Ajker Patrika

ছাগল কেনা থেকে অস্ত্র সরবরাহ, আফগান যুদ্ধে ঠিকাদারি ব্যবসায় রমরমা

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১১: ১৮
ছাগল কেনা থেকে অস্ত্র সরবরাহ, আফগান যুদ্ধে ঠিকাদারি ব্যবসায় রমরমা

মার্কিন বাহিনীর আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তান ত্যাগের মুহূর্তেই তালেবানদের কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে যুদ্ধ। দীর্ঘ দুই দশকের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কারা লাভবান হলো তা নিয়ে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। নিবন্ধটিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে এই যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামিয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছে বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। 

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হারালেও বেশ কয়েকটি বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুই দশকের এই যুদ্ধ থেকে বেশ লাভবান হয়েছে। অস্ত্র প্রস্তুতকারক থেকে শুরু করে উদ্যোক্তাসহ অনেকেই মোটা অঙ্কের অর্থ কামিয়েছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার এক ব্যবসায়ী কিরগিজস্তানে একটি বার চালাতেন। পরে নামেন জ্বালানি ব্যবসায়। আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু হলে ঠিকাদারি ব্যবসায় নামেন। এই ঠিকাদারি থেকেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন। একজন তরুণ আফগান অনুবাদক মার্কিন বাহিনীকে বিছানার চাদর সরবরাহ করার কাজ পেয়েছিলেন। রাতারাতি টাকার গাছ হয়ে যান। এরপর টিভি স্টেশন, অভ্যন্তরীণ এয়ারলাইনসহ বাণিজ্যের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। ওহাইও থেকে দুজন আর্মি ন্যাশনাল গার্ডসম্যান একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেন। তাঁরা মার্কিন সামরিক বাহিনীকে আফগান দোভাষী সরবরাহের কাজ শুরু করেন। এরপর তাঁরা সেনাবাহিনীর শীর্ষ ঠিকাদার হয়ে ওঠেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বেশ কয়েকটি চুক্তি থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন।

আফগানিস্তান ছেড়ে আসার চার মাস পর যুক্তরাষ্ট্র সামগ্রিক বিষয়ের মূল্যায়ন করছে। কিছু কর্মকর্তা ও পর্যবেক্ষকের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রে ঠিকাদারদের ওপর নির্ভরশীলতা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ পরিচালনার ব্যয় বাড়িয়েছে। 

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ভবনে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সেনা প্রত্যাহারের আগে পর্যন্ত এই যুদ্ধে ব্যয় হয়েছে ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। মূলত ঠিকাদারদের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে এই বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধ যত সম্প্রসারিত ও দীর্ঘায়িত হয়েছে, ততই লাভবান হয়েছে ঠিকাদারেরা। 

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্টস অব ওয়ার প্রজেক্টের হিসাব অনুসারে, যুদ্ধের মোট ব্যয়ের তিন ভাগের এক ভাগ বা অর্ধেকই গেছে ঠিকাদারদের পকেটে। অস্ত্র, রসদ সরবরাহ এবং অন্যান্য পরিষেবায় সিংহভাগ (২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার) গেছে পাঁচ বেসরকারি প্রতিরক্ষা কোম্পানির কাছে। কোম্পানিগুলো হলো—লকহিড মার্টিন করপোরেশন, বোয়িং কোম্পানি, জেনারেল ডাইনামিকস করপোরেশন, রেথিয়ন টেকনোলজিস করপোরেশন এবং নর্থরপ গ্রুম্যান করপোরেশন। 

শুধু যে বড় ঠিকাদার কোম্পানিই অর্থ বাগিয়ে নিয়েছে এমনটি নয়। ছোট ছোট অনেক কোম্পানিও লাভবান হয়েছে। আফগান পুলিশ অফিসারদের প্রশিক্ষণ, রাস্তা নির্মাণ, পশ্চিমা কূটনীতিকদের নিরাপত্তা প্রদানসহ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামিয়েছে।

গত দুই দশকে পর্যায়ক্রমে যুক্তরাষ্ট্র শাসন করেছে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা। দুই দলই ক্ষমতায় থাকার সময় যুদ্ধ পরিচালনায় ঠিকাদারদের ওপরই নির্ভর করেছে। মূলত ঠিকাদারদের ব্যবহার করে মার্কিন সেনা হতাহতের সংখ্যা কম রাখাই ছিল উদ্দেশ্য। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা এমনটিই জানিয়েছেন। 

ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ সময়ে ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ক্রিস্টোফার মিলার বলেছেন, ‘আপনি যখন অপারেশনে যাবেন, তখন কাজ করানোর জন্য আপনাকে ঠিকাদারদের মাধ্যমে অনেক বেশি আউটসোর্স করতে হবে।’

আফগানিস্তান পুনর্গঠনে এযাবৎ ১৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। তবে বহু প্রতিবেদনে অপচয় এবং জালিয়াতির কথা উঠে এসেছে। ২০২১ সালে পাওয়া সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন প্রজেক্টের মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার নতুন রাস্তা, হাসপাতাল, ব্রিজ ও কারখানা নির্মাণের কাজে ব্যয় করা হয়েছে, যা মোট প্রজেক্টের মাত্র ১৫ শতাংশ। কমপক্ষে ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার জঙ্গিবিমান, পুলিশ কার্যালয়, কৃষি কর্মসূচি এবং অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে।

আফগানিস্তানে তৈরি কাশ্মীরি শালের বাজার সম্প্রসারণে ৯টি ইতালীয় ছাগল আমদানি করে পেন্টাগন। এই প্রকল্পে খরচ করা হয় ৬ মিলিয়ন ডলার!

পেন্টাগন যুদ্ধ পরিচালনায় সব সময় ঠিকাদারদের ওপরই নির্ভর করেছেইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট আফগানিস্তানে ১ হাজার ২০০ মাইল রাস্তা নির্মাণের জন্য একটি কোম্পানিকে ২৭০ মিলিয়ন ডলার দেয়। ইউএসএআইডি বলছে, কোম্পানিটি তিন বছর কাজ করে মাত্র ১০০ মাইল রাস্তা করতে সক্ষম হয়। সেখানে বিদ্রোহীদের হামলায় ১২৫ জন নিহতের ঘটনা ঘটে। অসমাপ্ত অবস্থায় প্রকল্পটি বাতিল হয়। 

পেন্টাগনের মুখপাত্র মেজর রব লোডেউইক বলেছেন, ‘আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক মিশনে হাজার হাজার ঠিকাদারি কোম্পানির অংশগ্রহণ ছিল। এটি মার্কিন সেনাদের মুক্ত করার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’

২০১২ সাল থেকে আফগানিস্তান পুনর্গঠনে বিশেষ মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন জন সোপকো। তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন সার্বিক পরিস্থিতি। বছরের পর বছর ধরে ঠিকাদারদের ব্যর্থতা নথিভুক্ত করেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘ঠিকাদারদের অনেকেই প্রত্যাশা পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করেছে। কিন্তু নীতিনির্ধারক পর্যায়েই ভুল ছিল।’

জন সোপকো বলেন, ‘কিছু ঠিকাদার কোম্পানি বিপুল অর্থ কামিয়েছে। এটিই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা।’

উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ১ লাখ ৮৭ হাজার ৯০০ জন সেনা ছিলেন এবং ২ লাখ ৩ হাজার ৬৬০ জন ছিলেন ঠিকাদারি কর্মী। ঠিকাদার ও সৈন্যের অনুপাত ক্রমশ বেড়েছে। বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদে যখন বেশির ভাগ মার্কিন সেনা ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়, তখনো আফগানিস্তানে ২৬ হাজার ঠিকাদার ছিলেন। আর সৈন্য ছিলেন ৯ হাজার ৮০০। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের শেষ সময়ে আফগানিস্তানে সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৫০০ জনে। অন্যদিকে ঠিকাদারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮ হাজার। 

কস্টস অব ওয়ার প্রজেক্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার হেইডি পেল্টিয়ার বলেছেন, ‘হোয়াইট হাউসে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যে-ই ক্ষমতায় এসেছে, ঠিকাদার ইস্যুতে নীতি একই ছিল। ঠিকাদার বেড়েছে আর বেড়েছে।’

শ্রমদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আফগানিস্তান এবং ইরাক যুদ্ধে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোক নিহত হয়েছেন সাড়ে ৩ হাজারের বেশি। অন্যদিকে দুই দশকের যুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৭ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পদত্যাগ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

পাগল বেশে রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা কন্টেন্ট ক্রিয়েটর সম্পর্কে যা জানা গেল

প্রধান উপদেষ্টার নতুন বিশেষ সহকারী কে এই আনিসুজ্জামান চৌধুরী

সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জাতিসংঘের ফলকার তুর্কের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাল আইএসপিআর

হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের উপাধ্যক্ষকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত