Ajker Patrika

মশাবাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা নেই, শুধু লাভা নিয়ে জরিপ

  • পরীক্ষাগার ছাড়া রোগ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব–বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
  • দেশের জনস্বাস্থ্যের ওপর হুমকি বাড়ছে।
  • শুধু মশার লার্ভা নিয়ে জরিপ হয়।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে ডেঙ্গু রোগীরা। চলতি বছর ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে ডেঙ্গু রোগীরা। চলতি বছর ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, মশা নির্মূল ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যান্য ব্যবস্থা ও কৌশলের পাশাপাশি মশা পরীক্ষা এবং গবেষণাগারও প্রয়োজন। এতে করে স্থানীয় প্রজাতির মশার জিনগত বৈশিষ্ট্য, আচরণ ইত্যাদি বোঝার মাধ্যমে মশা নির্মূল ও রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। তবে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে সরকারের অগ্রাধিকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন কীটতত্ত্ব ও রোগতত্ত্ববিদেরা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি প্রজাতির মশা রয়েছে, যার মধ্যে ১০০ প্রজাতি মানবদেহে অন্তত ২০টি প্রাণঘাতী রোগ ছড়াতে সক্ষম। বাংলাদেশে ঠিক কত প্রজাতির মশা রয়েছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি সরকার বা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। তবে বাংলাদেশে বর্তমানে মশা ও মাছিবাহিত নয়টি মারাত্মক রোগ দেখা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ এবং সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এডিস মশা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস, জিকা; অ্যানোফিলিস মশা লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস, ম্যালেরিয়া; কিউলেক্স মশা জাপানিজ এনকেফালাইটিস, লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস, ওয়েস্ট নাইল ফিভার ও ফাইলেরিয়া এবং স্যান্ডফ্লাই নামের একধরনের মাছি কালাজ্বরের বাহক হিসেবে কাজ করে।

আমেরিকান মসকিউটো কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের (এএমসিএ) তথ্যমতে, পৃথিবীর অন্য যেকোনো জীবের তুলনায় মশা মানুষের জন্য বেশি দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। বিশ্বে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় মশাবাহিত রোগের কারণে।

বাড়ছে রোগের প্রাদুর্ভাব

দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এবং চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ বেশি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুকে জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের বলে অভিহিত করেছে ডব্লিউএইচও। সরকারের তথ্য বলছে, দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। সাম্প্রতিককালে দেশের সব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে একসময় মূলত রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকা রোগটি। প্রথম ডেঙ্গু রোগের সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া যায় ২০০০ সালে। ২০১৯ সালে শহর ও গ্রাম উভয় স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (ইসিডিসি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন ডেঙ্গুতে বিশ্বে সর্বোচ্চ মৃত্যু হারের দেশ।

ডেঙ্গুর মতোই জিকা এবং চিকুনগুনিয়াও ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। দেশে ২০০৮ সালে প্রথম চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। ২০১৭ সালে দেশজুড়ে ভাইরাল এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। দেশে জিকাও শনাক্ত হয়েছে।

ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায় স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার মাধ্যমে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০০৭-২৪ সাল পর্যন্ত দেশে ৬ লাখ ১ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ৬৬৩ জন। চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগের ১৩ জেলায় ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি ও ম্যানসোনিয়া মশা দেশের অন্তত ৩৪টি জেলায় ফাইলেরিয়া বা গোদরোগ ছড়াচ্ছে। ১৯৯৩ সাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে কালাজ্বরের রোগী। দেশে প্রথম জাপানিজ এনকেফালাইটিস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৭৭ সালে। ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসবাহিত জ্বরের সংক্রমণও শনাক্ত হয়েছে।

নেই পরীক্ষা বা গবেষণায় গুরুত্ব

মশাবাহিত রোগ বছরের পর বছর ভোগালেও এটি মোকাবিলায় সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গ সামর্থ্য গড়ে তোলা হচ্ছে না। অন্তত সিকি শতাব্দী ধরে কখনো কখনো প্রাণঘাতী হয়ে ওঠা ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। রোগের ধরন পরিবর্তন, মশকনিধন কর্মসূচির ত্রুটি ও ব্যর্থতা, জনসচেতনার প্রকট অভাবসহ বিভিন্ন কারণে ডেঙ্গুর দৌরাত্ম্য না কমে বরং বাড়ছে। মশা জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর মধ্যে একটি উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ভেক্টর ডিজিজ কন্ট্রোল ইন্টারন্যাশনাল (ভিডিসিআই) বলেছে, মশা নির্মূলে কার্যকর ব্যবস্থাপনা, মশার ক্রিয়াকলাপ, মশার প্রজননের ক্রমবর্ধমান গতিশীলতা ও কীটনাশক নিয়ে বিস্তৃত পদক্ষেপ নিতে হলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারে গবেষণা জরুরি। অস্ট্রেলিয়ার কিউআইএমআর বার্গোফার (সাবেক কুইন্সল্যান্ড ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল রিসার্চ), যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন ও ব্রাজিলের ওসওয়াল্ডো ক্রুজ ইনস্টিটিউটও বলছে, রোগপ্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য মশার পরীক্ষাগার গুরুত্বপূর্ণ। মশাবাহিত রোগে আক্রান্তের হার বেশি এমনসব অঞ্চল থেকে মশা সংগ্রহ করে গবেষণা করতে হবে। মশার জীববিজ্ঞান, আচরণ, প্রজাতি, বহনকারী ভাইরাসের পরিবর্তন বা রূপান্তর, মশার ঘনত্ব, প্রজাতি শনাক্তকরণ, কীটনাশকের কার্যকারিতা এবং রোগের সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন।

কিন্তু অনেক দেশেই মশার মতো রোগের বাহক অর্থাৎ ‘ভেক্টর’ নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষাগার থাকলেও বাংলাদেশে মতো মশাবহুল দেশে তা নেই। অথচ কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব তেমন নেই, এমন অনেক দেশেও সমন্বিত পরীক্ষাগার রয়েছে। যেখানে মশার ধরন, মশার জীববিজ্ঞান, প্রজনন, কীটনাশক, ভাইরাস বা পরজীবী নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করা হয়। বাংলাদেশে মশার বেড়ে ওঠা ও পরিপক্বতা অর্জন, জীবাণুর সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি পরিবর্তন হচ্ছে। এ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন; কিন্তু তার ব্যবস্থা নেই।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আবহাওয়ার সঙ্গে মশার অভিযোজন, বহনকারী ভাইরাসের রূপান্তর, ভাইরাসের স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কি না তা জানতে গবেষণা প্রয়োজন। মশা ধ্বংসকারী কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে হবে। কিন্তু গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, কারিগরি দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে মশাকে নির্মূল করা যাচ্ছে না। সরকারের উদ্যোগ নেই। দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও নিপসমে একটি মশা পরীক্ষাগার করা যায়নি।’

পরীক্ষাগারের বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকারে দেখা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘মশা ও রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি পরীক্ষাগার থাকা প্রয়োজন। ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগকে ২০১৯ সালে অর্গানোগ্রামসহ রূপরেখা দিয়েছিলাম। সরকারের আগ্রহ দেখা যায়নি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বক্তব্য

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, মশা নির্মূলে প্রজননস্থল খুঁজে তা ধ্বংস করা এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ স্থানীয় সরকার বিভাগের। মশা নিয়ে গবেষণা করবে স্থানীয় সরকার বা প্রাণিসম্পদ বিভাগ। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ করে রোগীর চিকিৎসার সব কাজ। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগ রয়েছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাগার থাকবে। তাদের সঙ্গে স্থানীয় সরকার সম্পৃক্ত হবে। প্রয়োজন হলে স্বাস্থ্যসেবাও সম্পৃক্ত হবে।

রোগ নিয়ে গবেষণা নিয়মিত হচ্ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক হালিমুর রশিদ বলেন, ‘মশার জন্য দেশে পরীক্ষাগার নেই। তবে আইইডিসিআরসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর বলেন, মশা নিয়ে বৃহৎ অর্থে গবেষণাগার নেই। তবে আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু, কীট, টিকা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। রোগীর নমুনার ওপর অধিকতর গবেষণাও হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত