জাহীদ রেজা নূর
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ভাষার প্রশ্নটি সামনে এসে গেল, গড়ে উঠল ইতিহাস। কিন্তু সে ইতিহাস আলোচনার আগে একটু বুঝে নেওয়া দরকার, বাংলা ভাষাকে কী চোখে দেখত সে কালের অভিজাতশ্রেণি। কেন বাংলা ভাষা নিয়ে সংশয় কাটাতে পারছিল না সাধারণ বাঙালি।
বাংলা ভাষাটা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অভিজাতশ্রেণির কাছে বেমানান হিসেবে ছিল। মূলত ধর্মীয় কিংবা উচ্চাঙ্গের আলাপ-আলোচনা বাংলায় করা যায় না, এ রকম একটি মনোভাব ব্যাপ্তি পেয়েছিল। হিন্দু ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা মনে করতেন, তাঁদের ধর্মীয় গ্রন্থাবলি সংস্কৃত ভাষায় থাকা বাঞ্ছনীয়। এমনকি তাঁরা এ কথাও বলেছেন যে কেউ যদি অষ্টাদশ পুরাণ ও রামচরিত সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ করে, তাহলে তাকে রৌরব নরকে যেতে হবে।
আর মুসলমানেরা? কোরআন-হাদিস বাংলা করলে পাপ হবে—এমন প্রচার যথেষ্ট চালানো হয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের যে লেখকেরা শুরুতে কোরআন-হাদিসের অনুবাদ করেছিলেন, তাঁদেরও কিন্তু ভয় ছিল পাপের। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, কর্মদোষে বাংলাদেশে বাঙালির জন্ম, তারা আরবি-ফার্সি বোঝে না বলেই ধর্মকথা বোঝানোর জন্য বাংলার ব্যবহার। ওই লেখকেরা কিন্তু অভিজাতশ্রেণি থেকে আসেননি। মাটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলেই মরিয়া হয়ে নিজ ভাষায় লিখেছিলেন।
উনিশ শতকে এসে একটি নতুন ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল মুসলমানরা। উচ্চশ্রেণির বঙ্গীয় মুসলমানদের মাতৃভাষা সে সময় হয়ে গিয়েছিল উর্দু। আর নিম্নশ্রেণির মুসলমানের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। নিম্নশ্রেণির হিন্দুর ভাষাও বাংলা। তবে বলা দরকার, মুসলমানেরা যে দেশ থেকেই আসুক না কেন, তারা যখন ভারতবর্ষে এসে রাজত্ব করেছে, তখন তাদের প্রশাসনিক ভাষা ছিল ফারসি। আস্তে আস্তে অভিজাত মুসলমানেরা তাদের বাড়ির ভাষা উর্দুতে পরিবর্তিত করে নিয়েছিল। মোগল আমলে অভিজাত মুসলমানেরা বাড়িতে উর্দু ভাষা ব্যবহার করত। তাতে এ রকম একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে বিদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী মুসলমানেরাই ছিলেন সত্যিকারের মুসলমান আর দেশে যাঁরা ধর্ম পাল্টে মুসলমান হয়েছেন, তাঁরা দুনম্বরি। অতএব সনাতন ধর্মের বর্ণবিদ্বেষের মতো মুসলমানদের মধ্যেও আশরাফ-আতরাফের সৃষ্টি হয়েছিল।
মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব ছিল বিদেশ থেকে আসা তুর্কি, আফগানি, ইরানি ও আরব মুসলমানদের হাতে। এরা মিলেই তৈরি করেছিল শরীফ বা আশরাফ অর্থাৎ অভিজাতশ্রেণি। অন্যদিকে যারা ধর্ম পাল্টে মুসলমান হয়েছিল, তাদের আতরাফ বা আজলাফ অর্থাৎ অনভিজাত বলে মনে করা হতো। ধর্মান্তরিত মুসলমানেরা সাধারণত ধর্মান্তরের আগে যে পেশায় ছিল, সে পেশাই বহাল রাখত। কবি মুকুন্দ রাম চক্রবর্তী ব্যাপারটিকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলেছেন এভাবে: ‘রোজা নামাজ করি কেহ হইলো গোলা/তাসন করিয়া নাম বসাইলো জোলা/বলদ বাহিয়া কেহ বলায় মুকেরি/পিঠা বেচিয়া নাম কেহ বলায় পিঠারি।’ তবে আতরাফশ্রেণির লোকেরা আর্থিকভাবে নিজেদের অবস্থান বদলাতে পারলে আশরাফশ্রেণিতে উন্নীত হতে পারত। নিম্নশ্রেণির মুসলমানেরা উচ্চশ্রেণিতে গেলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ে, বড় পদবি হয়। এ নিয়েই প্রচলিত কথা ছিল: ‘আগে থাকে উল্লা, শেষে হয় উদ্দিন/তলের মামুদ উপরে যায়/কপাল ফেরে যদ্দিন।’
বাংলাকে হিন্দুয়ানি ভাষা ভেবে মধ্যযুগে মুসলমান সাহিত্যিকেরা এই ভাষায় লিখবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছেন। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সৈয়দ সুলতান ১৫৮৪ সালে লিখেছেন, ‘কর্মদোষে বঙ্গেতে বঙ্গালী উৎপন/না বুঝে বঙ্গালী সবে আরবী বচন/...কিন্তু যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন/সেই ভাষা হয় তার অমূল্যরতন।’ ১৬৩৯ সালে কবি মুতালিব লিখেছেন, ‘আরবীতে সকলে না বুঝে ভালো মন্দ/তে কারণে দেশী ভাষে রচিলুঁ প্রবন্ধ/...মুসলমানি শাস্ত্রকথা বাঙ্গালা করিলুঁ, বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলু/কিন্তু মাত্র ভরসা আছে মনান্তরে/বুঝিয়া মুমীন দোয়া করিবে আমারে।’
তাই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কেন বাঙালি অভিজাত মুসলমানেরা উর্দুর সঙ্গে সখ্য পাতিয়েছিল আর আমজনতা বাংলাকেই নিয়েছিল নিজেদের পরিচয় হিসেবে। তা নিয়েই তো শুরু হলো সংগ্রাম।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ভাষার প্রশ্নটি সামনে এসে গেল, গড়ে উঠল ইতিহাস। কিন্তু সে ইতিহাস আলোচনার আগে একটু বুঝে নেওয়া দরকার, বাংলা ভাষাকে কী চোখে দেখত সে কালের অভিজাতশ্রেণি। কেন বাংলা ভাষা নিয়ে সংশয় কাটাতে পারছিল না সাধারণ বাঙালি।
বাংলা ভাষাটা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অভিজাতশ্রেণির কাছে বেমানান হিসেবে ছিল। মূলত ধর্মীয় কিংবা উচ্চাঙ্গের আলাপ-আলোচনা বাংলায় করা যায় না, এ রকম একটি মনোভাব ব্যাপ্তি পেয়েছিল। হিন্দু ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা মনে করতেন, তাঁদের ধর্মীয় গ্রন্থাবলি সংস্কৃত ভাষায় থাকা বাঞ্ছনীয়। এমনকি তাঁরা এ কথাও বলেছেন যে কেউ যদি অষ্টাদশ পুরাণ ও রামচরিত সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ করে, তাহলে তাকে রৌরব নরকে যেতে হবে।
আর মুসলমানেরা? কোরআন-হাদিস বাংলা করলে পাপ হবে—এমন প্রচার যথেষ্ট চালানো হয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের যে লেখকেরা শুরুতে কোরআন-হাদিসের অনুবাদ করেছিলেন, তাঁদেরও কিন্তু ভয় ছিল পাপের। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, কর্মদোষে বাংলাদেশে বাঙালির জন্ম, তারা আরবি-ফার্সি বোঝে না বলেই ধর্মকথা বোঝানোর জন্য বাংলার ব্যবহার। ওই লেখকেরা কিন্তু অভিজাতশ্রেণি থেকে আসেননি। মাটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলেই মরিয়া হয়ে নিজ ভাষায় লিখেছিলেন।
উনিশ শতকে এসে একটি নতুন ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল মুসলমানরা। উচ্চশ্রেণির বঙ্গীয় মুসলমানদের মাতৃভাষা সে সময় হয়ে গিয়েছিল উর্দু। আর নিম্নশ্রেণির মুসলমানের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। নিম্নশ্রেণির হিন্দুর ভাষাও বাংলা। তবে বলা দরকার, মুসলমানেরা যে দেশ থেকেই আসুক না কেন, তারা যখন ভারতবর্ষে এসে রাজত্ব করেছে, তখন তাদের প্রশাসনিক ভাষা ছিল ফারসি। আস্তে আস্তে অভিজাত মুসলমানেরা তাদের বাড়ির ভাষা উর্দুতে পরিবর্তিত করে নিয়েছিল। মোগল আমলে অভিজাত মুসলমানেরা বাড়িতে উর্দু ভাষা ব্যবহার করত। তাতে এ রকম একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে বিদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী মুসলমানেরাই ছিলেন সত্যিকারের মুসলমান আর দেশে যাঁরা ধর্ম পাল্টে মুসলমান হয়েছেন, তাঁরা দুনম্বরি। অতএব সনাতন ধর্মের বর্ণবিদ্বেষের মতো মুসলমানদের মধ্যেও আশরাফ-আতরাফের সৃষ্টি হয়েছিল।
মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব ছিল বিদেশ থেকে আসা তুর্কি, আফগানি, ইরানি ও আরব মুসলমানদের হাতে। এরা মিলেই তৈরি করেছিল শরীফ বা আশরাফ অর্থাৎ অভিজাতশ্রেণি। অন্যদিকে যারা ধর্ম পাল্টে মুসলমান হয়েছিল, তাদের আতরাফ বা আজলাফ অর্থাৎ অনভিজাত বলে মনে করা হতো। ধর্মান্তরিত মুসলমানেরা সাধারণত ধর্মান্তরের আগে যে পেশায় ছিল, সে পেশাই বহাল রাখত। কবি মুকুন্দ রাম চক্রবর্তী ব্যাপারটিকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলেছেন এভাবে: ‘রোজা নামাজ করি কেহ হইলো গোলা/তাসন করিয়া নাম বসাইলো জোলা/বলদ বাহিয়া কেহ বলায় মুকেরি/পিঠা বেচিয়া নাম কেহ বলায় পিঠারি।’ তবে আতরাফশ্রেণির লোকেরা আর্থিকভাবে নিজেদের অবস্থান বদলাতে পারলে আশরাফশ্রেণিতে উন্নীত হতে পারত। নিম্নশ্রেণির মুসলমানেরা উচ্চশ্রেণিতে গেলে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ে, বড় পদবি হয়। এ নিয়েই প্রচলিত কথা ছিল: ‘আগে থাকে উল্লা, শেষে হয় উদ্দিন/তলের মামুদ উপরে যায়/কপাল ফেরে যদ্দিন।’
বাংলাকে হিন্দুয়ানি ভাষা ভেবে মধ্যযুগে মুসলমান সাহিত্যিকেরা এই ভাষায় লিখবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছেন। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সৈয়দ সুলতান ১৫৮৪ সালে লিখেছেন, ‘কর্মদোষে বঙ্গেতে বঙ্গালী উৎপন/না বুঝে বঙ্গালী সবে আরবী বচন/...কিন্তু যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন/সেই ভাষা হয় তার অমূল্যরতন।’ ১৬৩৯ সালে কবি মুতালিব লিখেছেন, ‘আরবীতে সকলে না বুঝে ভালো মন্দ/তে কারণে দেশী ভাষে রচিলুঁ প্রবন্ধ/...মুসলমানি শাস্ত্রকথা বাঙ্গালা করিলুঁ, বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলু/কিন্তু মাত্র ভরসা আছে মনান্তরে/বুঝিয়া মুমীন দোয়া করিবে আমারে।’
তাই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, কেন বাঙালি অভিজাত মুসলমানেরা উর্দুর সঙ্গে সখ্য পাতিয়েছিল আর আমজনতা বাংলাকেই নিয়েছিল নিজেদের পরিচয় হিসেবে। তা নিয়েই তো শুরু হলো সংগ্রাম।
‘দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা সদরের বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী। গতকাল বুধবার সকালে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কথা হয় তাঁর...
১২ জুন ২০২৫ভারতের স্থলবন্দর নিষেধাজ্ঞার পর সীমান্তে আটকে থাকা তৈরি পোশাক, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের ট্রাকগুলো ফেরত আনছেন রপ্তানিকারকেরা। তবে যেসব ট্রাক বন্দরে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো ভারতে প্রবেশ করানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ট্রাক ঢুকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
১৯ মে ২০২৫আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
০৮ মে ২০২৫পাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
০৮ মে ২০২৫