ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভি

বিশ্বকোষ রচনার প্রেক্ষাপট
১৯৯৪ কিংবা ৯৫ সালের কথা। যুক্তরাজ্যের কয়েকটি সংবাদপত্রে মুসলিম নারী নিয়ে কিছু নেতিবাচক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে মুসলিম বিশ্বে নারীদের পশ্চাৎপদ ও শোচনীয় অবস্থার জন্য ইসলামকেই দোষারোপ করা হয়। সত্যি কথা হলো, বর্তমান মুসলিম সমাজে আসলেই নারীদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। তাদের কোনো অনুষ্ঠানে যেতে দেওয়া হয় না; গেলেও কোনো গয়না নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। জোর-জবরদস্তি ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার এমন মানসিকতা মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধারই নামান্তর। নারীরা মানুষ; তাদের মন আছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে নির্দেশনা দেন; ভালো-মন্দ ব্যাখ্যা করেন। এর পর যার ইচ্ছা ভালোটা গ্রহণ করবে, আর যার ইচ্ছা মন্দটা গ্রহণ করবে। এই সুযোগ সব মানুষকেই দিয়েছেন।
আল্লাহ পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তিনিই আমাদের স্রষ্টা। অথচ আমরা সব সময় নারীদের বাধ্য করার পথ খুঁজি। আলেমদের মুখেও নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বিদ্রূপাত্মক কথা শুনি; যা শুনে যে কেউ-ই রাগান্বিত হবেন। পুরুষদের নিয়ে অবমাননাকর কিছু বলা হলে তো তারা নিঃসন্দেহে রেগে যাবেন। মূলত আমরা নারীদের মানুষই মনে করি না। এমন মনোভাব ইসলাম সমর্থন না করলেও মুসলিম সমাজে দুঃখজনকভাবে প্রচলিত আছে।
যা হোক, প্রবন্ধগুলো পড়ে আমি খুবই আহত হই। কেউ খামাখা ইসলামকে দোষারোপ করুক, তা আমরা চাই না। তখন আমার মাথায় একটা চিন্তা এল। দীর্ঘদিনের হাদিস গবেষণার সূত্রে জ্ঞানচর্চায় বিখ্যাত অনেক মুসলিম নারী স্কলারের কথা আমার জানা ছিল। ভাবলাম, তাঁদের জীবনী এক মলাটে তুলে ধরলে একটা মোক্ষম জবাব হবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বইটি মুসলিম নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রেরণা হবে। তা ছাড়া আলেমদের আমাদের হারানো অতীত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চিন্তাও ছিল। এসব কারণেই আমি প্রকল্পটি হাতে নিই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। পুরো কাজটি একান্তই আমার আগ্রহের জায়গা থেকে করা। অক্সফোর্ডে আমি অন্য কাজ করতাম, পাশাপাশি এ কাজটিও স্বল্প পরিসরে শুরু করি। এর পর আরও তথ্য আমার কাছে আসতে থাকে। আমি সিরিয়া, মিসর ও অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করে পুরোনো পাণ্ডুলিপি থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করি। অবিশ্বাস্যভাবে অনেক বেশি তথ্য হাতে আসে। বইয়ের ভলিউম শুধুই বাড়ছিল।
মনে আছে, ৫ হাজার নারী স্কলারের তথ্য সংগ্রহ করার পর আমার এক খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ সহকর্মী এসে বলেন, ‘আপনি তো ৫ হাজারের তথ্য সংগ্রহ করলেন। আপনাকে এক বিখ্যাত প্রাচ্যবিদের কিছু কলাম দিচ্ছি।’ তিনি তা আমাকে সরবরাহ করেন। তাতে লেখক দাবি করেন, মুসলমানরা যদি পাঁচজন শিক্ষিত নারীর নাম পেশ করতে পারে, তবে তিনি স্বীকার করবেন যে, ইসলাম নারীর অধিকার দেয়। লেখাটি হাতে আসার পর আমার সংগ্রহ বাড়তে বাড়তে ৫ হাজার থেকে ৯ হাজার, তারপর ১০ হাজারে উন্নীত হয়। এর পর কাতারে আমাকে শাইখ ইউসুফ আল-কারজাবি কাজটি শেষ না হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তিনি পরামর্শ দেন, কাজে বিরতি দিয়ে যা হয়েছে, তা প্রকাশ করে দিতে। তাঁর অনুরোধে আমি কাজটি থামাই। বইটি বের হওয়ার পরও তাতে যুক্ত করার মতো আরও ২ হাজার নারীর তথ্য এখন আমার হাতে আছে।
এ বিষয়ে স্বতন্ত্র বিশ্বকোষ রচনার কাজ এটিই প্রথম। আশা করি, এর পর অনেকেই এ কাজে এগিয়ে আসবেন। আমি ফারসি জানলেও ফারসি ভাষাসহ মধ্য এশিয়ার অন্যান্য ভাষা, উজবেক কিংবা তুর্কি সোর্স থেকে আমি তথ্য নিইনি। ফলে এ ক্ষেত্রে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। একজনের জানা ভাষা ও সোর্স থেকে যদি এত তথ্য পাওয়া যায়, তবে ভবিষ্যতে বিষয়টি আরও সমৃদ্ধ হবে। তাই আমি অনেক খুশি।
৪৩ খণ্ডের এই বিশ্বকোষের ভূমিকা হিসেবে আরবি ও ইংরেজিতে একটি ভলিউম প্রকাশিত হয়। একবার আমি যুক্তরাষ্ট্রের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হই। সেখানে এক নারী শিক্ষার্থী তা নিয়ে আমার কাছে হাজির হন। তাঁর কপিটির প্রত্যেক পৃষ্ঠাতেই তিনি টীকা সংযোজন করেন। তিনি জানান, ‘সুদান, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইসলাম ত্যাগ করা অনেক নারীই এ বই পড়ে ইসলামে ফিরে আসেন।’
সুতরাং আমি মনে করি, এ গবেষণা মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে সাহায্য করছে। আমি সম্প্রতি ওমরাহ থেকে ফিরেছি। সৌদি আরবে দেখলাম, অনেক নারী-পুরুষই আমার এ কাজের জন্য আপ্লুত। হৃদয়ের গভীর থেকে বলি, নারীদের, বিশেষভাবে মুসলিম নারীদের, আরও বিশেষভাবে ভারত উপমহাদেশের মুসলিম নারীদের জন্য আমি কাজ করতে চাই। কারণ, আমার শেকড় ভারতেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের মুসলিম নারীদের অবস্থা অধিক শোচনীয়—আমি জানি।
ইসলামে নারীর অবদান
বিশ্বকোষটি রচনা করতে গিয়ে আমি দেখি, এ যুগের নারীদের তুলনায় আগের যুগের নারীদের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। তবুও তাঁরা জ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে পড়েননি। তাঁদেরও পারিবারিক জীবন ছিল। তাঁদের মধ্যেও ধনী-দরিদ্র ছিলেন। কারও বাচ্চা ছিল, পারিবারিক কলহ ছিল; কেউ আবার ডিভোর্সি ছিলেন। তাঁরা কোনো অভিযোগ না করে সবকিছু সামলে নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান। ইসলামের গণ্ডির মধ্যে থেকে সময়ের সদ্ব্যবহার করেন। সততার সঙ্গে ইসলামকে জানতে চান এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই জ্ঞান অর্জন করেন। তাই তো পুরুষদের বিরুদ্ধে হাদিস জালিয়াতির অভিযোগ থাকলেও নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ নেই।
ইসলামে নারীরা বিস্ময়কর অবদান রাখেন। ইসলামি জ্ঞানচর্চার এক চতুর্থাংশেই নারীর একচেটিয়া আধিপত্য। বাকি তিন ভাগে রয়েছে নারী-পুরুষের সমান অবদান। ইসলামি জ্ঞানের বিখ্যাত গ্রন্থগুলোতে নারীদের বর্ণিত হাদিসের ভিত্তিতেই অনেক বিধান প্রণীত হয়। নারী হওয়ার কারণে মুহাদ্দিসরা কখনো তাঁদের হাদিস বাদ দেননি; বরং সাদরে গ্রহণ করেন। কেবল নারীদের বর্ণিত হাদিসের ওপর ভিত্তি করেই অনেক বিধান প্রণীত হয়। তাই নারী আমাদের ধর্মেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের সূচনাকালে নারীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে মাজাহসহ হাদিসের অসংখ্য গ্রন্থে তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়। এসব গ্রন্থের রচয়িতারা নারীদের কাছে শুধু জ্ঞান আহরণই করেননি; বরং তাঁদের সনদ বর্ণনা সর্বাধিক বিশুদ্ধ বলেও প্রমাণিত।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পবিত্র কোরআনের পর বিশুদ্ধতম গ্রন্থ সহিহ বুখারির বিশুদ্ধতম কপিটি এক নারীর সম্পাদিত—কারিমা বিনতে আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ আল-মারওয়াজি (মৃত ৪৬৩ বা ৪৬৪ হি.)। অথবা উম্মুল খাইর ফাতিমা বিনতে ইবরাহিম (মৃত.৭১১ হি.)-এর কথাই ধরুন। তিনি সহিহ বুখারির শিক্ষক ছিলেন। বুখারির সর্বোৎকৃষ্ট সনদ তাঁর ছিল। অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি তাঁর কাছে শিখতেন। সিরিয়া থেকে হজে এসে তিনি মদিনায় জিয়ারতে আসেন এবং মসজিদে নববীতে হাদিস পাঠদান করেন। এমন আরও দু-তিনজন নারী স্কলার আছেন। সেকালের মুসলিম সমাজে যদি নারীর সম্মান না-ই থাকত, তাহলে কীভাবে তারা একজন নারীকে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র রওজার পাদদেশে বসার অনুমতি দিয়েছিলেন? একইভাবে তিন নারী স্কলার পবিত্র কাবাঘরের পাদদেশে হাতিম-এ পাঠদান করেছিলেন।
তাই আমি বলি, নীতিমান হলে অবশ্যই আপনাকে নারীর সম্মান দিতে হবে। ইসলামে তাদের অবদান স্বীকার করতে হবে; কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। এসব নারী স্কলারের জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাদানের কারণেই অনেক হাদিসগ্রন্থ আজ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। তাঁদের কারণেই অনেক হাদিসগ্রন্থ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাবরানি প্রণীত বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ মুজাম আল-কাবির তাঁর ছাত্রী ফাতিমা আল-জুজদানিয়া (মৃত ৫২৪ হি.)-এর সূত্রে বর্ণিত। এই ফাতিমার ছাত্ররাই স্পেন থেকে এসে মিসরে হাদিসশাস্ত্র পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন।
আরেক বিখ্যাত নারী স্কলারের নাম ফাতিমা আল-সামারকান্দি। তিনি তাঁর বাবা মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল-সামারকান্দি রচিত তুহফাত আল-ফুকাহা পুরো মুখস্থ করেন। আল-কাসানি নামে তাঁর এক ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকের কন্যা ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা নাকচ করে দেন। কারণ তিনি জানতেন, তাঁর মেয়ে তাঁর ছাত্রের তুলনায় বেশি জ্ঞানী। তবে পরে তাঁর গ্রন্থের একটি ব্যাখ্যা লিখে দেওয়ার শর্তে রাজি হন। আল-কাসানি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং বাদায়ে আল-সানায়ে নামের অনবদ্য এক ব্যাখ্যা-গ্রন্থ লিখে দেন, যা এখন পর্যন্ত হানাফি ফিকহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। চিন্তা করে দেখুন, হানাফি মাজহাবের একটি সেরা গ্রন্থ একজন নারীকে পেতে লেখা হয়েছিল!

ইসলামে নারীর অধিকার
মহানবী (সা.) কখনোই নারী-পুরুষের শিক্ষাগ্রহণ, শিক্ষাদান ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্য করেননি। নারীদের জন্য যুদ্ধ বাধ্যতামূলক না করলেও যেতে চাইলে তাঁদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। তেমনি জুমার নামাজ তাদের জন্য আবশ্যক করা না হলেও অংশ নিলে অবশ্যই পুরস্কৃত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘নারীদের মসজিদে আসতে বাধা দিয়ো না।’
আপনি দেখবেন, নারী সাহাবিরা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন, তলোয়ার হাতে লড়াই করছেন এবং মহানবী (সা.) নিজেই তাঁদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে ৩৫ জন নারী অংশ নেন। আপনিই বলুন, নারীরা যুদ্ধ করতে নামলে কি নারী হওয়ার কারণে শত্রুপক্ষ তাদের ছাড় দেবে? কখনোই না, আঘাত করার সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করবে না। তো মুসলিম নারী যদি রণাঙ্গনে শত্রুর বিরুদ্ধ লড়াই করার অনুমতি পায়, তাহলে আর কোন জায়গাটি তাদের জন্য অনুপযুক্ত থাকে? আয়েশা (রা.)-কেই দেখুন! পুরো একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভাষণ দিয়েছেন এবং হাজারো মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো বিতরণ করেছেন। হজ-ওমরাহর তাওয়াফেই নারী-পুরুষের কত ভিড় দেখুন! এমন ভিড় পৃথিবীর কোথাও দেখবেন না। যে ধর্মে তাওয়াফের মতো ভিড়ের স্থানে যাওয়ার অনুমতি আছে, সেখানে আর কোথায় যেতে বাধা থাকতে পারে?
নারীদের এগিয়ে যেতে হবে। জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হতে হবে। ভারতীয়রা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে। আমি বলি, আসল ক্ষমতায়ন হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান। মানুষকে শেখানো এবং শিক্ষিত জাতি তৈরি করাই আসল উন্নয়ন। আমি নারীদের বলি, আপনি বিদ্যার্জন অব্যাহত রাখলে পুরুষও আপনার কাছে শিখতে আসবে। সুতরাং যুক্তিতর্ক করার দরকার নেই।
আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, নারীরা ইসলামের বেশি খেদমত করতে পারে। কারণ তাদের প্রতারণার মনোভাব কম; আন্তরিকতা বেশি। ক্ষমতালিপ্সু নয় তারা। মুম্বাইয়ে আমার এক ছাত্রী তাফসির পড়ান। কিছু আলেম তাঁকে বলেন যে, ‘নারীরা পুরুষদের পড়াতে পারে না।’ আমি তাঁকে বলি, ‘কিছুই বলার দরকার নেই। নারীরা হাদিস শেখাতে না পারলে আমাদের কী হবে? এত মানুষ কীভাবে বিদ্যার্জন করবে। আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষকই তো আমাদের মাহরাম নন। সুতরাং কাজ করে যান। সত্য একদিন ছড়িয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ। আমি নারীদের পড়াই বলে অনেকেই এক সময় আমার সমালোচনা করতেন। এখন দেখি তাঁরাও নারীদের পড়ান।’
মুসলিম নারীদের পিছিয়ে পড়ার কারণ
মুসলিম বিশ্ব সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। শুধু নারীর ক্ষেত্রেই নয়, আজকাল পুরুষদেরও চরম অধঃপতন ঘটেছে। মুসলিমরা শিক্ষাকে মাদ্রাসার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। অতীতে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও বর্তমানে অধিকাংশ মাদ্রাসা পুরুষদের জন্য বরাদ্দ। বিশেষ করে উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে এবং মুসলিম কারিকুলামে গ্রিক দর্শনে বেশ জোর দেওয়া হয়। কারণ, গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে প্রায় সবাই নারী অবমাননা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। এ কারণেই কোনো নারী গ্রিক দার্শনিক আপনি খুঁজে পাবেন না। তাঁরা মনে করতেন, নারী বুদ্ধিমত্তায় নীচ। অ্যারিস্টটলকে আমি সম্মান করি, তবে তিনিই বলেন যে, ‘বুদ্ধিমত্তায় নারীদের নীচ হওয়ার একটি প্রমাণ হলো পুরুষের তুলনায় তাদের দাঁত কম।’ এত বড় দার্শনিক এমন বক্তব্য দিচ্ছেন, ভাবতেই অবাক লাগে!
মুসলিম বিশ্বের গ্রিক দর্শন প্রভাবিত কোনো মানুষই নারীদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয় না। এ কারণেই আমার বিশ্বকোষে সব ঘরানার নারী স্কলার থাকলেও দার্শনিক পরিবার থেকে আসা কোনো নারী স্কলার নেই। এমনকি ইমাম গাজ্জালির মতো বিখ্যাত দার্শনিক আলিমও রাজা-বাদশাহদের উপদেশ দেন যে—নারীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন না; করলেও তাদের মতের বিপরীত কাজ করুন। তিনি আরও বলেন যে—নারীর কারণেই পৃথিবীর সব মন্দ কাজ সংঘটিত হয়। মাদ্রাসাগুলোতে এখনো ইমাম গাজ্জালির বিরাট প্রভাব আছে। আমি নিজেও মাদ্রাসার ছাত্র। আমি সারা জীবন মাদ্রাসায় পড়েছি; তাঁদের শ্রদ্ধা করি এবং তাঁদের নিয়ে লিখি। তারপরও আমি বলব, এমন মানসিকতা তাঁদের মধ্যে আছেই; সেখান থেকে তাঁরা বেরোতে পারছে না। মাদ্রাসাগুলোর পরিবর্তনে সময় লাগবে। আমি তাঁদের সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে চাই না; আমি মানুষকে শেখাতে চাই। পরিবর্তন ধীরে ধীরেই হয়। ইনশা আল্লাহ একদিন পরিবর্তন আসবেই।
ঘরবন্দী করে রাখার যুক্তির অসারতা
অবশ্য নারীবাদকে তাদের জন্য সহায়ক মনে করি না আমি। এটি আরেক চরমপন্থা। নারীবাদের সমালোচনা করে আমি আরেকটি বই লিখেছি; শিগগিরই তা প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ। তবে নারীবাদের একটি ভালো দিক আছে—এটি নারীর জন্য সুবিচারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই পয়েন্টে আমরা একমত। নারীদের প্রতি সুবিচার করা উচিত। তবে নারীবাদের সমাধান ভালো নয়; সেটি তাদের জন্য ক্ষতিকর।
আয়েশা (রা.)-এর যুগে একটি হাদিস প্রচলিত ছিল—নামাজরত কোনো পুরুষের সামনে দিয়ে কোনো নারী হেঁটে গেলে নামাজ নষ্ট হবে। কুফার বিখ্যাত আলিম ও ফকিহ আসওয়াত ইবনে ইয়াজিদ আয়েশাকে হাদিসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি রেগে যান এবং বলেন, ‘হে কুফাবাসী, আমরা, নারীদের তোমরা গাধা ও বানরের সমান বানিয়ে ছেড়েছ! মহানবী (সা.) নামাজরত থাকতেন, আমি তাঁর সামনে থাকতাম, কই কিছুই তো হয়নি!’ এভাবে তিনি এই প্রচলিত ভুল শুধরে দেন। এ ঘটনা থেকে বুঝতে পারি, নারীরা মাঠে না থাকলে পুরুষেরা তাদের সম্পর্কে যা ইচ্ছা বলবে। প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না।
অনেকেই নারীদের নিকাব পরা বাধ্যতামূলক বলে দাবি করেন। আমার মনে হয়, তাঁদের এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ইসলামের মূল শিক্ষার চেয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবই বেশি। তাঁরা যুক্তি দেন যে, আপনার হিরে-জহরত থাকলে তা বাড়ির অন্দরে লুকিয়ে রাখেন। নারীও হিরে-জহরতের মতোই। আমরাও এক সময় এই যুক্তি বিশ্বাস করতাম। তবে এখানে একটি মৌলিক ভুল আছে—হিরে-জহরতের মন নেই, জীবন নেই; তবে নারীর চিন্তাশীল মন-মনন আছে। তারা ভালো-মন্দ বোঝে। কোরআন আদম (আ.)-কে এ আদেশ দেয়নি যে, স্ত্রীকে ভালো-মন্দ শেখান। বরং উভয়কে সম্বোধন করেই সমানভাবে আদেশ করা হয়েছে। নারীরা ভালো-মন্দ বোঝে, তাদের সঙ্গে পাথরের মতো আচরণ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
নারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় মাথায় রাখতে হবে যে, তারাও সচেতন মানবসন্তান। আল্লাহ তাআলা এভাবেই তাদের সম্বোধন করেন। আমার যুক্তি হলো, নারীরা মূল্যবান হিরে-জহরত হওয়ার কারণে যদি তাদের অন্তপুরে লুকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে পুরুষেরা তো নারীর চেয়েও মূল্যবান, তাদের তো বাক্সবন্দী করে রাখা দরকার! এই যুক্তি কি পুরুষসমাজ মেনে নেবে? মূলত কোরআন-হাদিসে এমন যুক্তির কোনো ভিত্তি নেই। এটি মানুষের মনগড়া ব্যাখ্যা। কোরআন নারীদের সঙ্গে কেমন মনোভাব পোষণ করে দেখুন। সাহাবিদের কর্মপন্থা দেখুন। ওমর (রা.) মদিনার নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই গনিমতের মাল বরাদ্দ করতেন। তিনি বাড়ি বাড়ি খবর পাঠাতেন—পুরুষেরা তাদের ভাগ নিয়ে যাক, নারীরা তাদের ভাগ নিয়ে যাক; কেউ কারও প্রতিনিধি হিসেবে আসার দরকার নেই। তিনি নিজ হাতেই তা নারীদের মধ্যে বণ্টন করতেন। কারও ভাই কিংবা স্বামী প্রতিনিধি হিসেবে এলে সেই নারীকে তিনি উপদেশ দিতেন—অন্য কাউকে তোমার টাকা নিতে পাঠানো সঠিক নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী একবার তাঁর কাছে একটি বিষয় জানতে চান। বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। তিনি বলেন, ‘তুমি মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো।’ তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘না, তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো।’ তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং তাঁকেই যেতে বলেন। তখন তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে বিষয়টি সরাসরি জিজ্ঞেস করেন। এ যুগের লোকজন বলবে, ‘না, না! মুফতির কাছে যেয়ো না; তোমার বদলে আমিই যাচ্ছি।’
নারীরা রাসুলের কাছে গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করতেন; কারণ ইসলাম সকল মানুষের ধর্ম। আমাদের সমাজে যা প্রচলিত আছে, তা অস্বাভাবিক। ইসলামের স্বাভাবিক নির্দেশনা হলো, আপনি তাদের চিন্তাশীল মানুষ ভাবুন, তাদের মন-মননকে সম্মান করুন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের আল্লাহর ইবাদত করার সুযোগ করে দিন। এতে তারা পুরুষের চেয়ে বেশি ধার্মিক হবে। আল্লাহভীতি কখনোই জোর-জবরদস্তি করে আনা যায় না; মন থেকেই আসতে হয়। পাথর কিংবা দেয়াল তো ধার্মিক নয়। তারা তো মিথ্যা বলে না। ভালো-মন্দ পরখ করার সুযোগ দিলেই তো ধার্মিক হওয়ার সুযোগ আসে। নারীরা নিজেদের পথ বেছে নিক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি কি তাকে (ভালো-মন্দ) দুটি পথ দেখাইনি?’ (সুরা বালাদ, আয়াত: ১০) তাই যুক্তি যাদের পক্ষ থেকেই আসুক, পরখ করে দেখুন। ইসলাম মজবুত যুক্তিই গ্রহণ করে; দুর্বল-খোঁড়া যুক্তি নয়।
ফিকহের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি
ইসলাম কোরআন-সুন্নাহর ওপরই প্রতিষ্ঠিত। ফিকহ কোরআন-সুন্নাহর একটি অংশ মাত্র। ফিকহের অধিকাংশ মাসায়েলই ইজতিহাদের ভিত্তিতে। এটি প্রথা ও সময়ের আলোকেই প্রণীত হয়। ফিকহি মতামত যুগের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়। মতামতগুলো মানুষেরই; একটি আরেকটির চেয়ে ভিন্নতর। একাধিক অর্থের সুযোগও থাকে অনেক ক্ষেত্রে। আমরা কোরআন-সুন্নাহর পরিবর্তন করতে বলছি না। তবে যুগের আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। আর ব্যাখ্যা দিতে হলে আমাদের মহানবী (সা.)-এর যুগে ফিরতে হবে। মদিনার সমাজবাস্তবতায় তিনি নারীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন, তা দেখতে হবে। নারীদের মসজিদে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন—আমাদেরও তা-ই করতে হবে। নারীদের কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে উৎসাহ দিয়েছেন—আমাদেরও তা-ই করতে হবে। ওমর (রা.) শিফা বিনতে আবদুল্লাহ নামের এক নারীকে বাজার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এত পুরুষ সাহাবি থাকার পরও তিনি একজন নারীকেই দায়িত্ব দেন। অন্য এক নারী, সামারা বিনতে নাহিককে তিনি সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ বিষয়ক দায়িত্ব দেন। হাতে লাঠি নিয়ে তিনি মানুষের অপরাধের শাস্তি দিতেন। নারীরা তখন কত সক্রিয় ছিল ভাবুন!
এই বিশ্বকোষটি লেখার পর আমি ইংল্যান্ডের লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে কয়েকজন আলেম আমাকে বলেন, ‘আপনার বইটি ইসলামকে পরিবর্তন করতে যাচ্ছে।’ আমি বলি, ‘না, এটি পরিবর্তনকেই সরাতে যাচ্ছে। এটি মানুষকে মহানবী (সা.)-এর সমাজে নিয়ে যাচ্ছে।’ আমি আরও বলি, ‘আপনারা আলেম মানুষ। আমার তথ্য-উপাত্তে কোনো ধরনের ভুল থাকলে শুধরে দিন। আমি তা বই থেকে মুছে দেব।’
একবার আমি ইংল্যান্ডের এক মসজিদে বক্তৃতা দিই। তাতে নারীদের মসজিদে আসতে উৎসাহ দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করি। ইমাম সাহেব এসে বলেন, ‘যা ইচ্ছা বলেন, তবে এমন কথা বলবেন না।’ আমি বলি, ‘কেন? আমার যুক্তিতে কোনো ভুল আছে?’ তিনি বলেন, ‘নাই। যুক্তি যথাযথ। তবে তারা মসজিদে আসুক, তা আমরা চাই না।’
নারীদের মসজিদে আসতে নিষেধ করার পেছনে চলমান সংস্কৃতিই তাদের আসল কথা; বাস্তবে তাদের কাছে নিরেট কোনো যুক্তি নেই। কিছু মানুষের কাছে ইসলামের চেয়ে মুসলিম সংস্কৃতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম সংস্কৃতি সর্বস্ব ধর্ম নয়, বরং এটি আল্লাহ ও পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা। নারী-পুরুষকে এক সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসে নারী-পুরুষ সমানভাবে অংশ নেওয়া সুযোগ রেখেছি।
নারীর অধিকার বনাম বঞ্চনা
বিয়ের পর নারীর স্বাধীন ও আলাদা ঘর নিশ্চিত করা পুরুষের দায়িত্ব, যা দুই পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের ঘর থেকে পৃথক হবে—এ বিষয়ে কোনো আলিমের দ্বিমত নেই। ঘরের পরিবেশও হতে হবে নিরিবিলি, হিজাব করা কিংবা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে চিন্তা থাকা যাবে না। স্বামী তার স্ত্রীকে বাবা-মা কিংবা ভাইয়ের ঘরে তুলতে পারে না। সকল মাজহাবেই এমনটি বলা হয়েছে। লোকে বলে, আমার বাবা-মা আছে, তাদের খেদমত করা লাগবে। আমি তাদের বলি, নারীদেরও বাবা-মা আছে। তারা স্বামীর বাবা-মায়ের সেবা করতে বাধ্য নয়। বাবা-মায়ের সেবার দায়িত্ব আপনারই। আপনি না পারলে লোক নিয়োগ দেন; স্ত্রীকে বাধ্য করতে পারেন না। তবে সে নিজ থেকে করলে তা একান্তই তার অনুগ্রহ; সে জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ হোন। আপনার স্ত্রীর খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। তার ভরণপোষণ, চিকিৎসা এমনকি শিক্ষার জন্যও ব্যয় করতে হবে। এটি অনুগ্রহ নয়; দান-সদকাও নয়। তার লাখ টাকা থাকলেও আপনাকে তা দিতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যরা অভাবগ্রস্ত হলেই তাদের দিতে হয়, তবে স্ত্রী ধনী হলেও দিতে হয়। এটি স্বামীর কর্তব্য।
কেউ কেউ বলে, ‘এত টাকা দিয়ে তারা কী করবে?’ আমি বলি, ‘তারা চ্যারিটি করবে; মসজিদ তৈরি করবে—অতীতের মতো। আগের যুগের নারীরা এমন কাজ অনেক করেছেন। তবে পরিহাসের বিষয় হলো, ফাতিমা আল-ফিহরিয়া নামের এক নারী মরক্কোর ফেজ শহরের কারাউয়্যিন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু সেখানে দীর্ঘদিন নারীদের পড়াশোনার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমি সেই কলেজে একবার লেকচার দিতে যাই। শ্রোতাদের সবাই আলেম। আমি বলি, ‘এই কলেজ একজন নারীর তৈরি। হাজার বছর ধরে আপনারা তাদেরই পড়াশোনার সুযোগ দেননি।’ অবশ্য এখন তারা নারীদের পড়ার অনুমতি দিচ্ছেন। তেমনি ভারতেও এমন অনেক মসজিদ আছে, যা নারীদের অর্থায়নে নির্মিত হলেও তাদের নামাজের অনুমতি নেই। মানুষ ইসলাম পড়ে না। মহানবী (সা.)-এর যুগের প্রেক্ষাপট এবং কোরআন-সুন্নাহ থেকে স্পষ্ট উদ্ধৃতি না দিলে কারও যুক্তিতে কান দেওয়ার দরকার নেই।
মুসলিম নারীর করণীয়
আমি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ডে বসবাস করছি। আমার মত হলো, নারী-পুরুষ উভয়কেই মূলধারার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, আমাদের তা অর্জনের অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। তবে পাশাপাশি আরবি ভাষা ও ইসলাম শিক্ষা পড়াতে হবে। সেই লক্ষ্যপূরণেই আমি ক্যামব্রিজে কাজ করে যাচ্ছি। আমি মনে করি, ভারত উপমহাদেশেও নারী-পুরুষদের মূলধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করা উচিত। তবে সপ্তাহের একদিন ইসলাম ও আরবি শেখার জন্য বরাদ্দ রাখলে তারা ইসলাম ভালোভাবে বুঝতে পারবে। ধর্মীয় জ্ঞান আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করবে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েদের জন্য আরবি শেখা মোটেও কঠিন কিছু নয়। তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করাই আসল কথা। আমার ক্লাসে নারী শিক্ষার্থীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও তাঁরা এগিয়ে যান। তাই নারীদের পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য করবেন না। সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও তারা ইসলাম শিখতে পারে। এতে তাঁরা আরও বেশি ধার্মিক হবে।
অনেক পিএইচডিধারী নারী আমার ক্লাসে আসেন। মাথায় স্কার্ফ নেই। সহিহ বুখারি পড়েন। লোকজন বলে, ‘এই নারী এমন পবিত্র গ্রন্থ স্কার্ফ ছাড়া পড়ছেন!’ আমি তাঁদের বলি, ‘চিন্তার কিছু নেই। ওদের আসতে দিন। দেখবেন, তাঁরা বদলে যাবে। তাঁরা তাহাজ্জুদগুজার হয়ে যাবে। এখান থেকে গিয়ে পরিবারকে শেখাবে। তাঁদের জানার সুযোগ দিতে হবে। তা জানলে আমরা কীভাবে তাঁদের বাধ্য করব? পুরুষদের মতো নারীরাও জান্নাতে যেতে চায়। তাদের পড়াশোনার করার সুযোগ দিন।’
উপমহাদেশের মহিলা মাদ্রাসাগুলোর ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট নই। তা খুবই নিম্নমানের। তারা নারীদের স্রেফ পাঁচ-ছয় বছর পড়াশোনা করার সুযোগ দেয়। এই অল্প সময়ে তারা তেমন কিছু শিখতে পারে না। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক; সপ্তাহান্তে সময় বের করে ইসলাম শিখুক। কারণ, মাদ্রাসাপড়ুয়া নারীরা সাধারণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। তাই তাদের আত্মবিশ্বাস বিকশিত করার সুযোগ দিন। অনেক পুরুষ ধার্মিক স্ত্রী পেলে খুশিতে গদগদ হয়। তবে তারাই আবার চায় না—নারীরা শিখুক। তবে একবার শিখে যখন তা মানার চেষ্টা করে, তখন সেই পুরুষদের খুশির সীমা থাকে না। তাহলে আমার কথা হলো—তাদের শিখতে দেন না কেন?

বিশ্বকোষ রচনার প্রেক্ষাপট
১৯৯৪ কিংবা ৯৫ সালের কথা। যুক্তরাজ্যের কয়েকটি সংবাদপত্রে মুসলিম নারী নিয়ে কিছু নেতিবাচক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে মুসলিম বিশ্বে নারীদের পশ্চাৎপদ ও শোচনীয় অবস্থার জন্য ইসলামকেই দোষারোপ করা হয়। সত্যি কথা হলো, বর্তমান মুসলিম সমাজে আসলেই নারীদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। তাদের কোনো অনুষ্ঠানে যেতে দেওয়া হয় না; গেলেও কোনো গয়না নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। জোর-জবরদস্তি ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার এমন মানসিকতা মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধারই নামান্তর। নারীরা মানুষ; তাদের মন আছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে নির্দেশনা দেন; ভালো-মন্দ ব্যাখ্যা করেন। এর পর যার ইচ্ছা ভালোটা গ্রহণ করবে, আর যার ইচ্ছা মন্দটা গ্রহণ করবে। এই সুযোগ সব মানুষকেই দিয়েছেন।
আল্লাহ পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তিনিই আমাদের স্রষ্টা। অথচ আমরা সব সময় নারীদের বাধ্য করার পথ খুঁজি। আলেমদের মুখেও নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বিদ্রূপাত্মক কথা শুনি; যা শুনে যে কেউ-ই রাগান্বিত হবেন। পুরুষদের নিয়ে অবমাননাকর কিছু বলা হলে তো তারা নিঃসন্দেহে রেগে যাবেন। মূলত আমরা নারীদের মানুষই মনে করি না। এমন মনোভাব ইসলাম সমর্থন না করলেও মুসলিম সমাজে দুঃখজনকভাবে প্রচলিত আছে।
যা হোক, প্রবন্ধগুলো পড়ে আমি খুবই আহত হই। কেউ খামাখা ইসলামকে দোষারোপ করুক, তা আমরা চাই না। তখন আমার মাথায় একটা চিন্তা এল। দীর্ঘদিনের হাদিস গবেষণার সূত্রে জ্ঞানচর্চায় বিখ্যাত অনেক মুসলিম নারী স্কলারের কথা আমার জানা ছিল। ভাবলাম, তাঁদের জীবনী এক মলাটে তুলে ধরলে একটা মোক্ষম জবাব হবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বইটি মুসলিম নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রেরণা হবে। তা ছাড়া আলেমদের আমাদের হারানো অতীত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চিন্তাও ছিল। এসব কারণেই আমি প্রকল্পটি হাতে নিই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। পুরো কাজটি একান্তই আমার আগ্রহের জায়গা থেকে করা। অক্সফোর্ডে আমি অন্য কাজ করতাম, পাশাপাশি এ কাজটিও স্বল্প পরিসরে শুরু করি। এর পর আরও তথ্য আমার কাছে আসতে থাকে। আমি সিরিয়া, মিসর ও অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করে পুরোনো পাণ্ডুলিপি থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করি। অবিশ্বাস্যভাবে অনেক বেশি তথ্য হাতে আসে। বইয়ের ভলিউম শুধুই বাড়ছিল।
মনে আছে, ৫ হাজার নারী স্কলারের তথ্য সংগ্রহ করার পর আমার এক খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ সহকর্মী এসে বলেন, ‘আপনি তো ৫ হাজারের তথ্য সংগ্রহ করলেন। আপনাকে এক বিখ্যাত প্রাচ্যবিদের কিছু কলাম দিচ্ছি।’ তিনি তা আমাকে সরবরাহ করেন। তাতে লেখক দাবি করেন, মুসলমানরা যদি পাঁচজন শিক্ষিত নারীর নাম পেশ করতে পারে, তবে তিনি স্বীকার করবেন যে, ইসলাম নারীর অধিকার দেয়। লেখাটি হাতে আসার পর আমার সংগ্রহ বাড়তে বাড়তে ৫ হাজার থেকে ৯ হাজার, তারপর ১০ হাজারে উন্নীত হয়। এর পর কাতারে আমাকে শাইখ ইউসুফ আল-কারজাবি কাজটি শেষ না হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তিনি পরামর্শ দেন, কাজে বিরতি দিয়ে যা হয়েছে, তা প্রকাশ করে দিতে। তাঁর অনুরোধে আমি কাজটি থামাই। বইটি বের হওয়ার পরও তাতে যুক্ত করার মতো আরও ২ হাজার নারীর তথ্য এখন আমার হাতে আছে।
এ বিষয়ে স্বতন্ত্র বিশ্বকোষ রচনার কাজ এটিই প্রথম। আশা করি, এর পর অনেকেই এ কাজে এগিয়ে আসবেন। আমি ফারসি জানলেও ফারসি ভাষাসহ মধ্য এশিয়ার অন্যান্য ভাষা, উজবেক কিংবা তুর্কি সোর্স থেকে আমি তথ্য নিইনি। ফলে এ ক্ষেত্রে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। একজনের জানা ভাষা ও সোর্স থেকে যদি এত তথ্য পাওয়া যায়, তবে ভবিষ্যতে বিষয়টি আরও সমৃদ্ধ হবে। তাই আমি অনেক খুশি।
৪৩ খণ্ডের এই বিশ্বকোষের ভূমিকা হিসেবে আরবি ও ইংরেজিতে একটি ভলিউম প্রকাশিত হয়। একবার আমি যুক্তরাষ্ট্রের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হই। সেখানে এক নারী শিক্ষার্থী তা নিয়ে আমার কাছে হাজির হন। তাঁর কপিটির প্রত্যেক পৃষ্ঠাতেই তিনি টীকা সংযোজন করেন। তিনি জানান, ‘সুদান, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইসলাম ত্যাগ করা অনেক নারীই এ বই পড়ে ইসলামে ফিরে আসেন।’
সুতরাং আমি মনে করি, এ গবেষণা মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে সাহায্য করছে। আমি সম্প্রতি ওমরাহ থেকে ফিরেছি। সৌদি আরবে দেখলাম, অনেক নারী-পুরুষই আমার এ কাজের জন্য আপ্লুত। হৃদয়ের গভীর থেকে বলি, নারীদের, বিশেষভাবে মুসলিম নারীদের, আরও বিশেষভাবে ভারত উপমহাদেশের মুসলিম নারীদের জন্য আমি কাজ করতে চাই। কারণ, আমার শেকড় ভারতেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের মুসলিম নারীদের অবস্থা অধিক শোচনীয়—আমি জানি।
ইসলামে নারীর অবদান
বিশ্বকোষটি রচনা করতে গিয়ে আমি দেখি, এ যুগের নারীদের তুলনায় আগের যুগের নারীদের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। তবুও তাঁরা জ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে পড়েননি। তাঁদেরও পারিবারিক জীবন ছিল। তাঁদের মধ্যেও ধনী-দরিদ্র ছিলেন। কারও বাচ্চা ছিল, পারিবারিক কলহ ছিল; কেউ আবার ডিভোর্সি ছিলেন। তাঁরা কোনো অভিযোগ না করে সবকিছু সামলে নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান। ইসলামের গণ্ডির মধ্যে থেকে সময়ের সদ্ব্যবহার করেন। সততার সঙ্গে ইসলামকে জানতে চান এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই জ্ঞান অর্জন করেন। তাই তো পুরুষদের বিরুদ্ধে হাদিস জালিয়াতির অভিযোগ থাকলেও নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ নেই।
ইসলামে নারীরা বিস্ময়কর অবদান রাখেন। ইসলামি জ্ঞানচর্চার এক চতুর্থাংশেই নারীর একচেটিয়া আধিপত্য। বাকি তিন ভাগে রয়েছে নারী-পুরুষের সমান অবদান। ইসলামি জ্ঞানের বিখ্যাত গ্রন্থগুলোতে নারীদের বর্ণিত হাদিসের ভিত্তিতেই অনেক বিধান প্রণীত হয়। নারী হওয়ার কারণে মুহাদ্দিসরা কখনো তাঁদের হাদিস বাদ দেননি; বরং সাদরে গ্রহণ করেন। কেবল নারীদের বর্ণিত হাদিসের ওপর ভিত্তি করেই অনেক বিধান প্রণীত হয়। তাই নারী আমাদের ধর্মেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের সূচনাকালে নারীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে মাজাহসহ হাদিসের অসংখ্য গ্রন্থে তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়। এসব গ্রন্থের রচয়িতারা নারীদের কাছে শুধু জ্ঞান আহরণই করেননি; বরং তাঁদের সনদ বর্ণনা সর্বাধিক বিশুদ্ধ বলেও প্রমাণিত।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পবিত্র কোরআনের পর বিশুদ্ধতম গ্রন্থ সহিহ বুখারির বিশুদ্ধতম কপিটি এক নারীর সম্পাদিত—কারিমা বিনতে আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ আল-মারওয়াজি (মৃত ৪৬৩ বা ৪৬৪ হি.)। অথবা উম্মুল খাইর ফাতিমা বিনতে ইবরাহিম (মৃত.৭১১ হি.)-এর কথাই ধরুন। তিনি সহিহ বুখারির শিক্ষক ছিলেন। বুখারির সর্বোৎকৃষ্ট সনদ তাঁর ছিল। অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি তাঁর কাছে শিখতেন। সিরিয়া থেকে হজে এসে তিনি মদিনায় জিয়ারতে আসেন এবং মসজিদে নববীতে হাদিস পাঠদান করেন। এমন আরও দু-তিনজন নারী স্কলার আছেন। সেকালের মুসলিম সমাজে যদি নারীর সম্মান না-ই থাকত, তাহলে কীভাবে তারা একজন নারীকে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র রওজার পাদদেশে বসার অনুমতি দিয়েছিলেন? একইভাবে তিন নারী স্কলার পবিত্র কাবাঘরের পাদদেশে হাতিম-এ পাঠদান করেছিলেন।
তাই আমি বলি, নীতিমান হলে অবশ্যই আপনাকে নারীর সম্মান দিতে হবে। ইসলামে তাদের অবদান স্বীকার করতে হবে; কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। এসব নারী স্কলারের জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাদানের কারণেই অনেক হাদিসগ্রন্থ আজ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। তাঁদের কারণেই অনেক হাদিসগ্রন্থ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাবরানি প্রণীত বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ মুজাম আল-কাবির তাঁর ছাত্রী ফাতিমা আল-জুজদানিয়া (মৃত ৫২৪ হি.)-এর সূত্রে বর্ণিত। এই ফাতিমার ছাত্ররাই স্পেন থেকে এসে মিসরে হাদিসশাস্ত্র পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন।
আরেক বিখ্যাত নারী স্কলারের নাম ফাতিমা আল-সামারকান্দি। তিনি তাঁর বাবা মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল-সামারকান্দি রচিত তুহফাত আল-ফুকাহা পুরো মুখস্থ করেন। আল-কাসানি নামে তাঁর এক ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকের কন্যা ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা নাকচ করে দেন। কারণ তিনি জানতেন, তাঁর মেয়ে তাঁর ছাত্রের তুলনায় বেশি জ্ঞানী। তবে পরে তাঁর গ্রন্থের একটি ব্যাখ্যা লিখে দেওয়ার শর্তে রাজি হন। আল-কাসানি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং বাদায়ে আল-সানায়ে নামের অনবদ্য এক ব্যাখ্যা-গ্রন্থ লিখে দেন, যা এখন পর্যন্ত হানাফি ফিকহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। চিন্তা করে দেখুন, হানাফি মাজহাবের একটি সেরা গ্রন্থ একজন নারীকে পেতে লেখা হয়েছিল!

ইসলামে নারীর অধিকার
মহানবী (সা.) কখনোই নারী-পুরুষের শিক্ষাগ্রহণ, শিক্ষাদান ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্য করেননি। নারীদের জন্য যুদ্ধ বাধ্যতামূলক না করলেও যেতে চাইলে তাঁদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। তেমনি জুমার নামাজ তাদের জন্য আবশ্যক করা না হলেও অংশ নিলে অবশ্যই পুরস্কৃত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘নারীদের মসজিদে আসতে বাধা দিয়ো না।’
আপনি দেখবেন, নারী সাহাবিরা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন, তলোয়ার হাতে লড়াই করছেন এবং মহানবী (সা.) নিজেই তাঁদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে ৩৫ জন নারী অংশ নেন। আপনিই বলুন, নারীরা যুদ্ধ করতে নামলে কি নারী হওয়ার কারণে শত্রুপক্ষ তাদের ছাড় দেবে? কখনোই না, আঘাত করার সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করবে না। তো মুসলিম নারী যদি রণাঙ্গনে শত্রুর বিরুদ্ধ লড়াই করার অনুমতি পায়, তাহলে আর কোন জায়গাটি তাদের জন্য অনুপযুক্ত থাকে? আয়েশা (রা.)-কেই দেখুন! পুরো একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভাষণ দিয়েছেন এবং হাজারো মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো বিতরণ করেছেন। হজ-ওমরাহর তাওয়াফেই নারী-পুরুষের কত ভিড় দেখুন! এমন ভিড় পৃথিবীর কোথাও দেখবেন না। যে ধর্মে তাওয়াফের মতো ভিড়ের স্থানে যাওয়ার অনুমতি আছে, সেখানে আর কোথায় যেতে বাধা থাকতে পারে?
নারীদের এগিয়ে যেতে হবে। জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হতে হবে। ভারতীয়রা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে। আমি বলি, আসল ক্ষমতায়ন হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান। মানুষকে শেখানো এবং শিক্ষিত জাতি তৈরি করাই আসল উন্নয়ন। আমি নারীদের বলি, আপনি বিদ্যার্জন অব্যাহত রাখলে পুরুষও আপনার কাছে শিখতে আসবে। সুতরাং যুক্তিতর্ক করার দরকার নেই।
আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, নারীরা ইসলামের বেশি খেদমত করতে পারে। কারণ তাদের প্রতারণার মনোভাব কম; আন্তরিকতা বেশি। ক্ষমতালিপ্সু নয় তারা। মুম্বাইয়ে আমার এক ছাত্রী তাফসির পড়ান। কিছু আলেম তাঁকে বলেন যে, ‘নারীরা পুরুষদের পড়াতে পারে না।’ আমি তাঁকে বলি, ‘কিছুই বলার দরকার নেই। নারীরা হাদিস শেখাতে না পারলে আমাদের কী হবে? এত মানুষ কীভাবে বিদ্যার্জন করবে। আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষকই তো আমাদের মাহরাম নন। সুতরাং কাজ করে যান। সত্য একদিন ছড়িয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ। আমি নারীদের পড়াই বলে অনেকেই এক সময় আমার সমালোচনা করতেন। এখন দেখি তাঁরাও নারীদের পড়ান।’
মুসলিম নারীদের পিছিয়ে পড়ার কারণ
মুসলিম বিশ্ব সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। শুধু নারীর ক্ষেত্রেই নয়, আজকাল পুরুষদেরও চরম অধঃপতন ঘটেছে। মুসলিমরা শিক্ষাকে মাদ্রাসার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। অতীতে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও বর্তমানে অধিকাংশ মাদ্রাসা পুরুষদের জন্য বরাদ্দ। বিশেষ করে উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে এবং মুসলিম কারিকুলামে গ্রিক দর্শনে বেশ জোর দেওয়া হয়। কারণ, গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে প্রায় সবাই নারী অবমাননা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। এ কারণেই কোনো নারী গ্রিক দার্শনিক আপনি খুঁজে পাবেন না। তাঁরা মনে করতেন, নারী বুদ্ধিমত্তায় নীচ। অ্যারিস্টটলকে আমি সম্মান করি, তবে তিনিই বলেন যে, ‘বুদ্ধিমত্তায় নারীদের নীচ হওয়ার একটি প্রমাণ হলো পুরুষের তুলনায় তাদের দাঁত কম।’ এত বড় দার্শনিক এমন বক্তব্য দিচ্ছেন, ভাবতেই অবাক লাগে!
মুসলিম বিশ্বের গ্রিক দর্শন প্রভাবিত কোনো মানুষই নারীদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয় না। এ কারণেই আমার বিশ্বকোষে সব ঘরানার নারী স্কলার থাকলেও দার্শনিক পরিবার থেকে আসা কোনো নারী স্কলার নেই। এমনকি ইমাম গাজ্জালির মতো বিখ্যাত দার্শনিক আলিমও রাজা-বাদশাহদের উপদেশ দেন যে—নারীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন না; করলেও তাদের মতের বিপরীত কাজ করুন। তিনি আরও বলেন যে—নারীর কারণেই পৃথিবীর সব মন্দ কাজ সংঘটিত হয়। মাদ্রাসাগুলোতে এখনো ইমাম গাজ্জালির বিরাট প্রভাব আছে। আমি নিজেও মাদ্রাসার ছাত্র। আমি সারা জীবন মাদ্রাসায় পড়েছি; তাঁদের শ্রদ্ধা করি এবং তাঁদের নিয়ে লিখি। তারপরও আমি বলব, এমন মানসিকতা তাঁদের মধ্যে আছেই; সেখান থেকে তাঁরা বেরোতে পারছে না। মাদ্রাসাগুলোর পরিবর্তনে সময় লাগবে। আমি তাঁদের সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে চাই না; আমি মানুষকে শেখাতে চাই। পরিবর্তন ধীরে ধীরেই হয়। ইনশা আল্লাহ একদিন পরিবর্তন আসবেই।
ঘরবন্দী করে রাখার যুক্তির অসারতা
অবশ্য নারীবাদকে তাদের জন্য সহায়ক মনে করি না আমি। এটি আরেক চরমপন্থা। নারীবাদের সমালোচনা করে আমি আরেকটি বই লিখেছি; শিগগিরই তা প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ। তবে নারীবাদের একটি ভালো দিক আছে—এটি নারীর জন্য সুবিচারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই পয়েন্টে আমরা একমত। নারীদের প্রতি সুবিচার করা উচিত। তবে নারীবাদের সমাধান ভালো নয়; সেটি তাদের জন্য ক্ষতিকর।
আয়েশা (রা.)-এর যুগে একটি হাদিস প্রচলিত ছিল—নামাজরত কোনো পুরুষের সামনে দিয়ে কোনো নারী হেঁটে গেলে নামাজ নষ্ট হবে। কুফার বিখ্যাত আলিম ও ফকিহ আসওয়াত ইবনে ইয়াজিদ আয়েশাকে হাদিসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি রেগে যান এবং বলেন, ‘হে কুফাবাসী, আমরা, নারীদের তোমরা গাধা ও বানরের সমান বানিয়ে ছেড়েছ! মহানবী (সা.) নামাজরত থাকতেন, আমি তাঁর সামনে থাকতাম, কই কিছুই তো হয়নি!’ এভাবে তিনি এই প্রচলিত ভুল শুধরে দেন। এ ঘটনা থেকে বুঝতে পারি, নারীরা মাঠে না থাকলে পুরুষেরা তাদের সম্পর্কে যা ইচ্ছা বলবে। প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না।
অনেকেই নারীদের নিকাব পরা বাধ্যতামূলক বলে দাবি করেন। আমার মনে হয়, তাঁদের এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ইসলামের মূল শিক্ষার চেয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবই বেশি। তাঁরা যুক্তি দেন যে, আপনার হিরে-জহরত থাকলে তা বাড়ির অন্দরে লুকিয়ে রাখেন। নারীও হিরে-জহরতের মতোই। আমরাও এক সময় এই যুক্তি বিশ্বাস করতাম। তবে এখানে একটি মৌলিক ভুল আছে—হিরে-জহরতের মন নেই, জীবন নেই; তবে নারীর চিন্তাশীল মন-মনন আছে। তারা ভালো-মন্দ বোঝে। কোরআন আদম (আ.)-কে এ আদেশ দেয়নি যে, স্ত্রীকে ভালো-মন্দ শেখান। বরং উভয়কে সম্বোধন করেই সমানভাবে আদেশ করা হয়েছে। নারীরা ভালো-মন্দ বোঝে, তাদের সঙ্গে পাথরের মতো আচরণ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
নারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় মাথায় রাখতে হবে যে, তারাও সচেতন মানবসন্তান। আল্লাহ তাআলা এভাবেই তাদের সম্বোধন করেন। আমার যুক্তি হলো, নারীরা মূল্যবান হিরে-জহরত হওয়ার কারণে যদি তাদের অন্তপুরে লুকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে পুরুষেরা তো নারীর চেয়েও মূল্যবান, তাদের তো বাক্সবন্দী করে রাখা দরকার! এই যুক্তি কি পুরুষসমাজ মেনে নেবে? মূলত কোরআন-হাদিসে এমন যুক্তির কোনো ভিত্তি নেই। এটি মানুষের মনগড়া ব্যাখ্যা। কোরআন নারীদের সঙ্গে কেমন মনোভাব পোষণ করে দেখুন। সাহাবিদের কর্মপন্থা দেখুন। ওমর (রা.) মদিনার নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই গনিমতের মাল বরাদ্দ করতেন। তিনি বাড়ি বাড়ি খবর পাঠাতেন—পুরুষেরা তাদের ভাগ নিয়ে যাক, নারীরা তাদের ভাগ নিয়ে যাক; কেউ কারও প্রতিনিধি হিসেবে আসার দরকার নেই। তিনি নিজ হাতেই তা নারীদের মধ্যে বণ্টন করতেন। কারও ভাই কিংবা স্বামী প্রতিনিধি হিসেবে এলে সেই নারীকে তিনি উপদেশ দিতেন—অন্য কাউকে তোমার টাকা নিতে পাঠানো সঠিক নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী একবার তাঁর কাছে একটি বিষয় জানতে চান। বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। তিনি বলেন, ‘তুমি মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো।’ তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘না, তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো।’ তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং তাঁকেই যেতে বলেন। তখন তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে বিষয়টি সরাসরি জিজ্ঞেস করেন। এ যুগের লোকজন বলবে, ‘না, না! মুফতির কাছে যেয়ো না; তোমার বদলে আমিই যাচ্ছি।’
নারীরা রাসুলের কাছে গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করতেন; কারণ ইসলাম সকল মানুষের ধর্ম। আমাদের সমাজে যা প্রচলিত আছে, তা অস্বাভাবিক। ইসলামের স্বাভাবিক নির্দেশনা হলো, আপনি তাদের চিন্তাশীল মানুষ ভাবুন, তাদের মন-মননকে সম্মান করুন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের আল্লাহর ইবাদত করার সুযোগ করে দিন। এতে তারা পুরুষের চেয়ে বেশি ধার্মিক হবে। আল্লাহভীতি কখনোই জোর-জবরদস্তি করে আনা যায় না; মন থেকেই আসতে হয়। পাথর কিংবা দেয়াল তো ধার্মিক নয়। তারা তো মিথ্যা বলে না। ভালো-মন্দ পরখ করার সুযোগ দিলেই তো ধার্মিক হওয়ার সুযোগ আসে। নারীরা নিজেদের পথ বেছে নিক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি কি তাকে (ভালো-মন্দ) দুটি পথ দেখাইনি?’ (সুরা বালাদ, আয়াত: ১০) তাই যুক্তি যাদের পক্ষ থেকেই আসুক, পরখ করে দেখুন। ইসলাম মজবুত যুক্তিই গ্রহণ করে; দুর্বল-খোঁড়া যুক্তি নয়।
ফিকহের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি
ইসলাম কোরআন-সুন্নাহর ওপরই প্রতিষ্ঠিত। ফিকহ কোরআন-সুন্নাহর একটি অংশ মাত্র। ফিকহের অধিকাংশ মাসায়েলই ইজতিহাদের ভিত্তিতে। এটি প্রথা ও সময়ের আলোকেই প্রণীত হয়। ফিকহি মতামত যুগের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়। মতামতগুলো মানুষেরই; একটি আরেকটির চেয়ে ভিন্নতর। একাধিক অর্থের সুযোগও থাকে অনেক ক্ষেত্রে। আমরা কোরআন-সুন্নাহর পরিবর্তন করতে বলছি না। তবে যুগের আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। আর ব্যাখ্যা দিতে হলে আমাদের মহানবী (সা.)-এর যুগে ফিরতে হবে। মদিনার সমাজবাস্তবতায় তিনি নারীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন, তা দেখতে হবে। নারীদের মসজিদে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন—আমাদেরও তা-ই করতে হবে। নারীদের কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে উৎসাহ দিয়েছেন—আমাদেরও তা-ই করতে হবে। ওমর (রা.) শিফা বিনতে আবদুল্লাহ নামের এক নারীকে বাজার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এত পুরুষ সাহাবি থাকার পরও তিনি একজন নারীকেই দায়িত্ব দেন। অন্য এক নারী, সামারা বিনতে নাহিককে তিনি সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ বিষয়ক দায়িত্ব দেন। হাতে লাঠি নিয়ে তিনি মানুষের অপরাধের শাস্তি দিতেন। নারীরা তখন কত সক্রিয় ছিল ভাবুন!
এই বিশ্বকোষটি লেখার পর আমি ইংল্যান্ডের লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে কয়েকজন আলেম আমাকে বলেন, ‘আপনার বইটি ইসলামকে পরিবর্তন করতে যাচ্ছে।’ আমি বলি, ‘না, এটি পরিবর্তনকেই সরাতে যাচ্ছে। এটি মানুষকে মহানবী (সা.)-এর সমাজে নিয়ে যাচ্ছে।’ আমি আরও বলি, ‘আপনারা আলেম মানুষ। আমার তথ্য-উপাত্তে কোনো ধরনের ভুল থাকলে শুধরে দিন। আমি তা বই থেকে মুছে দেব।’
একবার আমি ইংল্যান্ডের এক মসজিদে বক্তৃতা দিই। তাতে নারীদের মসজিদে আসতে উৎসাহ দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করি। ইমাম সাহেব এসে বলেন, ‘যা ইচ্ছা বলেন, তবে এমন কথা বলবেন না।’ আমি বলি, ‘কেন? আমার যুক্তিতে কোনো ভুল আছে?’ তিনি বলেন, ‘নাই। যুক্তি যথাযথ। তবে তারা মসজিদে আসুক, তা আমরা চাই না।’
নারীদের মসজিদে আসতে নিষেধ করার পেছনে চলমান সংস্কৃতিই তাদের আসল কথা; বাস্তবে তাদের কাছে নিরেট কোনো যুক্তি নেই। কিছু মানুষের কাছে ইসলামের চেয়ে মুসলিম সংস্কৃতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম সংস্কৃতি সর্বস্ব ধর্ম নয়, বরং এটি আল্লাহ ও পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা। নারী-পুরুষকে এক সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসে নারী-পুরুষ সমানভাবে অংশ নেওয়া সুযোগ রেখেছি।
নারীর অধিকার বনাম বঞ্চনা
বিয়ের পর নারীর স্বাধীন ও আলাদা ঘর নিশ্চিত করা পুরুষের দায়িত্ব, যা দুই পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের ঘর থেকে পৃথক হবে—এ বিষয়ে কোনো আলিমের দ্বিমত নেই। ঘরের পরিবেশও হতে হবে নিরিবিলি, হিজাব করা কিংবা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে চিন্তা থাকা যাবে না। স্বামী তার স্ত্রীকে বাবা-মা কিংবা ভাইয়ের ঘরে তুলতে পারে না। সকল মাজহাবেই এমনটি বলা হয়েছে। লোকে বলে, আমার বাবা-মা আছে, তাদের খেদমত করা লাগবে। আমি তাদের বলি, নারীদেরও বাবা-মা আছে। তারা স্বামীর বাবা-মায়ের সেবা করতে বাধ্য নয়। বাবা-মায়ের সেবার দায়িত্ব আপনারই। আপনি না পারলে লোক নিয়োগ দেন; স্ত্রীকে বাধ্য করতে পারেন না। তবে সে নিজ থেকে করলে তা একান্তই তার অনুগ্রহ; সে জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ হোন। আপনার স্ত্রীর খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। তার ভরণপোষণ, চিকিৎসা এমনকি শিক্ষার জন্যও ব্যয় করতে হবে। এটি অনুগ্রহ নয়; দান-সদকাও নয়। তার লাখ টাকা থাকলেও আপনাকে তা দিতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যরা অভাবগ্রস্ত হলেই তাদের দিতে হয়, তবে স্ত্রী ধনী হলেও দিতে হয়। এটি স্বামীর কর্তব্য।
কেউ কেউ বলে, ‘এত টাকা দিয়ে তারা কী করবে?’ আমি বলি, ‘তারা চ্যারিটি করবে; মসজিদ তৈরি করবে—অতীতের মতো। আগের যুগের নারীরা এমন কাজ অনেক করেছেন। তবে পরিহাসের বিষয় হলো, ফাতিমা আল-ফিহরিয়া নামের এক নারী মরক্কোর ফেজ শহরের কারাউয়্যিন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু সেখানে দীর্ঘদিন নারীদের পড়াশোনার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমি সেই কলেজে একবার লেকচার দিতে যাই। শ্রোতাদের সবাই আলেম। আমি বলি, ‘এই কলেজ একজন নারীর তৈরি। হাজার বছর ধরে আপনারা তাদেরই পড়াশোনার সুযোগ দেননি।’ অবশ্য এখন তারা নারীদের পড়ার অনুমতি দিচ্ছেন। তেমনি ভারতেও এমন অনেক মসজিদ আছে, যা নারীদের অর্থায়নে নির্মিত হলেও তাদের নামাজের অনুমতি নেই। মানুষ ইসলাম পড়ে না। মহানবী (সা.)-এর যুগের প্রেক্ষাপট এবং কোরআন-সুন্নাহ থেকে স্পষ্ট উদ্ধৃতি না দিলে কারও যুক্তিতে কান দেওয়ার দরকার নেই।
মুসলিম নারীর করণীয়
আমি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ডে বসবাস করছি। আমার মত হলো, নারী-পুরুষ উভয়কেই মূলধারার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, আমাদের তা অর্জনের অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। তবে পাশাপাশি আরবি ভাষা ও ইসলাম শিক্ষা পড়াতে হবে। সেই লক্ষ্যপূরণেই আমি ক্যামব্রিজে কাজ করে যাচ্ছি। আমি মনে করি, ভারত উপমহাদেশেও নারী-পুরুষদের মূলধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করা উচিত। তবে সপ্তাহের একদিন ইসলাম ও আরবি শেখার জন্য বরাদ্দ রাখলে তারা ইসলাম ভালোভাবে বুঝতে পারবে। ধর্মীয় জ্ঞান আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করবে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েদের জন্য আরবি শেখা মোটেও কঠিন কিছু নয়। তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করাই আসল কথা। আমার ক্লাসে নারী শিক্ষার্থীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও তাঁরা এগিয়ে যান। তাই নারীদের পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য করবেন না। সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও তারা ইসলাম শিখতে পারে। এতে তাঁরা আরও বেশি ধার্মিক হবে।
অনেক পিএইচডিধারী নারী আমার ক্লাসে আসেন। মাথায় স্কার্ফ নেই। সহিহ বুখারি পড়েন। লোকজন বলে, ‘এই নারী এমন পবিত্র গ্রন্থ স্কার্ফ ছাড়া পড়ছেন!’ আমি তাঁদের বলি, ‘চিন্তার কিছু নেই। ওদের আসতে দিন। দেখবেন, তাঁরা বদলে যাবে। তাঁরা তাহাজ্জুদগুজার হয়ে যাবে। এখান থেকে গিয়ে পরিবারকে শেখাবে। তাঁদের জানার সুযোগ দিতে হবে। তা জানলে আমরা কীভাবে তাঁদের বাধ্য করব? পুরুষদের মতো নারীরাও জান্নাতে যেতে চায়। তাদের পড়াশোনার করার সুযোগ দিন।’
উপমহাদেশের মহিলা মাদ্রাসাগুলোর ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট নই। তা খুবই নিম্নমানের। তারা নারীদের স্রেফ পাঁচ-ছয় বছর পড়াশোনা করার সুযোগ দেয়। এই অল্প সময়ে তারা তেমন কিছু শিখতে পারে না। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক; সপ্তাহান্তে সময় বের করে ইসলাম শিখুক। কারণ, মাদ্রাসাপড়ুয়া নারীরা সাধারণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। তাই তাদের আত্মবিশ্বাস বিকশিত করার সুযোগ দিন। অনেক পুরুষ ধার্মিক স্ত্রী পেলে খুশিতে গদগদ হয়। তবে তারাই আবার চায় না—নারীরা শিখুক। তবে একবার শিখে যখন তা মানার চেষ্টা করে, তখন সেই পুরুষদের খুশির সীমা থাকে না। তাহলে আমার কথা হলো—তাদের শিখতে দেন না কেন?
ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভি

বিশ্বকোষ রচনার প্রেক্ষাপট
১৯৯৪ কিংবা ৯৫ সালের কথা। যুক্তরাজ্যের কয়েকটি সংবাদপত্রে মুসলিম নারী নিয়ে কিছু নেতিবাচক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে মুসলিম বিশ্বে নারীদের পশ্চাৎপদ ও শোচনীয় অবস্থার জন্য ইসলামকেই দোষারোপ করা হয়। সত্যি কথা হলো, বর্তমান মুসলিম সমাজে আসলেই নারীদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। তাদের কোনো অনুষ্ঠানে যেতে দেওয়া হয় না; গেলেও কোনো গয়না নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। জোর-জবরদস্তি ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার এমন মানসিকতা মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধারই নামান্তর। নারীরা মানুষ; তাদের মন আছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে নির্দেশনা দেন; ভালো-মন্দ ব্যাখ্যা করেন। এর পর যার ইচ্ছা ভালোটা গ্রহণ করবে, আর যার ইচ্ছা মন্দটা গ্রহণ করবে। এই সুযোগ সব মানুষকেই দিয়েছেন।
আল্লাহ পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তিনিই আমাদের স্রষ্টা। অথচ আমরা সব সময় নারীদের বাধ্য করার পথ খুঁজি। আলেমদের মুখেও নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বিদ্রূপাত্মক কথা শুনি; যা শুনে যে কেউ-ই রাগান্বিত হবেন। পুরুষদের নিয়ে অবমাননাকর কিছু বলা হলে তো তারা নিঃসন্দেহে রেগে যাবেন। মূলত আমরা নারীদের মানুষই মনে করি না। এমন মনোভাব ইসলাম সমর্থন না করলেও মুসলিম সমাজে দুঃখজনকভাবে প্রচলিত আছে।
যা হোক, প্রবন্ধগুলো পড়ে আমি খুবই আহত হই। কেউ খামাখা ইসলামকে দোষারোপ করুক, তা আমরা চাই না। তখন আমার মাথায় একটা চিন্তা এল। দীর্ঘদিনের হাদিস গবেষণার সূত্রে জ্ঞানচর্চায় বিখ্যাত অনেক মুসলিম নারী স্কলারের কথা আমার জানা ছিল। ভাবলাম, তাঁদের জীবনী এক মলাটে তুলে ধরলে একটা মোক্ষম জবাব হবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বইটি মুসলিম নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রেরণা হবে। তা ছাড়া আলেমদের আমাদের হারানো অতীত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চিন্তাও ছিল। এসব কারণেই আমি প্রকল্পটি হাতে নিই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। পুরো কাজটি একান্তই আমার আগ্রহের জায়গা থেকে করা। অক্সফোর্ডে আমি অন্য কাজ করতাম, পাশাপাশি এ কাজটিও স্বল্প পরিসরে শুরু করি। এর পর আরও তথ্য আমার কাছে আসতে থাকে। আমি সিরিয়া, মিসর ও অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করে পুরোনো পাণ্ডুলিপি থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করি। অবিশ্বাস্যভাবে অনেক বেশি তথ্য হাতে আসে। বইয়ের ভলিউম শুধুই বাড়ছিল।
মনে আছে, ৫ হাজার নারী স্কলারের তথ্য সংগ্রহ করার পর আমার এক খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ সহকর্মী এসে বলেন, ‘আপনি তো ৫ হাজারের তথ্য সংগ্রহ করলেন। আপনাকে এক বিখ্যাত প্রাচ্যবিদের কিছু কলাম দিচ্ছি।’ তিনি তা আমাকে সরবরাহ করেন। তাতে লেখক দাবি করেন, মুসলমানরা যদি পাঁচজন শিক্ষিত নারীর নাম পেশ করতে পারে, তবে তিনি স্বীকার করবেন যে, ইসলাম নারীর অধিকার দেয়। লেখাটি হাতে আসার পর আমার সংগ্রহ বাড়তে বাড়তে ৫ হাজার থেকে ৯ হাজার, তারপর ১০ হাজারে উন্নীত হয়। এর পর কাতারে আমাকে শাইখ ইউসুফ আল-কারজাবি কাজটি শেষ না হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তিনি পরামর্শ দেন, কাজে বিরতি দিয়ে যা হয়েছে, তা প্রকাশ করে দিতে। তাঁর অনুরোধে আমি কাজটি থামাই। বইটি বের হওয়ার পরও তাতে যুক্ত করার মতো আরও ২ হাজার নারীর তথ্য এখন আমার হাতে আছে।
এ বিষয়ে স্বতন্ত্র বিশ্বকোষ রচনার কাজ এটিই প্রথম। আশা করি, এর পর অনেকেই এ কাজে এগিয়ে আসবেন। আমি ফারসি জানলেও ফারসি ভাষাসহ মধ্য এশিয়ার অন্যান্য ভাষা, উজবেক কিংবা তুর্কি সোর্স থেকে আমি তথ্য নিইনি। ফলে এ ক্ষেত্রে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। একজনের জানা ভাষা ও সোর্স থেকে যদি এত তথ্য পাওয়া যায়, তবে ভবিষ্যতে বিষয়টি আরও সমৃদ্ধ হবে। তাই আমি অনেক খুশি।
৪৩ খণ্ডের এই বিশ্বকোষের ভূমিকা হিসেবে আরবি ও ইংরেজিতে একটি ভলিউম প্রকাশিত হয়। একবার আমি যুক্তরাষ্ট্রের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হই। সেখানে এক নারী শিক্ষার্থী তা নিয়ে আমার কাছে হাজির হন। তাঁর কপিটির প্রত্যেক পৃষ্ঠাতেই তিনি টীকা সংযোজন করেন। তিনি জানান, ‘সুদান, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইসলাম ত্যাগ করা অনেক নারীই এ বই পড়ে ইসলামে ফিরে আসেন।’
সুতরাং আমি মনে করি, এ গবেষণা মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে সাহায্য করছে। আমি সম্প্রতি ওমরাহ থেকে ফিরেছি। সৌদি আরবে দেখলাম, অনেক নারী-পুরুষই আমার এ কাজের জন্য আপ্লুত। হৃদয়ের গভীর থেকে বলি, নারীদের, বিশেষভাবে মুসলিম নারীদের, আরও বিশেষভাবে ভারত উপমহাদেশের মুসলিম নারীদের জন্য আমি কাজ করতে চাই। কারণ, আমার শেকড় ভারতেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের মুসলিম নারীদের অবস্থা অধিক শোচনীয়—আমি জানি।
ইসলামে নারীর অবদান
বিশ্বকোষটি রচনা করতে গিয়ে আমি দেখি, এ যুগের নারীদের তুলনায় আগের যুগের নারীদের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। তবুও তাঁরা জ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে পড়েননি। তাঁদেরও পারিবারিক জীবন ছিল। তাঁদের মধ্যেও ধনী-দরিদ্র ছিলেন। কারও বাচ্চা ছিল, পারিবারিক কলহ ছিল; কেউ আবার ডিভোর্সি ছিলেন। তাঁরা কোনো অভিযোগ না করে সবকিছু সামলে নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান। ইসলামের গণ্ডির মধ্যে থেকে সময়ের সদ্ব্যবহার করেন। সততার সঙ্গে ইসলামকে জানতে চান এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই জ্ঞান অর্জন করেন। তাই তো পুরুষদের বিরুদ্ধে হাদিস জালিয়াতির অভিযোগ থাকলেও নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ নেই।
ইসলামে নারীরা বিস্ময়কর অবদান রাখেন। ইসলামি জ্ঞানচর্চার এক চতুর্থাংশেই নারীর একচেটিয়া আধিপত্য। বাকি তিন ভাগে রয়েছে নারী-পুরুষের সমান অবদান। ইসলামি জ্ঞানের বিখ্যাত গ্রন্থগুলোতে নারীদের বর্ণিত হাদিসের ভিত্তিতেই অনেক বিধান প্রণীত হয়। নারী হওয়ার কারণে মুহাদ্দিসরা কখনো তাঁদের হাদিস বাদ দেননি; বরং সাদরে গ্রহণ করেন। কেবল নারীদের বর্ণিত হাদিসের ওপর ভিত্তি করেই অনেক বিধান প্রণীত হয়। তাই নারী আমাদের ধর্মেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের সূচনাকালে নারীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে মাজাহসহ হাদিসের অসংখ্য গ্রন্থে তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়। এসব গ্রন্থের রচয়িতারা নারীদের কাছে শুধু জ্ঞান আহরণই করেননি; বরং তাঁদের সনদ বর্ণনা সর্বাধিক বিশুদ্ধ বলেও প্রমাণিত।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পবিত্র কোরআনের পর বিশুদ্ধতম গ্রন্থ সহিহ বুখারির বিশুদ্ধতম কপিটি এক নারীর সম্পাদিত—কারিমা বিনতে আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ আল-মারওয়াজি (মৃত ৪৬৩ বা ৪৬৪ হি.)। অথবা উম্মুল খাইর ফাতিমা বিনতে ইবরাহিম (মৃত.৭১১ হি.)-এর কথাই ধরুন। তিনি সহিহ বুখারির শিক্ষক ছিলেন। বুখারির সর্বোৎকৃষ্ট সনদ তাঁর ছিল। অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি তাঁর কাছে শিখতেন। সিরিয়া থেকে হজে এসে তিনি মদিনায় জিয়ারতে আসেন এবং মসজিদে নববীতে হাদিস পাঠদান করেন। এমন আরও দু-তিনজন নারী স্কলার আছেন। সেকালের মুসলিম সমাজে যদি নারীর সম্মান না-ই থাকত, তাহলে কীভাবে তারা একজন নারীকে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র রওজার পাদদেশে বসার অনুমতি দিয়েছিলেন? একইভাবে তিন নারী স্কলার পবিত্র কাবাঘরের পাদদেশে হাতিম-এ পাঠদান করেছিলেন।
তাই আমি বলি, নীতিমান হলে অবশ্যই আপনাকে নারীর সম্মান দিতে হবে। ইসলামে তাদের অবদান স্বীকার করতে হবে; কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। এসব নারী স্কলারের জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাদানের কারণেই অনেক হাদিসগ্রন্থ আজ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। তাঁদের কারণেই অনেক হাদিসগ্রন্থ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাবরানি প্রণীত বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ মুজাম আল-কাবির তাঁর ছাত্রী ফাতিমা আল-জুজদানিয়া (মৃত ৫২৪ হি.)-এর সূত্রে বর্ণিত। এই ফাতিমার ছাত্ররাই স্পেন থেকে এসে মিসরে হাদিসশাস্ত্র পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন।
আরেক বিখ্যাত নারী স্কলারের নাম ফাতিমা আল-সামারকান্দি। তিনি তাঁর বাবা মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল-সামারকান্দি রচিত তুহফাত আল-ফুকাহা পুরো মুখস্থ করেন। আল-কাসানি নামে তাঁর এক ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকের কন্যা ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা নাকচ করে দেন। কারণ তিনি জানতেন, তাঁর মেয়ে তাঁর ছাত্রের তুলনায় বেশি জ্ঞানী। তবে পরে তাঁর গ্রন্থের একটি ব্যাখ্যা লিখে দেওয়ার শর্তে রাজি হন। আল-কাসানি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং বাদায়ে আল-সানায়ে নামের অনবদ্য এক ব্যাখ্যা-গ্রন্থ লিখে দেন, যা এখন পর্যন্ত হানাফি ফিকহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। চিন্তা করে দেখুন, হানাফি মাজহাবের একটি সেরা গ্রন্থ একজন নারীকে পেতে লেখা হয়েছিল!

ইসলামে নারীর অধিকার
মহানবী (সা.) কখনোই নারী-পুরুষের শিক্ষাগ্রহণ, শিক্ষাদান ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্য করেননি। নারীদের জন্য যুদ্ধ বাধ্যতামূলক না করলেও যেতে চাইলে তাঁদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। তেমনি জুমার নামাজ তাদের জন্য আবশ্যক করা না হলেও অংশ নিলে অবশ্যই পুরস্কৃত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘নারীদের মসজিদে আসতে বাধা দিয়ো না।’
আপনি দেখবেন, নারী সাহাবিরা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন, তলোয়ার হাতে লড়াই করছেন এবং মহানবী (সা.) নিজেই তাঁদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে ৩৫ জন নারী অংশ নেন। আপনিই বলুন, নারীরা যুদ্ধ করতে নামলে কি নারী হওয়ার কারণে শত্রুপক্ষ তাদের ছাড় দেবে? কখনোই না, আঘাত করার সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করবে না। তো মুসলিম নারী যদি রণাঙ্গনে শত্রুর বিরুদ্ধ লড়াই করার অনুমতি পায়, তাহলে আর কোন জায়গাটি তাদের জন্য অনুপযুক্ত থাকে? আয়েশা (রা.)-কেই দেখুন! পুরো একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভাষণ দিয়েছেন এবং হাজারো মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো বিতরণ করেছেন। হজ-ওমরাহর তাওয়াফেই নারী-পুরুষের কত ভিড় দেখুন! এমন ভিড় পৃথিবীর কোথাও দেখবেন না। যে ধর্মে তাওয়াফের মতো ভিড়ের স্থানে যাওয়ার অনুমতি আছে, সেখানে আর কোথায় যেতে বাধা থাকতে পারে?
নারীদের এগিয়ে যেতে হবে। জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হতে হবে। ভারতীয়রা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে। আমি বলি, আসল ক্ষমতায়ন হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান। মানুষকে শেখানো এবং শিক্ষিত জাতি তৈরি করাই আসল উন্নয়ন। আমি নারীদের বলি, আপনি বিদ্যার্জন অব্যাহত রাখলে পুরুষও আপনার কাছে শিখতে আসবে। সুতরাং যুক্তিতর্ক করার দরকার নেই।
আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, নারীরা ইসলামের বেশি খেদমত করতে পারে। কারণ তাদের প্রতারণার মনোভাব কম; আন্তরিকতা বেশি। ক্ষমতালিপ্সু নয় তারা। মুম্বাইয়ে আমার এক ছাত্রী তাফসির পড়ান। কিছু আলেম তাঁকে বলেন যে, ‘নারীরা পুরুষদের পড়াতে পারে না।’ আমি তাঁকে বলি, ‘কিছুই বলার দরকার নেই। নারীরা হাদিস শেখাতে না পারলে আমাদের কী হবে? এত মানুষ কীভাবে বিদ্যার্জন করবে। আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষকই তো আমাদের মাহরাম নন। সুতরাং কাজ করে যান। সত্য একদিন ছড়িয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ। আমি নারীদের পড়াই বলে অনেকেই এক সময় আমার সমালোচনা করতেন। এখন দেখি তাঁরাও নারীদের পড়ান।’
মুসলিম নারীদের পিছিয়ে পড়ার কারণ
মুসলিম বিশ্ব সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। শুধু নারীর ক্ষেত্রেই নয়, আজকাল পুরুষদেরও চরম অধঃপতন ঘটেছে। মুসলিমরা শিক্ষাকে মাদ্রাসার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। অতীতে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও বর্তমানে অধিকাংশ মাদ্রাসা পুরুষদের জন্য বরাদ্দ। বিশেষ করে উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে এবং মুসলিম কারিকুলামে গ্রিক দর্শনে বেশ জোর দেওয়া হয়। কারণ, গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে প্রায় সবাই নারী অবমাননা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। এ কারণেই কোনো নারী গ্রিক দার্শনিক আপনি খুঁজে পাবেন না। তাঁরা মনে করতেন, নারী বুদ্ধিমত্তায় নীচ। অ্যারিস্টটলকে আমি সম্মান করি, তবে তিনিই বলেন যে, ‘বুদ্ধিমত্তায় নারীদের নীচ হওয়ার একটি প্রমাণ হলো পুরুষের তুলনায় তাদের দাঁত কম।’ এত বড় দার্শনিক এমন বক্তব্য দিচ্ছেন, ভাবতেই অবাক লাগে!
মুসলিম বিশ্বের গ্রিক দর্শন প্রভাবিত কোনো মানুষই নারীদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয় না। এ কারণেই আমার বিশ্বকোষে সব ঘরানার নারী স্কলার থাকলেও দার্শনিক পরিবার থেকে আসা কোনো নারী স্কলার নেই। এমনকি ইমাম গাজ্জালির মতো বিখ্যাত দার্শনিক আলিমও রাজা-বাদশাহদের উপদেশ দেন যে—নারীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন না; করলেও তাদের মতের বিপরীত কাজ করুন। তিনি আরও বলেন যে—নারীর কারণেই পৃথিবীর সব মন্দ কাজ সংঘটিত হয়। মাদ্রাসাগুলোতে এখনো ইমাম গাজ্জালির বিরাট প্রভাব আছে। আমি নিজেও মাদ্রাসার ছাত্র। আমি সারা জীবন মাদ্রাসায় পড়েছি; তাঁদের শ্রদ্ধা করি এবং তাঁদের নিয়ে লিখি। তারপরও আমি বলব, এমন মানসিকতা তাঁদের মধ্যে আছেই; সেখান থেকে তাঁরা বেরোতে পারছে না। মাদ্রাসাগুলোর পরিবর্তনে সময় লাগবে। আমি তাঁদের সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে চাই না; আমি মানুষকে শেখাতে চাই। পরিবর্তন ধীরে ধীরেই হয়। ইনশা আল্লাহ একদিন পরিবর্তন আসবেই।
ঘরবন্দী করে রাখার যুক্তির অসারতা
অবশ্য নারীবাদকে তাদের জন্য সহায়ক মনে করি না আমি। এটি আরেক চরমপন্থা। নারীবাদের সমালোচনা করে আমি আরেকটি বই লিখেছি; শিগগিরই তা প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ। তবে নারীবাদের একটি ভালো দিক আছে—এটি নারীর জন্য সুবিচারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই পয়েন্টে আমরা একমত। নারীদের প্রতি সুবিচার করা উচিত। তবে নারীবাদের সমাধান ভালো নয়; সেটি তাদের জন্য ক্ষতিকর।
আয়েশা (রা.)-এর যুগে একটি হাদিস প্রচলিত ছিল—নামাজরত কোনো পুরুষের সামনে দিয়ে কোনো নারী হেঁটে গেলে নামাজ নষ্ট হবে। কুফার বিখ্যাত আলিম ও ফকিহ আসওয়াত ইবনে ইয়াজিদ আয়েশাকে হাদিসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি রেগে যান এবং বলেন, ‘হে কুফাবাসী, আমরা, নারীদের তোমরা গাধা ও বানরের সমান বানিয়ে ছেড়েছ! মহানবী (সা.) নামাজরত থাকতেন, আমি তাঁর সামনে থাকতাম, কই কিছুই তো হয়নি!’ এভাবে তিনি এই প্রচলিত ভুল শুধরে দেন। এ ঘটনা থেকে বুঝতে পারি, নারীরা মাঠে না থাকলে পুরুষেরা তাদের সম্পর্কে যা ইচ্ছা বলবে। প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না।
অনেকেই নারীদের নিকাব পরা বাধ্যতামূলক বলে দাবি করেন। আমার মনে হয়, তাঁদের এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ইসলামের মূল শিক্ষার চেয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবই বেশি। তাঁরা যুক্তি দেন যে, আপনার হিরে-জহরত থাকলে তা বাড়ির অন্দরে লুকিয়ে রাখেন। নারীও হিরে-জহরতের মতোই। আমরাও এক সময় এই যুক্তি বিশ্বাস করতাম। তবে এখানে একটি মৌলিক ভুল আছে—হিরে-জহরতের মন নেই, জীবন নেই; তবে নারীর চিন্তাশীল মন-মনন আছে। তারা ভালো-মন্দ বোঝে। কোরআন আদম (আ.)-কে এ আদেশ দেয়নি যে, স্ত্রীকে ভালো-মন্দ শেখান। বরং উভয়কে সম্বোধন করেই সমানভাবে আদেশ করা হয়েছে। নারীরা ভালো-মন্দ বোঝে, তাদের সঙ্গে পাথরের মতো আচরণ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
নারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় মাথায় রাখতে হবে যে, তারাও সচেতন মানবসন্তান। আল্লাহ তাআলা এভাবেই তাদের সম্বোধন করেন। আমার যুক্তি হলো, নারীরা মূল্যবান হিরে-জহরত হওয়ার কারণে যদি তাদের অন্তপুরে লুকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে পুরুষেরা তো নারীর চেয়েও মূল্যবান, তাদের তো বাক্সবন্দী করে রাখা দরকার! এই যুক্তি কি পুরুষসমাজ মেনে নেবে? মূলত কোরআন-হাদিসে এমন যুক্তির কোনো ভিত্তি নেই। এটি মানুষের মনগড়া ব্যাখ্যা। কোরআন নারীদের সঙ্গে কেমন মনোভাব পোষণ করে দেখুন। সাহাবিদের কর্মপন্থা দেখুন। ওমর (রা.) মদিনার নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই গনিমতের মাল বরাদ্দ করতেন। তিনি বাড়ি বাড়ি খবর পাঠাতেন—পুরুষেরা তাদের ভাগ নিয়ে যাক, নারীরা তাদের ভাগ নিয়ে যাক; কেউ কারও প্রতিনিধি হিসেবে আসার দরকার নেই। তিনি নিজ হাতেই তা নারীদের মধ্যে বণ্টন করতেন। কারও ভাই কিংবা স্বামী প্রতিনিধি হিসেবে এলে সেই নারীকে তিনি উপদেশ দিতেন—অন্য কাউকে তোমার টাকা নিতে পাঠানো সঠিক নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী একবার তাঁর কাছে একটি বিষয় জানতে চান। বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। তিনি বলেন, ‘তুমি মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো।’ তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘না, তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো।’ তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং তাঁকেই যেতে বলেন। তখন তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে বিষয়টি সরাসরি জিজ্ঞেস করেন। এ যুগের লোকজন বলবে, ‘না, না! মুফতির কাছে যেয়ো না; তোমার বদলে আমিই যাচ্ছি।’
নারীরা রাসুলের কাছে গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করতেন; কারণ ইসলাম সকল মানুষের ধর্ম। আমাদের সমাজে যা প্রচলিত আছে, তা অস্বাভাবিক। ইসলামের স্বাভাবিক নির্দেশনা হলো, আপনি তাদের চিন্তাশীল মানুষ ভাবুন, তাদের মন-মননকে সম্মান করুন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের আল্লাহর ইবাদত করার সুযোগ করে দিন। এতে তারা পুরুষের চেয়ে বেশি ধার্মিক হবে। আল্লাহভীতি কখনোই জোর-জবরদস্তি করে আনা যায় না; মন থেকেই আসতে হয়। পাথর কিংবা দেয়াল তো ধার্মিক নয়। তারা তো মিথ্যা বলে না। ভালো-মন্দ পরখ করার সুযোগ দিলেই তো ধার্মিক হওয়ার সুযোগ আসে। নারীরা নিজেদের পথ বেছে নিক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি কি তাকে (ভালো-মন্দ) দুটি পথ দেখাইনি?’ (সুরা বালাদ, আয়াত: ১০) তাই যুক্তি যাদের পক্ষ থেকেই আসুক, পরখ করে দেখুন। ইসলাম মজবুত যুক্তিই গ্রহণ করে; দুর্বল-খোঁড়া যুক্তি নয়।
ফিকহের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি
ইসলাম কোরআন-সুন্নাহর ওপরই প্রতিষ্ঠিত। ফিকহ কোরআন-সুন্নাহর একটি অংশ মাত্র। ফিকহের অধিকাংশ মাসায়েলই ইজতিহাদের ভিত্তিতে। এটি প্রথা ও সময়ের আলোকেই প্রণীত হয়। ফিকহি মতামত যুগের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়। মতামতগুলো মানুষেরই; একটি আরেকটির চেয়ে ভিন্নতর। একাধিক অর্থের সুযোগও থাকে অনেক ক্ষেত্রে। আমরা কোরআন-সুন্নাহর পরিবর্তন করতে বলছি না। তবে যুগের আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। আর ব্যাখ্যা দিতে হলে আমাদের মহানবী (সা.)-এর যুগে ফিরতে হবে। মদিনার সমাজবাস্তবতায় তিনি নারীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন, তা দেখতে হবে। নারীদের মসজিদে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন—আমাদেরও তা-ই করতে হবে। নারীদের কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে উৎসাহ দিয়েছেন—আমাদেরও তা-ই করতে হবে। ওমর (রা.) শিফা বিনতে আবদুল্লাহ নামের এক নারীকে বাজার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এত পুরুষ সাহাবি থাকার পরও তিনি একজন নারীকেই দায়িত্ব দেন। অন্য এক নারী, সামারা বিনতে নাহিককে তিনি সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ বিষয়ক দায়িত্ব দেন। হাতে লাঠি নিয়ে তিনি মানুষের অপরাধের শাস্তি দিতেন। নারীরা তখন কত সক্রিয় ছিল ভাবুন!
এই বিশ্বকোষটি লেখার পর আমি ইংল্যান্ডের লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে কয়েকজন আলেম আমাকে বলেন, ‘আপনার বইটি ইসলামকে পরিবর্তন করতে যাচ্ছে।’ আমি বলি, ‘না, এটি পরিবর্তনকেই সরাতে যাচ্ছে। এটি মানুষকে মহানবী (সা.)-এর সমাজে নিয়ে যাচ্ছে।’ আমি আরও বলি, ‘আপনারা আলেম মানুষ। আমার তথ্য-উপাত্তে কোনো ধরনের ভুল থাকলে শুধরে দিন। আমি তা বই থেকে মুছে দেব।’
একবার আমি ইংল্যান্ডের এক মসজিদে বক্তৃতা দিই। তাতে নারীদের মসজিদে আসতে উৎসাহ দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করি। ইমাম সাহেব এসে বলেন, ‘যা ইচ্ছা বলেন, তবে এমন কথা বলবেন না।’ আমি বলি, ‘কেন? আমার যুক্তিতে কোনো ভুল আছে?’ তিনি বলেন, ‘নাই। যুক্তি যথাযথ। তবে তারা মসজিদে আসুক, তা আমরা চাই না।’
নারীদের মসজিদে আসতে নিষেধ করার পেছনে চলমান সংস্কৃতিই তাদের আসল কথা; বাস্তবে তাদের কাছে নিরেট কোনো যুক্তি নেই। কিছু মানুষের কাছে ইসলামের চেয়ে মুসলিম সংস্কৃতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম সংস্কৃতি সর্বস্ব ধর্ম নয়, বরং এটি আল্লাহ ও পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা। নারী-পুরুষকে এক সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসে নারী-পুরুষ সমানভাবে অংশ নেওয়া সুযোগ রেখেছি।
নারীর অধিকার বনাম বঞ্চনা
বিয়ের পর নারীর স্বাধীন ও আলাদা ঘর নিশ্চিত করা পুরুষের দায়িত্ব, যা দুই পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের ঘর থেকে পৃথক হবে—এ বিষয়ে কোনো আলিমের দ্বিমত নেই। ঘরের পরিবেশও হতে হবে নিরিবিলি, হিজাব করা কিংবা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে চিন্তা থাকা যাবে না। স্বামী তার স্ত্রীকে বাবা-মা কিংবা ভাইয়ের ঘরে তুলতে পারে না। সকল মাজহাবেই এমনটি বলা হয়েছে। লোকে বলে, আমার বাবা-মা আছে, তাদের খেদমত করা লাগবে। আমি তাদের বলি, নারীদেরও বাবা-মা আছে। তারা স্বামীর বাবা-মায়ের সেবা করতে বাধ্য নয়। বাবা-মায়ের সেবার দায়িত্ব আপনারই। আপনি না পারলে লোক নিয়োগ দেন; স্ত্রীকে বাধ্য করতে পারেন না। তবে সে নিজ থেকে করলে তা একান্তই তার অনুগ্রহ; সে জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ হোন। আপনার স্ত্রীর খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। তার ভরণপোষণ, চিকিৎসা এমনকি শিক্ষার জন্যও ব্যয় করতে হবে। এটি অনুগ্রহ নয়; দান-সদকাও নয়। তার লাখ টাকা থাকলেও আপনাকে তা দিতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যরা অভাবগ্রস্ত হলেই তাদের দিতে হয়, তবে স্ত্রী ধনী হলেও দিতে হয়। এটি স্বামীর কর্তব্য।
কেউ কেউ বলে, ‘এত টাকা দিয়ে তারা কী করবে?’ আমি বলি, ‘তারা চ্যারিটি করবে; মসজিদ তৈরি করবে—অতীতের মতো। আগের যুগের নারীরা এমন কাজ অনেক করেছেন। তবে পরিহাসের বিষয় হলো, ফাতিমা আল-ফিহরিয়া নামের এক নারী মরক্কোর ফেজ শহরের কারাউয়্যিন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু সেখানে দীর্ঘদিন নারীদের পড়াশোনার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমি সেই কলেজে একবার লেকচার দিতে যাই। শ্রোতাদের সবাই আলেম। আমি বলি, ‘এই কলেজ একজন নারীর তৈরি। হাজার বছর ধরে আপনারা তাদেরই পড়াশোনার সুযোগ দেননি।’ অবশ্য এখন তারা নারীদের পড়ার অনুমতি দিচ্ছেন। তেমনি ভারতেও এমন অনেক মসজিদ আছে, যা নারীদের অর্থায়নে নির্মিত হলেও তাদের নামাজের অনুমতি নেই। মানুষ ইসলাম পড়ে না। মহানবী (সা.)-এর যুগের প্রেক্ষাপট এবং কোরআন-সুন্নাহ থেকে স্পষ্ট উদ্ধৃতি না দিলে কারও যুক্তিতে কান দেওয়ার দরকার নেই।
মুসলিম নারীর করণীয়
আমি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ডে বসবাস করছি। আমার মত হলো, নারী-পুরুষ উভয়কেই মূলধারার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, আমাদের তা অর্জনের অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। তবে পাশাপাশি আরবি ভাষা ও ইসলাম শিক্ষা পড়াতে হবে। সেই লক্ষ্যপূরণেই আমি ক্যামব্রিজে কাজ করে যাচ্ছি। আমি মনে করি, ভারত উপমহাদেশেও নারী-পুরুষদের মূলধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করা উচিত। তবে সপ্তাহের একদিন ইসলাম ও আরবি শেখার জন্য বরাদ্দ রাখলে তারা ইসলাম ভালোভাবে বুঝতে পারবে। ধর্মীয় জ্ঞান আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করবে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েদের জন্য আরবি শেখা মোটেও কঠিন কিছু নয়। তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করাই আসল কথা। আমার ক্লাসে নারী শিক্ষার্থীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও তাঁরা এগিয়ে যান। তাই নারীদের পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য করবেন না। সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও তারা ইসলাম শিখতে পারে। এতে তাঁরা আরও বেশি ধার্মিক হবে।
অনেক পিএইচডিধারী নারী আমার ক্লাসে আসেন। মাথায় স্কার্ফ নেই। সহিহ বুখারি পড়েন। লোকজন বলে, ‘এই নারী এমন পবিত্র গ্রন্থ স্কার্ফ ছাড়া পড়ছেন!’ আমি তাঁদের বলি, ‘চিন্তার কিছু নেই। ওদের আসতে দিন। দেখবেন, তাঁরা বদলে যাবে। তাঁরা তাহাজ্জুদগুজার হয়ে যাবে। এখান থেকে গিয়ে পরিবারকে শেখাবে। তাঁদের জানার সুযোগ দিতে হবে। তা জানলে আমরা কীভাবে তাঁদের বাধ্য করব? পুরুষদের মতো নারীরাও জান্নাতে যেতে চায়। তাদের পড়াশোনার করার সুযোগ দিন।’
উপমহাদেশের মহিলা মাদ্রাসাগুলোর ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট নই। তা খুবই নিম্নমানের। তারা নারীদের স্রেফ পাঁচ-ছয় বছর পড়াশোনা করার সুযোগ দেয়। এই অল্প সময়ে তারা তেমন কিছু শিখতে পারে না। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক; সপ্তাহান্তে সময় বের করে ইসলাম শিখুক। কারণ, মাদ্রাসাপড়ুয়া নারীরা সাধারণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। তাই তাদের আত্মবিশ্বাস বিকশিত করার সুযোগ দিন। অনেক পুরুষ ধার্মিক স্ত্রী পেলে খুশিতে গদগদ হয়। তবে তারাই আবার চায় না—নারীরা শিখুক। তবে একবার শিখে যখন তা মানার চেষ্টা করে, তখন সেই পুরুষদের খুশির সীমা থাকে না। তাহলে আমার কথা হলো—তাদের শিখতে দেন না কেন?

বিশ্বকোষ রচনার প্রেক্ষাপট
১৯৯৪ কিংবা ৯৫ সালের কথা। যুক্তরাজ্যের কয়েকটি সংবাদপত্রে মুসলিম নারী নিয়ে কিছু নেতিবাচক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে মুসলিম বিশ্বে নারীদের পশ্চাৎপদ ও শোচনীয় অবস্থার জন্য ইসলামকেই দোষারোপ করা হয়। সত্যি কথা হলো, বর্তমান মুসলিম সমাজে আসলেই নারীদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। তাদের কোনো অনুষ্ঠানে যেতে দেওয়া হয় না; গেলেও কোনো গয়না নিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। জোর-জবরদস্তি ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার এমন মানসিকতা মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধারই নামান্তর। নারীরা মানুষ; তাদের মন আছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে নির্দেশনা দেন; ভালো-মন্দ ব্যাখ্যা করেন। এর পর যার ইচ্ছা ভালোটা গ্রহণ করবে, আর যার ইচ্ছা মন্দটা গ্রহণ করবে। এই সুযোগ সব মানুষকেই দিয়েছেন।
আল্লাহ পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তিনিই আমাদের স্রষ্টা। অথচ আমরা সব সময় নারীদের বাধ্য করার পথ খুঁজি। আলেমদের মুখেও নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বিদ্রূপাত্মক কথা শুনি; যা শুনে যে কেউ-ই রাগান্বিত হবেন। পুরুষদের নিয়ে অবমাননাকর কিছু বলা হলে তো তারা নিঃসন্দেহে রেগে যাবেন। মূলত আমরা নারীদের মানুষই মনে করি না। এমন মনোভাব ইসলাম সমর্থন না করলেও মুসলিম সমাজে দুঃখজনকভাবে প্রচলিত আছে।
যা হোক, প্রবন্ধগুলো পড়ে আমি খুবই আহত হই। কেউ খামাখা ইসলামকে দোষারোপ করুক, তা আমরা চাই না। তখন আমার মাথায় একটা চিন্তা এল। দীর্ঘদিনের হাদিস গবেষণার সূত্রে জ্ঞানচর্চায় বিখ্যাত অনেক মুসলিম নারী স্কলারের কথা আমার জানা ছিল। ভাবলাম, তাঁদের জীবনী এক মলাটে তুলে ধরলে একটা মোক্ষম জবাব হবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বইটি মুসলিম নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রেরণা হবে। তা ছাড়া আলেমদের আমাদের হারানো অতীত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চিন্তাও ছিল। এসব কারণেই আমি প্রকল্পটি হাতে নিই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। পুরো কাজটি একান্তই আমার আগ্রহের জায়গা থেকে করা। অক্সফোর্ডে আমি অন্য কাজ করতাম, পাশাপাশি এ কাজটিও স্বল্প পরিসরে শুরু করি। এর পর আরও তথ্য আমার কাছে আসতে থাকে। আমি সিরিয়া, মিসর ও অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করে পুরোনো পাণ্ডুলিপি থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করি। অবিশ্বাস্যভাবে অনেক বেশি তথ্য হাতে আসে। বইয়ের ভলিউম শুধুই বাড়ছিল।
মনে আছে, ৫ হাজার নারী স্কলারের তথ্য সংগ্রহ করার পর আমার এক খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ সহকর্মী এসে বলেন, ‘আপনি তো ৫ হাজারের তথ্য সংগ্রহ করলেন। আপনাকে এক বিখ্যাত প্রাচ্যবিদের কিছু কলাম দিচ্ছি।’ তিনি তা আমাকে সরবরাহ করেন। তাতে লেখক দাবি করেন, মুসলমানরা যদি পাঁচজন শিক্ষিত নারীর নাম পেশ করতে পারে, তবে তিনি স্বীকার করবেন যে, ইসলাম নারীর অধিকার দেয়। লেখাটি হাতে আসার পর আমার সংগ্রহ বাড়তে বাড়তে ৫ হাজার থেকে ৯ হাজার, তারপর ১০ হাজারে উন্নীত হয়। এর পর কাতারে আমাকে শাইখ ইউসুফ আল-কারজাবি কাজটি শেষ না হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তিনি পরামর্শ দেন, কাজে বিরতি দিয়ে যা হয়েছে, তা প্রকাশ করে দিতে। তাঁর অনুরোধে আমি কাজটি থামাই। বইটি বের হওয়ার পরও তাতে যুক্ত করার মতো আরও ২ হাজার নারীর তথ্য এখন আমার হাতে আছে।
এ বিষয়ে স্বতন্ত্র বিশ্বকোষ রচনার কাজ এটিই প্রথম। আশা করি, এর পর অনেকেই এ কাজে এগিয়ে আসবেন। আমি ফারসি জানলেও ফারসি ভাষাসহ মধ্য এশিয়ার অন্যান্য ভাষা, উজবেক কিংবা তুর্কি সোর্স থেকে আমি তথ্য নিইনি। ফলে এ ক্ষেত্রে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। একজনের জানা ভাষা ও সোর্স থেকে যদি এত তথ্য পাওয়া যায়, তবে ভবিষ্যতে বিষয়টি আরও সমৃদ্ধ হবে। তাই আমি অনেক খুশি।
৪৩ খণ্ডের এই বিশ্বকোষের ভূমিকা হিসেবে আরবি ও ইংরেজিতে একটি ভলিউম প্রকাশিত হয়। একবার আমি যুক্তরাষ্ট্রের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হই। সেখানে এক নারী শিক্ষার্থী তা নিয়ে আমার কাছে হাজির হন। তাঁর কপিটির প্রত্যেক পৃষ্ঠাতেই তিনি টীকা সংযোজন করেন। তিনি জানান, ‘সুদান, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইসলাম ত্যাগ করা অনেক নারীই এ বই পড়ে ইসলামে ফিরে আসেন।’
সুতরাং আমি মনে করি, এ গবেষণা মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে সাহায্য করছে। আমি সম্প্রতি ওমরাহ থেকে ফিরেছি। সৌদি আরবে দেখলাম, অনেক নারী-পুরুষই আমার এ কাজের জন্য আপ্লুত। হৃদয়ের গভীর থেকে বলি, নারীদের, বিশেষভাবে মুসলিম নারীদের, আরও বিশেষভাবে ভারত উপমহাদেশের মুসলিম নারীদের জন্য আমি কাজ করতে চাই। কারণ, আমার শেকড় ভারতেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের মুসলিম নারীদের অবস্থা অধিক শোচনীয়—আমি জানি।
ইসলামে নারীর অবদান
বিশ্বকোষটি রচনা করতে গিয়ে আমি দেখি, এ যুগের নারীদের তুলনায় আগের যুগের নারীদের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। তবুও তাঁরা জ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে পড়েননি। তাঁদেরও পারিবারিক জীবন ছিল। তাঁদের মধ্যেও ধনী-দরিদ্র ছিলেন। কারও বাচ্চা ছিল, পারিবারিক কলহ ছিল; কেউ আবার ডিভোর্সি ছিলেন। তাঁরা কোনো অভিযোগ না করে সবকিছু সামলে নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান। ইসলামের গণ্ডির মধ্যে থেকে সময়ের সদ্ব্যবহার করেন। সততার সঙ্গে ইসলামকে জানতে চান এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই জ্ঞান অর্জন করেন। তাই তো পুরুষদের বিরুদ্ধে হাদিস জালিয়াতির অভিযোগ থাকলেও নারী হাদিস বর্ণনাকারীদের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ নেই।
ইসলামে নারীরা বিস্ময়কর অবদান রাখেন। ইসলামি জ্ঞানচর্চার এক চতুর্থাংশেই নারীর একচেটিয়া আধিপত্য। বাকি তিন ভাগে রয়েছে নারী-পুরুষের সমান অবদান। ইসলামি জ্ঞানের বিখ্যাত গ্রন্থগুলোতে নারীদের বর্ণিত হাদিসের ভিত্তিতেই অনেক বিধান প্রণীত হয়। নারী হওয়ার কারণে মুহাদ্দিসরা কখনো তাঁদের হাদিস বাদ দেননি; বরং সাদরে গ্রহণ করেন। কেবল নারীদের বর্ণিত হাদিসের ওপর ভিত্তি করেই অনেক বিধান প্রণীত হয়। তাই নারী আমাদের ধর্মেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের সূচনাকালে নারীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে মাজাহসহ হাদিসের অসংখ্য গ্রন্থে তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়। এসব গ্রন্থের রচয়িতারা নারীদের কাছে শুধু জ্ঞান আহরণই করেননি; বরং তাঁদের সনদ বর্ণনা সর্বাধিক বিশুদ্ধ বলেও প্রমাণিত।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পবিত্র কোরআনের পর বিশুদ্ধতম গ্রন্থ সহিহ বুখারির বিশুদ্ধতম কপিটি এক নারীর সম্পাদিত—কারিমা বিনতে আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ আল-মারওয়াজি (মৃত ৪৬৩ বা ৪৬৪ হি.)। অথবা উম্মুল খাইর ফাতিমা বিনতে ইবরাহিম (মৃত.৭১১ হি.)-এর কথাই ধরুন। তিনি সহিহ বুখারির শিক্ষক ছিলেন। বুখারির সর্বোৎকৃষ্ট সনদ তাঁর ছিল। অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি তাঁর কাছে শিখতেন। সিরিয়া থেকে হজে এসে তিনি মদিনায় জিয়ারতে আসেন এবং মসজিদে নববীতে হাদিস পাঠদান করেন। এমন আরও দু-তিনজন নারী স্কলার আছেন। সেকালের মুসলিম সমাজে যদি নারীর সম্মান না-ই থাকত, তাহলে কীভাবে তারা একজন নারীকে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র রওজার পাদদেশে বসার অনুমতি দিয়েছিলেন? একইভাবে তিন নারী স্কলার পবিত্র কাবাঘরের পাদদেশে হাতিম-এ পাঠদান করেছিলেন।
তাই আমি বলি, নীতিমান হলে অবশ্যই আপনাকে নারীর সম্মান দিতে হবে। ইসলামে তাদের অবদান স্বীকার করতে হবে; কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। এসব নারী স্কলারের জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাদানের কারণেই অনেক হাদিসগ্রন্থ আজ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। তাঁদের কারণেই অনেক হাদিসগ্রন্থ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তাবরানি প্রণীত বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ মুজাম আল-কাবির তাঁর ছাত্রী ফাতিমা আল-জুজদানিয়া (মৃত ৫২৪ হি.)-এর সূত্রে বর্ণিত। এই ফাতিমার ছাত্ররাই স্পেন থেকে এসে মিসরে হাদিসশাস্ত্র পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন।
আরেক বিখ্যাত নারী স্কলারের নাম ফাতিমা আল-সামারকান্দি। তিনি তাঁর বাবা মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আল-সামারকান্দি রচিত তুহফাত আল-ফুকাহা পুরো মুখস্থ করেন। আল-কাসানি নামে তাঁর এক ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকের কন্যা ফাতিমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি তা নাকচ করে দেন। কারণ তিনি জানতেন, তাঁর মেয়ে তাঁর ছাত্রের তুলনায় বেশি জ্ঞানী। তবে পরে তাঁর গ্রন্থের একটি ব্যাখ্যা লিখে দেওয়ার শর্তে রাজি হন। আল-কাসানি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং বাদায়ে আল-সানায়ে নামের অনবদ্য এক ব্যাখ্যা-গ্রন্থ লিখে দেন, যা এখন পর্যন্ত হানাফি ফিকহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। চিন্তা করে দেখুন, হানাফি মাজহাবের একটি সেরা গ্রন্থ একজন নারীকে পেতে লেখা হয়েছিল!

ইসলামে নারীর অধিকার
মহানবী (সা.) কখনোই নারী-পুরুষের শিক্ষাগ্রহণ, শিক্ষাদান ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্য করেননি। নারীদের জন্য যুদ্ধ বাধ্যতামূলক না করলেও যেতে চাইলে তাঁদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। তেমনি জুমার নামাজ তাদের জন্য আবশ্যক করা না হলেও অংশ নিলে অবশ্যই পুরস্কৃত করা হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘নারীদের মসজিদে আসতে বাধা দিয়ো না।’
আপনি দেখবেন, নারী সাহাবিরা যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন, তলোয়ার হাতে লড়াই করছেন এবং মহানবী (সা.) নিজেই তাঁদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধে ৩৫ জন নারী অংশ নেন। আপনিই বলুন, নারীরা যুদ্ধ করতে নামলে কি নারী হওয়ার কারণে শত্রুপক্ষ তাদের ছাড় দেবে? কখনোই না, আঘাত করার সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করবে না। তো মুসলিম নারী যদি রণাঙ্গনে শত্রুর বিরুদ্ধ লড়াই করার অনুমতি পায়, তাহলে আর কোন জায়গাটি তাদের জন্য অনুপযুক্ত থাকে? আয়েশা (রা.)-কেই দেখুন! পুরো একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভাষণ দিয়েছেন এবং হাজারো মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো বিতরণ করেছেন। হজ-ওমরাহর তাওয়াফেই নারী-পুরুষের কত ভিড় দেখুন! এমন ভিড় পৃথিবীর কোথাও দেখবেন না। যে ধর্মে তাওয়াফের মতো ভিড়ের স্থানে যাওয়ার অনুমতি আছে, সেখানে আর কোথায় যেতে বাধা থাকতে পারে?
নারীদের এগিয়ে যেতে হবে। জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হতে হবে। ভারতীয়রা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে। আমি বলি, আসল ক্ষমতায়ন হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান। মানুষকে শেখানো এবং শিক্ষিত জাতি তৈরি করাই আসল উন্নয়ন। আমি নারীদের বলি, আপনি বিদ্যার্জন অব্যাহত রাখলে পুরুষও আপনার কাছে শিখতে আসবে। সুতরাং যুক্তিতর্ক করার দরকার নেই।
আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, নারীরা ইসলামের বেশি খেদমত করতে পারে। কারণ তাদের প্রতারণার মনোভাব কম; আন্তরিকতা বেশি। ক্ষমতালিপ্সু নয় তারা। মুম্বাইয়ে আমার এক ছাত্রী তাফসির পড়ান। কিছু আলেম তাঁকে বলেন যে, ‘নারীরা পুরুষদের পড়াতে পারে না।’ আমি তাঁকে বলি, ‘কিছুই বলার দরকার নেই। নারীরা হাদিস শেখাতে না পারলে আমাদের কী হবে? এত মানুষ কীভাবে বিদ্যার্জন করবে। আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষকই তো আমাদের মাহরাম নন। সুতরাং কাজ করে যান। সত্য একদিন ছড়িয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ। আমি নারীদের পড়াই বলে অনেকেই এক সময় আমার সমালোচনা করতেন। এখন দেখি তাঁরাও নারীদের পড়ান।’
মুসলিম নারীদের পিছিয়ে পড়ার কারণ
মুসলিম বিশ্ব সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। শুধু নারীর ক্ষেত্রেই নয়, আজকাল পুরুষদেরও চরম অধঃপতন ঘটেছে। মুসলিমরা শিক্ষাকে মাদ্রাসার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। অতীতে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও বর্তমানে অধিকাংশ মাদ্রাসা পুরুষদের জন্য বরাদ্দ। বিশেষ করে উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে এবং মুসলিম কারিকুলামে গ্রিক দর্শনে বেশ জোর দেওয়া হয়। কারণ, গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে প্রায় সবাই নারী অবমাননা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। এ কারণেই কোনো নারী গ্রিক দার্শনিক আপনি খুঁজে পাবেন না। তাঁরা মনে করতেন, নারী বুদ্ধিমত্তায় নীচ। অ্যারিস্টটলকে আমি সম্মান করি, তবে তিনিই বলেন যে, ‘বুদ্ধিমত্তায় নারীদের নীচ হওয়ার একটি প্রমাণ হলো পুরুষের তুলনায় তাদের দাঁত কম।’ এত বড় দার্শনিক এমন বক্তব্য দিচ্ছেন, ভাবতেই অবাক লাগে!
মুসলিম বিশ্বের গ্রিক দর্শন প্রভাবিত কোনো মানুষই নারীদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয় না। এ কারণেই আমার বিশ্বকোষে সব ঘরানার নারী স্কলার থাকলেও দার্শনিক পরিবার থেকে আসা কোনো নারী স্কলার নেই। এমনকি ইমাম গাজ্জালির মতো বিখ্যাত দার্শনিক আলিমও রাজা-বাদশাহদের উপদেশ দেন যে—নারীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন না; করলেও তাদের মতের বিপরীত কাজ করুন। তিনি আরও বলেন যে—নারীর কারণেই পৃথিবীর সব মন্দ কাজ সংঘটিত হয়। মাদ্রাসাগুলোতে এখনো ইমাম গাজ্জালির বিরাট প্রভাব আছে। আমি নিজেও মাদ্রাসার ছাত্র। আমি সারা জীবন মাদ্রাসায় পড়েছি; তাঁদের শ্রদ্ধা করি এবং তাঁদের নিয়ে লিখি। তারপরও আমি বলব, এমন মানসিকতা তাঁদের মধ্যে আছেই; সেখান থেকে তাঁরা বেরোতে পারছে না। মাদ্রাসাগুলোর পরিবর্তনে সময় লাগবে। আমি তাঁদের সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে চাই না; আমি মানুষকে শেখাতে চাই। পরিবর্তন ধীরে ধীরেই হয়। ইনশা আল্লাহ একদিন পরিবর্তন আসবেই।
ঘরবন্দী করে রাখার যুক্তির অসারতা
অবশ্য নারীবাদকে তাদের জন্য সহায়ক মনে করি না আমি। এটি আরেক চরমপন্থা। নারীবাদের সমালোচনা করে আমি আরেকটি বই লিখেছি; শিগগিরই তা প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ। তবে নারীবাদের একটি ভালো দিক আছে—এটি নারীর জন্য সুবিচারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই পয়েন্টে আমরা একমত। নারীদের প্রতি সুবিচার করা উচিত। তবে নারীবাদের সমাধান ভালো নয়; সেটি তাদের জন্য ক্ষতিকর।
আয়েশা (রা.)-এর যুগে একটি হাদিস প্রচলিত ছিল—নামাজরত কোনো পুরুষের সামনে দিয়ে কোনো নারী হেঁটে গেলে নামাজ নষ্ট হবে। কুফার বিখ্যাত আলিম ও ফকিহ আসওয়াত ইবনে ইয়াজিদ আয়েশাকে হাদিসটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি রেগে যান এবং বলেন, ‘হে কুফাবাসী, আমরা, নারীদের তোমরা গাধা ও বানরের সমান বানিয়ে ছেড়েছ! মহানবী (সা.) নামাজরত থাকতেন, আমি তাঁর সামনে থাকতাম, কই কিছুই তো হয়নি!’ এভাবে তিনি এই প্রচলিত ভুল শুধরে দেন। এ ঘটনা থেকে বুঝতে পারি, নারীরা মাঠে না থাকলে পুরুষেরা তাদের সম্পর্কে যা ইচ্ছা বলবে। প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না।
অনেকেই নারীদের নিকাব পরা বাধ্যতামূলক বলে দাবি করেন। আমার মনে হয়, তাঁদের এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ইসলামের মূল শিক্ষার চেয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবই বেশি। তাঁরা যুক্তি দেন যে, আপনার হিরে-জহরত থাকলে তা বাড়ির অন্দরে লুকিয়ে রাখেন। নারীও হিরে-জহরতের মতোই। আমরাও এক সময় এই যুক্তি বিশ্বাস করতাম। তবে এখানে একটি মৌলিক ভুল আছে—হিরে-জহরতের মন নেই, জীবন নেই; তবে নারীর চিন্তাশীল মন-মনন আছে। তারা ভালো-মন্দ বোঝে। কোরআন আদম (আ.)-কে এ আদেশ দেয়নি যে, স্ত্রীকে ভালো-মন্দ শেখান। বরং উভয়কে সম্বোধন করেই সমানভাবে আদেশ করা হয়েছে। নারীরা ভালো-মন্দ বোঝে, তাদের সঙ্গে পাথরের মতো আচরণ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
নারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় মাথায় রাখতে হবে যে, তারাও সচেতন মানবসন্তান। আল্লাহ তাআলা এভাবেই তাদের সম্বোধন করেন। আমার যুক্তি হলো, নারীরা মূল্যবান হিরে-জহরত হওয়ার কারণে যদি তাদের অন্তপুরে লুকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে পুরুষেরা তো নারীর চেয়েও মূল্যবান, তাদের তো বাক্সবন্দী করে রাখা দরকার! এই যুক্তি কি পুরুষসমাজ মেনে নেবে? মূলত কোরআন-হাদিসে এমন যুক্তির কোনো ভিত্তি নেই। এটি মানুষের মনগড়া ব্যাখ্যা। কোরআন নারীদের সঙ্গে কেমন মনোভাব পোষণ করে দেখুন। সাহাবিদের কর্মপন্থা দেখুন। ওমর (রা.) মদিনার নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই গনিমতের মাল বরাদ্দ করতেন। তিনি বাড়ি বাড়ি খবর পাঠাতেন—পুরুষেরা তাদের ভাগ নিয়ে যাক, নারীরা তাদের ভাগ নিয়ে যাক; কেউ কারও প্রতিনিধি হিসেবে আসার দরকার নেই। তিনি নিজ হাতেই তা নারীদের মধ্যে বণ্টন করতেন। কারও ভাই কিংবা স্বামী প্রতিনিধি হিসেবে এলে সেই নারীকে তিনি উপদেশ দিতেন—অন্য কাউকে তোমার টাকা নিতে পাঠানো সঠিক নয়।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী একবার তাঁর কাছে একটি বিষয় জানতে চান। বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। তিনি বলেন, ‘তুমি মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করো।’ তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘না, তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো।’ তিনি অস্বীকৃতি জানান এবং তাঁকেই যেতে বলেন। তখন তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে গিয়ে বিষয়টি সরাসরি জিজ্ঞেস করেন। এ যুগের লোকজন বলবে, ‘না, না! মুফতির কাছে যেয়ো না; তোমার বদলে আমিই যাচ্ছি।’
নারীরা রাসুলের কাছে গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করতেন; কারণ ইসলাম সকল মানুষের ধর্ম। আমাদের সমাজে যা প্রচলিত আছে, তা অস্বাভাবিক। ইসলামের স্বাভাবিক নির্দেশনা হলো, আপনি তাদের চিন্তাশীল মানুষ ভাবুন, তাদের মন-মননকে সম্মান করুন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের আল্লাহর ইবাদত করার সুযোগ করে দিন। এতে তারা পুরুষের চেয়ে বেশি ধার্মিক হবে। আল্লাহভীতি কখনোই জোর-জবরদস্তি করে আনা যায় না; মন থেকেই আসতে হয়। পাথর কিংবা দেয়াল তো ধার্মিক নয়। তারা তো মিথ্যা বলে না। ভালো-মন্দ পরখ করার সুযোগ দিলেই তো ধার্মিক হওয়ার সুযোগ আসে। নারীরা নিজেদের পথ বেছে নিক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি কি তাকে (ভালো-মন্দ) দুটি পথ দেখাইনি?’ (সুরা বালাদ, আয়াত: ১০) তাই যুক্তি যাদের পক্ষ থেকেই আসুক, পরখ করে দেখুন। ইসলাম মজবুত যুক্তিই গ্রহণ করে; দুর্বল-খোঁড়া যুক্তি নয়।
ফিকহের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি
ইসলাম কোরআন-সুন্নাহর ওপরই প্রতিষ্ঠিত। ফিকহ কোরআন-সুন্নাহর একটি অংশ মাত্র। ফিকহের অধিকাংশ মাসায়েলই ইজতিহাদের ভিত্তিতে। এটি প্রথা ও সময়ের আলোকেই প্রণীত হয়। ফিকহি মতামত যুগের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়। মতামতগুলো মানুষেরই; একটি আরেকটির চেয়ে ভিন্নতর। একাধিক অর্থের সুযোগও থাকে অনেক ক্ষেত্রে। আমরা কোরআন-সুন্নাহর পরিবর্তন করতে বলছি না। তবে যুগের আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। আর ব্যাখ্যা দিতে হলে আমাদের মহানবী (সা.)-এর যুগে ফিরতে হবে। মদিনার সমাজবাস্তবতায় তিনি নারীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন, তা দেখতে হবে। নারীদের মসজিদে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন—আমাদেরও তা-ই করতে হবে। নারীদের কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে উৎসাহ দিয়েছেন—আমাদেরও তা-ই করতে হবে। ওমর (রা.) শিফা বিনতে আবদুল্লাহ নামের এক নারীকে বাজার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এত পুরুষ সাহাবি থাকার পরও তিনি একজন নারীকেই দায়িত্ব দেন। অন্য এক নারী, সামারা বিনতে নাহিককে তিনি সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ বিষয়ক দায়িত্ব দেন। হাতে লাঠি নিয়ে তিনি মানুষের অপরাধের শাস্তি দিতেন। নারীরা তখন কত সক্রিয় ছিল ভাবুন!
এই বিশ্বকোষটি লেখার পর আমি ইংল্যান্ডের লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে কয়েকজন আলেম আমাকে বলেন, ‘আপনার বইটি ইসলামকে পরিবর্তন করতে যাচ্ছে।’ আমি বলি, ‘না, এটি পরিবর্তনকেই সরাতে যাচ্ছে। এটি মানুষকে মহানবী (সা.)-এর সমাজে নিয়ে যাচ্ছে।’ আমি আরও বলি, ‘আপনারা আলেম মানুষ। আমার তথ্য-উপাত্তে কোনো ধরনের ভুল থাকলে শুধরে দিন। আমি তা বই থেকে মুছে দেব।’
একবার আমি ইংল্যান্ডের এক মসজিদে বক্তৃতা দিই। তাতে নারীদের মসজিদে আসতে উৎসাহ দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করি। ইমাম সাহেব এসে বলেন, ‘যা ইচ্ছা বলেন, তবে এমন কথা বলবেন না।’ আমি বলি, ‘কেন? আমার যুক্তিতে কোনো ভুল আছে?’ তিনি বলেন, ‘নাই। যুক্তি যথাযথ। তবে তারা মসজিদে আসুক, তা আমরা চাই না।’
নারীদের মসজিদে আসতে নিষেধ করার পেছনে চলমান সংস্কৃতিই তাদের আসল কথা; বাস্তবে তাদের কাছে নিরেট কোনো যুক্তি নেই। কিছু মানুষের কাছে ইসলামের চেয়ে মুসলিম সংস্কৃতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম সংস্কৃতি সর্বস্ব ধর্ম নয়, বরং এটি আল্লাহ ও পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা। নারী-পুরুষকে এক সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসে নারী-পুরুষ সমানভাবে অংশ নেওয়া সুযোগ রেখেছি।
নারীর অধিকার বনাম বঞ্চনা
বিয়ের পর নারীর স্বাধীন ও আলাদা ঘর নিশ্চিত করা পুরুষের দায়িত্ব, যা দুই পক্ষের আত্মীয়-স্বজনের ঘর থেকে পৃথক হবে—এ বিষয়ে কোনো আলিমের দ্বিমত নেই। ঘরের পরিবেশও হতে হবে নিরিবিলি, হিজাব করা কিংবা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে চিন্তা থাকা যাবে না। স্বামী তার স্ত্রীকে বাবা-মা কিংবা ভাইয়ের ঘরে তুলতে পারে না। সকল মাজহাবেই এমনটি বলা হয়েছে। লোকে বলে, আমার বাবা-মা আছে, তাদের খেদমত করা লাগবে। আমি তাদের বলি, নারীদেরও বাবা-মা আছে। তারা স্বামীর বাবা-মায়ের সেবা করতে বাধ্য নয়। বাবা-মায়ের সেবার দায়িত্ব আপনারই। আপনি না পারলে লোক নিয়োগ দেন; স্ত্রীকে বাধ্য করতে পারেন না। তবে সে নিজ থেকে করলে তা একান্তই তার অনুগ্রহ; সে জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ হোন। আপনার স্ত্রীর খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। তার ভরণপোষণ, চিকিৎসা এমনকি শিক্ষার জন্যও ব্যয় করতে হবে। এটি অনুগ্রহ নয়; দান-সদকাও নয়। তার লাখ টাকা থাকলেও আপনাকে তা দিতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যরা অভাবগ্রস্ত হলেই তাদের দিতে হয়, তবে স্ত্রী ধনী হলেও দিতে হয়। এটি স্বামীর কর্তব্য।
কেউ কেউ বলে, ‘এত টাকা দিয়ে তারা কী করবে?’ আমি বলি, ‘তারা চ্যারিটি করবে; মসজিদ তৈরি করবে—অতীতের মতো। আগের যুগের নারীরা এমন কাজ অনেক করেছেন। তবে পরিহাসের বিষয় হলো, ফাতিমা আল-ফিহরিয়া নামের এক নারী মরক্কোর ফেজ শহরের কারাউয়্যিন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু সেখানে দীর্ঘদিন নারীদের পড়াশোনার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমি সেই কলেজে একবার লেকচার দিতে যাই। শ্রোতাদের সবাই আলেম। আমি বলি, ‘এই কলেজ একজন নারীর তৈরি। হাজার বছর ধরে আপনারা তাদেরই পড়াশোনার সুযোগ দেননি।’ অবশ্য এখন তারা নারীদের পড়ার অনুমতি দিচ্ছেন। তেমনি ভারতেও এমন অনেক মসজিদ আছে, যা নারীদের অর্থায়নে নির্মিত হলেও তাদের নামাজের অনুমতি নেই। মানুষ ইসলাম পড়ে না। মহানবী (সা.)-এর যুগের প্রেক্ষাপট এবং কোরআন-সুন্নাহ থেকে স্পষ্ট উদ্ধৃতি না দিলে কারও যুক্তিতে কান দেওয়ার দরকার নেই।
মুসলিম নারীর করণীয়
আমি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ইংল্যান্ডে বসবাস করছি। আমার মত হলো, নারী-পুরুষ উভয়কেই মূলধারার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, আমাদের তা অর্জনের অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। তবে পাশাপাশি আরবি ভাষা ও ইসলাম শিক্ষা পড়াতে হবে। সেই লক্ষ্যপূরণেই আমি ক্যামব্রিজে কাজ করে যাচ্ছি। আমি মনে করি, ভারত উপমহাদেশেও নারী-পুরুষদের মূলধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করা উচিত। তবে সপ্তাহের একদিন ইসলাম ও আরবি শেখার জন্য বরাদ্দ রাখলে তারা ইসলাম ভালোভাবে বুঝতে পারবে। ধর্মীয় জ্ঞান আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করবে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েদের জন্য আরবি শেখা মোটেও কঠিন কিছু নয়। তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করাই আসল কথা। আমার ক্লাসে নারী শিক্ষার্থীরা পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও তাঁরা এগিয়ে যান। তাই নারীদের পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য করবেন না। সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও তারা ইসলাম শিখতে পারে। এতে তাঁরা আরও বেশি ধার্মিক হবে।
অনেক পিএইচডিধারী নারী আমার ক্লাসে আসেন। মাথায় স্কার্ফ নেই। সহিহ বুখারি পড়েন। লোকজন বলে, ‘এই নারী এমন পবিত্র গ্রন্থ স্কার্ফ ছাড়া পড়ছেন!’ আমি তাঁদের বলি, ‘চিন্তার কিছু নেই। ওদের আসতে দিন। দেখবেন, তাঁরা বদলে যাবে। তাঁরা তাহাজ্জুদগুজার হয়ে যাবে। এখান থেকে গিয়ে পরিবারকে শেখাবে। তাঁদের জানার সুযোগ দিতে হবে। তা জানলে আমরা কীভাবে তাঁদের বাধ্য করব? পুরুষদের মতো নারীরাও জান্নাতে যেতে চায়। তাদের পড়াশোনার করার সুযোগ দিন।’
উপমহাদেশের মহিলা মাদ্রাসাগুলোর ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট নই। তা খুবই নিম্নমানের। তারা নারীদের স্রেফ পাঁচ-ছয় বছর পড়াশোনা করার সুযোগ দেয়। এই অল্প সময়ে তারা তেমন কিছু শিখতে পারে না। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক; সপ্তাহান্তে সময় বের করে ইসলাম শিখুক। কারণ, মাদ্রাসাপড়ুয়া নারীরা সাধারণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। তাই তাদের আত্মবিশ্বাস বিকশিত করার সুযোগ দিন। অনেক পুরুষ ধার্মিক স্ত্রী পেলে খুশিতে গদগদ হয়। তবে তারাই আবার চায় না—নারীরা শিখুক। তবে একবার শিখে যখন তা মানার চেষ্টা করে, তখন সেই পুরুষদের খুশির সীমা থাকে না। তাহলে আমার কথা হলো—তাদের শিখতে দেন না কেন?

তাকওয়া আত্মার পরিশুদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে ধারণ করে তাঁর আদেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। অন্তরে আল্লাহর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতিফলন এটি। তাকওয়া অর্জন হলে ব্যক্তি সব ধরনের পাপ থেকে দূরে থাকতে চায় এবং তার কাজকর্মে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
৬ ঘণ্টা আগে
নামাজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন আমাদের দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে, তেমনই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আজকের এই নামাজের সময়সূচি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, আল্লাহর জন্য সময় বের করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
১৩ ঘণ্টা আগে
আমি বিয়ে করেছি প্রায় ২৫ বছর হয়েছে। আল্লাহ আমাকে এখনো কোনো সন্তান দেননি। চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী, আমার স্ত্রীর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটি এতিম সন্তান দত্তক নেব। ইসলামে সন্তান দত্তক নেওয়ার সঠিক বিধান জানালে উপকৃত হব।
১ দিন আগে
সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিজেদের অধিকার রক্ষায় ঐক্য অপরিহার্য। মুসলিম উম্মাহর জন্যও এটি এক মৌলিক ভিত্তি। ইসলামের দৃষ্টিতে ঐক্যের মূল সূত্র হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, অর্থাৎ এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস।
১ দিন আগেইসলাম ডেস্ক

তাকওয়া আত্মার পরিশুদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে ধারণ করে তাঁর আদেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। অন্তরে আল্লাহর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতিফলন এটি। তাকওয়া অর্জন হলে ব্যক্তি সব ধরনের পাপ থেকে দূরে থাকতে চায় এবং তার কাজকর্মে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে মোত্তাকি বান্দারা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় এবং ভালোবাসার পাত্র।’ (সুরা হুজরাত: ১৩)
তাকওয়া অর্জনের সহজ তিনটি উপায় রয়েছে:
এক. ইখলাসের সঙ্গে ইবাদত করলে অন্তরে তাকওয়া আসে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ, তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত কর; যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মোত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা: ২১)
দুই. মহান আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ফিকিরের মাধ্যমে হৃদয়ে তাকওয়া সৃষ্টি করা সম্ভব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই রাত ও দিনের আবর্তনে, আর আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মাঝে আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তাতে তাকওয়া অবলম্বনকারী সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা ইউনুস: ৬)
তিন. নবীজি (সা.)-এর প্রতি নিরেট ভালোবাসা এবং তাঁর অনুসরণের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া অর্জন করা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাসুলের সামনে তাদের আওয়াজ নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তর তাকওয়ার জন্য যাচাই-বাছাই করে নিয়েছেন। তাদের জন্য আছে ক্ষমা আর মহাপুরস্কার।’ (সুরা হুজুরাত: ৩)
যারা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে, তাদের জন্য রয়েছে অনন্য সুসংবাদ। পবিত্র কোরআনে এসেছে, যারা ইমান আনে আর তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে আর আখিরাতেও। আল্লাহর কথার কোনো হেরফের হয় না, এটাই হলো বিরাট সাফল্য। (সুরা ইউনুস: ৬৩-৬৪)
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাকওয়া অর্জন করে জীবন পরিচালনার তৌফিক দিন। আমিন।

তাকওয়া আত্মার পরিশুদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে ধারণ করে তাঁর আদেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। অন্তরে আল্লাহর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতিফলন এটি। তাকওয়া অর্জন হলে ব্যক্তি সব ধরনের পাপ থেকে দূরে থাকতে চায় এবং তার কাজকর্মে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে মোত্তাকি বান্দারা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় এবং ভালোবাসার পাত্র।’ (সুরা হুজরাত: ১৩)
তাকওয়া অর্জনের সহজ তিনটি উপায় রয়েছে:
এক. ইখলাসের সঙ্গে ইবাদত করলে অন্তরে তাকওয়া আসে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মানুষ, তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত কর; যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মোত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা: ২১)
দুই. মহান আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ফিকিরের মাধ্যমে হৃদয়ে তাকওয়া সৃষ্টি করা সম্ভব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই রাত ও দিনের আবর্তনে, আর আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মাঝে আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তাতে তাকওয়া অবলম্বনকারী সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা ইউনুস: ৬)
তিন. নবীজি (সা.)-এর প্রতি নিরেট ভালোবাসা এবং তাঁর অনুসরণের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া অর্জন করা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাসুলের সামনে তাদের আওয়াজ নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তর তাকওয়ার জন্য যাচাই-বাছাই করে নিয়েছেন। তাদের জন্য আছে ক্ষমা আর মহাপুরস্কার।’ (সুরা হুজুরাত: ৩)
যারা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে, তাদের জন্য রয়েছে অনন্য সুসংবাদ। পবিত্র কোরআনে এসেছে, যারা ইমান আনে আর তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে আর আখিরাতেও। আল্লাহর কথার কোনো হেরফের হয় না, এটাই হলো বিরাট সাফল্য। (সুরা ইউনুস: ৬৩-৬৪)
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাকওয়া অর্জন করে জীবন পরিচালনার তৌফিক দিন। আমিন।

আল্লাহ পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তিনিই আমাদের স্রষ্টা। অথচ আমরা সব সময় নারীদের বাধ্য করার পথ খুঁজি। আলেমদের মুখেও নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বিদ্রূপাত্মক কথা শুনি; যা শুনে যে কেউ-ই রাগান্বিত হবেন। এমন মনোভাব ইসলাম সমর্থন না করলেও মুসলিম সমাজে দুঃখজনকভাবে প্রচলিত আছে।
০৮ মার্চ ২০২২
নামাজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন আমাদের দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে, তেমনই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আজকের এই নামাজের সময়সূচি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, আল্লাহর জন্য সময় বের করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
১৩ ঘণ্টা আগে
আমি বিয়ে করেছি প্রায় ২৫ বছর হয়েছে। আল্লাহ আমাকে এখনো কোনো সন্তান দেননি। চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী, আমার স্ত্রীর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটি এতিম সন্তান দত্তক নেব। ইসলামে সন্তান দত্তক নেওয়ার সঠিক বিধান জানালে উপকৃত হব।
১ দিন আগে
সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিজেদের অধিকার রক্ষায় ঐক্য অপরিহার্য। মুসলিম উম্মাহর জন্যও এটি এক মৌলিক ভিত্তি। ইসলামের দৃষ্টিতে ঐক্যের মূল সূত্র হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, অর্থাৎ এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস।
১ দিন আগেইসলাম ডেস্ক

জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে এবং আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে নামাজের কোনো বিকল্প নেই। একজন মুমিনের জন্য নামাজ হলো আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যম। এটি এমন এক ইবাদত—যা আমাদের মনে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি আনে, জীবনের প্রতিটি কাজে আনে বরকত। প্রতিদিন সময় মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক। তাই জেনে নেওয়া যাক আজ কোন ওয়াক্তের নামাজ কখন আদায় করতে হবে।
আজ শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫ ইংরেজি, ১৬ কার্তিক ১৪৩২ বাংলা, ০৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭ হিজরি। ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার নামাজের সময়সূচি তুলে ধরা হলো—
| নামাজ | ওয়াক্ত শুরু | ওয়াক্ত শেষ |
|---|---|---|
| তাহাজ্জুদ ও সেহরির শেষ সময় | ০০:০০ | ০৪: ৪৬ মিনিট |
| ফজর | ০৪: ৪৭ মিনিট | ০৬: ০৩ মিনিট |
| জোহর | ১১: ৪৩ মিনিট | ০৩: ৪২ মিনিট |
| আসর | ০৩: ৪৩ মিনিট | ০৫: ১৮ মিনিট |
| মাগরিব | ০৫: ২০ মিনিট | ০৬: ৩৬ মিনিট |
| এশা | ০৬: ৩৬ মিনিট | ০৪: ৪৬ মিনিট |
উল্লিখিত সময়ের সঙ্গে যেসব বিভাগের সময় যোগ-বিয়োগ করতে হবে, সেগুলো হলো:
বিয়োগ করতে হবে—
চট্টগ্রাম: ০৫ মিনিট
সিলেট: ০৬ মিনিট
যোগ করতে হবে—
খুলনা: ০৩ মিনিট
রাজশাহী: ০৭ মিনিট
রংপুর: ০৮ মিনিট
বরিশাল: ০১ মিনিট
নামাজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন আমাদের দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে, তেমনই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আজকের এই নামাজের সময়সূচি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, আল্লাহর জন্য সময় বের করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
আসুন, নামাজের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে তাঁর আরও কাছে নিয়ে যাই। জীবনে নিয়ে আসি ইমানের নুর।

জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে এবং আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে নামাজের কোনো বিকল্প নেই। একজন মুমিনের জন্য নামাজ হলো আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যম। এটি এমন এক ইবাদত—যা আমাদের মনে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি আনে, জীবনের প্রতিটি কাজে আনে বরকত। প্রতিদিন সময় মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক। তাই জেনে নেওয়া যাক আজ কোন ওয়াক্তের নামাজ কখন আদায় করতে হবে।
আজ শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫ ইংরেজি, ১৬ কার্তিক ১৪৩২ বাংলা, ০৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭ হিজরি। ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার নামাজের সময়সূচি তুলে ধরা হলো—
| নামাজ | ওয়াক্ত শুরু | ওয়াক্ত শেষ |
|---|---|---|
| তাহাজ্জুদ ও সেহরির শেষ সময় | ০০:০০ | ০৪: ৪৬ মিনিট |
| ফজর | ০৪: ৪৭ মিনিট | ০৬: ০৩ মিনিট |
| জোহর | ১১: ৪৩ মিনিট | ০৩: ৪২ মিনিট |
| আসর | ০৩: ৪৩ মিনিট | ০৫: ১৮ মিনিট |
| মাগরিব | ০৫: ২০ মিনিট | ০৬: ৩৬ মিনিট |
| এশা | ০৬: ৩৬ মিনিট | ০৪: ৪৬ মিনিট |
উল্লিখিত সময়ের সঙ্গে যেসব বিভাগের সময় যোগ-বিয়োগ করতে হবে, সেগুলো হলো:
বিয়োগ করতে হবে—
চট্টগ্রাম: ০৫ মিনিট
সিলেট: ০৬ মিনিট
যোগ করতে হবে—
খুলনা: ০৩ মিনিট
রাজশাহী: ০৭ মিনিট
রংপুর: ০৮ মিনিট
বরিশাল: ০১ মিনিট
নামাজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন আমাদের দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে, তেমনই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আজকের এই নামাজের সময়সূচি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, আল্লাহর জন্য সময় বের করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
আসুন, নামাজের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে তাঁর আরও কাছে নিয়ে যাই। জীবনে নিয়ে আসি ইমানের নুর।

আল্লাহ পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তিনিই আমাদের স্রষ্টা। অথচ আমরা সব সময় নারীদের বাধ্য করার পথ খুঁজি। আলেমদের মুখেও নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বিদ্রূপাত্মক কথা শুনি; যা শুনে যে কেউ-ই রাগান্বিত হবেন। এমন মনোভাব ইসলাম সমর্থন না করলেও মুসলিম সমাজে দুঃখজনকভাবে প্রচলিত আছে।
০৮ মার্চ ২০২২
তাকওয়া আত্মার পরিশুদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে ধারণ করে তাঁর আদেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। অন্তরে আল্লাহর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতিফলন এটি। তাকওয়া অর্জন হলে ব্যক্তি সব ধরনের পাপ থেকে দূরে থাকতে চায় এবং তার কাজকর্মে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
৬ ঘণ্টা আগে
আমি বিয়ে করেছি প্রায় ২৫ বছর হয়েছে। আল্লাহ আমাকে এখনো কোনো সন্তান দেননি। চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী, আমার স্ত্রীর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটি এতিম সন্তান দত্তক নেব। ইসলামে সন্তান দত্তক নেওয়ার সঠিক বিধান জানালে উপকৃত হব।
১ দিন আগে
সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিজেদের অধিকার রক্ষায় ঐক্য অপরিহার্য। মুসলিম উম্মাহর জন্যও এটি এক মৌলিক ভিত্তি। ইসলামের দৃষ্টিতে ঐক্যের মূল সূত্র হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, অর্থাৎ এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস।
১ দিন আগেইসলাম ডেস্ক

আমি বিয়ে করেছি প্রায় ২৫ বছর হয়েছে। আল্লাহ আমাকে এখনো কোনো সন্তান দেননি। চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী, আমার স্ত্রীর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটি এতিম সন্তান দত্তক নেব। ইসলামে সন্তান দত্তক নেওয়ার সঠিক বিধান জানালে উপকৃত হব।
আলমগীর দেওয়ান, সিলেট
আপনার ২৫ বছরের দাম্পত্যজীবনে সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং সন্তানহীনতার শূন্যতা পূরণে একটি শিশুকে লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত মানবিক ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ইসলাম আপনার এই মহৎ সিদ্ধান্তকে শুধু অনুমোদনই করে না, বরং এতিম, গৃহহীন বা অসহায় শিশুর অভিভাবকত্ব নিয়ে তাকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাকে অত্যন্ত সওয়াবের কাজ হিসেবে উৎসাহিত করে। তবে শরিয়তের কিছু মৌলিক নীতিমালা মেনে এটি করতে হবে, যা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
দত্তক নিলে মানতে হবে যেসব বিধান
ইসলামে অন্য কারও সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ, মমতা, অন্ন, বস্ত্র ও শিক্ষা দিয়ে লালন-পালন করাকে কাফালাহ বা অভিভাবকত্ব গ্রহণ বলা হয়। এটি বৈধ, বলা যায় এটি একটি মহৎ ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এতিম বা অসহায় শিশুর দায়িত্ব নেওয়াকে বিপুল সওয়াবের কাজ বলে ঘোষণা করেছেন। (সহিহ বুখারি: ৬০০৫)
তবে সাধারণ অর্থে প্রচলিত দত্তক প্রথা ইসলাম সমর্থন করে না, যেখানে সন্তানের আসল পিতামাতার পরিচয় মুছে ফেলা হয় এবং তাকে জৈবিক সন্তানের মতো সকল আইনি অধিকার (উত্তরাধিকার ও পর্দা) দেওয়া হয়। বরং ইসলাম অনুমোদন করে কাফালাহ, যার মূল শর্ত হলো শিশুর আসল পিতৃপরিচয় বহাল রাখা।
ইসলামে কোনো স্বাধীন মানুষের প্রকৃত পিতৃপরিচয় ছিন্ন করা সম্পূর্ণভাবে হারাম ও কবিরা গুনাহ। দত্তক নেওয়ার কারণে শিশুর আসল মা-বাবা ও বংশের সম্পর্ক কোনোভাবেই বিলুপ্ত হবে না। তাই শিশুর জন্মসনদ, শিক্ষাসনদ, ভোটার আইডি বা অন্য যেকোনো দাপ্তরিক দলিলে তার আসল পিতার নাম উল্লেখ করা আবশ্যক।
দত্তক নেওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো পর্দার বিষয়টি। লালন-পালনকারীর সঙ্গে পালিত সন্তানের রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। ফলে পালক নেওয়া শিশুটি ছেলে হলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাকে পালক মায়ের সঙ্গে এবং মেয়ে হলে পালক বাবার সঙ্গে শরিয়তের পূর্ণ পর্দা রক্ষা করে চলতে হবে। পর্দার এই কঠোরতা এড়ানোর জন্য সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো—শিশুটিকে দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় (জন্মের পর প্রথম দুই বছরের মধ্যে) পালক নেওয়া মায়ের কোনো বোন বা মেয়ে দ্বারা এমনভাবে দুধ পান করানো, যাতে সে দুগ্ধ-সম্পর্কীয় মাহরাম হয়ে যায়। দুগ্ধ-সম্পর্ক তৈরি হলে তাদের মধ্যে পর্দা আর আবশ্যক থাকবে না। (সহিহ বুখারি: ২৬৪৫)
পালক সন্তান লালন-পালনকারীর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী (ওয়ারিশ) হিসেবে তাঁর সম্পত্তি থেকে কোনো অংশ পাবে না। কারণ রক্তের সম্পর্ক না থাকায় সে মিরাসের হকদার হয় না। তবে, লালন-পালনকারী তাঁর জীবদ্দশায় স্নেহবশত পালক সন্তানকে সম্পত্তি দান বা হেবা করতে পারবেন। অথবা, তিনি তাঁর মোট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ থেকে পালক সন্তানের জন্য অসিয়ত (উইল) করে যেতে পারবেন।
পোষ্য সন্তানের তার লালন-পালনকারীকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতাবশত মা-বাবা বলে ডাকা জায়েজ। একইভাবে তাঁরাও সন্তানকে স্নেহ করে ছেলেমেয়ে ডাকতে পারবেন।
উত্তর দিয়েছেন: মুফতি শাব্বির আহমদ, ইসলামবিষয়ক গবেষক

আমি বিয়ে করেছি প্রায় ২৫ বছর হয়েছে। আল্লাহ আমাকে এখনো কোনো সন্তান দেননি। চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী, আমার স্ত্রীর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটি এতিম সন্তান দত্তক নেব। ইসলামে সন্তান দত্তক নেওয়ার সঠিক বিধান জানালে উপকৃত হব।
আলমগীর দেওয়ান, সিলেট
আপনার ২৫ বছরের দাম্পত্যজীবনে সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং সন্তানহীনতার শূন্যতা পূরণে একটি শিশুকে লালন-পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত মানবিক ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ইসলাম আপনার এই মহৎ সিদ্ধান্তকে শুধু অনুমোদনই করে না, বরং এতিম, গৃহহীন বা অসহায় শিশুর অভিভাবকত্ব নিয়ে তাকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাকে অত্যন্ত সওয়াবের কাজ হিসেবে উৎসাহিত করে। তবে শরিয়তের কিছু মৌলিক নীতিমালা মেনে এটি করতে হবে, যা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
দত্তক নিলে মানতে হবে যেসব বিধান
ইসলামে অন্য কারও সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ, মমতা, অন্ন, বস্ত্র ও শিক্ষা দিয়ে লালন-পালন করাকে কাফালাহ বা অভিভাবকত্ব গ্রহণ বলা হয়। এটি বৈধ, বলা যায় এটি একটি মহৎ ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এতিম বা অসহায় শিশুর দায়িত্ব নেওয়াকে বিপুল সওয়াবের কাজ বলে ঘোষণা করেছেন। (সহিহ বুখারি: ৬০০৫)
তবে সাধারণ অর্থে প্রচলিত দত্তক প্রথা ইসলাম সমর্থন করে না, যেখানে সন্তানের আসল পিতামাতার পরিচয় মুছে ফেলা হয় এবং তাকে জৈবিক সন্তানের মতো সকল আইনি অধিকার (উত্তরাধিকার ও পর্দা) দেওয়া হয়। বরং ইসলাম অনুমোদন করে কাফালাহ, যার মূল শর্ত হলো শিশুর আসল পিতৃপরিচয় বহাল রাখা।
ইসলামে কোনো স্বাধীন মানুষের প্রকৃত পিতৃপরিচয় ছিন্ন করা সম্পূর্ণভাবে হারাম ও কবিরা গুনাহ। দত্তক নেওয়ার কারণে শিশুর আসল মা-বাবা ও বংশের সম্পর্ক কোনোভাবেই বিলুপ্ত হবে না। তাই শিশুর জন্মসনদ, শিক্ষাসনদ, ভোটার আইডি বা অন্য যেকোনো দাপ্তরিক দলিলে তার আসল পিতার নাম উল্লেখ করা আবশ্যক।
দত্তক নেওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো পর্দার বিষয়টি। লালন-পালনকারীর সঙ্গে পালিত সন্তানের রক্তের সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। ফলে পালক নেওয়া শিশুটি ছেলে হলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাকে পালক মায়ের সঙ্গে এবং মেয়ে হলে পালক বাবার সঙ্গে শরিয়তের পূর্ণ পর্দা রক্ষা করে চলতে হবে। পর্দার এই কঠোরতা এড়ানোর জন্য সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো—শিশুটিকে দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় (জন্মের পর প্রথম দুই বছরের মধ্যে) পালক নেওয়া মায়ের কোনো বোন বা মেয়ে দ্বারা এমনভাবে দুধ পান করানো, যাতে সে দুগ্ধ-সম্পর্কীয় মাহরাম হয়ে যায়। দুগ্ধ-সম্পর্ক তৈরি হলে তাদের মধ্যে পর্দা আর আবশ্যক থাকবে না। (সহিহ বুখারি: ২৬৪৫)
পালক সন্তান লালন-পালনকারীর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী (ওয়ারিশ) হিসেবে তাঁর সম্পত্তি থেকে কোনো অংশ পাবে না। কারণ রক্তের সম্পর্ক না থাকায় সে মিরাসের হকদার হয় না। তবে, লালন-পালনকারী তাঁর জীবদ্দশায় স্নেহবশত পালক সন্তানকে সম্পত্তি দান বা হেবা করতে পারবেন। অথবা, তিনি তাঁর মোট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ থেকে পালক সন্তানের জন্য অসিয়ত (উইল) করে যেতে পারবেন।
পোষ্য সন্তানের তার লালন-পালনকারীকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতাবশত মা-বাবা বলে ডাকা জায়েজ। একইভাবে তাঁরাও সন্তানকে স্নেহ করে ছেলেমেয়ে ডাকতে পারবেন।
উত্তর দিয়েছেন: মুফতি শাব্বির আহমদ, ইসলামবিষয়ক গবেষক

আল্লাহ পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তিনিই আমাদের স্রষ্টা। অথচ আমরা সব সময় নারীদের বাধ্য করার পথ খুঁজি। আলেমদের মুখেও নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বিদ্রূপাত্মক কথা শুনি; যা শুনে যে কেউ-ই রাগান্বিত হবেন। এমন মনোভাব ইসলাম সমর্থন না করলেও মুসলিম সমাজে দুঃখজনকভাবে প্রচলিত আছে।
০৮ মার্চ ২০২২
তাকওয়া আত্মার পরিশুদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে ধারণ করে তাঁর আদেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। অন্তরে আল্লাহর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতিফলন এটি। তাকওয়া অর্জন হলে ব্যক্তি সব ধরনের পাপ থেকে দূরে থাকতে চায় এবং তার কাজকর্মে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
৬ ঘণ্টা আগে
নামাজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন আমাদের দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে, তেমনই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আজকের এই নামাজের সময়সূচি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, আল্লাহর জন্য সময় বের করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
১৩ ঘণ্টা আগে
সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিজেদের অধিকার রক্ষায় ঐক্য অপরিহার্য। মুসলিম উম্মাহর জন্যও এটি এক মৌলিক ভিত্তি। ইসলামের দৃষ্টিতে ঐক্যের মূল সূত্র হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, অর্থাৎ এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস।
১ দিন আগেকাউসার লাবীব

সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিজেদের অধিকার রক্ষায় ঐক্য অপরিহার্য। মুসলিম উম্মাহর জন্যও এটি এক মৌলিক ভিত্তি। ইসলামের দৃষ্টিতে ঐক্যের মূল সূত্র হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, অর্থাৎ এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস। মুসলিম ঐক্যের ভিত্তি তিনটি মৌলিক উপাদানের ওপর প্রতিষ্ঠিত: এক. আল্লাহ, দুই. রাসুলুল্লাহ ও তিন. কিতাবুল্লাহ। যার অর্থ—এক আল্লাহর প্রতি অবিচল ইমান, তাঁর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা ও সম্পূর্ণ আনুগত্য এবং আল্লাহর কিতাব পবিত্র কোরআনের পরিপূর্ণ অনুসরণ। এই ভিত্তিই মুসলমানদের জাতি, বর্ণ ও ভাষার ঊর্ধ্বে এক অভিন্ন জাতিসত্তায় পরিণত করে।
মহানবী (সা.) মুমিনের পরিচয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, ‘যারা আমাদের নামাজ মানে, আমাদের কিবলা মানে এবং আমাদের জবাই করা হালাল পশুকে হালাল মনে করে; তারা মুসলিম। তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল জিম্মাদার। সুতরাং তোমরা আল্লাহর জিম্মাদারি খিয়ানত কোরো না।’ (সহিহ বুখারি: ৩৮৪-৩৮৫)।
ঐক্যবদ্ধ থাকার সুফল
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে মুমিনদের ঐক্য ও সংহতির বিষয়ে বারবার জোর দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সম্মিলিতভাবে ধারণ করো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো। যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের অন্তরগুলোয় প্রীতি দিয়েছেন, ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে ভ্রাতৃরূপ লাভ করেছ।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০৩)। এখানে আল্লাহর রজ্জু বলতে ইসলাম ও কোরআনের বিধানকে বোঝানো হয়েছে, যা একাধারে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক এবং মুসলমানদের পরস্পরের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার মাধ্যম।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো এবং পরস্পর কলহ কোরো না (ঐক্যবদ্ধ থাকো)। অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে। আর তোমরা ধৈর্য ধরো, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনফাল: ৪৬)। এই আয়াত পরিষ্কারভাবে বোঝায় যে অনৈক্য কেবল গুনাহের কাজ নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর শক্তি, প্রতিপত্তি ও সুনাম নষ্টের প্রধান কারণ।
ইসলামে মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় মুমিনেরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে।’ (সুরা হুজরাত: ১০)। এই সম্পর্কের নিদর্শন হলো পারস্পরিক সহানুভূতি, করুণা ও দয়ার্দ্রতা।
মহানবী (সা.) এই সম্পর্কের গভীরতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বাসী মুমিনগণ সম্প্রীতি, করুণা ও দয়ার্দ্রতায় যেন এক দেহ এক প্রাণ—যেমন শরীরের একটি অঙ্গে আঘাত পেলে সারা অঙ্গ ব্যথা অনুভব করে, যন্ত্রণায় নির্ঘুম রাত কাটায় ও জ্বরে ঘর্মাক্ত হয়।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)। অর্থাৎ, একজন মুসলিমের বিপদ বা দুঃখকে অপর মুসলিম তার নিজের কষ্ট হিসেবে অনুভব করবে—এটাই ইসলামের শিক্ষা। মহানবী (সা.)-এর ভাষায়, প্রকৃত মুমিন তো সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে।’ (সহিহ বুখারি)।
বিভেদ ও মতানৈক্য নিরসনের পথ
মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য বা দ্বন্দ্ব-বিবাদ থাকা স্বাভাবিক। তবে ইসলামে এই মতানৈক্য বহাল রেখে বিচ্ছিন্ন থাকার কোনো সুযোগ নেই। মতবিরোধের সৃষ্টি হলে এর সমাধানের জন্য কোরআন ও সুন্নাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ করো, তাহলে তা আল্লাহ ও রাসুলের দিকে প্রত্যর্পণ করো, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ইমান রাখো। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।’ (সুরা নিসা: ৫৯)। এ ছাড়া, বিবাদ দেখা দিলে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনে। বলা হয়েছে, নিজেদের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে নেওয়ার কথা।
অনৈক্যের পরিণাম ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ অনৈক্য, বিভেদ-বিসংবাদ ও কলহে জর্জরিত। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিভাজন আজ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, সারা বিশ্বে মুসলমানেরা নিপীড়িত-নির্যাতিত এবং তাদের রক্ত ঝরছে। এই বিভেদ জিইয়ে রাখা শয়তানের কাজ, যা উম্মাহর মধ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
ইতিহাস সাক্ষী, ঐক্যই শক্তি। পশ্চিমা শক্তিগুলো যখন তাদের ঐতিহাসিক শত্রুতা ভুলে নিজেদের স্বার্থে একই প্ল্যাটফর্মে সমবেত হয়, তখন মুসলিম দেশগুলো নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও বিভাজনে ডুবে থাকে। মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ না থাকার কারণেই বহির্বিশ্বে আজ মুসলিমরা তাদের ন্যায্য অধিকার হারাচ্ছে, নিজ ভূখণ্ডে দাসে পরিণত হচ্ছে এবং মজলুমদের কান্না থামছে না।
আখিরাতে মুক্তি ও দুনিয়ায় সফলতার জন্য পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি অপরিহার্য। সকল ভেদাভেদ, বিভেদ-বিভাজন ভুলে এক জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকা মুমিনের ইমানি দায়িত্ব। বিভেদ নয়, বরং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করে সহিষ্ণুতা ও কল্যাণকামিতার ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করতে পারলেই আমরা আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র হতে পারব এবং বহিঃশত্রুর সামনে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হতে পারব।

সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিজেদের অধিকার রক্ষায় ঐক্য অপরিহার্য। মুসলিম উম্মাহর জন্যও এটি এক মৌলিক ভিত্তি। ইসলামের দৃষ্টিতে ঐক্যের মূল সূত্র হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, অর্থাৎ এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস। মুসলিম ঐক্যের ভিত্তি তিনটি মৌলিক উপাদানের ওপর প্রতিষ্ঠিত: এক. আল্লাহ, দুই. রাসুলুল্লাহ ও তিন. কিতাবুল্লাহ। যার অর্থ—এক আল্লাহর প্রতি অবিচল ইমান, তাঁর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা ও সম্পূর্ণ আনুগত্য এবং আল্লাহর কিতাব পবিত্র কোরআনের পরিপূর্ণ অনুসরণ। এই ভিত্তিই মুসলমানদের জাতি, বর্ণ ও ভাষার ঊর্ধ্বে এক অভিন্ন জাতিসত্তায় পরিণত করে।
মহানবী (সা.) মুমিনের পরিচয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, ‘যারা আমাদের নামাজ মানে, আমাদের কিবলা মানে এবং আমাদের জবাই করা হালাল পশুকে হালাল মনে করে; তারা মুসলিম। তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল জিম্মাদার। সুতরাং তোমরা আল্লাহর জিম্মাদারি খিয়ানত কোরো না।’ (সহিহ বুখারি: ৩৮৪-৩৮৫)।
ঐক্যবদ্ধ থাকার সুফল
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে মুমিনদের ঐক্য ও সংহতির বিষয়ে বারবার জোর দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সম্মিলিতভাবে ধারণ করো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো। যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের অন্তরগুলোয় প্রীতি দিয়েছেন, ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে ভ্রাতৃরূপ লাভ করেছ।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০৩)। এখানে আল্লাহর রজ্জু বলতে ইসলাম ও কোরআনের বিধানকে বোঝানো হয়েছে, যা একাধারে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক এবং মুসলমানদের পরস্পরের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার মাধ্যম।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো এবং পরস্পর কলহ কোরো না (ঐক্যবদ্ধ থাকো)। অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে। আর তোমরা ধৈর্য ধরো, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনফাল: ৪৬)। এই আয়াত পরিষ্কারভাবে বোঝায় যে অনৈক্য কেবল গুনাহের কাজ নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর শক্তি, প্রতিপত্তি ও সুনাম নষ্টের প্রধান কারণ।
ইসলামে মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় মুমিনেরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে।’ (সুরা হুজরাত: ১০)। এই সম্পর্কের নিদর্শন হলো পারস্পরিক সহানুভূতি, করুণা ও দয়ার্দ্রতা।
মহানবী (সা.) এই সম্পর্কের গভীরতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বাসী মুমিনগণ সম্প্রীতি, করুণা ও দয়ার্দ্রতায় যেন এক দেহ এক প্রাণ—যেমন শরীরের একটি অঙ্গে আঘাত পেলে সারা অঙ্গ ব্যথা অনুভব করে, যন্ত্রণায় নির্ঘুম রাত কাটায় ও জ্বরে ঘর্মাক্ত হয়।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)। অর্থাৎ, একজন মুসলিমের বিপদ বা দুঃখকে অপর মুসলিম তার নিজের কষ্ট হিসেবে অনুভব করবে—এটাই ইসলামের শিক্ষা। মহানবী (সা.)-এর ভাষায়, প্রকৃত মুমিন তো সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে।’ (সহিহ বুখারি)।
বিভেদ ও মতানৈক্য নিরসনের পথ
মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য বা দ্বন্দ্ব-বিবাদ থাকা স্বাভাবিক। তবে ইসলামে এই মতানৈক্য বহাল রেখে বিচ্ছিন্ন থাকার কোনো সুযোগ নেই। মতবিরোধের সৃষ্টি হলে এর সমাধানের জন্য কোরআন ও সুন্নাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ করো, তাহলে তা আল্লাহ ও রাসুলের দিকে প্রত্যর্পণ করো, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ইমান রাখো। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।’ (সুরা নিসা: ৫৯)। এ ছাড়া, বিবাদ দেখা দিলে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনে। বলা হয়েছে, নিজেদের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে নেওয়ার কথা।
অনৈক্যের পরিণাম ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ অনৈক্য, বিভেদ-বিসংবাদ ও কলহে জর্জরিত। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিভাজন আজ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, সারা বিশ্বে মুসলমানেরা নিপীড়িত-নির্যাতিত এবং তাদের রক্ত ঝরছে। এই বিভেদ জিইয়ে রাখা শয়তানের কাজ, যা উম্মাহর মধ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
ইতিহাস সাক্ষী, ঐক্যই শক্তি। পশ্চিমা শক্তিগুলো যখন তাদের ঐতিহাসিক শত্রুতা ভুলে নিজেদের স্বার্থে একই প্ল্যাটফর্মে সমবেত হয়, তখন মুসলিম দেশগুলো নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও বিভাজনে ডুবে থাকে। মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ না থাকার কারণেই বহির্বিশ্বে আজ মুসলিমরা তাদের ন্যায্য অধিকার হারাচ্ছে, নিজ ভূখণ্ডে দাসে পরিণত হচ্ছে এবং মজলুমদের কান্না থামছে না।
আখিরাতে মুক্তি ও দুনিয়ায় সফলতার জন্য পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি অপরিহার্য। সকল ভেদাভেদ, বিভেদ-বিভাজন ভুলে এক জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকা মুমিনের ইমানি দায়িত্ব। বিভেদ নয়, বরং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করে সহিষ্ণুতা ও কল্যাণকামিতার ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করতে পারলেই আমরা আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র হতে পারব এবং বহিঃশত্রুর সামনে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হতে পারব।

আল্লাহ পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তিনিই আমাদের স্রষ্টা। অথচ আমরা সব সময় নারীদের বাধ্য করার পথ খুঁজি। আলেমদের মুখেও নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বিদ্রূপাত্মক কথা শুনি; যা শুনে যে কেউ-ই রাগান্বিত হবেন। এমন মনোভাব ইসলাম সমর্থন না করলেও মুসলিম সমাজে দুঃখজনকভাবে প্রচলিত আছে।
০৮ মার্চ ২০২২
তাকওয়া আত্মার পরিশুদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাকওয়া মানে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে ধারণ করে তাঁর আদেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। অন্তরে আল্লাহর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতিফলন এটি। তাকওয়া অর্জন হলে ব্যক্তি সব ধরনের পাপ থেকে দূরে থাকতে চায় এবং তার কাজকর্মে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
৬ ঘণ্টা আগে
নামাজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন আমাদের দৈহিক পবিত্রতা নিশ্চিত করে, তেমনই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। আজকের এই নামাজের সময়সূচি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, আল্লাহর জন্য সময় বের করা আমাদের প্রধান দায়িত্ব।
১৩ ঘণ্টা আগে
আমি বিয়ে করেছি প্রায় ২৫ বছর হয়েছে। আল্লাহ আমাকে এখনো কোনো সন্তান দেননি। চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী, আমার স্ত্রীর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটি এতিম সন্তান দত্তক নেব। ইসলামে সন্তান দত্তক নেওয়ার সঠিক বিধান জানালে উপকৃত হব।
১ দিন আগে