু, সবুজ এক পাহাড়। শরীরে গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট-বড়, হরেক জাতের গাছপালা।

বিশেষ করে সীতা পাহাড়ের বন বিভাগের রাম পাহাড় বিট অফিসের ওই পাশের অংশটা ভারি সুন্দর। উঁচু উঁচু সব গাছের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের লতা পাহাড়ি জঙ্গলটিকে করে তুলেছে আরও দুর্ভেদ্য। খুব ভোরে রাম পাহাড়ি বিট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে সীতা পাহাড়ের ওপরের এক গাছে ছোট কয়েকটা বিন্দুর মতো ছোটাছুটি করতে দেখে একবার চমকে উঠেছিলাম। একটু ভালোভাবে খেয়াল করতেই বুঝে যাই, বানর কিংবা হনুমানের দল, ডালে ডালে নাচানাচি করছে।

পাহাড়ের ওপর একটি জুম ঘর।আপনি রোমাঞ্চপ্রেমী হলে সীতা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যেতে পারেন। তবে আগেই বলে রাখছি, পথের কোনো কোনো অংশ বেশ দুর্গম। আমরা যেমন বেশ কয়েক বছর আগে একেবারে খাঁড়া একটা পথ ধরে উঠতে গিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছিলাম। পাহাড়ে ওঠার সময় সঙ্গে বাঁশের লাঠি রাখলে কষ্টটা কম হবে। তবে একবার ওপরে উঠে গেলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। অনেক ওপর থেকে নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলী, পিচঢালাই পথে সূর্যের আলোর ঝিকিমিকি দেখে নয়ন জুড়াবে।

সীতা পাহাড়ের মতো রাম পাহাড়ে ওঠারও কয়েকটি পথ আছে। শুনেছিলাম ‘হাঁটু ভাঙা’ নামে পরিচিত পথটা নাকি সবচেয়ে খাড়া। আমি অবশ্য মোটামুটি সহজ একটি পথে রাম পাহাড়ে উঠেছিলাম। রাম পাহাড়ে ঘুরতে গেলে স্থানীয় কোনো বাসিন্দার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে আপনার, যে শোনাবে গাছে চড়ায় দক্ষ লতা বাঘের গল্প। এই লতা বাঘ আসলে মেঘলা চিতা বা ক্লাউডেড ল্যাপার্ড। পরে কাপ্তাইয়ের জঙ্গলে ক্যামেরা ট্র্যাপেও ধরা পড়ে আশ্চর্য সুন্দর প্রাণী মেঘলা চিতার ছবি।

নানা ধরনের পাখি ও বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে কাপ্তাইয়ের অরণ্যে।কাপ্তাইয়ের বালুর চর এলাকায় একটা লোহার সেতু পাবেন। জঙ্গলের নিস্তব্ধ পরিবেশে ঢং ঢং শব্দে গাড়িগুলো যখন সেতুটি পার হয়, তখন কেমন অন্যরকম একটি অনুভূতি হয়। ব্যাঙছড়ি এলাকায় পাহাড়ের ওপর বন বিভাগের রেস্ট হাউস।

এবার বরং কাপ্তাই মুখ খালের গল্প বলি। আমার মতে, কাপ্তাইয়ের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর একটি কাপ্তাই মুখ খাল। কর্ণফুলী নদীতে এখানে এসে পড়েছে কাপ্তাই মুখ খাল, তাই অরণ্যটিরও এই নাম। যেতে হয় নৌকায় চেপে। প্রথম সেখানে গিয়েছিলাম আজ থেকে এক যুগেরও বেশি আগে, ২০১২ সালে। সেবার সেগুন বাগানের পথ ধরে হাঁটার সময় হঠাৎ আকাশ কালো করে ঝড় নেমেছিল। পরে অবশ্য আরও গিয়েছি বনটিতে।

কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীতে আছে কায়াকিং করার ব্যবস্থা।কাপ্তাই মুখ খাল ও নদীর অপর পাশের কর্ণফুলী বিট দুটি জায়গাই বুনো হাতির জন্য বিখ্যাত। কপালে থাকলে এখানে ঘুরে বেড়াবার সময় বুনো হাতির দলের দেখা পেয়ে যেতে পারেন। তবে কথা হলো পাহাড়ে এখন হাতিদের খাবারের বড় অভাব। তাই তাদের মেজাজ-মর্জি কেমন থাকে তা বোঝা মুশকিল। হাতির পালের দেখা পেলেও দূরে থাকাটাই তাই নিরাপদ। কাপ্তাই মুখ খালে প্রথমবার গিয়ে বনকর্মীদের মুখে শুনেছিলাম নিঃসঙ্গ এক চিতা বাঘের গল্প। সঙ্গী মারা যাওয়ায় একাকী হয়ে পড়া চিতা বাঘটা মনের দুঃখে পাড়ি দিয়েছিল অন্য কোনো জঙ্গলে।

কাপ্তাইয়ের জঙ্গলে আছে হরেক জাতের বন্য প্রাণী। বানর কিংবা হনুমান চোখে পড়ে সহজেই। খুব ভোরে যদি জঙ্গলে ঢুকতে পারেন তবে লালচে শরীরের মায়া হরিণের দেখাও পেয়ে যেতে পারেন। সৌভাগ্যবান হলে বন মোরগ কিংবা মথুরার দর্শনও লাভ করতে পারেন। বুনো কুকুরের আনাগোনার কথাও শোনা যায় কখনো কখনো। পাখিও আছে অনেক জাতের।

পাহাড়-অরণ্য মিলিয়ে অসাধারণ এক জায়গা।এখন আপনি নিশ্চয় জানতে চাইবেন কাপ্তাই তো যাবেন, কিন্তু থাকবেন কোথায়? কাপ্তাইয়ে এখন সুন্দর কয়েকটি রিসোর্ট বা কটেজ হয়েছে। মোটামুটি দুই থেকে চার হাজার টাকা খরচ করে এগুলোতে থাকতে পারবেন। আবার চাইলে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থাও আছে কোনো কোনো রিসোর্টে।

কাপ্তাই থেকে ভেতরের শর্টকাট পথে কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন রাঙামাটিতে। সেখানকার কোনো হোটেল বা রিসোর্টে থেকেও কাপ্তাইয়ে ঘুরে যেতে পারবেন। তবে আমার পরামর্শ শুনলে কাপ্তাইয়ে রাতে থেকেই উপভোগ করুন অরণ্যটির সৌন্দর্য। ও একটা কথা, এখন কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীতে কায়াকিং করারও চমৎকার ব্যবস্থা আছে।

আর ঢাকা থেকে কাপ্তাই যাওয়ার সরাসরি বাস আছে। ভাড়া ৮০০ টাকা। রাতে রওনা দিলে সকালেই পৌঁছে যাবেন। কাজেই পাঠক আর দেরি কেন, কাপ্তাই ভ্রমণের জোগাড়যন্ত্র করা শুরু করে দিন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত