Ajker Patrika

বিভেদ নয়, ভ্রাতৃত্বই মুমিনের শক্তি

কাউসার লাবীব
আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৪৫
বিভেদ নয়, ভ্রাতৃত্বই মুমিনের শক্তি

সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিজেদের অধিকার রক্ষায় ঐক্য অপরিহার্য। মুসলিম উম্মাহর জন্যও এটি এক মৌলিক ভিত্তি। ইসলামের দৃষ্টিতে ঐক্যের মূল সূত্র হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, অর্থাৎ এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস। মুসলিম ঐক্যের ভিত্তি তিনটি মৌলিক উপাদানের ওপর প্রতিষ্ঠিত: এক. আল্লাহ, দুই. রাসুলুল্লাহ ও তিন. কিতাবুল্লাহ। যার অর্থ—এক আল্লাহর প্রতি অবিচল ইমান, তাঁর রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা ও সম্পূর্ণ আনুগত্য এবং আল্লাহর কিতাব পবিত্র কোরআনের পরিপূর্ণ অনুসরণ। এই ভিত্তিই মুসলমানদের জাতি, বর্ণ ও ভাষার ঊর্ধ্বে এক অভিন্ন জাতিসত্তায় পরিণত করে।

মহানবী (সা.) মুমিনের পরিচয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, ‘যারা আমাদের নামাজ মানে, আমাদের কিবলা মানে এবং আমাদের জবাই করা হালাল পশুকে হালাল মনে করে; তারা মুসলিম। তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুল জিম্মাদার। সুতরাং তোমরা আল্লাহর জিম্মাদারি খিয়ানত কোরো না।’ (সহিহ বুখারি: ৩৮৪-৩৮৫)।

ঐক্যবদ্ধ থাকার সুফল

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে মুমিনদের ঐক্য ও সংহতির বিষয়ে বারবার জোর দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সম্মিলিতভাবে ধারণ করো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো। যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের অন্তরগুলোয় প্রীতি দিয়েছেন, ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে ভ্রাতৃরূপ লাভ করেছ।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০৩)। এখানে আল্লাহর রজ্জু বলতে ইসলাম ও কোরআনের বিধানকে বোঝানো হয়েছে, যা একাধারে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক এবং মুসলমানদের পরস্পরের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার মাধ্যম।

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো এবং পরস্পর কলহ কোরো না (ঐক্যবদ্ধ থাকো)। অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে। আর তোমরা ধৈর্য ধরো, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনফাল: ৪৬)। এই আয়াত পরিষ্কারভাবে বোঝায় যে অনৈক্য কেবল গুনাহের কাজ নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর শক্তি, প্রতিপত্তি ও সুনাম নষ্টের প্রধান কারণ।

ইসলামে মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় মুমিনেরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে।’ (সুরা হুজরাত: ১০)। এই সম্পর্কের নিদর্শন হলো পারস্পরিক সহানুভূতি, করুণা ও দয়ার্দ্রতা।

মহানবী (সা.) এই সম্পর্কের গভীরতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বাসী মুমিনগণ সম্প্রীতি, করুণা ও দয়ার্দ্রতায় যেন এক দেহ এক প্রাণ—যেমন শরীরের একটি অঙ্গে আঘাত পেলে সারা অঙ্গ ব্যথা অনুভব করে, যন্ত্রণায় নির্ঘুম রাত কাটায় ও জ্বরে ঘর্মাক্ত হয়।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)। অর্থাৎ, একজন মুসলিমের বিপদ বা দুঃখকে অপর মুসলিম তার নিজের কষ্ট হিসেবে অনুভব করবে—এটাই ইসলামের শিক্ষা। মহানবী (সা.)-এর ভাষায়, প্রকৃত মুমিন তো সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে।’ (সহিহ বুখারি)।

বিভেদ ও মতানৈক্য নিরসনের পথ

মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য বা দ্বন্দ্ব-বিবাদ থাকা স্বাভাবিক। তবে ইসলামে এই মতানৈক্য বহাল রেখে বিচ্ছিন্ন থাকার কোনো সুযোগ নেই। মতবিরোধের সৃষ্টি হলে এর সমাধানের জন্য কোরআন ও সুন্নাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ করো, তাহলে তা আল্লাহ ও রাসুলের দিকে প্রত্যর্পণ করো, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ইমান রাখো। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।’ (সুরা নিসা: ৫৯)। এ ছাড়া, বিবাদ দেখা দিলে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনে। বলা হয়েছে, নিজেদের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে নেওয়ার কথা।

অনৈক্যের পরিণাম ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ অনৈক্য, বিভেদ-বিসংবাদ ও কলহে জর্জরিত। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিভাজন আজ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, সারা বিশ্বে মুসলমানেরা নিপীড়িত-নির্যাতিত এবং তাদের রক্ত ঝরছে। এই বিভেদ জিইয়ে রাখা শয়তানের কাজ, যা উম্মাহর মধ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করছে।

ইতিহাস সাক্ষী, ঐক্যই শক্তি। পশ্চিমা শক্তিগুলো যখন তাদের ঐতিহাসিক শত্রুতা ভুলে নিজেদের স্বার্থে একই প্ল্যাটফর্মে সমবেত হয়, তখন মুসলিম দেশগুলো নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও বিভাজনে ডুবে থাকে। মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ না থাকার কারণেই বহির্বিশ্বে আজ মুসলিমরা তাদের ন্যায্য অধিকার হারাচ্ছে, নিজ ভূখণ্ডে দাসে পরিণত হচ্ছে এবং মজলুমদের কান্না থামছে না।

আখিরাতে মুক্তি ও দুনিয়ায় সফলতার জন্য পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি অপরিহার্য। সকল ভেদাভেদ, বিভেদ-বিভাজন ভুলে এক জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকা মুমিনের ইমানি দায়িত্ব। বিভেদ নয়, বরং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করে সহিষ্ণুতা ও কল্যাণকামিতার ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করতে পারলেই আমরা আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র হতে পারব এবং বহিঃশত্রুর সামনে সিসাঢালা প্রাচীরের মতো শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হতে পারব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১৬ ডিসেম্বরের পর পুরোনো ও নতুন মোবাইল ফোনের রেজিস্ট্রেশন হবে যেভাবে

১৪ বছরের মেয়ে যেন নির্বিঘ্নে ভিডিও বানাতে পারে, তাই দেশ ছাড়ল ইনফ্লুয়েন্সার পরিবার

প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্ষতি করতে বিদেশ থেকে সাইবার হামলা, কিছু আইএসপিকে শনাক্ত করেছে সরকার

সাপের ছোবল খেয়ে সাপসহ হাসপাতালে নারী

গাংনীতে কাঠমিস্ত্রির মরদেহ উদ্ধার

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ