Ajker Patrika

জাতীয় ঐক্যের স্বপ্ন

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৪, ০৭: ৩৭
Thumbnail image

কেমন ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ? কেমনইবা ছিল মার্চ মাস? সে বছর মার্চ মাসেও শীতটা যাই যাই করে যাচ্ছিল না। একটা সোয়েটার পরতেই হচ্ছিল। বাইরে একটু একটু শীত কিন্তু ভেতরে প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে আমরা ঘুরছি। ছাত্ররা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একের পর এক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বিরুদ্ধে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই চলেছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে দলমত-নির্বিশেষে সবার দৃষ্টি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে। দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ছোট-বড় সব অফিসই সক্রিয়। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-সরকারি কর্মচারী সবাই জাগ্রত। ৩২ নম্বর থেকে যে সিদ্ধান্তই আসে, তা-ই কার্যকর হয়। আন্দোলন করতে হবে? কোনো কথা নেই। সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর। সারা দেশে এসবের বিরুদ্ধে বলার কোনো লোক নেই। মুসলিম লীগও ভেঙে গেছে।

আইয়ুব খানের তৈরি কনভেনশন মুসলিম লীগ কোথায় যেন গা ঢাকা দিয়েছে। কেউ কেউ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে। পাকিস্তানের পক্ষে বলার কোনো মানুষই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের নেতারাও পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে তাঁদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কথা বলে যাচ্ছেন। প্রায়ই তাঁরা ঢাকায় আসছেন। ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করছেন, আলোচনা করছেন। আবার মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কাগমারী চলে যাচ্ছেন। পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার সঙ্গে তাঁদের বঞ্চনাও একাকার হয়ে যাচ্ছে।

দুই ভূখণ্ডেই বেসামরিক প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। তবে সেনা ছাউনিগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। ইপিআর আর খোদ সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের নিরস্ত্র করার গোপন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমগুলো চলছিল। এই কার্যক্রমের সংবাদ অবশ্য গোপন থাকেনি। দেশে এমন ঐক্য আর কখনো দেখা যায়নি।

সংস্কৃতিকর্মীরা তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যেখানেই প্রয়োজন, সেখানেই আবৃত্তি, গানের সঙ্গে অতীত বিপ্লবী আন্দোলনের কথা বলে যাচ্ছেন। কবিতা, গান রচিত হচ্ছে। গানের সুরারোপ হয়ে যাচ্ছে। পোশাক-পরিচ্ছদও পাল্টে যাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী হাতে তৈরি তাঁতের কাপড় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিক্ষুব্ধ মানুষ চাইছে একটা পাল্টা কর্মসূচি। পশ্চিম পাকিস্তান ভোটে হেরে গিয়ে শুধু সামরিক ক্ষমতাবলে যা কিছু করছে তার বিরুদ্ধে চাই একটা পাল্টা কর্মসূচি। বিস্ফোরণের আগে বারুদ যেমন জ্বলতে থাকে, তেমনি একটা পরিস্থিতি।

সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের দোতলা থেকে একটি হ্যান্ডমাইকে উপস্থিত জনতার সামনে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জনতা চাইছে আরও সুনির্দিষ্ট কিছু বলবেন তিনি। এই পটভূমিতে আহ্বান এল ৭ মার্চের। স্থান নির্দিষ্ট হলো রেসকোর্স ময়দান। রেসকোর্স ময়দান ছাড়া এত মানুষের স্থান সংকুলানের কোনো উপায় নেই। দুপুরবেলা আমরা পৌঁছানোর অনেক আগেই রেসকোর্স ভরে গেছে। আমরা জায়গা নিলাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ জনতার আনাগোনা দেখছি। নেতা কখন আসবেন, তা প্রথমে একটু অনিশ্চিতই মনে হলো। আগেই বলেছি, শীতটা যাই যাই করেও যাচ্ছিল না। তাই রোদটা অতটা তীব্রও লাগছিল না। এর মধ্যেই দেখা গেল একটি হেলিকপ্টার উড়ছে আকাশে। হেলিকপ্টার দেখে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। একটা সংঘবদ্ধ হুংকার শোনা গেল। এর মধ্যেই দ্রুত নেতা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে উঠে পড়লেন ছোট একটা তৈরি করা মঞ্চে।

চারদিকে মানুষের কোলাহল, জয়ধ্বনি, স্লোগানের মধ্যেই নেতার কণ্ঠস্বর শোনা গেল—‘ভায়েরা আমার...’, তারপর নাতিদীর্ঘ ভাষণের মূলকথা বেরিয়ে এল—‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...’। আহ্বান এবং নির্দেশ এল—তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়েই তৈরি হও, পাড়া-মহল্লায় দুর্গ গড়ে তোলো। এরপর নেতা চলে গেলেও মানুষের মনে দুর্গ গড়ে তোলার প্রত্যয়। একটি স্বপ্নের, একটি প্রতিশোধের মধ্যে মানুষ আবর্তিত হচ্ছে। মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বসে আছে—যেন রেসকোর্সটাই যুদ্ধক্ষেত্র। আলাপ চলছে, আলোচনা হচ্ছে। বারবার ওই নাতিদীর্ঘ বক্তৃতার ব্যাখ্যা চলছে। একটা কনসার্টের রেশ যেন চলছে তো চলছেই। আমরা ভাবছি, কোথায় যাব! ঘরে ফেরার কোনো তাড়া নেই। খাওয়ার কোনো তাড়া নেই। একটা নির্দেশ পাওয়া গেছে। সেটা কীভাবে কার্যকর হবে, তার ভাবনা। কিন্তু ভাবনাটাও আর একার নয়। যেভাবে ঐক্যবদ্ধ কিছু হয়, তার জন্যই একটা চিন্তা।

আমি তখন টেলিভিশনে কাজ করি। টেলিভিশন তখন স্বাধীন। নাটক হচ্ছে, গান হচ্ছে। সবই স্বাধীনতার পক্ষে, মানুষের পক্ষে। সামরিক কোনো আইন সেখানে কার্যকর নয়। সবকিছু প্রকাশ করা যাচ্ছে। তাই আনন্দে আমাদের যতটুকু সৃজনশীলতা আছে, তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছি।

এর মধ্যেই শুরু হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের আলাপ-আলোচনা। সামরিক বাহিনীর দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসছেন। সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও ঢাকায়। আমাদের নেতারাও আলোচনায় বসবেন। তবে সবার সঙ্গে এ-ও ভাবি, পাকিস্তানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কী হবে? কিন্তু বঙ্গবন্ধুসহ নেতারা যে গণতান্ত্রিক একটা প্রক্রিয়ায় আছেন তাই তাঁকে আলোচনায় বসতেই হবে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেখতেই হবে। কিন্তু ৭ মার্চের যে ডাক, তা তো দেওয়া হয়েই গেছে। জনতা তাই এগিয়ে গেছে অনেক দূর। কোনো আপস আর সম্ভব নয়।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিকেলটা কেমন ছিল? উদ্দশ্যেহীনভাবে আমরা জনতার সঙ্গে হাঁটলাম। চায়ের দোকানের সামনে বসে পড়ি। উপলক্ষ চা খাওয়া নয়, মানুষের কথা শোনা। বোঝার চেষ্টা করা, কী বলে মানুষের হৃদয়। হ্যাঁ, একই কথা—আপসহীন সংগ্রামের কথা। নেতা যা বলেছেন, তারপরও তাঁর না-বলা কথাও বোঝার চেষ্টা। নেতার চেহারায় যে দেশের ছবিটা ভেসে উঠেছে তা-ও বোঝার কী আপ্রাণ চেষ্টা!

আজ তিপ্পান্ন বছর পর যখন লিখছি, কী মনে হয়? এত ঐক্য আমাদের জীবদ্দশায় আর দেখিনি। আজকের বিভক্ত জাতি কি সেদিনের সেই স্বপ্ন দেখতে পারে?

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত