Ajker Patrika

সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভাঙা শুরু বিকল্প ছাড়াই

রাশেদ রাব্বি ও সৌগত বসু, ঢাকা 
সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভাঙা শুরু বিকল্প ছাড়াই

রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় সরকারি বহির্বিভাগ ডিসপেনসারিতে (জিওডি) প্রতিদিন ৩০০ জনের মতো রোগী বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে আসছিলেন। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত এই সেবাপ্রতিষ্ঠানে সেবা দিতেন এমবিবিএস চিকিৎসক, ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টসহ বেশ কিছু স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু এসবের কোনো গুরুত্ব নেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কাছে। জায়গার মালিকানার জোরে ডিএসসিসি গত সোমবার ডিসপেনসারিটি ভাঙতে শুরু করেছে। এতে ওই এলাকার বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা বন্ধ হয়ে গেল। একই সঙ্গে বাধাগ্রস্ত হলো সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কার্যক্রম। 
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলা জনস্বার্থবিরোধী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, অধিদপ্তর থেকে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষকে কয়েকবার এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র না ভাঙতে অনুরোধ করা হয়েছে। অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, ঘনবসতিপূর্ণ গেন্ডারিয়ায় মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র অনেক মানুষের বাস। চলমান একটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র বন্ধ করা হলে এলাকার জনগণের মধ্যে সরকার সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থা না করে চলমান স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম বন্ধ করা সমীচীন নয়।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেকও সোমবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের বিকল্প নেই। তা ছাড়া সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।

এত অনুরোধের পরও ভবনটি ভাঙার কারণ জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. রাসেল সাবরিন বলেন, ‘এ বিষয়ে জানতে হলে জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি নথি না দেখে কিছু বলতে পারব না।’

ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাসের জানান, এটি জরাজীর্ণ হিসেবে অনেক আগেই নিলামের মাধ্যমে ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এটি না ভাঙতে অনুরোধ করার পরও কেন ভাঙা হলো জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

জানা গেছে, গেন্ডারিয়ায় জিওডিটি ডিএসসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী অঞ্চল-৫-এর অধীন শরাফতগঞ্জ মাঠে অবস্থিত। ইতিপূর্বে মাঠের নামকরণ করা হয় মেয়র সাঈদ খোকন পার্ক। ওই সময় পার্কের উন্নয়নের নামে ডিসপেনসারিটি জরাজীর্ণ উল্লেখ করে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তখন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি না ভাঙতে অনুরোধ করে আসছে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) শেখ দাউদ আদনান ৪ জুন এক চিঠিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কাছে এক চিঠিতে অসংখ্য দরিদ্র মানুষের চিকিৎসার একমাত্র জিওডি ভেঙে না ফেলতে অনুরোধ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ডিএসসিসি জরাজীর্ণ বলে উল্লেখ করলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরেই ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে সেটি সংস্কার করা হয়। 

একই দিনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব মুহাম্মদ শাহাদত খন্দকার অন্য এক চিঠিতে ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তাকে জিওডিটি না ভাঙতে অনুরোধ করেন। চিঠিতে তিনি বলেন, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ বাস্তবায়ন করতে চায়। এসডিজি অর্জনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতে পঞ্চম সেক্টর কর্মসূচি প্রণয়নের কার্যক্রমও চলমান। সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম ও শহর পর্যায়ে সর্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন।

কিন্তু এসব যুক্তি ও অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে সোমবার স্থাপনাটি ভাঙতে বুলডোজার পাঠায় ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়। গত ২৯ মে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাছে দেওয়া চিঠিতে ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন ৫ জুন সকাল ১০টায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ সদস্য পাঠাতে অনুরোধ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এর আগে ২০২১ সালে এটি নিলামে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিএসসিসি। ঢাকা জেলার তখনকার সিভিল সার্জন আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে এক চিঠিতে ভবনটি নিলামে না ভাঙতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, এটি জরাজীর্ণ নয়, বিগত অর্থবছরে স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের অর্থায়নে ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে এটির মেরামত ও সংস্কার করা হয়েছে। সে সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেও অনুরূপ চিঠি পাঠানো হয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ডিএসসিসিতে।

২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তখনকার সিভিল সার্জন স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠিতে শরাফতগঞ্জ পার্কের ডিসপেনসারি নিলামের কার্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকেও একই অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। 
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, এটা একটা গর্হিত অপরাধ। স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ভেঙে জনগণের চিকিৎসার অধিকারবঞ্চিত করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এটা জনস্বার্থবিরোধী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত