Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

দক্ষিণপন্থীদের কবজায় বাংলাদেশের রাজনীতি: বদরুদ্দীন উমর

লেখক, গবেষক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর। ফাইল ছবি

বদরুদ্দীন উমর লেখক, গবেষক ও বামপন্থী রাজনীতিক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি পান। দেশে ফিরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। পরবর্তীকালে সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি ও সংস্কৃতি পত্রিকার সম্পাদক। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

আজকের পত্রিকা: অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। এ সরকার কি আদৌ সংস্কার কার্যক্রমে সফল হতে পারবে?

বদরুদ্দীন উমর: সংস্কারের কথা অনেক বলা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। তারা কী সংস্কার করতে চায়—এ বিষয়ে তো পরিষ্কার কিছু বোঝা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রশাসন, অর্থনীতি, শিক্ষাসহ হাজারো রকম সংস্কারের দরকার আছে। এখন হাজার রকম সংস্কারের সাগরের মধ্যে পড়ে সরকার হাবুডুবু খাচ্ছে। নির্দিষ্টভাবে সরকার বলেছে না যে তারা কোথায় কোথায় সংস্কার চায়। এর মধ্যে তারা অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছে। তারা তাদের রিপোর্টও জমা দিয়েছে। কিন্তু এগুলো থেকে তারা কয়টির সংস্কার করতে পারবে, সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই।

তারা যেসব সংস্কার কমিশন করেছে, তার কিছু ভালো দিক থাকতে পারে। এ দেশের জন্য এখন কী কী করণীয়? সেটা এসব কমিশন থেকে বোঝার কথা। এখন করণীয় দুভাবে—তাৎক্ষণিকভাবে এবং দূরবর্তী করণীয় হতে পারে। দূরবর্তী করণীয় নিয়ে এ সরকারের কিছু করার নেই। এ সরকার অনির্বাচিত এবং অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এ জন্য তাদের সংস্কার নিয়ে দূরবর্তী করণীয় থাকতে পারে না। তাই হাতের কাছে যেসব করণীয়, সেগুলোই তারা করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো নির্বাচন করা। তার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কার তারা করতে পারে। আমার কাছে মনে হয়, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার ছাড়া অন্য কোনো সংস্কার তাদের দ্বারা সম্ভব না। আর সেই সংস্কার করলেও সেটা টেকসই কিছু হবে না। কারণ, এ সরকার যেটা করবে, পরবর্তী সরকার সেটা পাল্টে দিতে পারে।

আজকের পত্রিকা: এখন তাহলে করণীয় কী?

বদরুদ্দীন উমর: এখন উপদেষ্টারা নানা ধরনের কথা বলছেন। এটা করব, সেটা করব, ওমুক করব, তমুক করব। কিন্তু এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? সেদিকে তাকালে দেখা যাবে, খুব সামান্য কিছু কাজ হয়েছে। তবে তারা ব্যাংকিং সেক্টরে ভালো নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছে। কিন্তু অন্য সব সংস্কারের ক্ষেত্রে কিছু পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

প্রশাসনে অনেক কিছু ঘটছে, তাতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। যেমন—এখানে আওয়ামী লীগের লোকেরা বিদেশে চলে যাচ্ছে নাকের ডগায়। চলে যাওয়ার পর হইচই করা হচ্ছে, কীভাবে চলে যাচ্ছে? চলে যাওয়ার পর তদন্ত করা হচ্ছে। চলে যাওয়ার পর তো তদন্ত করে কী লাভ হয়?

এরপর শিক্ষাব্যবস্থা একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো কমিশনই তারা করেনি। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ছাত্ররা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিল, কিন্তু তারাও বলল না, কেন শিক্ষা কমিশন করা হলো না।

তবে এ সরকারের ভালো ইচ্ছা আছে সংস্কার নিয়ে। কিন্তু তার জন্য প্রশাসনে শক্ত অবস্থান থাকা দরকার। তারা সব সংস্কারের রিপোর্টের ভিত্তিতে যে কাজ করতে পারবে, তার কোনো কারণ নেই। আর সব সংস্কার বাস্তবায়ন করার দায়িত্বও তো তাদের না। তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, দেশে যাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি না হয়। তারা সে কাজটি প্রথম দিকে ভালোভাবে করেছে। তারপর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করা তো তাদের কাজ নয়।

আজকের পত্রিকা: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো নিয়ে বিএনপি, বাম, জামায়াত ও নবগঠিত এনসিপির মধ্যে মতভিন্নতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে আদৌ কোনো সংস্কার কি হবে?

বদরুদ্দীন উমর: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিভিন্ন পার্টি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে কিছু ভালো প্রস্তাবও আছে। কিন্তু এসব নিয়ে যে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে, সেটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। একেকটা দলের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। আর সেটা হয়েছে শ্রেণির রাজনীতির ভিত্তিতে। দলগুলো তাদের ভিন্নতা নিয়ে যে ঐকমত্যে পৌঁছাবে, সেটার তো কারণ নেই। যেভাবে এখন আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পার্থক্য নিয়ে—এই পার্থক্যগুলোর নিরসনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষেও দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ নিরসন করা সম্ভব না। কাজেই এটা একটা অচল অবস্থা তৈরি করেছে। এই অচলাবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তাদের উচিত হবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

আজকের পত্রিকা: বিএনপির একমাত্র দাবি হচ্ছে তাড়াতাড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠানের। তারা কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস দেখছে কি?

বদরুদ্দীন উমর: এখানে দেখা যাবে জামায়াতে ইসলামী, অন্যান্য ইসলামি দল ও এনসিপি আরও অনেক পরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষপাতী। তারা বলছে আগে সংস্কার, তারপরে নির্বাচন। এটা একটা স্টুপিড কথা। দেশে হাজার রকম সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কোন সংস্কার করার পর নির্বাচন হওয়া দরকার, সেটা তো তারা বলছে না। আর নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের কিসের সম্পর্ক? সংস্কার একটা ধারাবাহিক ব্যাপার। সংস্কার চলতেই থাকবে।

যারা সংস্কারে বেশি জোর দিচ্ছে, তাদের অবস্থা হচ্ছে, জামায়াত নিজেদের আরও গুছিয়ে নিতে চাচ্ছে নির্বাচনের জন্য। ছাত্রদের দলও নতুন। নির্বাচন করার জন্য দেশের মধ্যে যে একটা অবস্থান তৈরি করতে হয়, সেটা তাদের নেই। তারা নির্বাচনমুখী দেশের অন্য বিষয়ে কথা না বলে তারা নির্বাচনের কথাই বলছে। কিন্তু নির্বাচন করার মতো তাদের কোনো সাংগঠনিক অবস্থান নেই। তাই সাংগঠনিক অবস্থা তৈরি করার জন্য তাদের সময় দরকার। সে জন্য তারা নির্বাচন পেছানোর কথা বলছে।

অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচন করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। দেশের এখন সবচেয়ে সংগঠিত ও জনপ্রিয় সংগঠন বলা যেতে পারে বিএনপিকে। নির্বাচন হলে তারাই যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই তারা তাড়াতাড়ি নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছে।

আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি জনগণের চাওয়া-পাওয়া কতটুকু পূরণ করতে পারবে বলে মনে করেন?

বদরুদ্দীন উমর: জনগণের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে তো এদের কোনো সম্পর্ক দেখছি না। এখন পর্যন্ত তারা যে কর্মসূচি দিয়েছে বা যেসব কাজকর্ম করছে, তার সঙ্গে জনগণ বা কোনো শ্রমজীবী মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। এখন পর্যন্ত তো তারা তাদের কর্মসূচিতে শ্রমিক, কৃষকের দাবিদাওয়ার কথাই বলছে না। কিছুই নেই।

তারা গঠিত হওয়ার পর কোনো জনসভা করেনি ঢাকায়। একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা ইফতার পার্টি করেছে। তারা এমনভাবে কাজ করছে, তাতে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা সাংগঠনিক কিছু ছোটখাটো জমায়েত করছে। কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত একটাও জনসভা করেনি। তারা ছাত্র। তারা পার্টি গঠন করেই ক্ষমতায় যেতে চায়। এ-ও তো আশ্চর্য ব্যাপার। তারা অভ্যুত্থানের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তাদের চরিত্রের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। অভ্যুত্থানের সময় তো তাদের কিছুই ছিল না। এখন তো দেখা যাচ্ছে, তাদের রমরমা অবস্থা।

অভ্যুত্থানের সময় তাদের কাছে কোনো টাকাপয়সা ছিল না। এখন তাদের মধ্যে কোটি কোটি টাকার খেলা চলছে। এত টাকা তারা কীভাবে খরচ করছে এবং এই টাকা কোথা থেকে আসছে এবং কে দিচ্ছে? এর হিসাব তো তারা দিচ্ছে না। এখানে তো কোনো স্বচ্ছতা দেখা যাচ্ছে না। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এখানকার সব শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীরা তাদের টাকা দিচ্ছে। কাদের টাকায় একটা সংগঠন চলছে, যাকে বলে মস্ত বড় একটা নিশানা তাদের চরিত্রের। যারা সংগঠিত হয়ে এ রকম শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। শুধু যে সাংগঠনিক কাজে খরচ করছে, তা-ই নয়। দেখা গেল এদের এক নেতা শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে তার এলাকায় গেছে। সে নাকি প্রায় ছয় লাখ টাকা খরচ করেছে এ রকম শোডাউন দেওয়ার জন্য। এটা কি তামাশা নয় কি? সে আবার বলেছে, তার পরিবারের লোক এ টাকা দিয়েছে। এটা কি অ্যাবসার্ড কথাবার্তা নয় কি? এসব তো ভয়াবহ দুর্নীতির লক্ষণ। টাকা এভাবে এনে তারা শুধু সাংগঠনিক কাজে ব্যয় করছে না, ব্যক্তিগতভাবে অর্থে হাত লাগাচ্ছে।

তাহলে জনগণের চাওয়া-পাওয়া বলতে যা বোঝায়, তা নিয়ে তারা তো কোনো ম্যানিফেস্টো বা কর্মসূচি দেয়নি। তাদের যে নীতিগত অবস্থান কী, সেটাও তারা সেভাবে ব্যাখ্যা করেনি। যারা জনগণের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারবে, যারা জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধি। কিন্তু এরা তো জনগণের পক্ষে কোনো কথাই বলছে না। এরা শুধু সংস্কারের কথা বলছে।

আজকের পত্রিকা: তাদের ভবিষ্যৎ কী?

বদরুদ্দীন উমর: তারা হয়তো মনে করছে, নির্বাচনে বড় ধরনের সাফল্য পাবে। কিন্তু এভাবে তাদের ভাবা একটা অজ্ঞতার মতো ভাবনা এবং মূর্খতার একটা দিক। তারা একটা ছাত্রসংগঠন হিসেবে জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু নির্বাচন হলো অন্য ব্যাপার। নির্বাচন করতে গেলে এলাকায় যে ধরনের অবস্থান থাকা দরকার, নানা রকম সম্পর্ক থাকা দরকার—এগুলো ছাড়া যে কোনো নির্বাচনে জেতা সম্ভব নয়। এদের এসবের কিছুই নেই। আমার মনে হয়, এরা নির্বাচনে দাঁড়ালে অন্য কোনো পার্টির সঙ্গে জোট করে নির্বাচন না করে এককভাবে নির্বাচন করে সারা দেশে একটা আসনও পাবে না। একটা আসন পাওয়ার কোনো কারণ দেখি না। কিন্তু তারা নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে।

এর থেকে বোঝা যায়, এদের যে রাজনীতি বোঝার প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং রাজনীতি বোঝার যে সামান্য দৃষ্টিভঙ্গি—সেসবও তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। মানে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য তারা উন্মাদ হয়ে গেছে। হাতে কোটি কোটি টাকা আসায় তাদের যে চরিত্র অভ্যুত্থানের সময় ছিল, সেটার আমূল পরিবর্তন হওয়ার কারণে তাদের এই অবস্থা হয়েছে। এদিক দিয়ে দেখলে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। জনগণকে তারা কিছু দিতে চায় না।

আজকের পত্রিকা: টিএনজেড গ্রুপের গার্মেন্টস শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করার কথা থাকলেও তা এখনো করা হয়নি। বরং প্রতিশ্রুতি ভাঙার প্রতিবাদে আন্দোলন করার কারণে সম্প্রতি শ্রমিক নেতৃবৃন্দের ওপর পুলিশ হামলা করেছে। তাহলে এ সরকারকে কি শ্রমিকবান্ধব বলা যাবে?

বদরুদ্দীন উমর: আমি বিভিন্ন সময় বলেছি, এ সরকার তো আকাশ থেকে পড়েনি। এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে আগস্ট মাসের আন্দোলনের পরে শূন্যতা পূরণ করার জন্য। কিন্তু এ সরকারকেও কাজ করতে হচ্ছে একটা কাঠামোর মধ্যে। এখানকার প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতির মধ্য থেকে কাজ করতে হচ্ছে। এই দেশে একটা শাসকশ্রেণি আছে। কারা এই শাসকশ্রেণি? ১৯৭২ সাল থেকে এখানে একটা ব্যবসায়ী শ্রেণি শাসকশ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। সেই শ্রেণিই গত ৫৫ বছরে ফুলে-ফেঁপে ফুঁসে ওঠে শেখ হাসিনার শাসনামলে অক্টোপাসের মতো সমাজের সবকিছুতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। শেখ হাসিনা চলে গেছে কিন্তু এই শাসক ও ব্যবসায়ী শ্রেণি তো দেশে রয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, এ দেশের যে প্রশাসন ব্যবস্থা, তাতেও তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যেমন দেখা যাবে, আওয়ামী লীগ চলে গেলেও তাদের লোক এখানে ব্যাপক মাত্রায় রয়ে গেছে। পুলিশ, সামরিক বাহিনীসহ সর্বত্র রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ এই গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করত। তেমনি ইউনূসের সরকারও শ্রমিকদের কোনো দাবিদাওয়া মানছে না। আগেও যেমন চা-শ্রমিকসহ গার্মেন্টস শ্রমিকদের ওপর হামলা করা হতো। সে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে এ সরকারের শ্রেণিগত তেমন পার্থক্য নেই। এ কারণে এ সরকারকে শিল্পমালিক, ব্যবসায়িক শ্রেণির স্বার্থের কাঠামোর মধ্য থেকে কাজ করতে হচ্ছে। এই সরকারও মালিকদের সরকার। কাজেই মালিকদের সরকার হিসেবে মালিকদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে শ্রমিকেরা দাবিদাওয়া পেশ করছে, তাতে তাদের প্রতি দরদ থাকার কোনো প্রশ্ন থাকার কথা না; বরং মালিকদের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের দমন করাই তাদের কাজ। সেই দমন করার কাজটাই এরা করছে। কেউ যদি মনে করে, বর্তমান সরকার জনগণের সরকার এবং সর্বস্তরের জনগণের জন্য কাজ করবে—সেটা হবে মূর্খতার শামিল। দেশের পরিস্থিতি বুঝতে হবে, দেশের শাসনব্যবস্থা বুঝতে হবে, দেশের শাসকশ্রেণির চরিত্র বুঝতে হবে এবং এদের সমর্থন ছাড়া যে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব নয়, সেটাও বুঝতে হবে। আর দেশের ব্যবসায়ী ও শাসকশ্রেণি যদি মনে করে, এ সরকারকে ফেলে দিতে হবে অন্য যত ধরনের সাপোর্ট থাকুক না কেন, তারা ফেলে দেবেই। কাজেই এদের অনেক ধরনের লম্বা-চওড়া কথা বলার পরেও এই শাসকশ্রেণির পক্ষে কাজ করতে হচ্ছে। এবং এই কাজ করতে গিয়েই তারা শ্রমিকদের সব ধরনের দাবিদাওয়া উপেক্ষা করছে। আন্দোলন করলে শ্রমিকদের মারপিট করছে। এটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার, এটাই বাস্তব। এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা করা ঠিক নয়।

আজকের পত্রিকা: সরকার আইন না করে চাপে পড়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। চাপের মুখে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা ভালো ফল বয়ে আনে না। কারও চাপে নয়, বরং সিদ্ধান্তগুলো হওয়া উচিত জনগণের প্রত্যাশা ও আইন বুঝে। আপনার মতামত কী?

বদরুদ্দীন উমর: আওয়ামী লীগ দল ও সরকার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিল। ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়ার পরেও তাদের সক্রিয়তা তো চলছে। এটার একটা বড় কারণ হচ্ছে, ভারত সরকার আওয়ামী লীগকে এখনো সাহায্য করছে। মুসলিম লীগ ১৯৫৪ সালে উৎখাত হওয়ার পর তাদের ভারতের মতো দেশ ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ উৎখাত হওয়ার পরে ভারত সরকার এখনো তাদের প্রতি সাহায্যকারী হয়ে রয়েছে। তারা শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। শেখ হাসিনা সেখান থেকে যে নানা রকম উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে এবং টেলিফোনের মাধ্যমে তার নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দিচ্ছে। এভাবে তারা শেখ হাসিনাকে শুধু আশ্রয় নয়, প্রশ্রয়ও দিচ্ছে।

দেশে আওয়ামী লীগের সে রকম প্রকাশ্য সক্রিয়তা না থাকলেও তারা তো কোনোভাবেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। আওয়ামী লীগের লোকজন সুযোগ বুঝে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করার সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

কিন্তু তারা এসব কাজ করার সুযোগ খুঁজলেও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা ঠিক হয়নি। দলটি ভারত সরকারের সহযোগিতায় যতই ফিরে আসার সুযোগ বা অন্তর্ঘাতমূলক অপতৎপরতা খুঁজুক, তাদের কিন্তু শিগগির জনগণের মধ্যে আবার কাজ করার বিশেষ ক্ষমতা নেই। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো ছিল। তারা তাদের কাজ করে যেতে পারে, যতটা পারে। এই অবস্থায় তারা বেশি দূর অগ্রসর হওয়ার মতো অবস্থায় নেই। কিন্তু তাদেরকে নিষিদ্ধ করার কারণে জনগণ তাদের প্রতি সমবেদনা দেখানোর সুযোগ পাবে। তারা এই সুযোগে কাজ করারও সুযোগ পাবে। একটা পার্টিকে নিষিদ্ধ করলেই দুর্বল হয়ে যায় না। আওয়ামী লীগ জামায়াতকে তো নিষিদ্ধ করেছিল এবং বিভিন্ন সময় অন্য অনেক দলকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু জামায়াত ভেতরে ভেতরে অনেক কাজ করেছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলেও তাদের লোক তো সর্বত্র রয়েছে। এ কারণে তাদের সক্রিয়তা কোনোভাবেই কমবে না; বরং নিষিদ্ধের কারণে তাদের কাজ করার আরও সুবিধা হবে। জনগণের সমর্থনও তারা পাবে হয়তো, যেটা নিষিদ্ধ না হলে পেত না। তাই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা কোনোভাবেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া হয়নি। এটার মধ্য দিয়ে বরঞ্চ আওয়ামী লীগকে সাহায্য করাই হয়েছে।

আজকের পত্রিকা: আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে না কেন?

বদরুদ্দীন উমর: এখানে বলা যেতে পারে, অভ্যুত্থানের পরে অনেকে মনে করেছিল, সারা দেশে বামপন্থী শক্তির উত্থান ঘটবে। তাদের কার্যক্রম আরও বাড়বে। সে রকম কিছুই হয়নি। এখানে অভ্যুত্থান-পরবর্তী পর্যায়ে বামপন্থী দলগুলোর বিশেষভাবে কাজ নেই। কিন্তু বিশেষ করে দক্ষিণপন্থীরা এখানে সামনে এসেছে। দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে অগ্রসর এবং সবচেয়ে দুষ্ট প্রকৃতির দল। এরাই বেশি এখন তৎপর। সে কারণে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করে কোনো লাভ হবে না। এই পার্টি শক্তিশালী হওয়ার কারণে তাকে নিষিদ্ধ করলে দেশে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

আজকের পত্রিকা: কিছুদিন আগে হেফাজতে ইসলাম নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সম্পূর্ণভাবে বিরোধিতা করেছে এবং এ কমিটির নারী সদস্যদের ‘বেশ্যা’ বলে গালিগালাজ করেছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

বদরুদ্দীন উমর: পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অল্পবিস্তর আছে। আমাদের দেশে নারীবিদ্বেষ বিশেষভাবে আছে। এটা হিন্দুধর্মের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে আছে। মনুসংহিতায় নানা বিষোদ্‌গার করে নারীদের শত্রু ভাবা হয়েছে। হিন্দুশাস্ত্রে একজন পুরুষ অসংখ্য বিয়ে করতে পারে। কিন্তু একজন নারী একটার বেশি বিয়ে তো করতেই পারে না। বিধবা হয়ে গেলে আর বিয়ে করা সম্ভব হয় না। বিধবা হওয়ার পর নানা ধরনের অত্যাচার চলে। যেমন—এটা যাওয়া যাবে না, এটা-ওটা করা যাবে না। পঞ্চাশ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। আবার পৈতৃক কোনো সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার নেই নারীদের।

ইসলামের মধ্যেও তা-ই। তুলনামূলকভাবে কিছু অধিকার দেওয়া থাকলেও নানা ধরনের বিধিনিষেধ আছে। ইসলামে ছেলে-মেয়ে সম্পত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে দুই নিয়ম। মেয়েরা ছেলেদের থেকে অর্ধেক সম্পত্তি পায়। এই ধরনের যে পার্থক্য যেসব দেশে থাকে, সেটা তো অবশ্যই পশ্চাৎপদ দেশ। আর যারা এ ধরনের বিষয় নিয়ে দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে, তাদের তো আধুনিক ভাষায় বর্বর ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এই যে হেফাজতে ইসলাম এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যারা কট্টরপন্থী আছে, তারা তো বর্বর ছাড়া কিছুই নয়। এ রকম বর্বরতা বিভিন্ন দেশে এখনো আছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্বরতা আছে। এ রকম বর্বরতার ধরন একেক দেশে একেক রকম। আমাদের দেশে বর্বরতার যেসব অপকর্ম হয়, তার শিক্ষা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকেই আসে। ইসলামের স্বার্থরক্ষাকারী বা ইসলামি পণ্ডিত দাবিদার যেসব লোক আছে, তারা ইসলামের নামে নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়। তারা তো ইসলামকে একটা পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম হিসেবে রক্ষা করে চলছে। তাই হেফাজতে ইসলাম হলো জামায়াতে ইসলামীর চেয়েও খারাপ। জামায়াতে ইসলামীর চেয়েও এরা একটা বর্বর সংগঠন।

নারী সংস্কার কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, নারী-পুরুষের সম্পত্তিতে যে সমান অধিকারের কথা বলেছে, তার বিরুদ্ধে তারা দাঁড়িয়েছে। তাই এখানে ইসলাম নয়, সম্পত্তির স্বার্থের বিষয়টা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারা এত বর্বর এবং নোংরা মানসিকতার যে নারী সংস্কার কমিশনের সদস্যদের তারা বেশ্যা বলেছে। এটা তো কুৎসিত সংস্কৃতির ধারক-বাহক ছাড়া কেউ এভাবে নারীদের নিয়ে এ ধরনের কথা উচ্চারণ করতে পারে না। তাই এরা সংস্কৃতির মাপকাঠিতেও নীচু মনের মানুষ। আসলে এদের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষার কোনো ব্যাপার নেই। এরা আবার এ দেশের সম্পদশালী গোষ্ঠীরই প্রতিনিধি। এ জন্যই তারা নারীদের অধিকারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। এসব ঘটনা শুধু আজকে হচ্ছে না। যখন থেকে নারীরা তাদের দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে, তখন থেকেই কিন্তু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করে আসছে।

আজকের পত্রিকা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিলতার দিকে যাচ্ছে বলে কেউ কেউ বলছেন। আপনার কাছে কী মনে হচ্ছে?

বদরুদ্দীন উমর: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিলতার চেয়ে ঘোলাটে হয়ে গেছে। নানা ধরনের স্বার্থ এখানে মাথাচাড়া দিচ্ছে। এখানে যেহেতু একটা অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, তারা একটা নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকার কারণে সব সংগঠনের সঙ্গে ডিল করতে পারছে না। শুধু বামপন্থী দলগুলোর তেমন কোনো সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না চোখে পড়ার মতো। এই অবস্থায় দেশে দক্ষিণপন্থীদেরই রাজত্ব চলছে। দক্ষিণপন্থীরাই বাংলাদেশের রাজনীতিকে কবজা করে রেখেছে। এটা একটা বড় বিস্ময়কর ব্যাপার। আগস্টের অভ্যুত্থানের পরে এখানে জনগণের প্রকৃত শক্তির আবির্ভাব ঘটেনি। সে জন্য শিক্ষার্থীদের দলটি গঠিত হওয়ার পরেও দলটির বামপন্থী কোনো পরিচয় নেই। তারা বলেছে, আমরা বামপন্থীও না, দক্ষিণপন্থীও না—আমরা মধ্যপন্থী। আসলে মধ্যপন্থী বলে কিছু নেই। আসলে তাদের যে কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে, তাতে এদেরকে দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল বলে আখ্যায়িত করতে হবে।

এই অবস্থায় ঘোলাটে পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বের হওয়া যাবে, সে রকম কোনো পথনির্দেশও এ সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। কাজেই এ সরকারের পক্ষে এখন যেটা দরকার, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তাহলে কিন্তু ঘোলাটে পরিস্থিতি থাকবে না।

(মতামত সাক্ষাৎকারদাতার নিজস্ব)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সেনানিবাস ঘিরে ‘নাশকতার পরিকল্পনা’, বরখাস্ত সৈনিকসহ গ্রেপ্তার ৩

বাংলাদেশ এড়িয়ে সমুদ্রপথে সেভেন সিস্টার্সকে যুক্ত করতে নতুন প্রকল্প ভারতের

থাইল্যান্ডে পর্যটন ভিসা পেতে আর্থিক সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে

দক্ষিণপন্থীদের কবজায় বাংলাদেশের রাজনীতি: বদরুদ্দীন উমর

এবার প্রশাসনিক কাজে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত কুয়েট শিক্ষক সমিতির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত