Ajker Patrika

রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কেন চলছে ব্যাপক ধরপাকড়, কী চান পুতিন 

আপডেট : ০৩ জুন ২০২৪, ১২: ২৭
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কেন চলছে ব্যাপক ধরপাকড়, কী চান পুতিন 

ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। মূলত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে এই ধরপাকড় চলছে। তবে পরিশুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে এ ধরনের ধরপাকড় অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকা প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া এবং তার পরপরই ধরপাকড় চালানো স্বাভাবিক বিষয় নয়। 

পঞ্চম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর গত সপ্তাহে সরকারে বেশ রদবদল আনেন পুতিন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে বরখাস্ত করে তাঁর স্থলে একজন অর্থনীতিবিদকে নিয়োগ দেন তিনি। এর পরপরই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কথা বলে একে একে মন্ত্রণালয়ের পাঁচজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধরপাকড়ের এ ঘটনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে ভীতি ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। 

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে রদবদল ও ধরপাকড় যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি এর সময়টাও বেশ উল্লেখযোগ্য। ইউক্রেনে দুই বছর তিন মাস ধরে চলা যুদ্ধে রাশিয়া সুবিধাজনক অবস্থানে। সম্প্রতি উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে খারকিভের আশপাশে যে হামলা শুরু করেছে, তাতেও তারা প্রায় সফল। পূর্বের দনবাসেও রুশ বাহিনী জয় পাচ্ছে। 

বিপরীতে সেনা ও অস্ত্র-গোলাবারুদের সংকটে ধুঁকছে ইউক্রেন। এই সংকটের মূলে আছে ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদনের জন্য মার্কিন কংগ্রেসে কয়েক মাস ধরে আটকে থাকা। রাশিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ইউক্রেনের এই সংকট কাজে লেগেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগতির পরও কেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধানকে সরিয়ে দিলেন পুতিন? 

বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছে সিএনএন। তাঁরা বলছেন, রাশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার অন্যতম প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। বিপুল অঙ্কের সামরিক ঠিকাদারি চুক্তির বিষয় প্রকাশ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যমগুলো। প্রকাশ্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও তাঁদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের সমালোচনা করছে। 

তবে বিশ্লেষকদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএনএনকে বলেন, ‘ (রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে রদবদল নিয়ে) আমরা যেটা প্রত্যক্ষ করছি, সেটা খুবই জটিল এক খেলা। এই খেলার অনেকগুলো দিক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এসব ঘটনার মেয়াদকাল এবং পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে জয়ের লক্ষ্যে পুতিনের আত্ম-অনুসন্ধান।’ 

ধরপাকড় ও রদবদলের কারণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ঝাঁকুনির নেপথ্যে রয়েছেন প্রয়াত ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন। তিনি রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের প্রধান। বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভের প্রতি নিজের ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা ও কটাক্ষ করে তাঁদের সমালোচনা করেছিলেন প্রিগোঝিন। তাঁর অভিযোগ, শোইগু ও গেরাসিমভ একই সঙ্গে যেমন অদক্ষ, তেমনি ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্তও। 

এই বিষয়কে কেন্দ্র করে মস্কোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শুরু করেছিলেন প্রিগোঝিন। ব্যর্থ সেই সামরিক বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল শোইগু ও গেরাসিমভকে পদ থেকে সরানো। তবে এটা করতে গিয়ে প্রিগোঝিন পুতিনকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেন। একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন পুতিনের সর্বময় ক্ষমতাকে। প্রতিক্রিয়ায় প্রিগোঝিনকে দেশদ্রোহী হিসেবে বর্ণনা করেন পুতিন। ব্যর্থ বিদ্রোহের পর রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিজের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনসহ নিহত হন প্রিগোঝিন। 

সেই থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অস্ত্র কেনা, ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীর দুর্বলতা ও দুর্নীতির অভিযোগের মতো বিষয়গুলো লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন পুতিন। তিনি মূলত ব্যর্থ সেই বিদ্রোহ নিয়ে যে ক্ষুব্ধ, সেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে চাননি। কারণ, এটা করলে রাশিয়ার জনগণের সামনে তাঁর সর্বময় ক্ষমতা ও শক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ তৈরি হতো। 

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য হয়তো অপেক্ষা করছিলেন পুতিন। গত মার্চের সেই নির্বাচনে পুতিন আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর গত ৯ মে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও পুতিন ও শোইগুকে পাশাপাশি হৃদ্যতাপূর্ণ অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বিজয় দিবসের কয়েক দিন পর শোইগুকে বরখাস্ত করেন। মন্ত্রণালয়ে শুরু হয় ধরপাকড়। তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করলেও শোইগুকে নিজের ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে রেখেছেন পুতিন। বরখাস্ত করার পর শোইগুকে নিরাপত্তা পরিষদের সচিবের দায়িত্বে এনেছেন। 

কার্নিজ রাশিয়া—ইউরেশিয়া সেন্টার নামে একটি থিংকট্যাংকের জ্যেষ্ঠ ফেলো তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলেন, ‘প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে প্রিগোঝিন যা বলেছিলেন, তা ঠিক না বেঠিক ছিল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাশিয়ার রাজনীতিতে ঠিক ও ভুল বলে কিছু নেই। সেখানে যা আছে, তা কেবলই স্বার্থ।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুতিনের স্বার্থ হলো তাঁর ঘরে যেন শৃঙ্খলা থাকে। তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ইউক্রেনে বিজয় অর্জন। আর ইউক্রেনে এ যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে, তার কেন্দ্রে রয়েছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। 

সের্গেই শোইগুকে সরিয়ে আন্দ্রেই বেলুসভকে নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন পুতিন। বেসামরিক ব্যক্তি ও অর্থনীতিবিদ আন্দ্রেই বেলুসভকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ করার মধ্য দিয়ে পুতিন এই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে চলতি বাজেটে সামরিক খাতের জন্য রেকর্ড সর্বোচ্চ যে বরাদ্দ দিয়েছেন, তার আওতায় আরও দ্রুত ও সুলভ মূল্যে অস্ত্র কিনতে চান তিনি। 

রাশিয়ার চলতি বছরের বাজেটের ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সামরিক খাতের জন্য, যা আধুনিক রাশিয়ার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এবারের বাজেটে সামরিক খাতের বরাদ্দ সামাজিক খাতকেও ছাড়িয়ে গেছে। পুতিন যে দেশে যুদ্ধকালীন একটি অর্থনীতি চাইছেন, সামরিক খাতের জন্য এই বরাদ্দ তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাভিত্তিক ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ভিজিটিং ফেলো রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিখাইল কোমিন বলেন, রাশিয়ার অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে যারা সরকারি নীতি ও অর্থনীতিকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শোইগু ও তাঁর দলবল। 

গত শুক্রবার রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান ও কমিউনিকেশন ডিরেক্টরেটের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভাদিম শামারিনের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ, যোগাযোগ সরঞ্জাম সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তিনি ৩ কোটি ৬০ লাখ রুবল (রাশিয়ার মুদ্রা) ঘুষ নিয়েছেন। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটিকে বিপুল অঙ্কের সরকারি ঠিকাদারির কাজ দিয়েছেন তিনি। 

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যে ধরপাকড় চলছে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যমগুলো। শামারিনকে গ্রেপ্তার করার পর গত মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যম রিয়া নভোস্তির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শামারিনের স্ত্রী ২০১৮ সালে ২ কোটি রুবল (২ লাখ ১৮ হাজার ডলার) দিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছিলেন। অথচ সেই সময় শামারিনের বাৎসরিক আয় ৩৪ হাজার ডলারের বেশি ছিল না। 

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে পাঁচজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে একজন উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী তিমুর ইভানভ। গত এপ্রিলে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ইভানভ ও তাঁর মেয়ে বন্ধুরও বিলাসী জীবনযাপন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

গুঞ্জন উঠেছে এখন পুতিনের ‘টার্গেট’ সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ। রাশিয়া—ইউরোশিয়া সেন্টারের তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলেন, ‘এখন চারপাশে গুঞ্জন ছড়িয়েছে যে গেরাসিমভকেও উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।’ 

সিএনএন থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত