Ajker Patrika

জোগান বাড়লেও কাটছে না খরা

ফারুক মেহেদী ও  জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা
জোগান বাড়লেও কাটছে না খরা

অর্থনীতির টানাটানি যেন কাটছেই না। এই টানাটানির প্রায় সকল পর্যায়েই জড়িয়ে আছে ডলার। সেই ডলারের খরা শিগগির যে কাটবে, এমন আভাসও কেউ দিতে পারছেন না। যদিও প্রধান খাতগুলো থেকে ডলারের জোগান বেড়েছে।

প্রায় এক বছর ধরে ডলার সাশ্রয় করতে আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ পুরো অর্থনীতিতে কৃচ্ছ্রসাধন করা হয়েছে। এতে আমদানি ঠিকই ৪০ শতাংশের মতো কমে এসেছে, কিন্তু ডলারের মজুত আর বাড়ছে না। উল্টো অতিমাত্রায় আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে সার্বিক অর্থনীতির গতি থমকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। একসময়ে ৪৮ বিলিয়নে উঠে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে এখন ৩২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। আইএমএফের হিসাব ধরলে তা আরও কমে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ইতিবাচক ধারায় ভর করেও রিজার্ভকে টেনে তোলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বর্তমানে বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমলেও আর্থিক হিসাবে বরাবরের মতো নেতিবাচক। রেমিট্যান্স বিগত কয়েক মাসে বেড়েছে। কিন্তু যে হারে শ্রমশক্তি রপ্তানি হয়েছে, তার প্রতিফলন নেই রিজার্ভে। তাহলে প্রবাসীদের আয় যাচ্ছে কোথায়? হয় পাচার, নাহয় হুন্ডি হচ্ছে। আবার আমদানি ও রপ্তানিতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের ব্যাপারও রয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়ার চেয়ে দায় শোধ করতে হচ্ছে বেশি। এতে ডলার বেশি ব্যয় হচ্ছে। যার ফলে রিজার্ভ বাড়ছে না।’

গত এক বছরের অর্থনৈতিক চিত্র, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে জানা যায়, কোভিড-পরবর্তী বিশ্ববাণিজ্যে আকস্মিক চাহিদা বাড়ায় ডলারে উত্তাপ লাগা শুরু হয়। পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাণিজ্য-অর্থনীতি চরম অস্থিরতার কবলে পড়ে। বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ প্রায় সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন বাড়তে থাকে। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশও এ ধাক্কায় নাকাল হয়। এখানে ডলার ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হতে থাকে। গত প্রায় এক বছরের অস্থিরতায় ডলারের দাম বাড়ার কারণে টাকা অন্তত ২৫ শতাংশ দর হারায়। পরিস্থিতি ক্রমেই নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পৃথক নির্দেশনায় আমদানি নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপ করে। বিশেষ করে বিলাসী ও কম দরকারি পণ্য আমদানি সীমিত রাখতে বিধিনিষেধ জারি ও শুল্ক-কর আরোপ করা হয়। ধীরে ধীরে আমদানি কমে আসে। শুধু কমেই আসেনি; বরং বিলাসী পণ্যের পাশাপাশি অত্যাবশ্যক পণ্যসহ সব ধরনের পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতেও ব্যাংকগুলো অতিমাত্রায় রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। ফলে ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র খোলার সংকটে পড়েন। এ সংকট এখনো কাটেনি। অতিমাত্রায় কড়াকড়ির ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিকই আমদানি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জানুয়ারি মাসের হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, জানুয়ারি মাসে ৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। অথচ গত বছরের জুলাই মাসে ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। জুলাই মাসের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এক মাসেই প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি কম পণ্য আমদানি হয়েছে। এ সময়ে সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে বড় অঙ্কের ডলার সাশ্রয় করতে সক্ষম হলেও বাস্তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের মজুত বাড়েনি। বরং আগের মতোই তা দিন দিনই কমছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত রপ্তানির হালনাগাদ তথ্য বলছে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আগের বছরের তুলনায় ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে রপ্তানিতে। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে ৩৭ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার এসেছে রপ্তানি আয় থেকে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল ৩৩ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। গত নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাসেই ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। নভেম্বরে এসেছে ৫ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। আর ডিসেম্বরে এসেছে আরও বেশি ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে এর আগে কখনোই কোনো একক মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আসেনি। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, নানা বাধা-বিপত্তি ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বিদায়ী ২০২২ সালে রপ্তানি ভালো হয়েছে।

কয়েক মাস ধরে বাড়ছে রেমিট্যান্সও। এক দিন আগে প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের একই সময়ের চেয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ বেশি হারে রেমিট্যান্স এসেছে। ডলারের মজুত তবুও বাড়ছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুলাই মাস থেকে ক্রমেই রিজার্ভের মজুত কমে আসছে। জুলাই মাসের ৩৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার সেপ্টেম্বর মাসে কমে হয় ৩৬ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, অক্টোবর মাসে পৌঁছায় ৩৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে। নভেম্বর মাসে তা নেমে আসে ৩৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে। আর সবশেষ ১ মার্চ তা নেমে আসে ৩২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। অথচ এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ থেকে ঋণ হিসেবে পাওয়া গেছে ৪৭ কোটি ৬ লাখ ডলার। একই সময়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে কম হলেও ঋণ ও সহায়তা থেকেও বিভিন্ন অঙ্কের ডলার দেশে এসেছে। সব মিলিয়ে ডলার আসার যেসব পথ খোলা রয়েছে, তা একেবারে বন্ধ হয়নি, বরং সচল রয়েছে, আমদানি ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তারপরও ডলারের যে সংকট ও অস্থিরতা, তা কাটছে না।

সামনে ডলার মজুত আরও কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ব্যক্তি খাতে যে ১৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ আছে, সেটা ডলার সংকটে এত দিন শোধ করা যায়নি। সেটা এক বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সামনে পরিশোধ করতে হবে। অনেক এলসি (ঋণপত্র) দায় ডেফার্ড বা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোও সামনে শোধ করার চাপ থাকবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। ডলার সাশ্রয়ে বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিতের পাশাপাশি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতেও সংকট কাটছে না। জরুরি আমদানি দায় মেটাতে ক্রমাগত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দিতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে প্রায় ৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত