Ajker Patrika

যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যাওয়া মেনডোজা পরিবারের গল্প

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১০ জুলাই ২০২৫, ২২: ৫১
গত ২৮ জুন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকো চলে যায় মেনডোজা পরিবার। ছবি: সিএনএন
গত ২৮ জুন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকো চলে যায় মেনডোজা পরিবার। ছবি: সিএনএন

সাশা ও হুলিও মেনডোজা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা আর যুক্তরাষ্ট্রে থাকবেন না। তিনটি ছোট সন্তানসহ পরিবার নিয়ে তাঁরা স্থায়ীভাবে মেক্সিকো চলে যাচ্ছেন। এই সিদ্ধান্ত তাঁদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তগুলোর একটি।

হুলিওর জন্ম মেক্সিকোয়। মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিলেন। গন্তব্য ছিল পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গ শহর। কারণ, সেখানেই তাঁর বাবা-মা আগে থেকে বাস করছিলেন।

প্রথমবার পিটসবার্গ শহরটির উঁচু ভবনগুলো দেখে হুলিওর মনে হয়েছিল—এই তো সেই স্বপ্ন, যেটির জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। তাঁর চোখে এটি ছিল ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর মূর্ত রূপ।

কিন্তু সেই স্বপ্ন ধীরে ধীরে হুলিওর নাগালের বাইরে চলে যেতে শুরু করে। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর কাছে কোনো বৈধ কাগজ নেই—তাঁর উপস্থিতি এই দেশে অবৈধ। কৈশোরে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে গেলে তাঁর পরিচয়-সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। তিনি চিকিৎসা নিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাধ্য হন সেই পথ ত্যাগ করতে। এরপর তিনি নির্মাণশিল্পে কাজ শুরু করেন। তবে পিটসবার্গের প্রতি ভালোবাসা তাঁর হৃদয়জুড়ে ছিল। তিনি স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি শিখতে শুরু করেন, কিনে আনেন ‘পিটসবার্গিয়ান ভাষা’ শেখার বই। স্থানীয় স্টিলার্স ফুটবল টিমের বড় ভক্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘ম্যাক্সিকান ইনজার’।

২০১৮ সালে হুলিওর জীবনে আসেন ২৩ বছর বয়সী সাশা। এক বন্ধুর মাধ্যমে তাঁদের দেখা হয়। হুলিওকে দেখে সাশার মনে হয়েছিল—তাঁর মধ্যে আলাদা কিছু একটা আছে। জমে ওঠে প্রেম। প্রথম ডেটেই স্টিলার্সের জার্সি পরে হাজির হয়েছিলেন হুলিও। সাশা হাসতে হাসতে বলেন, ‘ও যেন পুরোপুরি পিটসবার্গিয়ান। তার পরিচয় নিয়ে তখনো খোলাখুলি কোনো আলোচনা করিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝে গিয়েছিলাম—ও এখানে অবৈধ!’

প্রেমের সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। তাঁরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন, বিয়ে করেন এবং তিনটি সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানদের বয়স এখন যথাক্রমে ৮, ৫ ও ৪ বছর। তাঁদের দাম্পত্যজীবন ছিল ভালোবাসা ও সংগ্রামের এক মিশ্র রূপ। যুক্তরাষ্ট্রে একটি ‘মিশ্র জাতীয়তার’ পরিবার হিসেবে বেঁচে থাকা সহজ ছিল না। কারণ, সাশা ও সন্তানেরা মার্কিন নাগরিক হলেও হুলিও ছিলেন অনিবন্ধিত অভিবাসী।

যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যাওয়ার আগে সিএনএনকে নিজেদের গল্পটি বলে যান সাশা ও হুলিও। ছবি: সিএনএন
যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যাওয়ার আগে সিএনএনকে নিজেদের গল্পটি বলে যান সাশা ও হুলিও। ছবি: সিএনএন

তাঁরা অনেক অভিবাসন আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু হুলিওর নাগরিকত্ব পাওয়ার সহজ কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশ করা অভিবাসীদের জন্য নাগরিকত্ব পাওয়া অত্যন্ত কঠিন।

তবে এই কঠিন বাস্তবতার সঙ্গেই তাঁরা মানিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়া পরিস্থিতিকে পাল্টে দেয়। সাশা বলেন, ‘এটা এখন আর শুধু বিতাড়নের ভয় নয়। ভয়টা হলো, ও (হুলিও) কাজ থেকে ফিরে আসবে কি না, পুলিশ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাবে কি না, আমাদের সন্তানদের স্কুল থেকে কে নিয়ে যাবে! কিংবা যদি ওকে ধরা হয়, তাহলে হয়তো আমরা জানতেই পারব না কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

এদিকে হুলিওর ভয়টাও আরও বড় হয়ে দাঁড়ায়, যখন তিনি কিলমার গার্সিয়ার ঘটনাটি শুনলেন। যুক্তরাষ্ট্রে কিলমার একজন সালভাদরের অভিবাসী ছিলেন। তাঁকে ভুলবশত এক কুখ্যাত কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হুলিওর মতো কিলমারের স্ত্রীও একজন মার্কিন। হুলিও বলেন, ‘ওর (কিলমার) জায়গায় আমি নিজেকে দেখি।’

এমন রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির মধ্যেই সাশা এক দিন হুলিওকে বলেন, ‘চলো, আমরা মেক্সিকো চলে যাই।’ সাশার কথা শুনে হুলিও জবাব দেন—‘হ্যাঁ, এবার সময় হয়েছে।’

পরবর্তী ছয় মাসে তাঁরা পিটসবার্গে বাড়িঘর গুছিয়ে ফেলেন, ছোট ব্যবসাটি বন্ধ করেন, ইন্টারনেট ঘেঁটে মেক্সিকোয় বসবাসের খুঁটিনাটি শিখে নেন। সাশা বলেন, ‘টিকটকে আমি এমন এক দলের খোঁজ পেয়েছি, যারা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে গেছে। তারা শেয়ার করেছে—কীভাবে ইন্টারনেট সংযোগ নিতে হয়, বাসা খুঁজতে হয়, এমনকি মেক্সিকোয় বাসিন্দা হিসেবে কীভাবে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়।’

গত ২৮ জুন, মেনডোজা পরিবার ওয়ান-ওয়ে টিকিটে মেক্সিকো সিটির পথে রওনা হয়। পেছনে রেখে যায় জীবনের এক বড় অধ্যায়—বন্ধুবান্ধব, স্মৃতি, ও আমেরিকান ড্রিমের এক অপূর্ণ গল্প।

হুলিও বলেন, ‘এখানে থেকে যাওয়াটা জুয়া খেলার মতো হতো। আমার, আমার স্ত্রীর, আমার সন্তানদের জীবনের সঙ্গে খেলা। আমি আমার শিকড়ে ফিরে যাচ্ছি, আমার পরিবারের কাছে। এবার নিজের গল্পটা নিজে লিখব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত